বুনোফুল পর্ব-১০

0
367

#বুনোফুল
পর্ব-১০
রুবাইদা হৃদি

নতুন জায়গা নতুন পরিবেশে আমি বেশ বিব্রত বোধ করলাম৷ অবশ্য আমাকে এয়ারপোর্টে থেকে সরাসরি ইউনিভার্সিটি ডরমিটরি পর্যন্ত গাড়ি ভার্সিটি থেকেই ব্যবস্থা করা ছিলো৷
আমি ছাড়াও আমার রুমে আরো দুজন স্টুডেন্ট আছে৷ একজন নেপাল থেকে আর একজন রাশিয়ান৷
আমি রুমে আসতে ওরা অনেকটা সমাদরে আমাকে স্বাগত জানাল৷ আমার কাছে ব্যাপার টা অনেকটা অন্যরকম ছিলো৷ আমি এরপর ফ্রেশ হয়ে বাসায় আম্মাকে কল দিলাম৷ উনি কল উঠাতেই আমার আসার খবর টা উনাকে দিলাম৷ উনি খুশি হলেন৷ আমার সাথে এয়ারপোর্টে আসতে পারেননি সে নিয়েও দুঃখ প্রকাশ করলেন৷ তবে আমি উনাকে মন খারাপ করতে মানা করলাম৷ এরপর কিছুটা সময় পর উনি ধীরকন্ঠে বললেন,

‘নীরা হাবিব তোমার সাথে কথা বলবে৷’

আম্মার কথাটা আমি না শোনার মতো করে বললাম,

‘আম্মা আমাকে এখুনি একটু বাইরে যেতে হবে৷ আজকে রাখি৷ আপনি নিজের যত্ন নিবেন৷’

আমি এই বলে কল রেখে দেই৷ অহেতুক পিছুটানে আমি অতীতে ফিরে যেতে চাই না৷ অতীত শুধু দুঃখ বয়ে আনে৷ দুঃখ বয়ে বেড়ানোর ইচ্ছাটা আর হচ্ছে না৷

.
ইতালির রোম শহর টা ছবির মতো সৌন্দর্য ধারণ করে৷ সব কিছুতে কেমন একটা গোছানো ভাব৷ মনে হয় কেউ একজন খুব নিখুত ভাবে সব গুছিয়ে রেখেছে৷ তবে আমি নীরা৷ সব কিছু যার জীবনে এলোমেলো৷ এই গোছানো পরিপাটি শহরে এসেও যে ভয়ে ভীত হয়ে থাকে৷ এই বুঝি কোনো ঝড়ের তান্ডনে আমার মতো বুনোফুলের জীবন খসে যাবে৷
ভয়ে ভয়েই সব করে যেতে লাগলাম৷ বাইরের দেশের একটা ব্যাপার হলো সব কিছু নিজেকে একা করতে হয়৷
এই সূক্ষ্ম ব্যাপার টা আমার জীবনের পরিবর্তন টা নিয়ে এলো যেন৷ তবে এখানে এসে নিজেকে অনেল হালকা লাগে৷ নতুন করে বাঁচার আগ্রহ জেগে উঠে৷ বিভিন্ন দেশের মানুষ তাদের কালচার সব আমাকে অভিভূত করে৷
আমার সেমিস্টারের সব স্টুডেন্টদের সাথে পরিচিত হবার জন্য একটা প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়েছে৷ যদিও এর আগে আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য একটা হয়েছিলো৷ তবে আমি যোগ দিতে পারি নি৷
ইউনিভার্সিটির এক পাশে ইন্টার ন্যাশনাল স্টুডেন্টদের জন্য আলাদা একটা রুম আছে৷ আমি সেখানে আমার ডকুমেন্টস দিলাম৷ ওখানের এক ম্যাম আমাকে খুব সুন্দর ভাবে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন,

‘জীবনকে উপভোগ করতে শেখো৷ তোমার নতুন জীবনে স্বাগতম৷’

আমি উনাকে ধন্যবাদ জানালাম৷ এদেশের মানুষ গুলো অন্যরকম৷ যদিও তাদের ধ্যান ধারণা ইসলামের বহিভূর্ত৷ তবে তাদের মানুষিকতা আমাদের তথাকথিত বাঙালিদের থেকে উন্নত৷ বাঙালিরা জেনে বুঝে মানুষকে কষ্ট দেয়৷ কিন্তু এই মহিলা!
সে আমাকে জানে না চেনে না তবে আমাকে জীবন উপভোগ করতে বললো৷ আমি আল্লাহ কে স্মরণ করলাম৷ ঘড়ির সময় দেখলাম জোহরের সময় যাচ্ছে৷
দ্রুত রুমে ফিরে নামাজ আদায় করলাম৷ আমার রুমের মেয়ে গুলা যথেষ্ট বিনয়ী৷ আমি নামাজ পড়ে উঠতেই সে জিগ্যেস করলো,

‘প্রার্থনা করলে?’

‘হ্যাঁ সালাত আদায় করলাম৷’

ও উত্তরের বিনিময়ে হাসলো৷ এরপর ওর সম্পর্কে বিভিন্ন কথা বললো৷
তবে ওর সাথে আমার একটা জায়গায় মিল আছে৷ ও নিজের বয়ফ্রেন্ডের কাছে থেকে বাজে ভাবে ঠকে গেছে৷ ওর বয়ফ্রেন্ড আর বেস্টফ্রেন্ডের ওর সাথে চিট করেছে৷ বেচারি বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললো৷
আমি অবাক হয়ে মেয়েটাকে দেখলাম৷ রাশিয়ার মেয়ে গুলো জন্মগত ভাবেই অন্যরকম সুন্দরী৷ এবং মেয়েটার বাবার অঢেল টাকা আছে৷ মাথার উপর ছায়া আছে৷ তবুও মেয়েটা ঠকে গিয়েছে৷ আমি এতোদিন ভাবতাম আমি এতিম আর চালচুলোহীন বলেই ঠকে এসেছি৷ তবে! আজ বুঝলাম ঠকে যাবার জন্য কোনো কারণ লাগে না৷ আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম৷

.
ভার্সিটির প্রোগ্রামে একটা ছেলে এসে আমাকে দেখে বললো,

‘আরে আপনি এখানে!’

উনাকে দেখে আমি আশ্চর্য হলাম৷ বাঙ্গালি দেখে আমি হেসে বললাম,

‘আমি কি আপনাকে চিনি?’

লোকটা বেশ অবাক হলো৷ এরপর বললেন,

‘বাঙ্গালিদের এই এক স্বভাব৷’

‘বুঝলাম না৷ আসলে আমি আপনাকে চিনতে পারছি না৷’

আমার কথাতে উনি বেশ বিব্রত হলেন৷ বললেন,

‘আপনার সাথে আমার সাভার কাঠালবাগানে দেখা হয়েছিলো৷ আপনি মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজে যাচ্ছিলেন৷ রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলেন….

‘রাস্তা হারাই নি৷ আমি চিনতাম না কিছু৷’

‘যাক তাহলে এবার মনে পড়েছে?’

উনি উৎফুল্ল হয়ে প্রশ্ন করলেন৷ আমি হেসে বললাম,

‘হ্যাঁ৷ আর ওইদিন আমি আপনাকে ধন্যবাদ দিতে পারিনি৷ ওইদিনের জন্য ধন্যবাদ৷’

‘যাক বাঁচা গেলো৷ যেভাবে রিয়্যাক্ট করেছিলেন৷ আমি মনে মনে ভেবেছি এই বুঝি পুলিশ ডাকবেন৷’

আমি মুচকি হাসলাম৷ উনি আবার বললেন,

‘আপনি এখানে কিভাবে!’

‘মাস্টার্সের জন্য এসেছি৷’

‘ও গ্রেট৷ আমিও সেম৷ তাহলে তো আমি আর আপনি ক্লাসমেট৷’

‘হ্যাঁ৷ কারণ প্রোগ্রাম শুধু আমাদের নিয়েই হচ্ছে৷’

এরপর অন্যান্য আলাপ আলোচনা চললো৷ আমি কিছুটা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলাম৷ যদিও লোকটাকে আমার খারাপ মনে হয় নি৷ তবুও!

.
আমাদের ক্লাস পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে৷ তার উপর আমি একটা পার্টটাইম জবের ব্যবস্থাও করেছি৷ একটা সুপারশপের সেলস গার্ল হিসেবে৷ নেক্সট সেমিস্টারের জন্য টাকা জোগাড় আর খাবার খরচের জন্য চাকরি টা আমার জন্য আল্লাহর রহমত৷
তবে ক্লাস শেষ করে আবার ডিউটি অনেকটাই কষ্টের ব্যাপার৷ আমি সব মিলিয়ে এতোটাই ব্যস্ত হয়ে গিয়েছি আমার অতীত জীবনের ছিটেফোঁটা ও আমার ইদানীং মনে পরে না৷
তবে সেই লোকটা মানে আতিব জামান৷ উনি আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে বেশ আগ্রহী৷ আমার রুমমেট ক্লারা মানে যে মেয়েটা রাশিয়ান৷ ও আমাকে বলে আতিব তোমাকে পছন্দ করে৷ ওর চোখে কিছু একটা আছে৷
আমি ক্লারার কথা শুনে বেশ ভয় পাচ্ছি৷ তবে আতিব কে দেখে ওরকম কিছু আমার মনে হয় না৷ তবুও আমি এড়িয়ে চলার বেশ চেষ্টায় থাকি৷
আমার রুমের নেপালের মেয়েটা ও কিছুদিন আগে বলতেছিলো,

‘নীরা তোমার বয়ফ্রেন্ড তোমার খোজে এসেছিলো৷’

আমি অবাক হতেই ও বর্ণনা দিতেই আমি বুঝলাম মুন আতিবের কথাই বলছে৷ আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম৷
এই গুটিকয়েক সময়ে আমি চাই না কোনো ভুল পদক্ষেপে পা বাড়াই৷ যার পপরিপ্রেক্ষিতে আমার জীবন এলোমেলো হয়ে যাক৷

.
আতিব ছেলেটা ইদানীং আমার পেছনে পরে আছে যেন৷ এই যেমন ক্লাস শেষে দাঁড়িয়ে থাকা৷ কখনো ডিনার বা লাঞ্চ অফার করা৷ আবার আমার কাজের জায়গায় গিয়ে বসে থাকা৷ ইত্যাদি বিষয়ে আমি এক প্রকার অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম৷
ও আজকেও শপে এসেছে৷ আমাকে দেখে হাত নাড়িয়ে বেশ উৎফুল্ল ভাবে বললো,

‘আজ তোমার সময় হবে?’

‘আমার সময় নেই আতিব৷’

আমি বিরক্ত কন্ঠে বললাম৷ তবে সে নাছোড়বান্দা৷ বললো,

‘আমি জানি আজকে তোমার কাজ নেই৷ আমরা চাইলে একসাথে ডিনার করতে পারি৷ আর আমি জানি তোমার ফেভারিট বিরিয়ানি৷ একটা বাঙ্গালি রেস্টুরেন্টে খুজে পেয়েছি৷’

‘আমি যেতে পারবো না৷আমার অন্য কাজ আছে৷’

‘তুমি আমার সাথে এমন করছো কেনো নীরা!’

‘শুনো আতিব তোমাকে একটা কথা বলি৷ আমার জীবন টা এতোটা সহজ নয় যতোটা তুমি দেখতে পারছো৷’

‘কঠিন জিনিস গুলা কি! আমাকে বলো৷’

আমি বেশ হতাশ হলাম৷ এক অচেনা অজানা ছেলেকে নিজের ব্যক্তিজীবনের কোনো কিছু আমি জানাতে ইচ্ছুক নই৷ আমি আতিবকে বললাম,

‘আমি তোমাকে কোনো কিছু বলত্র চাই না৷ তবে শুনো তুমি যে আশায় আমার সাথে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছো আমি সেই জন্যই তোমার থেকে দূরে থাকতে চাই৷ প্লিজ আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখো৷’

কথাগুলো শুনে আতিব বেশ লজ্জিত হলো বোধহয়৷ সে আর একটা কথাও বললো না৷ ও চলে যেতেই আমি হাফ ছেড়ে বেঁচেছি৷ আবার কোনো কষ্টের সাগর আমি পাড়ি দিতে চাই না৷

.
শপের ঘটনার পর আতিবের সাথে আমার হাই হ্যালোর সম্পর্ক টাও নষ্ট হয়ে গিয়েছে৷ ও আমাকে দেখকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে৷ ব্যাপার টা আমিও করি৷
তবে আমি বেশ গুরুতর একটা সমস্যায় পরেছি৷ টিউশন ফি জমা দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত টাকা জোগাড় করতে পারি নি৷ এইদিকে লাস্ট ডেট ও এসে পরছে৷ আমার শাশুড়ী আম্মাকে কল দিতেই উনি ভালোমন্দের খোজ নিয়ে বললেন,

‘নীরা আমার হাজার দশেক টাকার দরকার৷ তুমি কি আমাকে দিতে পারবে?’

আম্মার কথা শুনে আমি অবাক হলাম৷ পাল্টা প্রশ্ন করার আগেই উনি বললেন,

‘শুনলাম এখন ভালোই ইনকাম করছো৷ প্রত্যেক মাসে আমাত হাত খরচ বাবদ কিছু টাকা পাঠালে ভালো হয়৷’

আমি আচ্ছা বলে অজুহাত দেখিয়ে ফোন রেখে দিলাম৷ ব্যাপার টা আমার অনেক অদ্ভুত লাগলো৷ আম্মার টাকার অভাব নেই কিন্তু!
টিউশন ফি জমা করবো কিভাবে এই চিন্তায় আমার ঘুম হারাম হয়ে গেলো৷ আর এইদিকে আম্মা নিয়ম করে ফোন করে টাকা চেয়ে যাচ্ছেন৷

চলবে..