মন কেমনের দিন পর্ব-০১

0
1

মন কেমনের দিন
সূচনা পর্ব
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

সাদিফ ভাইকে চেনেন না এমন মানুষ এলাকায় কমই আছেন। নেতা নেতা ভাব নিয়ে চলা মানুষটা আসলে নেতা নন। ছোটখাটো ইম্পোর্টের ব্যবসা আছে। এইতো, পাড়ার কিছু ছেলেপেলেকে নিয়েই। মেজাজে গরম, স্বভাবে ভদ্র হিসেবে নামডাক খুব। এলাকার মানুষ হাকিম ভূঁইয়াকে দেখে বড় সালাম দিয়ে বলেন, ‘ছেলে তো সোনার টুকরা, ভাইজান।’
অথচ মানুষীর তা মনে হয় না। লোকটা তার সঙ্গে সদা খাটখোট্টা। কথা কম বলে, বকে বেশি। গ্রামে এলেই তার পিছু পরে থাকে, কোনো এক ছুঁতোয় ঠাস করে গালে চড় বসাতে।

ওইতো, দুদিন হলো বড় চাচা চট্টগ্রাম থেকে মানিকগঞ্জ এসেছেন। সাদিফ অবশ্য তাদের সাথে আসেনি। এসেছে রাত্রি এগারোটায়। বাইকে করে গোটা পথ।

বোনেরা আর ভাইয়েরা মিলে সবাই তখন টিভিতে ‘তারেক মেহতাকা উলটা চাশমা’ দেখছিল। বাড়ির সবাই তখন গভীর ঘুমে। চাপা হাসির শব্দ ছাড়া বাকিসব সুনশান, নিরব। তারপর হঠাৎ! কোত্থেকে ভারী শক্তপোক্ত হাতের টোকা লাগলো মানুষীর মাথায়। বিশ্রীভাবে জ্বলে উঠলো মাথার পেছনটা। ব্যথা স্থানে হাত বুলাতে বুলাতে পেছনে তাকাতেই দেখলো, সাদিফ দাঁড়িয়ে আছে। মুখে হাসি নেই। কুশলাদির নূন্যতম আগ্রহ নেই। কপালে ভাঁজ ফেলে রাগী কণ্ঠে বলে উঠে, ‘খেয়াল কই থাকে তোর? আমি এসেছি, দেখিস নি?’

মানুষীর মন খারাপ হলো। এইযে, সে শুদ্ধ বাকিরা কেউই সাদিফের আসা খেয়াল করেনি। অথচ সবার মধ্য থেকে লোকটা তাকেই বকছে, মারছে! মন খারাপের সুর টেনে বললো, ‘আমি টিভি দেখছিলাম।’

‘ভাত খাবো। ভাত বাড়।’

মানুষী আবার টিভি দেখায় মন দিয়ে বললো, ‘আপনার চাচির কাছে চান। আমি পারবো না। এই এপিসোডটা আমি দেখিনি।’

‘দেখতে হবে না। তুই ভাত বাড়।’

‘পারবো না। আপনি যান তো!’

মানুষী ভেবেছিল, সাদিফ হয়তো রেগে গিয়ে তাকে আরও কয়েকটা বকবে, কথা শোনাবে। অথচ সে কিছুই করলো না। চুপচাপ চলে গেল নিজ রুমে। পায়ের কদমের আওয়াজ হলো। ধাপধুপ! ধাপধুপ! পাশ হতে মিতা বললো, ‘ভাতটা বেড়ে দিলেই তো পারিস। ভাইয়া দেখেছিস কেমন রাগ করলো?’

মানুষী বিরক্ত হয়ে বললো, ‘তোর এত দরদ উতলে পরলে তুই ভাত বেড়ে দে! যা!’

মিতা মুখ কালো করে বললো, ‘এপিসোডটা আমিও আগে দেখিনি রে… নইলে দিতাম।’

প্রথম এপিসোড শেষ করে পর পর আরও দুটো এপিসোট দেখলো তারা। নিশীথের গুমোট ভাব তখন তাড়া দিচ্ছে। ঘড়িতে একটা বেজে এক মিনিট।
রঞ্জন হামি দেওয়ার ভঙ্গিমা করে বললো, ‘আর দেখবো নারে। ঘুমাবো।’

মানুষীদের বিশাল বড় বাড়ি। বাড়ির বিশালতার জন্যই মানুষের সংখ্যাও নিছক নগন্য নয়। অনায়াসে অর্ধপঞ্চাশ ধরা যায়। প্রত্যেকটা ঘর তিন চারজন সদস্যদের জন্য বরাদ্দ। কেবল মাত্র সাদিফ ছাড়া। বারান্দার ওপাশের ঘরটা তার একার। কারণ বললে বলা যায়, তার বন্ধুর অভাব নেই। শহর থেকে কোন এক বন্ধু আসবে তার। ওই ঘরটায় সে আর তার ওই বন্ধুই থাকবে।
বন্ধুটার সঙ্গে মানুষীর একবার দেখা হয়েছিল। গ্রামের মানুষ সাদিফের এই চোর মতো বন্ধুকে ‘বাদল দিনের কান্না – বাদল’ বলে ডাকে। এর অবশ্য কারণও আছে। এক বছর আগে বাদল বেড়াতে এসে মাতব্বরের গাছের আম চুরি করেছিল। ধরা পরে সে কি জটিল কান্ড! মাতব্বর কিছুতেই মাথা ন্যাড়া না করে ছাড়বে না। ভয়ে বাদল নেতিয়ে যায়। সে কি আহাজারি তার! সে কি কান্না! বাদলের কান্নায় তখন আকাশও কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে গ্রামে পানি আসে। বন্যা হয়। ভয়াবহ স্রোতে একাকার করে দেয় পুরো গ্রাম!

ঘটনা মস্তিষ্কে হানা দিতেই মানুষী হেসে ফেলে। নিশ্চুপ স্বরে। ঘরে যেতে গিয়ে খেয়াল হয়, সাদিফকে ভাত দিতে ভুলে গেছে সে। লোকটা নিশ্চয়ই জেদ করে ভাত খায়নি? খাবেও বা কেন? লোকটা তো তাকে জ্বালাতে ভালোবাসে। জ্বালিয়ে মারতে পছন্দ করে।

_____

ঘরের দরজা ভেড়ানো। ফাঁক দিয়ে মোমবাতির আলো দেখা যাচ্ছে। কি আশ্চর্য! কারেন্ট থাকা সত্ত্বেও এ লোক মোম জ্বালিয়ে রেখেছে কেন? মানুষী দরজা ঠেললো। অনুভব করলো, দক্ষিনের জানালা খোলা। ভ্যাপসা গরমেও ফ্যান বন্ধ। মানুষী ভালো ভাবে তাকাতে চেষ্টা করলো। আঁধার চোখে সইতেই সাদিফকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখলো সে। কপালে হাত দিয়ে কেমন মরা মানুষের মতো শুয়ে আছে। ঘুমিয়েছে কি-না বোঝা যাচ্ছে না। মানুষী আস্তে করে ডাকলো, ‘সাদিফ ভাই, শুনছেন?’

জবান নেই। মানুষী আবার ডাকলো, ‘শুনছেন না আপনি? এই সাদিফ ভাই! ভাত খাবেন। উঠুন।’

‘খাবো না। তুই যা এখান থেকে।’

কণ্ঠে তেজ নেই। মলিন, ম্লান।

‘গলা এমন শোনাচ্ছে কেন? কি হয়েছে আপনার?’

‘কিছু হয়নি। তুই যা।’

মানুষী শুনলো না। আলতো করে তার বাহুতে হাত রাখতেই আঁতকে উঠলো খুব। লোকটার শরীর এত গরম!

‘আপনি কি পাগল? জ্বর এসেছে বলেননি কেন?’

‘বললে কি হবে? তুই তো আমাকে চোখেই দেখিস না।’

মানুষী শুনলো না বোধহয়। সে ততক্ষণে রান্নাঘর থেকে একটা বড় বোল আনতে চলে গেছে। খুঁজে খুঁজে রুমাল এনেছে। বাথরুম থেকে বোল পুরিয়ে পানি এনে তাড়া লাগিয়ে বসেছে সাদিফের শিওরে।

‘ভাত তো এখন বোধহয় খাবেন না। অন্য কিছু আনি? স্যুপ খাবেন?’

সাদিফ কিয়ৎক্ষণ কিছু বললো না। চুপচাপ দেখতে লাগলো মানুষীকে। এরপর ঢিমে স্বরে বললো, ‘তুই কেন আমার কথা শুনিস না, মানুষী?’

তপ্ত কপালে ভেঁজা রুমাল দিয়ে মানুষী শুধালো, ‘কোন কথা শুনিনি?’

‘সব কথা। তোর উচিত আমার সব কথা শোনা।’

‘শুনে কি হবে?’

‘অনেক কিছু। তুই কথা শুনলে আমার মন ভালো হয়ে যায় মানুষী।’

মানুষী অভিমানের সুরে বলে, ‘আপনি যে চুন থেকে নুন হলেই মারেন, সেই বেলা?’

‘আর মারবো না। আমি তোকে আর মারবো না মানুষী। বকবোও না। তুই একবার আমার দিকে তাকিয়ে দেখ। আমার বুকে মাথা পেতে দেখ। আমি তোর ব্যাকুলতায় নিশ্বাস নিতে পারিনা রে।’

__________________

চলবে~