মন কেমনের দিন
শেষ পর্ব.
বৈশাখ মাসের শুরুটা তখন অন্যরকম। ঝড়ো হাওয়া, ঝিরিঝিরি বৃষ্টির আগমনের পর হুট করে মুষলধারে বৃষ্টির দেখাও পাওয়া যায় জোড়দার দাপটের সঙ্গেই। গ্রামের কাঁচা-পাঁকা রাস্তা কিংবা বাড়ি-ঘরের উঠোন জুড়ে অচিরেই কাঁদা মাটির ভীড়। ভেঁজা ভেঁজা একটা ঘ্রাণও সুমিষ্ট হয়ে আশপাশে ঘুরঘুর করছে। গাছে গাছে এত এত আমের ঝাঁক! মানুষীদের বিশাল বড় বাড়িতে আম গাছের অভাব নেই। শত শত ঝুলে থাকা আমগুলোকে দেখলে মনে প্রশান্তি জাগে। ঝড়ের দাপটে সেগুলো ধুপধাপ শব্দে আছড়ে পরছে মাটিতে। ভাইবোনেরা তাই আর দেড়ি করেনি। বৃষ্টির পানিতে নাইতে নেমেছে ঘণ্টাখানেক হলো। গামছা, লুঙ্গি, ওড়নার ছোটখাটো কোলজুড়ে এক এক করে রাখছে কালবৈশাখীর ঝড়ে অকালে ঝরে পরা আমগুলোকে। প্রান্ত, ধুরতা, মিতা আর রঞ্জন ঐতো! একটু দূরেই কাঁদা মাটিতে লাফাচ্ছে। ওদের হৈ হুল্লোড়ের শেষ নেই। প্রত্যেকের মুখেই হাস্যোজ্জ্বল দ্যুতির উদয়মান প্রতিমা। যেন কারো মনেই পিছলে পরার ভয় নেই। জ্বর-সর্দির অপ্রয়োজনীয় সঙ্কা নেই। বহুদিন বাদে বৃষ্টির শীতল স্পর্শে শরীর উপচে আনন্দের মিঠে হাওয়া শিরশির করছে যেন। কি আশ্চর্য সুখময় অনুভূতি! সেই অনুভূতির সফেদ পর্দা সরিয়ে আচমকাই নিচ থেকে কাঁদা তুলে প্রান্তর মুখ মাখিয়ে দিল কৃষ্ণ। খিকখিক করে হেসে বলল, “গ্রামের ময়লা মাটি মাখ বেডা! আরও ফর্সা হইয়া যাবি!”
“ইছ! ছিইইইই!”
প্রান্তর গগণ বিহারি চিৎকারে আর কেউ পাত্তা না দিলেও মানুষী খুব দিল। করিডোরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিষ্পলক চেয়ে চেয়ে দেখল ওদের বৃষ্টিতে ভেঁজা, কাঁদা মাখানো, অসীম আনন্দের এক ছটা! বুকে কেমন হাহাকার হচ্ছে। নিদারুণ কষ্টে হু হু করছে মন। ওরা কেন কেউ মানুষীকে ডাকলো না? ওদের আনন্দের একটুখানি ভাগ দিলো না? মানুষীর কাল পরীক্ষা বলে? পরীক্ষা বলেই বৃষ্টিতে ভেঁজা যাবে না? এমন আশ্চর্য বিশ্রী নিয়ম বানিয়েছেটা কে? নিয়ম বানালেই মানতে হবে? হাজারো প্রশ্নের উঁকিঝুঁকিতে নিজেকে বড্ড ক্লান্ত মনে হলো মানুষীর। তার অভিমান বেশি। ছোট থেকেই। মন মতো কিছু না হলেই অভিমানে টইটুম্বুর হয়ে পরে সে। এবারও হলো। ভাই বোনদের এহেন চরম স্বার্থপরতায় ফুঁপিয়ে উঠল ক্ষণেই। কেঁপে কেঁপে উঠলো শরীর, মন, মস্তিষ্ক! সেই কাঁপনটুকু বাড়িয়ে দিতেই বোধকরি তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সাদিফ। আগাগোড়া তাকে পরখ করে গম্ভীর কণ্ঠে শুধাল, “এমন শাকচুন্নির মতো কাঁদছিস কেন? কে মারা গেছে?”
“আপনি।”
চোখের পানিতে মলিন গাল ভিঁজে গেছে। হাতের উলটো পিঠে পানিটুকু মুছলো মানুষী। আড়চোখে একবার কাকভেঁজা সাদিফের দিকে তাকালো। এই শীত শীত মৌসুমেও লোকটা শুধুমাত্র একটা শর্ট প্যান্ট পরে আছে। শরীর বেয়ে গড়িয়ে পরা পানি মেঝে ভিঁজিয়ে দিচ্ছে অনায়াসে। উন্মুক্ত ফর্সা পিঠ, বুকে লালচে আবরণ। চোখ আর নাক রক্তিম। নিমিষেই একটা হাঁচি দিতেই মানুষী অভিমান ভুলে বলল, “বৃষ্টি যখন শরীরে সয় না তখন ভিঁজেছেন কেন?”
“তো কি করবো? তোর মতো শাকচুন্নি সেজে করিডোরে দাঁড়িয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদবো?”
কথার পিঠে সাদিফের এমন পালটা প্রশ্ন পছন্দ হলো না মানুষীর। মুখ কালো করে বলল, “আমাকে একটু ভিঁজতে দিলে কি হতো? আপনারা নিজে নিজে একা একা ভিঁজেছেন। আমাকে একটু ডাকেনও নি! আমি কত কষ্ট পেয়েছি জানেন?”
সাদিফ ঈষৎ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “জেনে? জেনে কি হবে? তোকে আমরা তবুও ডাকতাম না।”
থেমে যাওয়া কান্নাটা হঠাৎই আবার নিয়ন্ত্রণ ছাড়া হলো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে মানুষী খুব করে অভিযোগ জানালো, “আপনি একটা ইতর সাদিফ ভাই। আমার মন বোঝেন না! কষ্ট বোঝেন না! কি বুঝেনটা কি আপনি? আমাকে এভাবে কষ্ট না দিলে হয় না?”
সাদিফ জবাব দিলো না। এ প্রথম কোনোরকম ত্যাড়ামো করতেও দেখা গেল না তাকে। চেয়ে চেয়ে, খুব শান্ত নজরে মানুষীকে পরখ করে বুঝলো, মেয়েটাকে কাঁদলে ভালো মানায়। চোখের পাঁপড়িগুচ্ছে অল্পসল্প পানি জমলে মায়াবী লাগে। কেন লাগে? সে কথার উত্তর নেই। উত্তর খোঁজার সামান্য উদ্বেগও নেই। হাত বাড়িয়ে মানুষীর চুলে হাত রাখলো সাদিফ। ভ্রুদ্বয় কিঞ্চিৎ কুঁচকে বলল, “চুল এমন রুক্ষ কেন? তেল-টেল লাগাস না?”
মানুষী দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বলল, “ভালো লাগে না লাগাতে।” পরপরই আবদারের সুরে বলল, “আপনি লাগিয়ে দেবেন?”
এ কথার উত্তর সঙ্গে সঙ্গেই পাওয়া গেল না। একটু রয়েসয়ে, মানুষীর চোখে চোখ রেখে সাদিফ কেমন নিগূঢ় গলায় বলল, “আচ্ছা, আমি চেঞ্জ করার পর রুমে আসিস।”
সাদিফ যে এত সহজে রাজী হয়ে যাবে— মানুষী ভাবেনি। কস্মিনকালেও না! এই লোক জন্মগত ইতর। মাথায় গুরুতর সমস্যার কারণে কোনো কাজ সোজা ভাবে করতে পারে না। সেই অ-সোজা পথের পথিক হঠাৎ করে সোজা পথে হাঁটছে কেমন করে? উত্তেজনা, কৌতূহলে পিষ্ট মানুষী আর দেড়ি করেনি। তক্ষুণি তেলের বোতল নিয়ে হাজির হয়েছে সাদিফের ভূতুড়ে, ঝমঝম করা ঘরটায়। সাদিফ ততক্ষণে গোসল সেড়ে বিছানায় বসেছে। চুল মুছতে মুছতেই একবার মানুষীর চঞ্চল বদনে নজর বুলালো। মেঝের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “বয়।”
মানুষী ভারী অবাক হয়ে শুধালো, “এই মেঝেতে?”
“তো? কোথায় বসবি? আমার মাথায়?”
“বিছানায় বসি?”
“না।”
“কেন? বসলে কি হয়?”
“ডায়রিয়া হয়।”
মানুষী এগিয়ে এসে মেঝেতে বসে পরলো। কপট রাগ দেখিয়ে বলল, “আপনার সঙ্গে আমি আর কথাই বলবো না। আপনি ভালো কথার মানুষ নন। আপনার চোখে মুখে ইতরামি।”
সাদিফ কি একটু হাসল? মানুষী আড়চোখে দেখার চেষ্টা করলো। নাহ্! হাসছে নাতো। তেলের বোতল থেকে একটু একটু তেল হাতের তালুতে নিচ্ছেন মহাশয়। মানুষীর মাথায় সিঁথি কেটে কি মোলায়েম আদুরে স্পর্শে তেল লাগিয়ে দিচ্ছে লোকটা! মানুষী তো সাদিফের এই ছোট ছোট আদরেই মন হারিয়েছে। কুপোকাত হয়েছে লোকটার ইতরামির পেছনের যত্নগুলোতে। এমন মানুষকে না ভালোবেসে পারা যায়? ভেতর থেকে মন সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিল, “নাহ্, পারা যায় না।”
ভালোবাসার এই সহজ স্বীকারোক্তির বছর পেরিয়েছে। তখন মানুষীর বয়স কতইবা ছিল? নবম শ্রেণীতে পরতো সে। কালবৈশাখের তোলপাড় মাখা দুপুরের এক ক্ষণে এভাবেই সাদিফের ঠুনকো যত্নে মন হারিয়েছিল মানুষী। আজও কালবৈশাখ। কালবৈশাখের ঝড়ে আজও বাড়ির উঠোনে ধুপধাপ শব্দে আছড়ে পরছে স্বাদের আমগুলি। কিন্তু হায়! উঠোনে আজ ভাইবোনদের কাঁদা ছুড়োছুড়ি নেই। আনন্দের খিলখিল ধ্বনি নেই। হৈ-হুল্লোড়ে কেউ চেঁচিয়ে উঠছে না। কেন উঠছে না? জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষী তপ্ত নিশ্বাস ফেলল। ভেঁজা গালদুটো মুছলো গাঢ় স্পর্শে। দরজায় ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। শায়লা খাতুন ডাকছেন তাকে।
“এভাবে না খেয়ে আর কতদিন মানুষী? যে গেছে সে কি তোর কান্নায় ফিরে আসবে?”
মলিন মুখে মায়ের দিকে একবার তাকালো মানুষী। ধীর কণ্ঠস্বরে বলল, “খাবার রেখে যাও। পরে খাবো।”
“আমি জানি তুই খাবি না।”
“তাহলে নিয়ে যাও।”
ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গলো যেন। মেয়ের সামনেই সশব্দে কাঁদলেন শায়লা খাতুন। আহাজারির সুরে বললেন, “আর কত মানুষী? আর কতদিন এভাবে নিজেকে কষ্ট দিবি? সাদিফ আর ফিরবে না। কোনো কিছুই ওকে আর ফেরাতে পারবে না। এই সামান্য কথা কেন বুঝতে পারছিস না? নিজেকে কেন এত কষ্ট দিচ্ছিস?”
আনমোনা মানুষী তখন গভীর মনোযোগে কি যেন ভাবছে। হয়তো মায়ের কথার উত্তর খুঁজছে। কাঙ্ক্ষিত উত্তরটা পেয়ে যেতেই বলল, “আমি সাদিফ ভাইকে বাইকে আসতে মানা করেছিলাম মা। মানা না করলে উনি মরতেন না।”
চোখমুখ শক্ত করে মানুষীর দিকে তাকালেন শায়লা খাতুন। অনেক হয়েছে মেয়ের পাগলামো দেখা। অনেক প্রশ্রয় দিয়েছেন তিনি। আর না! মানুষীর পরনের সাদা শাড়ির পাড় খামচে ধরে শক্ত গলায় তিনি বললেন, “তোর আর সাদিফের বিয়ে হয়নি, মানুষী। তুই কার জন্য ইদ্দত পালন করছিস? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর? পাগল হয়ে গেছিস?”
শুকনো ঠোঁটে অনেকদিন হয়েছে ভ্যাসলিনের ছোঁয়া পরে না। ফেঁটে চৌচির হয়ে রক্তজমাট হয়ে আছে। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁটটা একটু ভেঁজালো মানুষী। খুব আস্তে করে বলল, “আমি মনে হয়… আমার সত্যি নিজেকে পাগল পাগল লাগে মা। মনে হয়, আমার জন্যই সাদিফ ভাই আর নেই। আমি কেন তাকে বাইকে আসতে মানা করলাম মা? আমি মানা করেছি বলেই এমন হয়েছে। আমার কথা না শুনলে আজকে সবাই কত খুশি থাকতো! বড় চাচা-চাচির ছেলে হারাতে হতো না। আসলে আমিই খারাপ। আমার জন্য কেউ সুখে থাকতে পারছে না।”
বলতে বলতে মায়ের দিকে একপলক তাকালো মানুষী। এক দৃষ্টিতে। আনমনে শুধাল, “সাদিফ ভাইকে কি আর সত্যিই ফিরিয়ে আনা যাবে না, মা?”
“না, যাবে না। যাবে না বলেই তুই এখন থেকে এসব পাগলামো বাদ দিবি। আমি আর তোর বাবা ছেলে দেখছি। বড় ভাইজানও দেখছেন।”
“ছেলে দেখে কি হবে?”
“চুপচাপ বিয়ে করে নিবি।”
মানুষী গূঢ় ভাবনায় মত্ত্ব হয়ে বলল, “বিয়ে তো আমি সাদিফ ভাইকে করতে চেয়েছিলাম। উনি নেই। আমি আর বিয়ে করে কি করবো?”
“জীবনটাকে কি তুই নাটক সিনেমা পেয়েছিস?”
মানুষী ভীষণ শীতল গলায় আওড়ায়, “নাটক সিনেমা জীবন থেকেই নেওয়া হয় মা।”
শায়লা খাতুন কিছু বললেন না। ভাতের প্লেটটা বিছানার একপাশে রেখে চলে গেলেন সেখান থেকে।
________
পৃথিবীর একটা অপার সৌন্দর্যের কথা জানেন? এই পৃথিবীতে যখন-তখন যা কিছু ঘটতে পারে না। কিছু কিছু ঘটা হয় স্বস্তির, আনন্দের, উল্লাসের। আবার কিছু কিছু ঘটা হয় ঘনঘটা। আকাশে যেমন হুট করে কালো মেঘ উদয় হয়? এই ঘনঘটার উদাসময় বিষাদ অধ্যায়ও শুরু হয় আকস্মিক তাড়া নিয়েই। কালো কালো মেঘের মাদুরে বিশ্রী এক বিষন্নতা নিয়ে একেবারে ঘেটে ফেলে নির্দিষ্ট কিছু মানুষের জীবন। আকাঙ্ক্ষা কিংবা খুশি বলতে আর কিছু থাকে না। এই ভূঁইয়া বাড়ির মানুষদের জীবনও ঠিক তেমনিই হারিয়ে ফেলেছে এতকালের জমিয়ে রাখা সব উজ্জ্বল স্মৃতি। বিয়ে নামক চমৎকার এক উৎসবের মাঝে যখন তাদের স্মৃতিগুলো আরও জোড়ালো হবার কথা ছিল ঠিক সেখানেই তা মুখ থুবড়ে পরেছে। কান্নায়-আহাজারিতে সেই বিয়েতে তখন আর আনন্দ মিশে নেই। আদর আদর আবহাওয়ায় কপট ধমকের দরুণ সব ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। দুষ্টু লোকেদের ধমকে মিইয়ে গেছে গুটি কয়েক মানুষের জীবন। সাদিফ বরাবরই সাহসী একটা ছেলে। মেধাবী। কিন্তু সেদিন চরম নির্বুদ্ধিতার প্রমাণ দিয়ে ডাকাতের হাত থেকে বাসের লোকদের বাঁচাতে চেয়েছিল সে। শুধু সে নয়। আরও দুটো তার বয়সী ছেলে। অনবরত বাসের মানুষের কান্না, ডাকাতদের পরপর মেয়েদের ওড়না নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া কি সহ্য করা যায়? পুরুষত্ব যার আছে, মানবিকতা যার আদর্শ— তারা কি এসব দেখে চুপ থাকতে পারে? নাহ্! পারে না। সাদিফরাও পারেনি।
মানুষীর স্পষ্ট মনে আছে, অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে সাদিফ যখন মারা গেল? বড় চাচা আর একমুহুর্ত দেড়ি না করে সাদিফকে নিয়ে চলে এসেছিলেন বাড়িতে। বিয়ের রাতে সেদিন সাউন্ড বক্সে কোনো গান বাজনা হয়নি। মরিচবাতির টিমটিম করা লাল-হলুদ-নীল বাতি নিভিয়ে মরা সাদা এক বাতি জ্বলে উঠেছিল সারা বাড়িজুড়ে। মৃদু মৃদু মানুষের কান্নায় ফাঁটল ধরেছিল জীর্ণ দেওয়ালে। মন ভাঙ্গার ফাঁটল। আশা, ভরসা পরিশেষে প্রতিজ্ঞার ফাঁটল। মানুষী শোয়া থেকে উঠে বসল। ঘড়িতে রাত দুটো বাজছে। শায়লা খাতুন যেভাবে ভাতের প্লেট রেখে গিয়েছিলেন ঠিক সেভাবেই পরে আছে প্লেটটা। সে ধীরপায়ে জানালার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো। এখান থেকে বাড়ির উঠান দেখা যায়। দৈর্ঘ্যে লম্বা, প্রস্থে মোটা উঠান। এর ঠিক মধ্যিখানেই সাদিফের খাটিয়া ছিল। মানুষী ঠিক এখানে দাঁড়িয়েই সাদিফকে আনমনে দেখছিল সেদিন। নিচে গিয়ে লোকটাকে একটু কাছ থেকে দেখা হয়নি। একটু করে শেষবারের মতো ছুঁয়ে দেখা হয়নি। ছুঁবে কিভাবে? সাদিফ যদি রেগে যায়? অভিমান করে বলে, “তুই আমাকে সেদিন বাইকে যেতে কেন মানা করলি মানুষী? মানা না করলে তো আমি বাসে যেতাম না। তখন কি এভাবে মরতাম বল? তুই অভিমান করে আমার সঙ্গে এমন করেছিস তাই না? তোর এই অভিমান আমাকে এভাবে মেরে ফেলল?”
মানুষী জবাব দিতে পারে না। শূণ্য শূণ্য উত্তরে ডুকরে উঠে খুব। ভীষণ যন্ত্রণায় বুক ফাঁটে, হাঁসফাঁস লাগে। এ কেমন পীড়া? আশপাশ এমন নিঝুম, নিস্তব্ধ কেন? দূর থেকে পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে। মানুষীর সহ্য হলো না ডাকটা। ধাম করে জানালার দরজা লাগিয়ে সে আবারও শুয়ে পরলো বিছানায়। ঘরের বাতিটা আর নেভালো না। ইদানিং সে বাতি নেভালে ঘুমাতে পারে না। ভয় ভয় লাগে। মনে হয়, কে যেন কানের কাছে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করছে, “এত অভিমান তোর?”
জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিয়ে বিছানা হাতড়ে লাল বেনারসি শাড়িটা বুকে জড়িয়ে নিল মানুষী। শাড়িটার জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। ছোপ ছোপ রক্তের দাগ মিলেমিশে একাকার। মানুষীর বিশ্বাস, এ রক্ত সাদিফের।
বালিশের পাশ থেকে মোবাইল বের করল মানুষী। বাসে ওঠার পর সাদিফ তাকে একটা মেসেজ পাঠিয়েছিল। লম্বা, দীর্ঘ যান্ত্রিক বার্তা। এ নিয়ে কতবার এই দীর্ঘ লিখাটা পড়েছে, মানুষীর জানা নেই। যতবারই পড়েছে, বালিশ ভিঁজিয়ে খানখান হয়েছে হৃদয়। এবারও হলো। একটু বেশিই হলো বোধহয়।
‘প্রিয় অভিমানিনী আমার,
আমি বাসে উঠেছি। রাত দশটার বাস। মজার বিষয় কি জানিস? আমার অফিস ছুটি হয়েছে সাড়ে ন’টায়। আমি ছুটি পেয়েই আগে বাস ধরেছি। তোর কাছে তাড়াতাড়ি আসতে হবে না? সাথে অবশ্য জামা-কাপড় কিছুই নেইনি। আমি আর বেনাসরি শাড়ি আসছি শুধু। তুই কিন্তু অভিমানে মুখ ফুলিয়ে রাখিস না মানুষী। আমি তাড়াতাড়িই আসার চেষ্টা করব। তোকে বউ সাজে দেখব। তোর নামে কবুল বলব। ব্যাপারটা কেমন নষ্টালজিক ভাবতে পারছিস?
মানুষী, আমি কখনো তোকে বলিনি, তুই আমার কাছে একটা উত্তপ্ত দুপুর। তোকে ভালোবেসে আমি উত্তপ্ত দুপুরে ক্লান্ত পথিকের তৃষ্ণা খুব করে অনুভব করেছি। তোর অভিমান আমার কাছে যেমন দুপুরবেলার খরা, ঠিক তেমনি অভিমান ভুলে তুই যখন আমার দিকে এক পলক তাকাস? বিশ্বাস কর, এমন সুন্দর এক পশলা বৃষ্টি আমি আগে কখনো দেখিনি।
আমি খুব তাড়াতাড়ি তোর কাছে আসছি, ঠিকাছে? তোকে বউ বানিয়ে নিজের কাছে নিয়ে যাবো। একটু ইতরামি বাদ দিয়ে ভালো হওয়ার চেষ্টা করবো। তুই বউ হচ্ছিস না এখন আমার? আমি ইতরামি করলেই ধমক দিয়ে শাষণ করবি, ‘সাদিফ, শুনুন! এখন বউ লাগি আপনার। ইতরামি বাদ দিয়ে ভালোবাসুন, বুঝেছেন?’ বিশ্বাস কর, আমি ভালোবাসবো মানুষী।
ইতি,
সাদিফ ভূঁইয়া।”
বলা হয়নি, সাদিফরা কখনো কথা রাখে না।
__________________
সমাপ্ত।
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা