মম হৃদয় বিহারিনী পর্ব-০২

0
299

#মম_হৃদয়_বিহারিনী
#ঐশী_রানী_রক্তিমা
২.
সদ্য বিবাহিত স্বামীর বুকে অচেতন রমনী,তার হঠাৎ আগমন আর ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরাটা ছিল আমার জীবনের দ্বিতীয় ধাক্কা।প্রথম ধাক্কাটা সাড়িয়ে উঠতে না উঠতেই এমন দৃশ্যের সম্মুখীন হলাম।মেয়েটা বাস্তবে উনার কি হয় ভাবতে ভাবতে বাথরুম থেকে শাড়ি পাল্টে বেরুলাম।বিয়ের লাল শাড়িটা পাল্টে কালো খয়েরী একটা শাড়ি পরেছি আমি।আমার চোখ মুখে বিস্ময়ের ছাপ এখনো লেপ্টে।অচেতন মেয়েটাকে বাড়ির বসার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।তার কি অবস্থা সেটা জানার তীব্র ইচ্ছে জাগলো মনে।

আচ্ছা মেয়েটা কি ধ্রুবর স্ত্রী?এমন ভয়ানক কথা ভাবতেই বক্ষ কেঁপে উঠলো আমার।একজন স্ত্রীর নিকট নিজের স্বামী সম্পর্কে এমন ধারণা করাটা কতটা হৃদয়বিদারক তা আমি টের পেলাম আজ।কিন্তু মনে পরলো মেয়েটার পরনে শাখা-সিঁদুর কিছুই নেই।এবার খানিক নিশ্চিত হলাম আমি।বেশ বড় সড় একটা শ্বাস টানলাম।কিন্তু আবার একটা খেয়াল মাথায় এলো আমার।মেয়েটা নিশ্চয়ই ধ্রুবর প্রেমিকা?প্রশ্নটা আমার গলায় কাঁটার মতে বিঁধে রইলো।

বিশাল বাড়িটার মতো বসার ঘরটাও অনেক বড়।পরিবারের সকলের খাওয়াদাওয়া একসাথে সেখানেই হয়।এককোণে মাদুর পেতে তাতে শোয়ানো হয়েছে শশীকে।ধ্রুবর বুকে অচেতন হয়ে ঢলে পরা রমনীর নাম শশী।বৈদ্য এসে নাড়ি পরীক্ষা করছে তার।পাশেই পেছনে হাতদুটো রেখে অত্যন্ত গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন ধ্রুব।উনার পরনে এখনো বিয়ের সেই পাঞ্জাবি-ধুতি।উনার মা পার্বতী দেবীর কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ।ছেলে কি জন্যে হুট করে বিয়ে করে বাড়িতে হাজির তার কারণ কেবল ধ্রুবর মা জানেন।বাকি সবাই এ ব্যাপারে অজ্ঞাত।অনেকের ধারণা আমার সাথে উনার বহুদিনের প্রেম ছিল। ছেলে শহরে পড়তে গিয়ে শহুরে মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে এমনটা অহরহই ঘটে।

বৈদ্য মশাই নাড়ি পরীক্ষা করে জানালেন,

“তেমন কিছুই হয়নাই।কিছু দেখে অজ্ঞান হইছে আরকি।চোখে মুখে পানি ছিটাইলেই হুঁশ ফিরবো।”

পার্বতী দেবী একজনকে ইশারা করলেন পানি নিয়ে আসার জন্য।শশীর মা তারা শশীর শিউরে বসে নিচুস্বরে গুনগুনিয়ে কাঁদছেন।

গ্রামের স্কুল মাস্টারের মেয়ে শশী।শিক্ষিতা,রুপবতী ও গুনবতী হওয়ায় ছেলের বউ হিসেবে তাকে পছন্দ করেছিলেন পার্বতী দেবী।শশীর মনের সুপ্ত কোণেও ধ্রুবর জন্য লুকানো প্রেম ছিল যা পার্বতী দেবীর প্রস্তাবে প্রকাশিত হয়েছিল।কিন্তু ধ্রুব এখনই বিয়ে করতে রাজি ছিল না।তার ইচ্ছে পড়াশোনা শেষ করার।তাই ধ্রুব শহরে আসে পড়াশোনার জন্য।গ্রামে শশী রয়ে যায় তার অপেক্ষায়।ধ্রুব পড়াশোনা শেষ করে আসলেই তাদের বিয়ে হবে একথা গ্রামের প্রায় সকলেই জানতো।এ বাড়ির লোক এই সংবাদ না ছড়ালেও শশীর মা গ্রামের লোকদের সাথে কথা বলে এ কথা ছড়িয়েছেন।এই কাজে তার খুব বেশি পরিশ্রম করতে হয়নি।গ্রামে এক বাড়িতে কোন ঘটনা ঘটলে তা লোকমুখে এমনিতেই ছড়িয়ে যায়।
পানি নিয়ে আসা হলে শশীর চোখেমুখে তা ছিটিয়ে দেন বৈদ্য মশাই।অচেতন শশীকে ঘিরে ছিল এ বাড়ির প্রায় সকলে।সকলের চোখেমুখে কৌতুহল আর দুশ্চিন্তা।শশীকেই সকলে এবাড়ির বউ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়ে ছিল।এ বাড়িতে ছিল তার অবাধ চলাচল।তাই তার জন্য সকলের খারাপ লাগাটা স্বাভাবিক।

আমিও তেমনি কক্ষে বসে বসে দুশ্চিন্তায় ভুগছিলাম।আমার বুক কাঁপছিলো ভীষণ।চলচ্চিত্রে দেখা বেশ কিছু সিন মাথায় ঘুরছিলো তখন।ধ্রুব কি মেয়েটাকে ঠকালো?
না, না।উনার সম্মন্ধে এমন মন্তব্য আমি করতে পারি না।উনার জন্যই আজ মাথা উঁচিয়ে আছি আমি।কিন্তু আমার চিন্তা কমার নাম নিচ্ছিলো না।আমি মনে মনে ঠিক করলাম বসার ঘরে গিয়ে দেখে আসি মেয়েটার অবস্থা।জ্ঞান ফিরেছে তো?

যেই ভাবা সেই কাজ। আমি আড়ষ্ট মনে কক্ষ থেকে বেরিয়ে ধ্রুবর সাথে আসা পথ ধরে হাঁটতে লাগলাম।আমার কৌতুহলী দৃষ্টি এবারও বাড়িটার দেওয়ালগুলো ছুঁয়ে দেখলো।
জ্ঞান ফেরার পর থেকেই শশীর দৃষ্টি একদম মেঝেতে স্থির।এ বাড়ির মানুষেরা তার অজ্ঞান হওয়ার কারণ আন্দাজ করলেও শশীর মা এ সম্পর্কে অবগত।জমিদার বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী যে শহর থেকে বিয়ে করে ফিরেছে তা এখনো গ্রামের লোকেদের কাছে প্রায় অজানা।যেহেতু আমরা বাড়িতে এসেছি প্রায় ভোরের দিকে।

শশীর জ্ঞান ফিরতেই তার মা তাকে অজ্ঞান হওয়ার হেতু জিজ্ঞেস করে।ঠিক তখনই বিকট শব্দে সকলের দৃষ্টি এসে পৌঁছায় সিঁড়ির দিকে।
সিঁড়ি থেকে নামতে গিয়ে অসাবধানতার কারণে আমার শাড়ির আঁচলে সিঁড়ির শেষধাপে থাকা ফুলদানিতে পেঁছিয়ে যায়। সেটা মেঝেতে পরেই এমন বিকট শব্দ উৎপন্ন হয়েছে।সেই শব্দ অনুসরণ করে সকলের দৃষ্টি আমার উপর এসে পরায় আমি ভীষণ অস্বস্তিতে পড়লাম।লজ্জায় দৃষ্টি নত হয়ে গিয়েছিল আমার।সকলে কেমন অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।আমাকে এখানে বোধহয় কেউই আশা করেনি।

সকলের মতো আমাকে দেখলেন শশীর মাও।কেবল একবারও চোখ তুলে তাকালো না শশী।আমাকে শশীর মা বেশ গাঢ় চোখে দেখলেন।আটপৌরে শাড়ি পরিহিতা আমি,মাথার দীঘল কেশ উন্মুক্ত,হাতে শাখা আর মাথায় সিঁদুর যেন উনাকে সবকিছু পরিষ্কার করে দিলো।জমিদার বাড়িতে আজই ধ্রুবর আগমন আর অপরিচিতা বিবাহিত রমনী ধ্রুবর সম্পর্কে যে কি হতে পারে তা উনি স্পষ্ট বুঝলেন।

আমি আড়ষ্টতা ভেঙে একটু একটু করে ভীড়ের দিকে এগোচ্ছিলাম।হঠাৎ ভীড় ঠেলে মেয়ের শিউর থেকে উঠে এলেন শশীর মা।আমার উপর উনার রক্তচক্ষু বর্ষিত হলো।আমি ভীত চোখে তাকালাম উনার দিকে।আকস্মিক উনি আমার দিকে আক্রমণাত্মক ভাবে তেড়ে আসলেন।আমি আৎকে উঠে ধ্রুবর পেছনে লুকালাম।এ বাড়িতে আমার একমাত্র ভরসার স্থল কেবল ধ্রুবই।

শশীর মা আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,

“কাল নাগিনী,দুনিয়াতে কি আর কোন পোলা ছিল না?আমার মেয়ের কপাল পুড়ালি এভাবে?”

উনার এমন মন্তব্য আঘাত হানলো আমার হৃদমাঝারে।মনে পরে গেল কালকে মায়ের এমনি কিছু সম্মোধন।আমি ধ্রুবর পরনের পাঞ্জাবি খাঁমচে ধরলাম।আমার চক্ষু পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো অশ্রুতে।
এবার সকলকে আশ্চর্য করে দিয়ে ধ্রুব গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,

“আপনি ওকে এভাবে বলতে পারেন না কাকিমা।”

শশীর মা এবার কাঁদতে কাঁদতে বললো,

“এ মেয়েটা তো আমার মেয়ের জীবনটা নষ্ট করে দিলো।”

“বিয়ে করে আনলাম আমি আর জীবন নষ্ট করলো নির্বানী?”

তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে শশীর মার কাছে প্রশ্ন ছুঁড়লো ধ্রুব।তার ওষ্ঠকোণে তাচ্ছিল্য মিশ্রিত একটুকরো হাসি লেপ্টে।হাসিটা সমাজের চিন্তাধারার উপর হেসেছে সে।

ধ্রুব উপস্থিত সকলের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে শক্ত কন্ঠে কাঠ কাঠ স্বরে বললো,

“নির্বানীর সাথে আমার বহুদিনের প্রেম।ওকে ভালোবাসি আমি।তাই কেউ ওর সাথে কোন কারণে খারাপ আচরণ করলে অবশ্যই আমি চুপ থাকবো না। ওর দিকে আঙুল তোলার আগে কথাটা সকলে নিজের মাথায় ঢুকিয়ে নিন।”

এতক্ষণ গুঞ্জন উঠে থাকা বসার ঘর মুহুর্তেই নিশ্চুপ হয়ে গেল।তাতে ঝংকার তুললো ধ্রুবর রুদ্রকন্ঠ।সকলের চোখেমুখে গাঢ় বিস্ময়।যে ধ্রুব বড়দের সাথে কখনো উঁচু স্বরে কথা বলেনি,আজ সে একদিনের বিবাহিত স্ত্রীর জন্য সকলকে বজ্রকন্ঠে শাঁসালো?ভারী বিস্ময়ের ব্যাপার!

আমার চোখে মুখে ফুটে উঠা বিস্ময় তখন সকলের উর্ধ্বে।এত বড় মিথ্যা কথা কেন বললেন উনি?আমার ভাবনার মাঝেই আমার হাতে টান পরলো।উনি আমার হাত ধরে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে এলেন।পেছনে থাকা সকল লোকেদের দৃষ্টি আমাদের দিকে।পাথর বনে থাকা শশী একবার চোখ তুলে আমাদের দেখলো।ধ্রুবর হাতের মুঠোয় আমার হাত,সকলের সামনে ধ্রুব আমার প্রতি প্রেমের স্বীকারোক্তি তাকে নিঃশেষ করে দিল।চোখে জমে থাকা অশ্রুরা নিঃশব্দে শশীর শুভ্র কপোলে গড়িয়ে তার দুঃখের আভাস দিল।

আমাকে নিয়ে সোজা কক্ষে আসলেন ধ্রুব।রাগে উনার নাকের পাটা কিছুটা ফুলে উঠেছে।কক্ষে পৌঁছেই আমার হাতটা ছেড়ে দিলেন উনি।তপ্ত শ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলেন,

“তুমি নিচে গিয়েছিলে কেন নির্বানী?”

আমার চোখেমুখের বিস্ময় তখনো কাটেনি।ধ্রুবর সকলের সামনে মিথ্যে প্রেমের স্বীকারোক্তি আমাকে তাদের সামনে যে উঁচু করবে না তা আমি জানি।বরং আমাকে তারা অপরাধীর চোখে দেখবে।একটা মেয়ের সংসার করার বাসনা ভঙ্গ করার অপরাধী!

আমি ধ্রুবর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলে উঠলাম,

“আপনি কেন সকলের সামনে মিথ্যে বললেন?”

উনি উত্তর না দিয়ে বিছানার এসে বসলেন।জানালা গলে সকালের নরম রোদ এসে পড়লো উনার চোখেমুখে।আমি উত্তরের আশায় উনার দিকে তাকিয়ে।ধ্রুব জোরে জোরে শ্বাস ফেলছেন।হয়ত নিজের রাগটা সামলানোর জন্য।
ক্ষনকাল বাদে উনি পূর্ণদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন।আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি উনার দিকেই নিবদ্ধ ছিল।ধ্রুব খুব শান্ত স্বরে বললেন,

“যদি আমি বললাম তোমাকে লগ্নভ্রষ্টা হওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য আমি তোমাকে বিয়ে করেছি, তবে তাদের নিকট তুমি আরো নিচু হয়ে যেতে।লাঞ্চনার চোখে দেখতো ওরা তোমায়।তাদের যে ধারণা আমি তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করে এনেছি সেটা মিথ্যে হয়ে যেত।এখন যতটুকু সম্মানের সাথে তোমাকে দেখছে সেটাও নেই হয়ে যেত।আমি এটা হতে দিতে পারি না।সে যেভাবেই আমাদের বিয়ে হোক না কেন তুমি এখন সকলের কাছে ধ্রুব দেবনাথের স্ত্রী।তোমাকে সর্বোচ্চ সম্মান পাইয়ে দেওয়াটা আমার কর্তব্য।আমার একটা মিথ্যে কথায় ওরা মনে মনে তোমার সম্পর্কে যাই ধারণা করুক না কেন,তোমাকে অপমান করার সাহস ওদের হবে না।”

শুদ্ধ,ঝরঝরে,স্পষ্ট বুলি ধ্রুবর।আমি স্তব্ধ হয়ে রইলাম উনার কথা শুনে।আমার মুখশ্রীতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন উনি।তারপর দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকালেন।উনার কথায় সেদিন আমি বুঝলাম উনি একজন ভালো মানুষ।কিন্তু একটা প্রশ্ন আমার মাথাতে তখনও ঘুরপাক খাচ্ছিলো।শশীর সাথে কি উনার সম্পর্ক ছিল?নয়ত মেয়েটা এভাবে উনাকে জড়িয়ে ধরার সাহস কিভাবে পায়?
আমি নিজের মনে থাকা সমস্ত সংকোচ ভেঙে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে উঠলাম,
“আপনি কি ওই মেয়েটাকে ভালোবাসেন?”

চলবে…