#মম_হৃদয়_বিহারিনী
#ঐশী_রানী_রক্তিমা
১০.
“জমিদার গিন্নি হওয়ার জন্য কি কি যোগ্যতা লাগে বলুন তো রাইদি।”
রাই সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে।খুটিয়ে দেখলো আমাকে।আমার মুখশ্রীতে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম তাকে জানান দিলো শশীর কোন কথায় আমি বড্ড বিচলিত।রাইয়ের উত্তর দিতে দেরি হওয়ায় আমি ধৈর্য হারালাম।তাড়া দিয়ে বললাম,
“বলুন না?”
রাই একটা ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে বললো,
“তুমি যেমন আছো যোগ্য আছো।আর কোন যোগ্যতার প্রয়োজন নেই।”
“এটা শুধু তুমি বললেই তো চলবে না!”
শশীর কন্ঠ শুনে আমরা দুজনেই সর্বপ্রথম সিঁড়িটার দিকে তাকালাম।শশী দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি লেপ্টে।শশীর কথায় উত্তরে রাই শক্ত কাঠকাঠ গলায় উত্তর দিলো,
“কি চলবে না চলবে সেটা বলার তুই কে?অন্তত এই জমিদার বাড়ির কেউ না!”
রাইয়ের কথায় শশীর মুখের হাসিখানা নিভে গেল ক্ষনিকেই।দৃষ্টি হয়ে আসলো সরু।দুজনের মুখশ্রীতে ফুটে উঠলো প্রতিশোধ পরায়ণতা।রাইয়েরটা স্বাভাবিক আর শশীরটা স্বভাবগত!
“তুইও তো এ বাড়ির কেউ না।স্বামী মারা যাওয়ায় আশ্রিতা হয়ে পরে আছিস!”
শশীর কথার তীক্ষ্ণতা বোধহয় রাইয়ের হৃদয় স্পর্শ করলো।দৃষ্টিকটু আচরণ আর অপশব্দ প্রয়োগের ফলে আমি শশীর উপর চরম রাগলাম।শশীর দিকে ফিরে শক্ত কন্ঠে বলে উঠলাম,
“নিজের মুখে লাগাম দিন শশী।ভুলে যাবেন না কার স্ত্রীর সামনে দাড়িয়ে কথা বলছেন।তাই একটু বুঝেশুনে শব্দ উচ্চারণ করবেন।”
শশীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবার আমার উপর এসে আটকানো।তার নাকটা রক্তাভ বর্ণ ধারণ করেছে।প্রচন্ড আক্রোশে বলে উঠলো,
“তোমার কথা অন্তত আমি মান্য করি না।আমাকে জ্ঞান দেওয়ার আগে নিজের দিকে তাকাও।দেহে না আছে কোন আভূষণ আর না কোন সাজ!এই জমিদার বাড়ির মান তো তুমিই ডুবাবে।”
এতটুকু বলে থামলো শশী।আরো কিছু বলবে তখনি বাঁধ সাধলো শুভর কন্ঠ।
“উফ!তোমরাও মেয়েরাও না।সরো তো।রাস্তা দাও আমায়।”
কথাখান বলতে বলতে শশীকে ইশারায় কি বললো শুভ।মুহুর্তেই চুপ হয়ে গেল শশী।আমাকে বলার জন্য জিহ্বায় আসা শব্দগুলোও গিলে নিল সে।শুভ চলে যেতেই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলো শশীও।রাই নিচে দৃষ্টি দিয়ে দাড়িয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড।তারপর শুকনো একটা ঢোক গিলে প্রস্থান করলো।আমি শূন্য দৃষ্টি ফেলে সামনে তাকালাম।আনমনা হয়ে পা ফেললাম সিঁড়িতে।হাতের বালতিটা বড্ড অবহেলায় ধরে রেখেছি।হৃদয় আছন্ন হয়ে আছে খুব বেশি।শশীর বলা কথাটা কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বারবার,
“কিন্তু কতদিন এই পদ ধরে রাখতে পারো দেখি।প্রতিযোগি কিন্তু সবদিক দিয়েই টেক্কা দিবে তোমাকে।”
শুকনো একটা ঢোক গিলে ভীতু শ্বাস ফেললাম আমি।দ্রুত পা চালিয়ে প্রবেশ করলাম আমাদের কক্ষে।কিন্তু অক্ষিপটে যে দৃশ্য ভেসে উঠলো সেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল।শশী আমাদের কক্ষে দাড়িয়ে ধ্রুব সাথে আলাপ করছে!
আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলাম ধ্রুব আর শশীর দিকে।বুকশেলফের নিকটে মুখোমুখি দাড়িয়ে দুজন।ধ্রুবর হাতে মোটা একটা বই।হয়ত বুকশেলফ থেকে বই নিচ্ছিলো সে।শশী তার সামনে হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রীতে দাড়িয়ে।হঠাৎ কিছু কথা বলে খিলখিলয়ে হেসে উঠে শশী।সেটা আমার কর্ণকুহরে পৌঁছোতেই হাত মুঠো করে ফেলি আমি।শরীর জুড়ে বয়ে যায় রাগের প্রবাহ।শশীর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এবার ধ্রুবর পানে তাকাই আমি।ওনার মুখে সৌজন্যতার একটুকরো হাসি লেপ্টে।শশীর বলা কথাখান এবার আমার কানে আসে,
“তুমি কি এখন আমাকে বন্ধু অবধি ভাবো না?”
সময় নিয়ে জবাব আসে ধ্রুব।
“বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার মতো কিছু অবশ্যই করনি।তাহলে উত্তরটা তুমিই বুঝে নাও।”
শান্ত স্বরে কথাখান বলে হঠাৎ বা দিকে তাকান উনি।দৃষ্টি পরে আমার উপর।আমি ওদের থেকে নজর সরিয়ে স্নানঘরে গিয়ে হাতের বালতি খানা রেখে আসি।শশী আড়চোখে চায় এদিকে।
ধ্রুব এবার তার থেকে দুরত্ব বজায় রেখে পড়ার টেবিলে এসে বসে।আমি স্নানঘর থেকে বেরিয়ে আসি।
শশী আমাকে লক্ষ্য করে ধ্রুবর নিকটে এসে বসে।ধ্রুবর দিকে ঝুঁকে বলে উঠে,
“কি বই পড়ছো দেখি?”
ধ্রুব ও শশী আগে একে অপরকে তুই বলেই সম্মোধন করতো।কিন্তু যবে থেকে শাঁকচুন্নিটার মনে ওনার প্রতি প্রেম জেগেছে তবে থেকে তুমি বলে সম্মোধন করেন ওনাকে।এখন সম বয়সী কেউ যদি তুমি বলে সম্মোধন করে,তাকে তুই বলে সম্মোধন করাটা একটু দৃষ্টিকটু লাগেই বৈকি।তাই ধ্রুবও ওকে তুমি বলেই সম্মোধন করেন।
শশীর এমন আচরণে ধ্রুব কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছিলেন সেটা বোঝা যাচ্ছিলো।মুখটা ধীরে ধীরে গম্ভীর হতে শুরু করেছিল ওনার।আমি এবার খানিক উচ্চস্বরে বলে উঠলাম,
“শশী আপনি এবার আসতে পারেন।ওনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
“বলো।আমি তো বলতে না করিনি।”
“আপনি নিলর্জ্জ হতে পারেন আমি নই।আমাদের ব্যাক্তিগত কথা শুনতে নিশ্চয়ই আপনার ভালো লাগবে না।”
কথাটুকু বলে আমি মুখে একখানা মেকি হাসি টেনে নিলাম।শশীর চোখে আগুনের আঁচ দেখা যাচ্ছিলো এবার।কিছু না বলে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল সে।সে চলে য়েতেই একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি।আপদ বিদেয় হয়েছে!
এবার আমার তীক্ষ্ণ চোখ এসে বর্তাল ধ্রুবর উপর।উনি এবার তাকালেন আমার দিকে।সহজ,স্বাভাবিক দৃষ্টি ওনার।কিন্তু আমি জটিল একটা প্রশ্ন করে ফেললাম,
“রাই দি কি এই বাড়িতে আশ্রিতা হিসেবে আছে?”
সাথে সাথে ওনার সরল দৃষ্টি পাল্টালো।গম্ভীর চোখে তাকিয়ে উনি বললেন,
“এ কিরকম শব্দ ব্যবহার করছো তুমি?”
“এ শব্দ আমার নয়।আপনার প্রাক্তন হবু স্ত্রী শশীর।”
শেষাক্ত বাক্যটা প্রচন্ড আক্রোশ নিয়ে বললাম আমি।ধ্রুবর প্রতিক্রিয়া খুবই লক্ষ্যনীয় ছিল।উনি আরো গম্ভীর হয়ে উঠেছিলেন।চোখে রাগের আভাস স্পষ্ট টের পেলাম আমি।মনে মনে প্রশান্তি পেলাম ।শশীকে আমি যতটা খারাপ মনে করেছিলাম তার থেকেও বেশি বিষাক্ত সে।
হঠাৎ ধ্রুব গম্ভীর,রাগী চোখমুখ নিয়ে কক্ষ ত্যাগ করলেন।আমি মনে মনে হাসলাম।কেননা আমি এতটুকু বুঝেছিলাম উনি এখন কোথায় যাবেন ও কি করবেন।
.
সেদিন প্রাতঃকাল আমার বিষন্নতাতেই কেটে গেল।দুপুর গড়িয়ে আধঘন্টার মতো হলো।ধ্রুব কাজে বেরিয়েছেন কাকা মশাইয়ের সাথে।কাজের প্রতিই যত আগ্রহ দেখছি লোকটার।তারপর রাতে কক্ষে এসে আবার বইয়ে মুখ গুঁজবেন।আমি বিছানায় বসে আছি হাঁটু ভাঁজ করে,বিষন্ন চিত্তে মুখশ্রীতে মলিন হাসি লেপ্টে।এ বাড়িতে প্রথম দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা স্মরণ করছি।শশীর মার আমাকে দেওয়া অপবাদ আর ধ্রুবর বজ্রকন্ঠে করা প্রতিবাদ।তখন আমার একমাত্র ভরসাস্থল ছিলেন উনি।আর আজও আছেন।তবে সেই তালিকায় বোধয় আরো এক মনুষ্যের নাম উঠেছে।রাই!
রাইয়ের কথা মনে পড়তেই মনটা বিষিয়ে উঠলো।শশী যে তার সত্তায় আক্রমণ করেছে সেটা ভাবতেই আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।শাড়ির আঁচল মেঝে স্পর্শ করলো তৎক্ষণাৎ।আমার চুলগুলো উন্মুক্ত ছিল।সেগুলো বেখেয়ালে সেভাবেই খোলা রেখে আমি কক্ষ থেকে বেরোলাম।আমার উদ্দেশ্য এখন দোতলায় রাইয়ের কক্ষ।
রাইয়ের কক্ষের সামনে পৌঁছে আমি প্রতিবারের মতো আজও কড়া নাড়লাম।তারপর মৃদুস্বরে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চাইলাম।যদিও আমি জানি ভেতর থেকে কি উত্তর আসবে।কিন্তু ক্ষণকাল ব্যয়িত হওয়ার পরেও ভেতর থেকে কোন উত্তর ভেসে আসলো না।আমি ভ্রু কুঁচকে ভেতরে প্রবেশ করলাম।
বিছানা লাগোয়া জানালায় পাশে হেলান দিয়ে বসে আছে রাই।প্রায় কোমড় সমান দীর্ঘ কেশের বেনি লুটোপুটি খাচ্ছে বিছানার চাদরে।বড্ড আনমনে হয়ে তাকিয়ে রাই।চোখেমুখের উজ্জ্বল্য কমে গেছে বেশ খানিক।আমি প্রবেশের সময় যে নুপুরের আওয়াজে পেছন না ফিরেই আমাকে চিনে ফেলে!সে আজ এতটাই আনমনা যে আমার ডাকও তার কানে পৌঁছানো না।
তৃতীয়বারের ন্যায় আমি তাকে ডেকে উঠলাম।এইবার খানিক উচ্চ আওয়াজে।
“রাই দি!কোথায় হারিয়ে আছো?”
আমার কথাটা কর্ণগোচর হতেই চমকে তাকালো রাই।সময় নিয়ে মলিন একটা হাসি উপহার দিলো আমায়।তারপর গভীর একটা শ্বাস টেনে বললে,
“জানা নেই।বসো!”
বিছানার চাদর হাত দিয়ে একটু ঝেড়ে দিয়ে আমাকে বসার জন্য ইশারা করে।আমি বসতে বসতে রাইয়ের কায়া জুড়ে চোখ বুলালাম।লতার মতো দেহে গাঢ় বেগুনী রঙের শাড়ি আটপৌরে পরা।হাতের দুটো সোনার বালা হাতদুটোর শোভা বাড়ালো নাকি নিজেদের শ্রী বৃদ্ধি করলো বলা দায়!মাথার চুলগুলো আজ এলোমেলো ঠেকলো।তবুও সৌন্দর্য কমলো?ডাগর আঁখিদুটোয় আজ কাজলের ছোঁয়া নেই।কোমল ওষ্ঠদুটো তো এমনিতেই গোলাপ রাঙা।তাকে দেখতে দেখতে আমার এরুপ মনে হলো যেন স্বয়ং বৃন্দাবন বিহারিনী ছদ্মবেশে আমার সম্মুখে বসে আছে!যিনি শান্ত,স্নিগ্ধ,মাতৃসুলভ ও প্রেমময়ী।
আমার এমন তাকানো দেখে লাজুক হাসি ফুটলো রাইয়ের মুখে।আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললাম,
“এমন অপরুপ মুখশ্রীতে বিষন্নতার ছোঁয়া মানাচ্ছে না!”
“মৃত হৃদয়ে কোন অনুভূতি ধরা দেয় না।আমাকে বিষন্ন লাগছে এটা তোমার চোখের ভ্রম!”
শান্ত,জড়তাহীন বাক্য।হঠাৎ কোন খেয়ালে রাইয়ের মৃত পতিকে দর্শনের বাসনা জাগলো আমার হৃদয়ে।কোন বানরের গলায় মুক্তোর মালা শোভা পেয়েছিলো?
আমার ভাবনার মাঝেই রাই প্রশ্ন করে উঠলো,
“তুমি ধ্রুবকে ভালোবাসো,নির্বানী?”
আমি থমকালাম!এমন কোন প্রশ্নের প্রত্যাশা কখনো করিনি আমি।প্রশ্নখানা করে আমার দিকে গাঢ় চোখে তাকালো রাই।উত্তরের কোন আকাঙ্ক্ষা নেই সেথায়।কেবল প্রশ্নের দ্বারা আমাকে বিব্রত করার প্রচেষ্টা।
আমি রাইয়ের চোখে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি নত করে নিলাম।মনে মনে হাসলো সে।মৃদুস্বরে তাড়া দিলো,
“বলো?”
সময় নিয়ে মিহিস্বরে আমি বলে উঠলাম,
“আমাদের মাঝে এরুপ কোন সম্পর্ক নেই।”
“আমি তোমাদের কথা জিজ্ঞেস করিনি।তুমি তোমার মনের কথা বলো।ধ্রুবকে ভালোবাসো তুমি?”
আমি চোখ তুলে তাকালাম রাইয়ের পানে।সে হাঁটু ভাজ করে তাতে থুতনি ঠেকিয়ে অতি আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে।আমি ভারী অস্বস্তিতে পরছিলাম।
রাই ফের বললো,
“শশী যদি ধ্রুবকে নিজের করে ফেলে তবে?কিরকম লাগবে তোমার?”
শশীর কোনকিছুই যে সুবিধার ঠেকছে না তা আমরা দুজনেই বুঝেছিলাম।আমি চোখ বুঁজে নিলাম।বাক্যটা অসহ্য ঠেকলো আমার নিকট।
“তুমি ধ্রুবকে ভালোবেসে ফেলেছো নির্বানী!তোমার অস্থিরতায় তার সাক্ষ্য দিচ্ছে।এবার তৈরি হও!নিজের মানুষ নিজের করে রাখতে।”
আমি চট করে উঠে পরলাম বিছানা থেকে।শ্বাসপ্রশ্বাস অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিলো আমার।শশীর ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরার সেই দৃশ্যটা ভেসে উঠছিলো চোখে।আমি রাইয়ের কক্ষে আর দাঁড়ালাম না।রুদ্ধশ্বাস ফেলে ছুটে বেরিয়ে আসলাম কক্ষ থেকে।ঝংকার দিয়ে উঠলো আমার পায়ের নুপুর।আমার ভেতরে আন্দোলিত সংগ্রাম যেন তারা ধারণ করে বেজে উঠেছিলো!
.
সময় কেটে গেল দ্রুত।বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হলো।পশ্চিমাকাশে রক্তাভ বর্ণ ধারণ করে অস্ত গেল সূর্য।আঁধার ঘনিয়ে এল ধরিত্রীর এই কোণে।আজ আকাশ পরিষ্কার হলেও,দখিনা বাতাসের আনাগোনা বন্ধ নেই।চৈত্র মাস বলে কথা!
জমিদার বাড়ি আলোকিত হয়ে উঠলো প্রদীপ,মশাল আর হারিকেনের আলোয়।সন্ধ্যা হতেই ঘরে ফিরলেন সুবোধ দেবনাথ ও ধ্রুব।বসার ঘরে বড়দের ডাকা হলো বিশেষ কারণে।বিষয়বস্তু বৌভাত!গ্রামে নাকি রব উঠেছে যে জমিদার পুত্র বিয়ে করে আনলো অথচ বৌভাত কিংবা কোন অনুষ্ঠান করা হয়নি।একথা সরাসরি সুবোধ দেবনাথের কানে না আসলেও লোকমুখে শুনেছেন।আত্মসম্মানে আঘাত করেছে কথাটা।তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যত দ্রুত সম্ভব বৌভাতের অনুষ্ঠান করবেন।একটু দেরি হয়ে গেল সমস্যা নেই।সকলে মিলে সিদ্ধান্ত হলো আগামী সপ্তাহে বৌভাতের অনুষ্ঠান হবে।
বৈঠক শেষ করে একেবারে রাতের খাবার ছেড়ে কক্ষে আসলেন ধ্রুব।কক্ষে এসে দরজা লাগিয়ে পেছন ফিরতেই আমাকে নজরে আসলো।আমি জানালার সামনে দাড়িয়ে আছি।এই ভর সন্ধ্যাতেও আমার কেশ ছিল উন্মুক্ত।জানালাটাও ছিল খোলা।সেই জানালা গলে আসা মৃদু বাতাসে প্রদীপের শিখাগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছিলো।আর তাতে দ্যুতি ছড়াচ্ছিলো আমার বাহুতে থাকা বাজু!
ধ্রুব আমার পানে তাকিয়ে পড়ার টেবিলের সামনে চেয়ারটায় এসে বসলেন।পরনের সাদা রঙের পাঞ্জাবিটার হাতা গোটাতে গোটাতে মৃদুস্বরে বলে উঠলেন,
“বাইরে কি দেখছো,নির্বানী?”
আমি ধীরে ধীরে ধ্রুবর দিকে ফিরে তাকালাম।তখনই পাঞ্জাবির হাতা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমার পানে চাইলেন উনি।মুহুর্তেই দৃষ্টি শিথিল হয়ে আসলো ওনার।আমি মৃদুপায়ে ওনার সম্মুখে এসে দাঁড়ালাম।আমার পুরো কায়ায় নজর বুলিয়ে ওনার ওষ্ঠদ্বয় আপন শক্তিতে ঈষৎ আলগা হয়ে এল।
আমার ঠিক সোজাসুজি রাখা দর্পনে গম্ভীর দৃষ্টি ফেললাম।অবলোকন করলাম পুরো আমিটাকে।আশ্চর্য হলেও আমি আজকে কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরেছি।কানে সোনার ছোট একটা দুল,গলায় গয়না আর চোখে গাঢ় করে কাজল দিয়েছি।ধ্রুব আমাকে পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু উচালেন।তারপর বললেন,
“তুমি না বলেছিলে তোমার সাজগোছ পছন্দ নয়।”
আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। কিছু সময় পরে মৃদু স্বরে বলে উঠলাম,
“আমাকে কেমন লাগছে?”
ধ্রুব আমার দিকে না চেয়েই বলে উঠলেন,
“হুম..ভালো!”
তারপর একটা বই নিয়ে সেটা নিজের সম্মুখে মেলে ধরলেন।আমি তুষ্ট হলাম না।বরং ওনার আচরণ আমাকে ব্যথিত করলো।আমি নিজের উপর তাচ্ছিল্য করে বলে উঠলাম,
“আমি আপনার উপর বোঝা হয়ে গেছি তাইতো?আমার জন্যই শশীর সাথে আপনার বিয়ে হলো না।”
আমার কথা শুনে এবার আমার দিকে ফিরে চাইলেন ধ্রুব।
“হোয়াট ননসেন্স!এসব কেন বলছো তুমি?”
“কারণ এটাই সত্যি!”
আমার কথায় ওনার উপর জমা আমার অভিমান স্পষ্ট হয়ে উঠছিলো।আমি ফের বললাম,
“আমি আপনার জন্য সাজগোছ করলাম!অথচ আপনি ভালো করে একবার চাইলেন ও না।শশীর সাথে ঠিকই হেসে হেসে কথা বলেন।এটা তো সত্যিই যে আপনি আমাকে শুধু এবং শুধুমাত্র দায়িত্ব পালনের জন্য বিয়ে করেছেন।আমার সম্মান যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য।আমার প্রতি আপনার কোন টান নেই।”
কথা বলতে বলতে আমার চোখে অশ্রুর পাথার জমে গেল।আমার শুধু এটাই মনে হচ্ছিল শশী ওনাকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিবেন।আমি ওনাকে হারিয়ে ফেলবো।
আমি আচমকা কেঁদে ফেললাম শব্দ করে। ধ্রুব দ্রুত এগিয়ে এসে আঁকড়ে ধরলেন আমাকে।আমার পিঠে হাত বুলিয়ে আমাকে শান্ত হতে বললেন উনি।ওনার এই যত্নখানায় বোধহয় আমাকে আরো ভংগুর করে দিলো।
“তুমি হঠাৎ এমন করছো কেন?কেউ তোমায় কিছু বলেছে?আমি কিছু করেছি?বলো নির্বানী।”
চলবে….
লেখায় খুব ভুল হচ্ছে অভিযোগ উঠছে।সেগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখে ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইলো।
#মম_হৃদয়_বিহারিনী
#ঐশী_রানী_রক্তিমা
(বোনাস পর্ব)
নিজের বুকের সাথে আমার মাথা চেপে ধরে আছেন ধ্রুব।ওনার বলিষ্ঠ হাত আমার পিঠে স্বান্তনার স্পর্শ দিতে ব্যাস্ত।কিন্তু ওনার যত্নে আমার কান্না থামার নাম নিচ্ছিলো না।মানুষটার উপর যে আমি খুব বাজেভাবে আসক্ত হয়ে গেছি!তার সাথে বিচ্ছেদের প্রশ্ন আমাকে বাচ্চাসুলভ আচরণ করতে বাধ্য করছে।ধ্রুব এবার ধীর স্বরে বলে উঠে,
“হোয়াটস রং উইথ ইউ,নির্বানী?”
ধ্রুবর বুক থেকে মাথা সরিয়ে ওনার থেকে কিছুটা দুরে সরে আসি আমি।হুট করে কেঁদে ফেলার পর আমি এখন বুঝতে পারছি কতটা বাচ্চামো করে বসেছিলাম।চোখের কাজল লেপ্টে বিশ্রী লাগছিলো আমায়।আমি দুরে সরে আসতেই আমার অতি নিকটে এসে দাঁড়ান ধ্রুব।চোখমুখ এবার গম্ভীর হয়ে উঠেছে ওনার।আচমকা আমার দুগালে হাত দিয়ে স্পর্শ করেন উনি।আমি চমকে দৃষ্টি উঁচু করে ওনার দিকে তাকাই।দীর্ঘদেহী লোকটার সামনে আমি নিতান্তই বাচ্চা।
ধ্রুব বরফের ন্যায় শান্ত স্বরে শুধান,
“আমার কথার অমান্য করছো?কি হয়েছে বলতে বললাম তো?”
আমি উত্তর দিলাম না।ওনার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নত চোখে তাকালাম।সাথে সাথে ধ্রুবের তীক্ষ্ণ স্বর আঘাত হানলো।
“আমার দিকে তাকাও,নির্বানী।”
“আপনি শশীকে ভালোবাসেন তাইতো?”
কথাটা বলে ওনার চোখে চোখ রাখলাম আমি।তাতে ঈষৎ রাগ লেগে আছে।ধ্রুব যে ভয়ংকর রাগী সেটা আমি পরে বুঝেছিলাম।আমাকে উনি এটা বুঝতেই দেননি যে ওনার আসলে এতটা রাগ!
আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে খুব বেশি সময় নিলেন না ধ্রুব।স্পষ্ট স্বরে বলে উঠলেন,
“না!”
“মিথ্যে বলছেন?”
“ভালোবাসি বললে মিথ্যে বলা হতো।”
আকস্মিক আমার কপালে নিজের কপাল ঠেকালেন উনি।ওনার গরম নিঃশ্বাস এসে পরতে লাগলো আমার চোখেমুখে।হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল আমার।বুকের ভেতর অসহ্য তোলপাড় হচ্ছিল।সেই তোলপাড় প্রবল হলো ধ্রুবর গাঢ় স্বরে,
“এখান থেকে যাওয়ার পর কতটা অস্থিরতায় দিন কেটেছে আমার,সে ব্যাপারে তোমার কোন ধারণা আছে?এবারের পরীক্ষা সবচেয়ে বাজে হয়েছে আমার।পারিনি শুধু সবকিছু ছেড়েছুড়ে ছুটে আসতে।পরীক্ষা শেষ হওয়ার একঘন্টার মধ্যেই বাড়ির ট্রেন ধরেছি আমি।যা কিনা প্রথম বারের মতো হয়েছে।”
খানিক বাদে আমার থেকে সরে গেলেন ধ্রুব।ওনার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের অস্তিত্ব দেখা গেল।লোকটা অস্থির হয়ে বিছানায় বসে পরলেন।আমার দিকে না তাকিয়েই গম্ভীর স্বরে আদেশ করলেন,
“শাড়িটা নিজের মতো করে পরে আসো।কাউকে অনুসরণ করার প্রয়োজন নেই।”
আমি চুপচাপ স্নানঘরে গিয়ে আটপৌরে শাড়ি পরে,চোখেমুখে পানি দিয়ে বাইরে এলাম।তারপর কাচুমাচু ভঙ্গিতে দাড়িয়ে রইলাম।খানিক বাদে শীতল দৃষ্টি মেলে আমার পানে তাকালেন ধ্রুব।লোকটা ঘেমে উঠছে ইতিমধ্যেই।তার উপর ঘরে থাকা আগুনের শিখা উত্তপ্ততা ছড়াচ্ছে।
আমি নতমুখে দাড়িয়ে রইলাম।ধ্রুব তখনো শান্ত ভঙ্গিতে আমার পানে তাকিয়ে।হঠাৎ উনি বলে উঠলেন,
“তুমি সুন্দর তোমার নিজস্ব ভঙ্গিতে,নিজস্ব আচরণে।অন্যকে অনুসরণ করে আমার মন জয় করার কোন প্রয়োজন নেই।আমি তোমার স্বামী!আমার প্রতি কেবল তোমার অধিকার,নির্বানী।”
চট করে চোখ তুলে ওনার পানে তাকালাম আমি।উনি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন তখনি।আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার হাতটা ওনার হাতের মুঠোয় নিলেন উনি।একটা হারিকেনের আলো সর্বোচ্চ করে দিয়ে সেটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পরলেন।আমি অন্ধের ন্যায় চলতে লাগলাম ওনার সাথে।যেন একমাত্র উনিই আমার জীবনের আলোর রশ্মি,আঁধারে প্রদীপের শিখা!
আমাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসলেন উনি।ওনার পরনে সফেদ ধুতি আর পাজ্ঞাবি।হারিকেনের আলোয় সেগুলো সোনালী বর্ণ ধারণ করেছে।উনি আমাকে নিয়ে বাড়ির গেট পার হলেন।আমি একটা টু শব্দও না করে ওনার সাথে সাথে চলতে লাগলাম।
আজকে আজ মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে।হারিকেনের আলোকে ছাড়িয়ে গেছে চাঁদের উজ্জ্বলতা।আমাকে সাথে নিয়ে গ্রামের মেঠোপথে হাঁটছেন উনি।গায়ে এসে লাগছে মৃদু প্রশান্তিকর বায়ু।উনি অজান্তেই আমার মনের কোণের সুপ্ত এক বাসনা পূর্ণ করে দিচ্ছেন।চাঁদনী রাতে এভাবে প্রিয় মানুষের হাত ধরে গ্রামের মেঠোপথে হাঁটার শখ আমার কিশোরী মনে বহু আগেই দোলা দিয়েছিলো।আচ্ছা উনি কি অন্তর্যামী?আমার মনের সব কথা কিভাবে যেন পড়ে নেন!
আমার ভাবনার মাঝেই থামলেন উনি।সাথে সাথে থামলো আমার পায়ের গতিও।আমার চোখের দৃষ্টি সারাটা পথ ধ্রুবের উপর আটকে ছিল।মানুষটা আমায় ঘোরে ফেলে দিয়েছে নিজের শব্দ দ্বারা।উনি কথা বলেন স্পষ্ট স্বরে।যা ওনার কথার সত্যতা দৃঢ়ভাবে ধারণ করে।আর কিছু মুহুর্ত আগে ওনার বলা প্রতিটি শব্দ ছিলো সত্য!
ধ্রুব আমাকে হাতের ইশারায় কিছু দেখালেন।আমি সেদিকে তাকাতেই চোখেমুখে বিস্ময় এসে ধরা দিলো।অসংখ্য জোনাকি পোকারা উড়ে উড়ে নৃত্য প্রদর্শন করছে সেথায়।আমি সেদিকে ছুটে গেলাম।একটু সামনে যেতেই আরেকবার চমকে উঠলাম আমি।আমার থেকে দুকদম সামনে স্বচ্ছ স্রোতস্বিনী!
সেই স্রোতস্বিনী যা আমি ধ্রুবের কক্ষের সেই বিশাল জানালা দিয়ে দেখতাম।
আমি দৃষ্টিতে বিস্ময় নিয়েই ধ্রুবর পানে তাকালাম।উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বাভাবিক স্বরে বললেন,
“আপনার বিষন্ন হৃদয়ের বিষন্নতা মুছে দেওয়ার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।আই হোপ জায়গাটা আপনার ভালো লাগবে,মন ভালো হবে।আর আমাকে আজেবাজে অপবাদে জর্জরিত করবেন না।”
কন্ঠে কিছু রসিকতাও মিশে ছিল।লোকটাকে আমি যত দেখি ততই অবাক হই।সমাজের কটুবাক্য থেকে রক্ষা করার জন্য একজনকে বিয়ে করে,তার প্রতি এতটা যত্নশীল কে হতে পারে?
হঠাৎ একটা জোনাকি এসে আমার গালে বসতেই ধ্যান ছুটে আমার।ধ্রুব আমার হাতটা ধরে আরো কিছুটা সামনে এগোতেই একজন মাঝির দেখা মিলে।খোলামেলা মাঝারি সাইজের একটা নৌকায় বসে আছেন মাঝিটি।
ধ্রুবকে দেখতেই লোকটা হেসে বলে উঠে,
“আদাব জমিদার বাবু।এত রাতে এখানে?কোন দরকার?”
“মতিন চাচা,তোমার নৌকাটা কি আজকে রাতের জন্য দেওয়া যাবে?”
ওনার কথা শুনে আমার দিকে লক্ষ্য করেন মতিন নামের লোকটা।আমাকে দেখেই হাতদুটো জড়ো করে প্রণামের ভঙ্গি করেন।সাথে সাথে আমিও হাতদুটো জড়ো করে প্রণাম জানাই ওনাকে।
“আপনে বললে তো জানও কুরবান জমিদার বাবু।আর এই নৌকা?এইডা তো আপনেই।”
কথাটা বলে মতিন মিয়া নৌকা থেকে নেমে বৈঠাটা ধ্রুবর হাতে ধরিয়ে দেন।ধ্রুবকে আরেকবার আদাব জানিয়ে একটা আঞ্চলিক গান গাইতে গাইতে চোখের আড়াল হয়ে যান।
নৌকাটা নদীর কিনারায় থাকা একটা বাঁশে আগে থেকেই বাধা ছিল।আমার হাতে হারিকেনটা ধরিয়ে দিয়ে প্রথমে নিজে নৌকায় পা রাখলেন উনি।আমি কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করে ফেললাম,
“আপনি নৌকা চালাতো যানেন?”
“হুম।হাতটা বাড়াও।”
আমার শৈশব থেকে শুরু করে কৈশোর সবই শহরের অট্টালিকার মাঝেই কেটেছে।গ্রামে আমি খুব কমই এসেছি।হয়তো বা দুই-তিনবারের মতো।তাও সেই ছোটবেলায় দিদা,দাদু বেঁচে থাকার সময়।নৌকায় চড়া হয়নি কখনো।এমনকি সাঁতারও জানি না আমি।সেই হিসেবে আমার আজ নৌকায় চড়ার সময় প্রচন্ড ভয় পাওয়ার কথা।কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে আমি খুব বেশি ভয় পেলাম না।ধ্রুবর বাড়িয়ে দেওয়া হাতের মুঠোয় নিজের সমস্ত ভয় অপর্ণ করে নির্ভয়া হয়ে উঠলাম আমি।
নৌকোয় পা রাখতেই সেটা নড়ে উঠলো খানিক।আমি ভয় পেয়ে কোন শব্দ করবো তা আগেই ধ্রুব বলে উঠলেন,
“ভয় পেয়ো না।এদিকটায় জল কম,কিছু হবে না।”
আমি নৌকায় উঠে বসতেই বৈঠা ঠেলে নদীর জলে নিয়ে গেলেন নৌকাটা।আমি জীবনে প্রথমবারের মতো উপভোগ করতে লাগলাম নৌকা ভ্রমণ!
নৌকায় বৈঠা চালিয়ে সেটা মাঝ নদীতে নিয়ে আসলো ধ্রুব।এখন আমাদের মাথার উপর পূর্ণচন্দ্র।যার জোছনায় আলোকিত চারপাশ।নৌকায় রাখা হারিকেনের আলোয় নদীর জলে কিছুটা সোনালী আভা দেখা যাচ্ছে।বৈঠার সাথে পানির সংঘর্ষে কলকল ধ্বনি।আমার এক মুহুর্তের জন্য মনে হচ্ছিলো আমি নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে কোন অপরুপ স্বপ্নে মজেছি।আমি নিজের সন্দেহ দুর করার জন্য হাতে আস্তে করে চিমটি কাটলাম।না!এ মিথ্যে নয়।
আমার মনের বিষন্নতা কেটে গেল।যাদুর মতো কাজ করলো এই নদী।আমি একহাত দিয়ে জল স্পর্শ করলাম।ধ্রুব ধীরগতিতে বৈঠা চালাচ্ছেন।জল নিয়ে একমুহূর্ত খেলার পরে ধ্রুবর দিকে তাকালাম আমি।ওনার সুগভীর নেত্র জোড়ার দৃষ্টি যে আমার উপর তা চাঁদের আলোয় স্পষ্ট।আমি ওনার দিকে তাকানোর পরেও উনি সেভাবেই তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।আমি ইতস্তত করে বললাম,
“চোখের কাজল কি লেপ্টে বাজে লাগছে?আমি তো ভালো করে ধুয়েছিলাম!”
আমার বোকা প্রশ্ন শুনে নিচের ওষ্ঠ কামড়ে হেসে ফেললো ধ্রুব।তারপর দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বৈঠা চালাতে লাগলো।অন্যদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফের আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
“আকাশের চাঁদ আর মর্তের চাঁদের মাঝে পার্থক্য কি জানো?”
আমি মৃদু হেসে উত্তর দিলাম,
“মর্তে আবার চাঁদ আছে নাকি?”
“মর্তের চাঁদ এভাবে হেসে প্রশ্ন করে।আর আকাশের চাঁদ বাকহীন,জড়বস্তুুর ন্যায়।”
আমার ওষ্ঠে থাকা হাসির মাত্রা কমে এলো।ওনার কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে লাজুক হেসে বললাম,
“আমাকে চাঁদ বললে চাঁদের অপমান হবে।”
“অপমানিত তো সে এমনিতেই বোধ করবে।কেননা তার গায়ে অসংখ্য কলংক।শুদ্ধ,কোমল,পবিত্র হৃদয়ের সাথে নিজের তুলনা হলে সে তো অপমানিত বোধ করবেই!”
আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম।মানুষটার কথা বলার ধরন এত সুন্দর!শুদ্ধ,ঝরঝরে,স্পষ্ট বাক্য তার কন্ঠে যেন মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠে।
“মাথার অতিযত্নে বাঁধা চুলটা একটু উন্মুক্ত করবে?ভুতের সাথে আমি লড়বো!এতটুকু বিশ্বাস তো অর্জন করেছি নাকি?”
তার কথার সাথে বাতাসও যেন অনুরোধ করে উঠলো।মাথায় থাকা ঘোমটা খুলে আমাকে অনুরোধ জানালো কথাটা মেনে নিতে।ভুতের ভয় আমার এমনিতেই নেই।
কিন্তু ভীষণ লজ্জা করছিলো।আমি আস্তে আস্তে শক্ত করে খোঁপা করে রাখা চুলটা ছেড়ে দিলাম।মৃদু বাতাসে দুলে উঠলো তারা।যেন উন্মুক্ত হওয়ার বহু সাধ ছিলো তাদের।ধ্রুব হঠাৎ বৈঠা চালানো বন্ধ করে আমার পানে তাকালেন গাঢ় চোখে।সেটা লক্ষ্য করেই দৃষ্টি নত করে নিলাম আমি।মৃদুস্বরে আস্তে করে উনি বলে উঠলেন,
“এভাবেই মাঝে মাঝে রাগ করে শৃঙ্গার করো তো।রাগানোর দায়িত্ব আমার!”
চলবে….