মম হৃদয় বিহারিনী পর্ব-১৬

0
2

কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ!

#মম_হৃদয়_বিহারিনী
#ঐশী_রানী_রক্তিমা
১৬.
শশী কক্ষ থেকে চলে যাওয়ার পর ধ্রুবর দৃষ্টি এসে আমার উপর বর্তায়।ভ্রু কুঁচকে কৌতুহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে আমার পানে।আমি তখনো রেগে আছি খানিক।শশী কোন সুযোগ রাখছে না ধ্রুবর সামনে আমাকে অপমান করার।ধ্রুবকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমি বলে উঠলাম,

“এভাবে কি দেখছেন?”

“শশীর সাথে হঠাৎ এমন আচরণ করলে কেন?”

ধ্রুবর কথায় আমি আরেকটু রাগলাম।এর মানে কি উনি বোঝাতে চাইছেন শশীর আমাকে করা অপমানের প্রেক্ষিতে আমার এভাবে আচরণ করা ঠিক হয়নি?
আমি মনে মনে ভাবা কথাটা মুখ ফুটেই বলে উঠলাম,

“এর মানে আপনি বলতে চাইছেন যে আমার শশীর সাথে এমন আচরণ করা উচিত হয়নি?উনি আমাকে যা নয় তাই বললেন আর তার বিপরীতে..”

আমার কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই ধ্রুব হতাশার শ্বাস ছাড়লেন।বললেন,

“আমার কথার এই অর্থ ছিলো না।আমি শুধু জানতে চেয়েছি আমার শান্ত প্রকৃতির বউ কেন হঠাৎ এমন রাগ্বানিতা হয়ে গেল?”

ওনার কথা শুনে শান্ত হলাম আমি।ধ্রুব ফের বললেন,

“ইজ এনিথিং রং?”

ওনার কথায় আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলাম,

“আগে বলুন আমার উপর আপনার আস্থা কতটুকু?”

“তোমার উপর আমার আস্থা কতটুকু তার পরিচয় আমি দিয়েছি।দিই নি কি?”

ওনার কথা শুনে আমি লজ্জা পেলাম।যেভাবে সবার সামনে উনি আমাকে বিশ্বাস করে সাথে থেকেছেন,সেক্ষেত্রে আমার একদম উচিত হয়নি ওনাকে এইরূপ কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেসা করা।আমি নিজ ভুল স্বীকার করে মাথা নত করলাম।ধ্রুব উত্তর শোনার অপেক্ষায় অথচ আমাকে কোন প্রকার তাড়া দিচ্ছেন না।

“আমি যদি বলি কাল যা যা হলো সেগুলো কারোর পরিকল্পিত!তবে কি আপনি অবাক হবেন?”

কথাটা বলে আমি চোখ তুলে তাকালাম ধ্রুবর দিকে।ওনার মুখশ্রী স্বাভাবিক,বদ্ধ জলাশয়ের ন্যায় শান্ত।কিন্তু আমি সেথায় বিস্ময়ের ছাপ আশা করেছিলাম।

“আমি অবাক হচ্ছি না কারণ এটা আমি আগে থেকেই ধারণা করেছি।তোমার আমার সম্পর্ক অনেকের মনে ধরেনি।কিন্তু প্রশ্ন হলো শুধুমাত্র এর জন্য কেউ এমন জঘন্য পরিকল্পনা কেন করবে?”

আমি ধ্রুবর প্রশ্নে চুপ করে রইলাম।কালকের ঘটনা আমার হৃদয়কে পুনরায় বিষন্নতায় ভরে দিলো।আমি ধীরে ধীরে বিছানায় এসে বসলাম।হালকা রাগে লেপ্টে থাকা মুখশ্রীতে ফুটে উঠলো কষ্টরেখা।ধ্রুব আমার দিকে তাকিয়ে থাকায় আমার চেহারায় পরিবর্তন ওনার চোখে ঠিকই ধরা পরলো।উনি আমাকে কোন প্রশ্ন না করেই ওনার ব্যাগের নিকটে গেলেন।তারপর সেখান থেকে কিছু একটা বের করে আমার সামনে এসে দাড়ালেন।

অক্ষিকোটরে ওনার পরনের শুভ্র পাঞ্জাবি ভেসে উঠতেই আমি চোখ তুলে তাকালাম।ওনার চোখের মোলায়েম দৃষ্টি আমার উপরেই।এবার আমি ওনার হাতে থাকা জিনিসটার দিকে তাকালাম।ছোট কৌটায় অগুনতি লাল টিপ।সেটা আমার হাতে গুঁজে দিতে দিতে বললেন,

“তোমার জন্য আমার তরফ থেকে এই সামান্য উপহার।”

আমি হাতের টিপের কৌটোটার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ওনার দিকে অবাক হয়ে তাকালাম।আমার দৃষ্টি ওনাকে নিরবে এই প্রশ্ন করে উঠলো যে,

“আপনি কতটা গভীরভাবে আমায় লক্ষ করেন ধ্রুব?”

ধ্রুব আমার হাতের মুঠোয় থাকা কৌটো থেকে একটা টিপ বের করে আমার কপালের দুই ভ্রুয়ের মধ্যে পরিয়ে দিলেন।তারপর আমাকে বসা থেকে তুলে আরশির সম্মুখে এনে দাঁড় করিয়ে আমার পেছনে এসে দাড়ালেন।স্বচ্ছ কাঁচে ফুটে উঠলো আমার এবং আমার অর্ধাঙ্গের প্রতিবিম্ব।আমার দু ভ্রুয়ের মধ্যিখানে থাকা টিপটার আকার ছোট হলেও তাতে মিশে থাকা ভালোবাসার পরিমাণ বিশাল।সমুদ্রের বিশাল জলরাশির ন্যায়!

উনি দর্পনে ভেসে উঠা আমার প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়েই বলে উঠলেন,

“কিছু একটা মিসিং লাগছিলো।এবার ঠিক আছে।”

আমি দৃষ্টি নত করে স্মিত হেসে উঠলাম।
দ্বিতীয়বারের ন্যায় দরজায় কড়া পরলো।ধ্রুব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমার নিকট থেকে সরে গেলো।আমি মাথায় ঘোমটা দিয়ে নিলাম।দরজার ওপারে ছিল পরিচারিকা।সকালের নাস্তার জন্য ডাকতে এসেছেন।আমরা আসছি একথা জানিয়ে ধ্রুব তাকে প্রস্থানে আদেশ দিলো।কিন্তু আমি ইতস্তত করছিলাম।কালকে যা হলো তারপর আমি কিভাবে ওনাদের সামনে দাঁড়াবো?ওনাদের তীর্যক দৃষ্টির সম্মখীন হবো কিভাবে?

আমি চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসলাম ধ্রুবর কথায়,

“এসো,সকালের নাস্তার জন্য তলব এসেছে।”

আমি ইতস্তত করে তাকালাম।আমতা আমতা স্বরে বলে উঠলাম,

“আপনি যান।আমি বসার ঘরে যাবো না।সকলে আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকাবে!”

আমার কথার বিপরীতে আমার হাতখানা শক্ত করে ধরলেন ধ্রুব।আমি আকুতির নজরে তাকালাম।আমি সত্যিই কারোর মুখোমুখি হতে চাচ্ছি না।ধ্রুবর সামনে ওরা আমায় কিছু না বললেও মনে মনে আমার সমন্ধে বাজে খেয়াল ওনাদের মাথায় আসবে।আর মেজো কাকি তো সুযোগ পেলেই কথা শুনিয়ে দিবেন।আমি যে ওনার চোখের কাঁটা এটা বুঝতে আমার বেশি সময় লাগেনি।

“কেউ যদি তোমার দিকে বাঁকা নজরে তাকাইবা তবে কি যায় আসে?তুমি কোন দোষ করনি।কারো বাজে পরিকল্পনার শিকার হয়েছো।”

এতটুকু বলে একটু থামেন ধ্রুব।পরপরই বলে উঠেন,

“শোন নির্বানী,তুমি পবিত্র!অন্যরা তোমায় যদি শতবার অপবিত্র বলে আখ্যায়িতও করে তাতে কিচ্ছু যায় আসে না।মিথ্যকে জোর করে সত্য বানানো যায় না।সত্য সত্যই।”

তবুও আমার মনে দ্বিধা ছিল।আমার দ্বিধাকে পরোয়া করলেন না ধ্রুব।উনি এক হাতে আমার হাত ধরে কক্ষ থেকে বের হলেন।বসার ঘরে পৌঁছাতেই আমি অস্বস্তিতে মাথা নিচু করে নিলাম।একহাত দ্বারা চেপে ধরলাম ধ্রুবর বাহু।প্রতিদিনকার মতো দুটো আসন খালি ছিল।যদিও এই দুটো আসনের একটা আমার আর অন্য রাইয়ের জন্য বরাদ্দ থাকতো।কিন্তু আজ সেখানে আমি এবং ধ্রুব বসে পড়লাম।আমি ভ্রু কুঁচকে এদিক ওদিক তাকালাম রাইয়ের সন্ধানে।কালকে রাতে তাকে যে আটকে রাখা হয়েছিল নিজ রুমে!তারপর?কেউ কি দ্বার খুলে দেয়নি?

আমি দুঃশ্চিন্তা আর অস্বস্তির মাঝে খাবার শেষ করলাম দ্রুত।তারপর হাত ধুয়ে দ্রুত চলে আসলাম সিঁড়ির দিকে।ধ্রুব আমার দিকে একবার তাকিয়ে খাওয়া শেষ করলেন।তারপর চলে গেলেন ওনার মার ঘরে।
আমি দোতলায় এসে পৌঁছালাম।দোতলার শেষে রাইয়ের কক্ষের সামনে আসতেই থমকে দাড়ালাম আমি।বাইরে থেকে দুয়ার আটকে রাখা।আমি দ্রুত সেটা খুলে দিলাম।কাল রাত থেকে আটকে পরে আছে মেয়েটা।কেউ কি খোঁজ নিতেও আসেনি?

রাইকে আটকে রাখার কথা ধ্রুবর অজানা।রাইকে জোর করে নিয়ে যাওয়ার পর ধ্রুবর আগমন ঘটেছিলো।
আমি দরজা খুলেই ভেতরে প্রবেশ করলাম।মেঝেতে পরে আছে রাই!কপালের দিকে রক্ত শুকিয়ে আছে।আমি দ্রুত তার সামনে এসে বসে পড়লাম।গালে হালকা করে চাপড় দিতে দিতে ডেকে উঠলাম তাকে।মেয়েটা কপালে আঘাত পেলো কি করে?

আমি ধারণা করলাম এ ঘরে এনে তাকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে ফেলা হয়েছিল।আর তাতেই কপালে ভারী চোট পেয়েছে সে।আমি রাইকে ডাকতে ডাকতে কাঁদো কাঁদো হয়ে পরলাম।হৃদপিণ্ডের বেহাল দশা আমাকে শান্ত হতে দিচ্ছিলো না।আমি রাইয়ের নাকের কাছে কাঁপা কাঁপা হাত নিয়ে পর্যবেক্ষণ করলাম।রাই অজ্ঞান হয়ে আছে।আমি পুরো ঘর জুড়ে জলের সন্ধান করলাম।কিন্তু এ কক্ষে কোন জল নেই।আমি এবার বেরিয়ে এলাম রাইয়ের ঘর থেকে।উদ্দেশ্য ব্যপারটা ধ্রুবকে জানানো।
বসার ঘরে আমার আগমনে পুনরায় সকলের নজর এসে পরলো আমার উপর।কিন্তু আমি তা পরোয়া করার পর্যায়ে নেই।আমার দৃষ্টিজোড় তখন ধ্রুবকে খুঁজে চলেছে।হঠাৎ ধ্রুবকে শাশুড়ী মার কক্ষ থেকে বের হতে দেখা গেলো আমি দ্রুত গতিতে এগিয়ে গেলাম ওনার দিকে।
.

বিছানায় শুয়ে রাখা হয়েছে রাইকে।বাড়ির পুরুষ বলতে এই ঘরে কেবল ধ্রুবই আছেন।পেছনে দুহাত রেখে গম্ভীর চোখে তাকিয়ে আছেন বৈদ্যের দিকে।রাইয়ের শিয়রে বসে গুনগুনিয়ে কাঁদছেন রাইয়ের মা।আমি ওনার দিকে খানিক বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকালাম।কাল থেকে ওনার মেয়ে এ কক্ষে আটকে রয়েছে অথচ উনি মা হয়ে একবার খোঁজ দিতেও আসেন নি!আসা উচিত ছিল তো।
আর এখন গুনগুনিয়ে কাঁদছেন!আমার দৃষ্টি ওনার থেকে সরলো বৈদ্যের কথায়।

“মাথায় গভীর আঘাত পাওয়ায় অজ্ঞান হয়ে গেছে।জ্ঞান ফিরতে একটু সময় লাগবে।চিন্তার কিছু নাই।আর শরীরটাও অনেকটাই দুর্বল লাগছে।ভালোমন্দ খাওয়াতে হবে।”

কথা শেষ করে কিছু জড়িবুটি দিলেন বৈদ্যমশাই।ধ্রুব কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন ওনাকে খানিকটা এগিয়ে দিতে।এ কক্ষে রয়ে গেলাম আমি,শাশুড়ী মা আর রাইয়ের মা।রাইয়ের মায়ের কান্না তখনো বিদ্যমান।আমি খানিক ত্যক্ত হয়ে বলে উঠলাম,

“পিসি মা,আপনি কি একটু চুপ করবেন?”

উনি ভ্রু কুঁচকে আমার পানে তাকালেন।ক্ষেপে বলে উঠলেন,

“কেন?দেখতাছো না আমার মাইয়াটার কি হইছে?”

রাইয়ের কপালে বাধা পট্টিটায় হাত বুলাতে বুলাতে কথাটা বললেন উনি।প্রতিত্তোরে আমি বলে উঠলাম,

“আপনার এই স্নেহ,মমতা অতিরঞ্জিত মনে হচ্ছে।কাল থেকে এই ঘরে বদ্ধ অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে পরে ছিল আপনার মেয়ে!খোঁজ নিয়েছিলেন একবারো?এখন আপনার মাতৃত্ব জেগে উঠছে!প্রশ্ন এটা একজন মায়ের নিকট।”

আমার কথাটা ওনার গায়ে ভীষন।উনি বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়লেন এবার।ক্রুদ্ধ স্বরে বলে উঠলেন,

“আমারে এগুলা বলতাছো তুমি?আমারে?ন*ষ্টা মাইয়া কোথাকার!এই সব কিছু তোমার লাইগা ঘটছে।”

পিসিমার বলা কথায় আমি স্তব্ধ হয়ে তাকালাম।ক্ষনকাল বাদেই অক্ষিকোটরে অশ্রু জমতে শুরু করলো।শাশুড়ী মা বলে উঠলেন,

“আহ!চাঁপা।চুপ করবে।”

আমি সেখানে আর দাঁড়ালাম না।দ্রুত বেগে কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ঘুরে দাড়ালাম।দরজায় কাছটায় এসে ধ্রুবর সাথে মুখোমুখি হলাম আমি।আমার চোখ তখন অশ্রুতে পরিপূর্ণ।আমি ওনাকে কিছু না বলে ওমন টলমল চোখ নিয়েই বেরিয়ে আসলাম ঘর থেকে।

কালকের অচেনা লোকটাকে যেখানে বন্দি করে রাখা হয়েছিল সেখানে দুপুরের আগে আগে উপস্থিত হয় ধ্রুব।মাটির দেওয়াল,ছনের ছাওনি দেওয়া ঘরটার দিকে চেয়ে দায়িত্বে থাকা দুজন পালোয়ানের সন্ধান চালায় সে।দুজনকে দেখা যায় অদূরেই গাছের ছায়ায় বসে থাকতে।ধ্রুবর উপস্থিতি চোখে পরতেই বসা থেকে উঠে ধ্রুবর নিকটে এসে দাড়ায় তারা।ধ্রুব বলে,

“দরজাটা খুলো।”

ধ্রুব কথা শেষ হতে না হতেই দরজা খুলে দেওয়া হয়।মাটির ঘরটার দরজা ধ্রুবর উচ্চতার চেয়ে কম হওয়া একটু নিচু হয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ধ্রুব।ভেতরে প্রবেশ করতেই অর্ধচেতন হয়ে পরে থাকা লোকটা নজরে আসে।শ্যামলা দেহে অসংখ্য মারের দাগ।জায়গায় জায়গায় রক্ত শুকিয়ে চামড়ার সাথে মিশে আছে।লোকটা বিরবির করে কিছু বলছে।ধ্রুব কান খাঁড়া করে সেটা শোনার চেষ্টা করে।

“পানি..পানি..”

লোকটা পানির জন্য কাতরাচ্ছে।ধ্রুব আশেপাশে তাকিয়ে পানির খোঁজ করে।মাটিতে পিতলের গ্লাসে সামান্য পানি দেখতে পায় সে।সেটা নিয়ে লোকটার চোখেমুখে নিক্ষেপ করে সে।এতক্ষণ ধরে বন্ধ করে রাখা চোখদুটো মেলে তাকায় লোকটা।ধ্রুবর গম্ভীর মুখখানা ভেসে উঠে তার অক্ষিপটে।লোকটা একটা ঢোক গিলার প্রয়াস চালায়।কিন্তু গলা শুকিয়ে কাঠ!

ধ্রুব হাঁটু ভেঙে লোকটার সামনে বসে।একটা ভ্রু উঁচিয়ে শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,

“কালকে করা আমার প্রশ্নটা মনে আছে নিশ্চয়ই?যত তাড়াতাড়ি উত্তর পাবো,তাতেই তোমার মঙ্গল!”

লোকটা দীর্ঘদেহী ধ্রুবর পানে তাকিয়ে কালকের ঘটনার স্মৃতিচারণ করে।তারপর ভয়ে ভয়ে তাকায় তার দিকে।জমিদার পুত্রের আদর্শ আর ব্যাক্তিত্বে পুরো গ্রাম মুখরিত থাকলেও তার রাগ সমন্ধে অবগত গুটি কয়েক মানুষ।লোকটাকে মৌন দেখে ধ্রুব পালোয়ান দুজনকে চাবুক নিয়ে আসার আদেশ দেয়।সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না বোঝা যাচ্ছে।
চাবুক নিয়ে আসা হলে ধ্রুব সেটা হাতে পেঁচাতে পেঁচাতে বলে উঠে,

“তোর ভাগ্য ভালো আমার স্ত্রীকে স্পর্শ করার প্রয়াস করেও তুই ব্যর্থ হয়েছিস।ধরে নে গায়ের এই জখমগুলো শুধুমাত্র সেই প্রচেষ্টার ফল।তুই যদি সেই ব্যক্তির নাম না বলিস তবে এর থেকে দ্বিগুণ মার মরবে।জীবনের মায়া আছে তো নাকি?”

কথাখানা শেষ করেই লোকটার গায়ে চাবুক মারে ধ্রুব।ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠে লোকটা।চোখেমুখে ভয় ফুটে উঠে।ধ্রুব তখন বেশ ক্রোধান্বিত!
লোকটার গায়ে দ্বিতীয়বারে ন্যায় মার পরতেই সে বলে উঠে,

“আমি বলছি মালিক..বলছি।”
.

প্রাতঃকালে সমাপ্ত হয়ে মধ্যান্নের সুচনা হতেই স্নান ছেড়ে এলাম আমি।ভেজা কাপড়গুলো শুকোতে দিয়ে এসে মাথা থেকে গামছাটা খুলে ফেললাম আমি।ওমনি আমার দীর্ঘ কেশ উন্মুক্ত হয়ে ছড়িয়ে পরলো পিঠ জুড়ে।কোঁকড়া চুলে জলের স্পর্শ লাগায় সেগুলোকে আরেকটু লম্বা মনে হচ্ছে।আমি মাথার চুল আঁচড়ে সিঁথি করে নিলাম।তারপর সিঁথিতে সিঁদুর লেপ্টে নিয়ে সরে দাড়ালাম আয়নার সামনে থেকে।বিছানার কাছের বিশাল আয়নার সামনে এসে দাড়াতেই কিছু একটা মনে হলো।আমি ফের এসে দাঁড়ালাম আয়নার সামনে।টিপের কৌটো থেকে একটা টিপ বের করে পরে নিলাম।আপনা আপনি মুচকি হেসে উঠলাম আমি।পরক্ষণেই মিলিয়ে গেল সেই হাসি।মন খারাপের মাত্রা একটু বেশিই আজকে।আলগোছে জানালার কাছটায় এসে ফের দাঁড়ালাম আমি।তখনই দরজায় শব্দ হলো।আমি ফিরে তাকাতেই ধ্রুবর অবয়ব ভেসে উঠলো অক্ষিকোটরে।আমি মৃদুস্বরে বলে উঠলাম,

“কোথায় ছিলেন?”

তারপর ওনার দিকে তাকাতেই খেয়াল করলাম একেবারে স্নান ছেড়ে এসেছেন উনি।পরনে আকাশি বর্ণের নতুন ফতুয়া আর সাদা ধুতি।আমার প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন উনি।আমি দৃষ্টি নত করে নিলাম।ধ্রুব আমাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে আলতা পূর্ণ একটা বাটি নিয়ে আসলেন।মেঝেতে বসে আমার পা যুগলের দিকে হাত বাড়াতেই আমি পা সরিয়ে নিলাম।চোখ কপালে তুলে বলে উঠলাম,

“আপনি ফের এমনটা করছেন!আপনি আমার স্বামী ধ্রুব!এভাবে যখন তখন পায়ে হাত দিবেন না।”

উনি আমার কথা কানে তুললেন না।আমি বিছানা ছেড়ে নেমে ওনার মতো করেই মেঝেতে বসলাম।উনি আলতায় তুলি ভেজাতে ভেজাতে বললেন,

“যখন স্বয়ং ঈশ্বর নিজের প্রিয়তমার পায়ে হাত দিতে দ্বিধা বোধ করেন না।তখন আমি তো সামান্য এক মনুষ্য!আমি ছুঁলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?”

কথাটা বলে উনি আমার পায়ে লাল রাঙা আলতা ছোঁয়ালেন।আমি আমার পায়ের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ওনার দিকে তাকালাম।রেশমি ভেজা চুল কপালে এসে ঠেকেছে উনার।চোখের পাপড়িতে লেগে থাকা সুক্ষ্ম পানির কনা বলে দিচ্ছে ভালো করে মুখটাও মুছেন নি উনি।গভীর চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিজের অর্ধাঙ্গিনীর পায়ে আলতা আঁকায় মগ্ন।উনি আমার দিকে না তাকিয়েই ডেকে উঠলেন,

“নির্বানী?”

“হু?”

“তোমাকে জন্য আরেকটি সম্মোধন বরাদ্দ আছে।সেটা কি জানো?”

আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,

“না।কি সেটা?”

ধ্রুব আঁকায় খুব ব্যস্ত।আমি এবার পায়ের দিকে তাকালাম।আজকে নিখুঁতভাবে আলতা এঁকেছেন উনি।পায়ের মাধখানের নিখুঁত বৃত্তটার চারপাশে ছোট ছোট ফোঁটা আঁকতে আঁকতে উনি বলে উঠলেন,

“মম হৃদয় বিহারিণী।”

খানিক চমকে ওনার দিকে তাকালাম আমি।আমার পানে এবার দৃষ্টি নিলেন উনি।ঠোঁটের কোণে সুক্ষ্ম হাসি লেপ্টে আছে ওনার।উনি এবার মৃদু,শান্ত স্বরে বলে উঠলেন,

“হৃদয়ের সমস্ত প্রেম তার প্রতি অর্পণ,
মম অন্তস্থলে যার সর্বক্ষণ বিচরণ…”

চলবে…