মম হৃদয় বিহারিনী পর্ব-১৮

0
1

#মম_হৃদয়_বিহারিনী
#ঐশী_রানী_রক্তিমা
১৮.
রাই শশীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

“আমি নির্বানী নই।আমি ওকে ক্ষমা করতে পারবো না।শুধু এতটুকুই চাইবো এই জমিদার বাড়ির ভিটেতে শশী নামক কাল সর্পিণীর ছায়া যেন না পরে।ও যেন গ্রামবাসী সকলের কাছে এই বলে ক্ষমা চায় যে জমিদার বাড়ির মেয়ে রাই কোনদিন কোন বাজে কাজ করেনি।সবটাই ছিল তার প্ররোচনা।ওর অধিকারপরায়ণতার বিষাক্ত ছোবল পরেছে আমার উপর।”

ধ্রুবর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পরলো এবার শুভর উপর।ঝাঁকড়া চুলের চশমিশ ছেলেটা পিঠপিছে এমন কাজ করলো?ওকে তো ধ্রুব আপন ভাইয়ের থেকে কম ভাবেনি কোনদিন।ছেলেটাও তো তার অনুগত ছিল বেশ!

ধ্রুব শুভর দিকে তাকিয়ে আছে এটা শুভর চোখে পরতেই শুভ দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকায়।ধ্রুবর কঠোর স্বর এবার থাবা মারে শুভর দিকে।

“আমার যতটুক ধারণা নির্বানীর প্রতি তোর কোন রাগ থাকার কথা না।তবে তুই এই কাজে কি জন্যে সাথ দিলি?”

ধ্রুবর কথাটা একজন বড় ভাইয়ের ছোট ভাইয়ের প্রতি করা রাগের মতো শোনানো।সুবোধ দেবনাথও ছেলের উপর রেগে।এমন কাজ করে তার মাথা হেট করার কারণ কি?
শুভ নিজের দোষ মানতে বোধহয় নারাজ ছিল।কিংবা কারণটা বলার জন্য প্রস্তুত নয় সে।ধ্রুব শুভকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার একপ্রকার গর্জে উঠে ফের।

“এখন চুপ করে আছিস কেন? তুই শশীর সাথ দিছনি?”

শুভের ধৈর্যের বাধ ভাঙল যেন এবার।একপ্রকার চেঁচিয়ে বলে উঠলো সে,

“হ্যা দিয়েছি সাথ।কেন দিতাম না?যা আমার প্রাপ্য যদি আমি না পাই তবে কেন সুখে থাকবে তুমি?”

ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে ফেললো।সেই সাথে আমিও।শুভর চিৎকারের ঝংকার উঠলো বসার ঘরে।ধ্রুবর দিকে তাকাতেই ওনার দৃষ্টিতে অবিশ্বাস দেখতে পারছিলাম আমি।
শুকনো ঢোক গিলে শুভর দিকে তাকালাম।সুবোধ দেবনাথও ছেলের দিকে তাকালেন লজ্জিত মুখে।মেজো কাকি মনির মুখ তখন ছেয়েছে অন্ধকারে।সকলের দৃষ্টি শুভর নিকট পৌঁছালো আবার।

“জেঠু মারা যাওয়ার পর থেকেই এই জমিদারি সামলাচ্ছে বাবা।ওনার সন্তান হিসেবে তো আমার জমিদার হওয়ার কথা তাই না?কিন্তু এই গ্রামের সকলে জমিদার বলে কেন তোমাকে মানবে?”

শুভর হিংসাত্মক কথা বসার ঘরে বজ্রপাতের ন্যায় ঠেকলো।এ কথা তার মাথায় ঢুকিয়েছে কে?সুবোধ দেবনাথ ছেলের দিকে একবার তাকিয়ে স্ত্রীর পানে তাকান।স্বামীর দৃষ্টিতে পরতেই ভয়ে ভয়ে মাথা নত করেন মেজো কাকি।কাকা মশাই মনে মনে রেগে উঠেন।বড় ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তিনি জমিদারি সামলালেও কখনো এমনটা ভাবেননি তিনি।এই সবকিছু ধ্রুবর প্রাপ্য আর সে যোগ্যও!দু একবার মেজো কাকি এই নিয়ে ওনার সাথে আলাপ করলেও এড়িয়ে গিয়েছেন উনি।দাদার বেশ অনুগত ছিলেন সুবোধ দেবনাথ।তার অনুপস্থিততে তার রেখে যাওয়া দায়িত্ব সামলানো ওনার ধর্ম।যুবক বয়সেই মারা গেছেন ধ্রুবর বাবা।তারপর বছর কয়েক পর ছোটভাই মরলেন অসুখে।পরপর শ্রদ্ধেয় ও স্নেহের ভাইকে হারানোর শোকে এখনো বিষন্ন হয়ে পরেন উনি।স্ত্রী ও ছেলের এমন কার্যে বেশ ক্ষুব্ধ হন সুবোধ দেবনাথ।

ধ্রুব শুভর পানে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে দু দন্ড।তারপর কাকা মশাইয়ের পানে দৃষ্টি দিয়ে অবাক হয় বলে,

“ছোট থেকে আমাকেই তো আপনি বলেছেন যে এই জমিদারি আমার বাবার পরে আমার হবে।তাই না কাকা বাবু?”

সুবোধ দেবনাথ লজ্জিত হয়ে মাথা নেড়ে হ্যা বোঝায়।ধ্রুব ফের বলে,

“প্রতিত্তোরে কিছুদিন যাবত আমি কি বলে এসেছি আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই?”

সুবোধ দেবনাথ চোখ বুঁজে নেন।তিনি আসলেই ছেলের কাজে লজ্জিত।শুভটা এমন বিকৃত চিন্তা মস্তিষ্কে পুষে রেখেছিল।

“এই সম্পত্তি তোমার।দাদার অবর্তমানে আমি শুধু এর দেখফাল করছি।এটাই তো বলতেন আপনি তাইনা?প্রতিত্তোরে বোধহয় আমি বহুবার বলেছি আপনার পরে এসবে শুভর অধিকার থাকা দরকার।কিন্তু আপনি আমায় শুধু থমকে চুপ করিয়ে দিতেন।”

বসার ঘরে পিনপতন নিরবতা বইলো ধ্রুব চুপ করার পর।আমি ধীরে ধীরে শুভর দিকে তাকালাম।একটু অনুশোচনা খুঁজলাম তার চোখেমুখে।তবে থমথমে হয়ে থাকা মুখশ্রীর অভিব্যাক্তি বুঝতে অক্ষম আমি।নিরবতা কাটলো ধ্রুবর বাক্যেই।

” শুভর কথা শুনে শুভর শাস্তির দায়িত্ব আমি নিতে চাচ্ছি না।হয়ত দেখা যাবে এমন কঠোর শাস্তি দিয়ে ফেলছি যার দরুন আপনারা আমাকেই বাঁকা নজরে দেখেন।আপনাদের আপন সন্তান তো!”

কথাটা বলে মেজো কাকি মনির দিকে তাকালেন ধ্রুব।তিনি ফট করে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন।

“একজন নারীর সম্মানের দিকে আঙুল তোলার শাস্তি কম নয়।আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ।আপনাকে টপকে আমি কোন সিদ্ধান্ত নিলে খারাপ দেখায়।তাই আশা করছি শুভকে যথাযথ শাস্তি দিবেন।ন্যায় বিচার আশা করছি।”

“ওর শাস্তি তুমিই দাও ধ্রুব।ওকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার তোমার।”

কথাখানা বলে সুবোধ দেবনাথ বসার ঘর ত্যাগ করেন।ওনার চলে যাওয়া দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন ধ্রুব।

.
বহুদিন ধরে যা লোকসমাজে আলোচিত হয়ে আসছে,হঠাৎ যদি বলা হয় সেটা সম্পূর্ণ ভুল,মিথ্যা বার্তা।তবে লোকজন বিস্মিত হবেই।এমনটাই হয়েছে গ্রাম বাসীর ক্ষেত্রে।রাইয়ের সম্পর্কে এতদিন অবধি লোকেদের ধারণা ছিল খুবই নিচ প্রকৃতির।কেননা গাঁয়ের সকলের মাঝে এই সংবাদ ছড়ানো হয়েছিল যে রাইয়ের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ছিল।একেবারে ঘনিষ্ঠ পর্যায়ের!

তখনকার জামানায় এমন কাজকে লোকেরা গুরুতর পাপ হিসেবে দেখতো।যদিও এটা বাস্তবেই গুরুতর অপরাধ।তবে সময়ের সাথে সাথে এই অপরাধ লোক সমাজে ম্নান হয়ে এসেছে।

যেদিন বিকেলে গাঁয়ের লোকেদের ডাকা হয় জমিদার বাড়িতে।লোকেরা এসে উঠোনে জড়ো হতেই ধ্রুব সকলকে নমস্কার জানায়।গ্রাম জুড়ে ধ্রুবর একটা ডাকনাম আছে।জমিদার বাবু!জমিদার পদে ঘোষিত না হয়েই এই ডাকনাম কামিয়েছে সে।তার দানশীল স্বভাব লোকেদের মনে নিজের জায়গা করে নিতে সাহায্য করেছে।গ্রামের লোকজন জড়ো হওয়ার পর শশীকে ধ্রুব ইশারা করে সত্য স্বীকার করার জন্য।আশ্চর্যজনক ভাবে বাড়ির বারান্দায় বাড়ির সব মেয়েলোক থাকলেও রাই ছিল গুম।তার কলংক ধুয়ে যাচ্ছে অথচ মেয়েটাই এখানে উপস্থিত নেই?

আমার চিন্তার মাঝেই শশী তার কথা বলা শুরু করলো।সামনে তাকিয়ে,পাথর বনে একেকটা শব্দ উচ্চারণ করলো।রাই নির্দোষ হওয়ার সাক্ষ্য দিলো।সেই সাথে এটাও বললো সেই রাইয়ের উপর হিংসাত্মক হয়ে এমন সংবাদ সরিয়েছে।তারপর যা হওয়ার হলো।এ বাড়ির লোক বিশেষত রাইয়ের মা মেয়ের ব্যপারে এমন রটনা সহ্য করতে না পেরে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলেন।ইচ্ছের বিরুদ্ধে!

শশীর উপর গায়ের লোক ক্ষ্যাপলোও খুব।গাঁয়ের মাস্টারের মেয়ে শশী।একমাত্র সন্তান।শিক্ষিতা,রুপবতী, গুনবতীও বটে।মানুষের জীবন নষ্ট করে দেওয়ার গুন খুব ভালোভাবেই রপ্ত।

শশীর উপর রেগেমেগে নানা কথা বলতে বলতে লোকেরা রাইয়ের প্রতি দয়া দেখাতে লাগলো।বেচারা!একটা মিথ্যের উপর তার জীবনটা এতদিন কলুষিত ছিল।গায়ের লোকেরা শশীকে বাজে কথা শোনাতে শোনাতে আর রাইয়ের উপর নিজেদের সমস্ত মায়া-দয়া উৎসর্গ করে জমিদার বাড়ি ত্যাগ করলো।শুভর বিষয়টা উল্লেখ করা হলো না।যেহেতু এ বাড়ির লোক বাদে ঘটনাটি কেউ জানে না।তাই বিষয়টা গোপন রাখলেন ধ্রুব।এর বিচার এই বাড়িতেই হবে।অবশ্য এ কথা গোপন রাখার আরেকটা কারণ আছে।সেটা আমি!
মেজো কাকি বোনকে আচ্ছা করে বলে দিলেন এই খবর যেন গাঁয়ে না ছড়ায়।

কিন্তু শুভর বিচার করার সুযোগ পেলেন না ধ্রুব।সেদিন রাতেই শুভকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিলেন মেজো কাকি মা।ওনার ভয় ছিল ধ্রুবর উপর।প্রথমদিন আমায় নিয়ে বাজে কথা বলার পর ধ্রুবর বজ্রকন্ঠ!কাকা মশাইয়ের সাথে কঠোর বাক্যালাপ আর সেদিন আমাকে নিয়ে স্বয়ং জ্বলন্ত কয়লা পাড়ি দেওয়ার জেদ ওনাকে ভীত করে দিয়েছিল।ছেলের মাথায় অবশ্য এটা উনিই ঢুকিয়েছিলেন যে এ বাড়িতে তার অধিকার।এই জমিদারি তার প্রাপ্য।কিন্তু ধ্রুবর আমার প্রতি যে অটুট প্রেম তা সকলের মতো ওনারও অজানা ছিল।হয়ত শুভর বলা কথাটার পরে ধ্রুবর প্রথমদিন বলা কথাটা উনি ভুলেই গিয়েছিলেন!যে আমাকে কেবল লগ্নভ্রষ্টা হওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য বিয়ে করা হয়েছে।এ কথা অবশ্য সত্যি।কিন্তু অগ্নি সাক্ষী রেখে, সাত পাঁকে বাঁধা পরার মাঝে একটা অদৃশ্য শক্তি আছে।পবিত্র মনে একজনকে স্ত্রী কিংবা স্বামী হিসেবে মানার মাঝে এক শক্তি আছে।নারী-পুরুষ একে অপরকে মন থেকে স্বামী স্ত্রী হিসেবে মেনে নিলে সেই ঘরে,সেই সংসারে অটুট প্রেমের আবির্ভাব অসম্ভব কিছু নয়।বরং সেই প্রেম অমর হয়ে থাকে চিরকাল।

শুভর পালিয়ে যাওয়ার খবর আমরা সকালে পেয়েছিলাম।ধ্রুব গম্ভীর হয়ে ছিলেন কিছুক্ষণ।তারপর আমাকে আদেশ করলেন আমার প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নিতে।বিকেলেই আমাকে নিয়ে শহরে রওনা হবেন উনি।আমি ওনার কথামতো আমার আর ওনার জিনিস এক ব্যাগেই ভরে নিলাম।খুব কমই কাপড়চোপড় নেওয়া হলো আমার।ওনার ব্যাগে এবার জিনিসপত্র কম থাকায় সুবিধেই হলো।আমি সকাল সকাল কাজ ছেড়ে রাইয়ের কক্ষের উদ্দেশ্যে বেরোলাম।রাইকে সেদিনের মতো আজও তার কক্ষে পেলাম না।তবে আমি জানি এই মুহুর্তে রাই কোথায় থাকতে পারে।আমি বসার ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।বসার ঘরে পৌঁছাতেই দেখা পেলাম তার।সেদিনের মতো কলসি নিয়ে বেরোচ্ছে।আমি আজকে পিছু না ডেকে তার পিছনে ছুটলাম।নুপুরের তীব্র ঝংকারে ভরে গেল বসার ঘর তখন।রাই ভ্রু কুঁচকে পেছন ফিরে তাকালো।আমাকে দেখে হেসে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।আমি তার কাছে পৌঁছাতে ফের চলা শুরু করলো রাই।আমি চুপচাপ চললাম তার সাথে।আজ তার পরনে সাদা রঙের শাড়ি।আমি রাইকে যতই দেখি ততই আশ্চর্য হই।এতদিন নিজের উপর থাকা সমস্ত কলংক নিয়েও মেয়েটা বৈধব্যকে অস্বীকার করে রঙিন বস্ত্র পরিধান করেছে।অথচ আজ স্বইচ্ছায় শুভ্রা শাড়ি পরনে!

আমার হঠাৎ মনে হলো তার বৈধব্য না মানতে চাওয়ার সিন্ধান্ত শ্রেয় ছিল। কেননা এই শুভ্র বস্ত্র যে সে অপ্সরার থেকে কম লাগছিলো না।
অথচ এত রুপ থাকার পরেও কোনদিন এমন কথা বলেনি যাতে আমি অপমানিত বোধ করি।আমি চুপচাপ রাইকে অবলোকন করতে করতে তার পেছন পেছন হাঁটছিলাম।রাই হঠাৎ আমাকে বলে উঠলো,

“তোমাকে এই রক্ত লাল রঙে অসম্ভব রুপবতী লাগে নির্বানী।আগে কখনো বলা হয়নি।”

আমি একপ্রকার চমকে উঠলাম।আমরা যার প্রশংসায় মজে থাকি।সে।স্বয়ং যদি অপ্রত্যাশিত ভাবে আমাদের প্রশংসা করে বসে তখন সবকিছু বিস্ময়কর লাগে।প্রথমে তো মনে হয় স্বপ্নের ঘোরে আছি বোধহয়।

রাই পেছন ফিরে তাকালো হঠাৎ।আমরা তখন আম বাগানের একে মাঝে মাঝখানে।চৈত্রের শেষ হওয়ায় আমের গুটি বেশ বড়ো বড়ো হয়ে গেছিলো।রাই আমার দিকে একবার তাকিয়ে আখগুলোর দিকে তাকালো।পুষ্ট হয়ে উঠছে গুটিগুলো।ভেতরের বিচিটাও বোধহয় শক্ত হতে শুরু করেছে!রাই আমার দিকে কলসিটা এগিয়ে দিলো হঠাৎ।আমি সেটা নিতেই রাই হন্য হয়ে এদিক ওদিক চোখ ঘুরালো।তার সাথে সাথে আমিও তাকালাম।দুরেই মাটির ঢেলা দেখে সেটা কুড়িয়ে আনলো রাই। তারপর ঢিল ছুড়লো গাছের দিকে।প্রথমবার ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয়বার দুটো বড়ো বড়ো কাঁচা আম পরলো মাটিতে।বুঝলাম সে একাজে বেশ পটুই।
রাই আম দুটো কুড়িয়ে নিয়ে ফের আমার সাথে পুকুর পাড়ের দিকে চলতে লাগলো।আমি চুপচাপ কিছু না বলে সাথে সাথে গেলাম।পুকুরে পৌঁছে শান বাঁধানো ঘাটে আয়েশ করে বসলাম আমরা।রাই হঠাৎ শাড়ির আঁচলের কোনা থেকে নুন আর মরিচ বের করলো। তারপর আমারকে তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,

“আগে কখনো এভাবে আম খাওনি?”

আমি দুপাশে মাথা নেড়ে না বোঝালাম।রাই আচ্ছা বলে আমদুটো শাড়ির আঁচলে নুন মরিচের সাথে বেঁধে নিলো।তারপর পুকুরের ঘাটে মারি মেরে মেরে আমগুলো ফাটিয়ে নিলো।সাথে সাথে বলতে লাগলো,

“ছোট বেলায় এভাবে কত আম খেয়েছি জানো?আমি,ধ্রুব আর..শুভ।ঢিল মেরে মেরে আম পেরে এভাবে কত আম খেয়েছি।”

বলতে বলতে শাড়ির আঁচলের বাঁধন খুলে আমগুলো মেলে ধরলো।তারপর সেখান থেকে বেছে বেছে একটা আম আমার দিকে এগিয়ে দিলো সে।আরেকটা নিয়ে তাতে কামড় বসিয়ে দিলো।তার দেখাদেখি আমি খেতে লাগলাম।টক,ঝালের দারুণ মিশ্রণ।নেচে উঠলো আমার মন।এমনভাবে আম খাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার কখনো হয়নি।

“দেখেছো কত মজা?”

আমি হেসে হ্যা বোঝালাম।রাইও হেসে ফেললো।আমি তাকিয়ে রইলাম মুগ্ধ হয়ে।আমার হৃদয়ে খুব করে জায়গা করে নিয়েছে এই নারীটি।

“আজ শহরে যাচ্ছো তোমরা?

” হু!”

“তোমাকে খুব মনে পরবে।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো রাই।আমিও একটা গাঢ় শ্বাস ফেলে বললাম,
“তোমাকেও।”

আমাদের রওনা হতে হতে একটু দেরি হয়ে গেলো।শাশুড়ী মা, কাকিমনিরা,প্রভা -আভা আর রাই এসে উঠোনে এসে উপস্থিত হয়েছে আমাদের বিদায় দেওয়ার জন্য।আমি একে একে সবাইকে প্রমাণ করে শাশুড়ী মার নিকট এসে দাড়ালাম।ওনাকে প্রমাণ করতেই আমায় ওনার হাতের গাঢ় ছোঁয়া পেলাম।

“আমায় করে দিও নির্বানী।সেদিন তোমার পাশে না দাঁড়াতে পারার জন্য।”

আমি বিনিময়ে একটা স্মিত হাসি উপহার দিলাম।সবশেষে রাইয়ের নিকট এসে দাঁড়াতেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো সে।জড়িয়ে ধরেই বললো,

“ভালো থেকো তোমরা দুজন।একটা সুন্দর সংসার হোক তোমাদের।”

আজ আমারও রাইকে কিছু বলার ছিল।আমি রাইয়ের হাতদুটো মুঠোয় নিয়ে একটা গাঢ় শ্বাস ফেলে বললাম,

“একটা অনুরোধ তোমার কাছে।”

রাই চোখের ইশারায় কি বোঝালো।আমি বললাম,

“তোমার জীবনের সমস্ত ঘটনা জেনেও যদি কেউ স্বচ্ছ মনে তোমার সাথে জড়াতে চায়,তবে তাকে সুযোগ দিও।তোমার এখনো অনেক সুখ পাওয়া বাকি।আমার বিশ্বাস ঈশ্বর ফুলের মতো মেয়েটার কপালে অন্তত এই সুখটা রেখেছেন।”

রাই বিস্ময় নিয়ে আমার কথা শুনলো।আমি ধীরে ও আস্তে বলায় অন্যদের কানে বোধহয় পৌঁছায়নি।আমি এবার বলে উঠলাম,

“ভালো থেকো।আসছি।”

রাইয়ের মুখে সদার ন্যায় হাসি ফুটলো এবার।বললো,

“খারাপ ছিলাম কোনদিন বলোতো?”

আমি সুক্ষ অবাক দৃষ্টি সরিয়ে বিদায় নিলাম।ধ্রুব আমার হাতখানা শক্ত করে ধরে বেরিয়ে এলেন জমিদার বাড়ি থেকল।আমি পেছন ঘুরে একবার বিশাল অট্টালিকার দিকে তাকালাম।ধ্রুবর কক্ষের সেই জানলাটা এখান থেকে দেখা যায় না।বিয়ের পর ধ্রুবর হাত ধরে এই বাড়িতে প্রবেশ, আর শহরের উদ্দেশ্যেই ওনার হাত ধরেই প্রথমবারে ন্যায় বেরিয়ে এলাম এ বাড়ি থেকে।সঙ্গে নিয়ে গেলাম কিছু হাসি দুঃখ কান্না।একটা ভ্যান দাঁড়ানো ছিল বাড়ির সামনে।ধ্রুব সেখানে ব্যাগ রেখে আমাকে উঠতে সাহায্য করলেন।তারপর নিজেও আমার পাশে এসে বসলেন।আমি ধ্রুবর বাহু শক্ত করে ধরে চোখ বুঁজলাম।

চলবে…

ভুল-ত্রুটি মার্জনার অনুরোধ রইলো।