মম হৃদয় বিহারিনী পর্ব-২৬

0
1

#মম_হৃদয়_বিহারিনী
#ঐশী_রানী_রক্তিমা
২৬.
“ভালোই করেছিস এমন বেরঙিন সেজে।এবার তোকে নাহয় আমিই রঙিন করে তুলবো।আমি তোকে বিয়ে করবো রাই।শুধু তুই একবার হ্যা বল।শুধু একবার!”

রাই কাঁপা কাঁপা দৃষ্টিতে পূর্ণের পানে তাকালো।পূর্ণর দু’চোখে সমুদ্র সমান আকুতি।রাইয়ের চোখ টলমল করে উঠলো অশ্রুতে।পূর্ণ এবার আরেকটু নিকটে এসে দাড়ালো।দুজনের মাঝে এখন একহাত পরিমাণ দুরত্ব কেবল।

“তুই রঙিন হয়ে উঠবি আমার নামে।শুধু একবার হ্যা বল।”

এমন আকুল স্বরের মিনতি কি করে ফেরানো যায় রাইয়ের জানা নেই।রাইয়ের চোখে জমে থাকা অশ্রু কপোল বেয়ে গড়িয়ে পরে।পূর্ণ ব্যতিব্যস্ত হয়ে পরে হঠাৎ।রাইয়ের অশ্রু মুছে দিতে হাত বাড়িয়েও থেমে যায় সে।জিহ্বা দ্বারা ওষ্ঠ ভিজিয়ে বলে উঠে,

“প্রতিবার তোর চোখে আসা জল মুছে দেওয়ার অনুমতি চাইছি।দিয়ে দে না প্লিজ।”

রাইয়ের চোখের অশ্রুর মাত্রা বাড়ে।ভেজা চোখের অস্পষ্ট চাহনিতে সে পূর্ণের পানে তাকায়।লোকটাকে ঝাপসা দেখা যাচ্ছে অশ্রুর কারণে।রাই ঢোক গিলে কথা বলতে গিয়ে বুঝতে পারে গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না।অতিকষ্টে অস্ফুটস্বরে সে বলে উঠে,

“দিলাম।”

পূর্ণ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চায়।রাই মেনে নিলো!সম্মতি দিয়ে দিলো।তার ওষ্ঠদ্বয়ে হাসি যেন ধরে না।হাত বাড়িয়ে রাইয়ের অশ্রু ভেজা গাল মুছে দেয় সে,আলতোভাবে।আলিঙ্গনের তীব্র ইচ্ছে জাগ্রত হচ্ছে তার হৃদয়ে।তবে এই অধিকার সে দেখাবে তাদের বিয়ের পর।রাইকে সম্পূর্ণরুপে নিজের করে পাওয়ার পর।পূর্ণ রাইয়ের অশ্রু মুছে দিয়ে বলে,

“কাঁদবেন না।”

রাই চোখ তুলে তাকায় পূর্ণের পানে।লোকটা ফের তুই থেকে আপনিতে চলে গেছে।রাই খানিক ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে,

“আগে ঠিক করুন আমাকে কি বলে সম্মোধন করবেন।”

“আপনাকে সবসময় আমি ভালোবেসে ডাকবো।সম্মোধন করার শব্দ যাই হোক না কেন!”

রাইয়ের চোখের অশ্রু থামে।অক্ষিপটে জমে থাকা শেষ অশ্রুখানা গড়িয়ে গালে এসে পৌঁছাতেই চোখের মনিতে পূর্ণের প্রতিবিম্ব ভেসে উঠে।সেই সাথে রাইয়ের মনে সুক্ষ্ম আশা জাগে।একটু সুখের আশা!

সে কমই আশা রাখে এই জগত-সংসার থেকে।সেই কম আশায় তো তার পূর্ণ হয় না।আজ কোন শুভক্ষণে ঈশ্বর তার ভাগ্যে সুখের রেখা লিখে দিলো।কে জানে!কি পুন্য করে ফেলেছে সে।ঈশ্বর প্রসন্ন হয়ে সুখের দেখা দিলেন।রাই মনে-প্রাণে তার আরাধ্য দেবতাকে ধন্যবাদ জানাতে লাগলো।অক্ষিপটে ভেসে উঠা পূর্ণের প্রতিবিম্ব আর হৃদয়ের ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখে প্রকৃতিও যেন আকুতি করে উঠলো সেই পরম সত্যের নিকট।এই দুই মানব-মানবীর প্রেম যেন অমর রয়!হৃদয়ের কখনো-সখনো উৎপন্ন হওয়া দুঃখও যেন ফুল হয়ে বর্ষিত হয় দুটো পবিত্র হৃদয়ে।

.

সেইদিনের পর কাটলো ছয়টা দিন।দিনটা আমার নিকট সমগ্র জীবন ব্যাপি স্মরণীয় হয়ে থাকবে।আজ রাইয়ের বিয়ের দিন।এ বাড়ির লোককে এ ব্যাপারে মানানো টা একটু কষ্টের ছিলো বৈকি।তবে অসম্ভব ছিলো না।ধ্রুব ও আমি একাধারে মা আর কাকামশাইকে রাজি করিয়েছি।বেচারির সারা জীবন পরে আসে এখনো।সমগ্র জীবন সে এভাবেই কাটাবে নাকি?
যখন একজন তার অতীত যেনেও সবকিছু মেনে তাকে আপন করতে চাইছে তবে ওনারা কেন আপত্তি করবেন?

কাকা মশাই বোধহয় একটা ধাক্কার মধ্যে ছিলেন তখনও।ছেলের কার্যে ওনার মস্তিষ্ক ছিল নত।একমাত্র ভাগ্নির প্রতিও স্নেহ ছিলো।টানা তিন দিন অনুরোধ আর বোঝানোর পর বায়োজেষ্ঠ্যদের মন গললো।মেজো কাকি মা এসব শুনে নাক সিটকালেন স্বভাববশত।পাত্তা দিলাম না আমরা।রাইয়ের সম্মত্তি পাওয়ার পরপরই পূর্ণ চলে গিয়েছিলেন বাড়িতে।ওনাদের বাড়ি খুব বেশি দুরে ছিলো না।এখান থেকে চারটে গ্রাম পরেই ওনাদের বাড়ি।পূর্ণের বাবা বণিক।যথেষ্ট সম্ভান্ত্র পরিবারের।শেষমেষ এ বাড়ি থেকে সম্মতি দেওয়া হলো।বলা হলো পূর্ণর বাড়ি থেকে লোক নিয়ে আসতে।ধ্রুব এক্ষেত্রে একটা কাজ করে বসেছিলেন।পূর্ণকে উনি আগেভাগেই বলে রেখেছিলেন বোন যেন তার কোনরূপ খোঁটার সম্মুখীন না হয়।তার অতীত নিয়ে শশুর বাড়ির কেউ বিশেষত রাইয়ের হতে পারা শশুর-শাশুড়ী যেন কোন প্রকার খোঁটা না দেয়।
পূর্ণ হেসে শুধু জানিয়েছিলো যে এমনটা কিছুই হবে না তার উপর বিশ্বাস রাখতে।তারপর কাকা মশাইয়ের নিকট প্রস্তাব রেখে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় উনি।আমার আর ধ্রুবর উপর রেখে যান বিরাট দায়িত্ব!

বিয়ের মণ্ডপে রাইকে নিয়ে যাওয়ার ঘন্টাখানেক পূর্বে আমি তার কক্ষে প্রবেশ করলাম।প্রতিদিনের তুলনায় দ্বিগুণ প্রদীপ আজ তার কক্ষটায়।প্রদীপের আগুনের জ্বলন্ত শিখায় এমন মনে হচ্ছিল যেন, সমগ্র কক্ষে সূর্যের অতিক্ষুদ্র অংশ লুকায়িত ছিলো।আমি দর্পনের সম্মুখে বসে শৃঙ্গার রত রাইয়ের দিকে তাকালাম।তাকে ঘিরে আছে উত্তম বস্ত্রে সজ্জিত আভা-প্রভা।দুজন পরিচারিকাও আছেন।আমার উপস্থিতি সকলের নিকট অজানা রয়ে গেল।কক্ষজুড়ে চুড়ি আর অলংকারের অনবদ্য আওয়াজে আমার পায়ের নুপুরপর সুক্ষ্ম ধ্বনি কারো কর্ণগোচর হলোই না।তবে কক্ষ পৌঁছে সেকেন্ড কয়েক দাঁড়াতেই রাই হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রীতে ফিরে তাকালো।বুঝলাম কক্ষজুড়ে আজ এই দীপ্তির কারণ।মেয়েটার হৃদয় যে আজ প্রেমের আলোতে আলোকিত।কক্ষজুড়ে তারই যেন প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।

রাই হাস্যজ্জ্বল বধু বেশে তাকিয়ে আমার পানে।ধীরে ধীরে তার দৃষ্টি দখল করলো কৃতজ্ঞতা।আমিও হেসে এগিয়ে আসলাম তার নিকটে।
এমনিতেই মেয়েটার সৌন্দর্যে চক্ষু ফেরানো দায়।তারউপর আজ তার এমন শৃঙ্গার!আমি বিমোহিত হলাম।

কালকে অব্দিও রাইয়ের পরনে সাদা শাড়ি ছিল মাত্র।আজ পরিনয়ের উদ্দেশ্যে মেয়েটা কত আনন্দে সাজছে!আমার চক্ষু টলমল করে উঠলো।আমি তা লুকালাম দ্রুত।রাইয়ের এমনই আনন্দই আমার কাম্য ছিল।

পরনের লাল শাড়ি,কপালে চন্দন আঁকা,চোখে গাঢ় কাজল,ওষ্ঠে হালকা প্রসাধনীর ছোঁয়া,হাতে শাখা-পলা,সোনার অলংকারে রাই স্বর্গে অবস্থানকারী অপ্সরা মনে হচ্ছিলো।আমি তার নিকটে এসে মিষ্টি স্বরে বলে উঠলাম,

“তোমাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে রাইদি।তোমার হতে চলা বরের কি হাল হবে কে জানে!”

আমার কথায় লাজুক হেসে মাথা নুয়ালো রাই।তার পরপরই কক্ষে প্রবেশ করলেন কাকিমা রা।জানালেন পুরোহিত কনেকে ছাদনা তলায় নিয়ে যেতে বলেছেন।

কনেকে ছাদনা তলায় নিয়ে এসে উপস্থিত হতেই আমার দৃষ্টি এদিক ওদিক বিচরণ করতে লাগলো।উদ্দেশ্য একটাই!আমার পতি পরমেশ্বরকে দৃষ্টিতে বন্দি করা।

ছাদনা তলায় আগে থেকেই বসা ছিল পূর্ণ।রাই মাথা নত রেখেই তার মুখোমুখি দাঁড়ালো।মুখশ্রী ঢেকে রাখা পানের আবরণে।রাইয়ের বিয়ের এই দৃশ্যটা দেখতে দেখতে আমার নিজের বিয়ের মুহুর্তের কথা স্মরণে আসলো।শূন্য মস্তিষ্কে আঁখি মেলে বর বেশে থাকা ধ্রুবর পানে তাকানো।আমার দৃষ্টিতে লজ্জার বদলে কৌতুহল ছিলো বেশি।আর ওনার দৃষ্টিতে?জানা নেই।

ভাবতে ভাবতে অক্ষিপটে ভেসে উঠলো ধ্রুবর প্রতিচ্ছবি।আকাশি রঙের পাঞ্জাবি আর ঘিয়ে রঙের ধুতি ওনার পরনে।আমার ওষ্ঠে আপনা আপনি একটা হাসি ফুটে উঠলো।সাথে সাথে আমার দিকে তাকালেন উনি।থমকে তাকালেন কি?ওনার দৃষ্টি কেন সরছে না?স্থির দাঁড়িয়ে আছেন!

আমি চোখের ইশারায় প্রশ্ন করে উঠলাম।ওনার উত্তর পাওয়ার আগেই উলুধ্বনিতে দৃষ্টি সরলো।দৃষ্টি এসে পৌঁছালো ছাদনা তলায়।বর-কনের শুভদৃষ্টি হচ্ছে।আমি পরম আগ্রহে দৃষ্টি দিলাম সেদিকে।খেয়াল হলো না একজনের স্থির রইলো আমাতে।

মুখশ্রীর সামনে থেকে ধীরে ধীরে পান পাতা সরালো রাই।দৃষ্টি সর্বোচ্চ নত তার।পূর্ণের দিকে তাকাতেই দেখলাম চশমার আড়ালে থাকা তার চক্ষু মুগ্ধ হয়ে অবলোকন করছে রাইকে।আমি মনে মনে তৃপ্ত হয়ে হাসলাম।অবশেষে মেয়েটা পূর্ণ হলো।পূর্ণ নামক পূর্ণতা তার জীবনে এলো।

দেখতে দেখতে সাতপাঁকে বাঁধা পরে গেল দুজন।সিঁদুর দানের মুহুর্তে দুজনকে এত সুন্দর লাগছিলো।আমি ডুব দিলাম অন্য ভাবনায়।পোঁছে গেলাম আমাদের বিয়েতে।আমার সিঁথিতে সিঁদুরসহ ধ্রুবর সাবলীল স্পর্শ!
অনিশ্চিত এক ভবিষ্যৎের প্রত্যাশা নিয়ে এ বাড়িতে প্রথম পা রেখেছিলাম আমি।তবে ভগবানের অশেষ কৃপা।আমার অর্ধাঙ্গ একজন আদর্শ পুরুষ।
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ খেয়াল করলাম কেউ আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে।অন্যমনষ্ক থাকায় খানিক চমকে তাকালাম আমি।পরক্ষনেই হৃদয়ে একরাশ প্রশান্তি এসে জড়ো হলো।কানের কাছে ফিসফিসানো স্বরে একটা বাক্য ভেসে আসলো,

“আজ ওই কমল লোচনে কাজলের স্থান হলো তবে!”

আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম ওনার দিকে।ওনার দৃষ্টি এসে ঠেকলো আমার আঁখিতে।আমার পরনের ঘিয়ে রঙের শাড়ির আঁচল ছুঁয়ে দিলেন উনি।আমি ওনার চোখে সেকেন্ডের ন্যায় চেয়ে বলে উঠলাম,

“ক্ষতি হলো তাতে?”

চোখ সরিয়ে সামনে বিবাহের আসরে তাকাতেই ধ্রুবর গাঢ় স্বরে উচ্চারিত দুটো শব্দ কানে আসলো,

“বিরাট ক্ষতি!”

আমি ওনার দিকে না তাকিয়েই সরু চোখে তাকালাম।মিনিট পরে পাশ ফিরতেই দেখলাম উনি উধাও।ঠোঁট টিপে হেসে ফের আমি সামনে দৃষ্টি দিলাম।চোখের সম্মুখে তখন সিঁদুরে রাখা নববধূ।একটা গাঢ় স্বস্তির শ্বাস নির্গত হলো।চোখ জুড়ে খেলে উঠলো খুশির হাসি।নবদম্পতিকে মনে মনে অনেক শুভকামনা জানিয়ে ঠাঁই দাড়িয়ে তাকিয়ে রইলাম আমি।এভাবেই পূর্ণতা পাক সমস্ত রাইয়ের মনে লুকায়িত প্রেম।স্বর্গীয় আরতি হোক সেই প্রেম নামক হৃদয়ের পবিত্রতার।
.

রাত্রি গভীর হতেই নিজ কক্ষে প্রবেশ করলাম আমি।বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে প্রায় ঘন্টাখানেক হলো।আমি নিভু নিভু প্রদীপের বহ্নি শিখায় উজ্জ্বল কক্ষটায় প্রবেশ করে চেয়ারে বসলাম।ধ্রুবর সাথে যা বিয়ের মণ্ডপে দেখা হয়েছে।তারপর লোকটা গেল কোথায়?আমার চিন্তার মাঝেই একজন এসে বলে গেলো ধ্রুব আমাকে ছাঁদে যেতে বলেছেন।আমি মিনিট সময় নিয়ে কক্ষ থেকে বের হলাম।শাড়ির আঁচল মেঝে ছুঁয়ে ছুয়ে যেতে লাগলো।রাত্রি হওয়ায় মাথায় ঘোমটা দেওয়ার তাগিদ অনুভব করলাম না।ছাদে পৌঁছাতে আমার খুব বেশি সময় লাগলো না।আমি দরজায় পৌঁছে উঁকি দিয়ে তাকালাম।ধীরে ধীরে ছাদের মধ্যিখানে হেঁটে এসে আশেপাশে তাকিয়ে কাঙ্ক্ষিত লোকটার দর্শনের প্রত্যাশা করতে লাগলাম।ঘরে একটা ভ্যাপসা গরম লাগছিলো।এখানে আসার পর কায়াজুড়ে প্রশান্তি অনুভব করলাম যেন।আকাশে চোখ দিতেই দেখলাম প্রায় পূর্ণ চন্দ্র।তবে আজ পূর্ণিমা নয়!

তবুও চারপাশ আলোকিত কোন প্রকার কৃত্রিম আলে ব্যতিত।
মিনিট দুয়েক পরেও ধ্রুবের দেখে না পেয়ে আমি বিভ্রান্ত হলাম।আমাকে আবার ভুল সংবাদ দেওয়া হয়নি তো?

ভাবনার মাঝেই ছাদে ধ্রুবের পদচারণার শব্দ কানে আসলো।আমি চটজলদি পেছন ফিরে তাকালাম।সুদর্শন সেই প্রিয় কায়া দেখে হৃদয়ে প্রশান্তি ফিরলো।ধ্রুব এসে দাড়ালেন আমার সামনে।আমি মিহিস্বরে প্রশ্ন করলাম,

“কি কারণে এখানে ডেকেছেন?”

ধ্রুব হঠাৎ এগোতে লাগলো আমার দিকে।থামার নাম নেই!বরং আমি পিছিয়ে যেতে লাগলাম।একসময় এসে পিঠ ঠেকলো ছাদের বেষ্টনীতে।ধ্রুব একহাত বেষ্টনীতে রেখে আমার দিকে তাকালেন।আমি শুকনো একটা ঢোক গিললাম।করুন দৃষ্টিতে তাকালাম ওনার দিকে উনি হঠাৎ দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন।বললেন,

“চোখে কাজল দেওয়া একদম উচিত হয়নি আপনার।”

ধ্রুবর এই আপনি সম্মোধনে তার হৃদয়ের শতাংশ প্রেম প্রকাশ পায় আমার নিকট।আমি প্রশ্ন ছুঁড়লাম,

“কেন?”

“এখানটায় তীরের তীক্ষ্ণ ফলার ন্যায় আঘাত করে।”

বুকের বাম পাশে চোখ দিয়ে ইশারা করে বোঝালেন উনি।আমি মুখ থেকে হেসে উঠলাম। সামান্য রিনরিনে স্বর হলো তাতে।ধ্রুব তাকালেন গাছ চোখে।আমার হাসি কমলো।হঠাৎ পেছনে রাখা হাতটা সামনে আনলেন উনি।আধফোঁটা একটা পদ্মফুল!আমি বিমুগ্ধ নয়নে তাকালম ওনার দিকে।ধ্রুব চোখের ইশারায় এটা নিতে বললেন।
তারপর মুখ ফুটে বললেন,

“তোমার প্রিয় ফুল!”

আমার ওষ্ঠজুড়ে তখন হাসির রেশ।চোখজুড়ে ওনার প্রতি উথলো পড়া প্রেম।আমি পদ্মটা নিতে নিতে ওনাকে প্রশ্ন করে বসলাম,

“আপনার প্রিয় ফুল কি বলুন তো?”

উনি হঠাৎ আমার নাকে নাক ঘষে বললেন,

“মিসেস ধ্রুব দেবনাথ!”

আমি থমকে,চমকে তাকালাম।ধ্রুবর চোখের দৃষ্টি গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে।আমি সেই সাংঘাতিক গভীর চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে হাতের গোলাপি পদ্মটার দিকে দৃষ্টি দিয়ে হেসে প্রশ্ন করলাম,

“আপনি এত ভালো কেন?”

ধ্রুব আমার এ প্রশ্নের উত্তর দেন না কভু।বিনিময়ে আমাকে উল্টো প্রশ্ন করে বসেন।যেমন আজ বললেন,

“উমম..আমার চক্ষু সম্মুখে পুষ্পহাতে থাকা রমনী এত রুপসী কেন?”

আমি চোখ পাকিয়ে ওনার বুকে আলতে আঘাত করে বসলাম।ধ্রুব আমার দিকে এগিয়ে এলেন অনেকটা।ওনার নিঃশ্বাস আছড়ে পড়তে লাগলো আমার চোখেমুখে।দৃষ্টিতে অন্যকিছু।যেন গাঢ় কোন নেশা ওনাকে আকর্ষণ করছে।ওনার এইরুপ দৃষ্টিতে আমার বুক কাঁপে অনবরত।হৃদপিণ্ডের দশা হয় বেহাল।গলার আওয়াজ বের হতে চায় না।আমি মৃদুস্বরে বলে উঠলাম,

“ধ্রু..ব!”

এতপর আর কিছু বলার সুযোগ পেলাম না আমি।ততক্ষণে আমার ওষ্ঠে চুম্বন করে বসেছেন উনি।আমি চোখ বুঁজে নিতেই সরে গেলেন উনি।ক্রমেই মত হয়ে এলো আমার দৃষ্টি।খোলা আকাশের নিচে এভাবে ওনার আমাকে চুম্বনে লজ্জায় মরে যাওয়ার দশা হচ্ছিলো আমার।আমি নত মস্তকেই মাথা রাখলাম ওনার বুকে।আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আগলে নিলেন ধ্রুব।মাথায় আলতো করে চুমু খেয়ে ফিসফিসয়ে বললেন,

“লাজুক নির্বানী ধ্রুব দেবনাথ!”
.

রাইয়ের বিদায়ের পরদিনই শহরে চলে এসেছিলাম আমরা।অনেকগুলো দিন পর আমাদের ছোট্ট সংসারে পদ রাখা হয়েছিলো।যেখানে আধিপত্য শুধু আমার।ধ্রুবর বাজার করে আনার সময় নিয়ে আসা মিষ্টি দইয়ের দুটো ছোট হাড়িতেই অধিকার আমার।ওনার বইপত্র গুছিয়ে রাখার দায়িত্ব আমার,ওনার পরনের শার্টের ঘ্রাণ নেওয়ার অধিকারও কেবল আমার।আমি সর্বোপরি স্বামীর প্রেমের ছায়াতলে থাকা এক রমনী।আমি বুঝেছিলাম এই কথা চিরন্তর।আমার প্রতি ধ্রুবর প্রেম অক্ষয়,ধ্রুব সত্য।যেমন সত্য ঈশ্বরের অস্তিত্ব!

শহরে আসার পর মাস পেরুতেই আমার কাছে নিকট একটা সংবাদ পাঠানো হলো।দুপুরের স্নান ছেড়ে আমি সবে চুল শুকাতে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি।তখনই দরজায় কড়া নাড়লো কেউ।এই সময়ে কেউ আসেনা।ধ্রুব আসবেন আরেকটু দেরিতে।আমি আধভেজা চুলটা খোঁপা করেই দরজা খুলে দিলাম।অচেনা একজন যুবকের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো অক্ষিপটে।আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,

“কে আপনি?”

প্রশ্নটা করেই আমি ছেলেটার দিকে তাকালাম।শার্ট পরনে ছোটখাটো একজন যুবক।মুখটা ঘেমে একাকার।চোখেমুখে কি এক দুঃশ্চিতার ছাপ।

“এটা ধ্রুবদার বাড়ি?”

আমি মাথা নেড়ে হ্যা বোঝালাম।

“আপনি ওনার স্ত্রী তাইতো?”

“হ্যা।কিন্তু আপনি এসব কেন প্রশ্ন করছেন?”

ছেলেটা একটা রুদ্ধশ্বাস ফেলে বললো,

“ধ্রুবটার এক্সিডেন্ট হয়েছে।হাসপাতালে ভর্তি আছে।এখানের ঠিকানা দিয়ে বললো আপনাকে সাবধানে ওনার কাছে নিয়ে যেতে।”

ছেলেটার সংবাদটা বলার ধরনে আমার বুক কেঁপে উঠলো।ধ্রুবর এক্সিডেন্ট হয়েছে!কিভাবে?
আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে উত্তেজিত হয়ে
বললাম,

“এক্সি..ডেন্ট!কি করে হলো?উনি কোথায়?আমাকে নিয়ে চলুন।”

ছেলেটা আমাকে ওর সাথে যেতে বললো।আমি অশ্রু টলমল চোখে ওর পেছন পেছন চললাম।সিঁড়ি বেয়ে নাৃার সময় অসাবধানে আমার সাথেও দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিলো।সৌভাগ্যবশত আমি পরে যাইনি।আমি নিজেকে সামনে আমার ছেলেটার পেছন পেছন চললাম।কর্ণকুহরে বাজতে লাগলো একটা বাক্য।

“ধ্রুবদার এক্সিডেন্ট হয়েছে!”

চলবে…