আ্যবাকাসের প্রণয়
শেষ পার্ট
লেখক: Borhan uddin
ইদানীং কলি নিজের ভেতরে কিছু পরিবর্তন টের পেতে শুরু করেছে। এই পরিবর্তনের আগুনে দিয়াশলাইর কাঠি হিসেবে অগ্নির সূচনাকারী কাদেরই কি না সেটা নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে কলি না আসতে পারলেও আজকাল মাঝেমধ্যে কলির কাদের সাহেবের কথা মনে পড়ে। কলি আগের চেয়েও নরম হয়েছে ব্যবহারে, কথাবার্তায়। বাবার কথাও খুব মনে পড়তে শুরু করেছে। কোথাও কোনো বাবা মেয়ের খুনসুটি দেখলে সে থমকে দাঁড়াচ্ছে। তীব্র মন খারাপ কিংবা অভিমানের পর বাবা যখন তার মাথায় হাত রাখত সে তখন হাপুসহুপুস করে কেঁদে বাবাকে জড়িয়ে ধরত। আজকাল তার বাবার ঐ হাত দুটোর কথা মনে পড়ে, সমস্ত জেদ মাটি চাপা দিয়ে বাবার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়তে মন চায় যেটা মাসখানেক আগেও তার মনে হয়নি৷
মামিকে একদিন ফোনে জানিয়েছিল বাবার কথা মনে পড়ে৷ মামি তখন প্রশ্নে করেছিল – তোর বাবাকে বলব তোকে ডাকতে?
কলি উত্তর দেয়নি।
এক সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরেই কলি দেখে দরজার বাইরে অনকগুলো জুতো রাখা। বুকটা কেমন করে ওঠে , কারা এলো বাসায়? বেল বাজাতে হলো না, দরজা খোলাই ছিল। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই কলি কেমন অপ্রস্তুত হয়ে যায় তার বাবাকে দেখে। আব্দুল কাদের, মামি, মা আর বাবা এসেছে তার বাসায়। মায়ের সাথে মাঝেসাঝে যোগাযোগ হলেও কলির বাবা একটা মুহূর্তের জন্য মেয়ের সাথে এতদিন যোগাযোগ করেনি। কলি দ্রুত নিজেকে সামলিয়ে নেয়। বাবা তার দুর্বলতার জায়গা বলেই বাবার চোখের দিকে তাকানোর সাহস হয় না। কোনো কথা না বলেই দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে ঢুকে যায় সে।
কলির বাবা খানিক্ষন দ্বিধায় থেকেও নিজের অভিমানের পুরু দেয়াল বেশিক্ষণ আগলে রাখতে পারলেন না। রক্তের টানের এক অদৃশ্য স্রোতে অভিমানের দেয়াল হুড়মুড়িয়ে ভাঙতেই মেয়ের রুমের দিকে পা বাড়াত সে, পেছনে যায় শিউলিটাও।
খাটের ওপর বসে থাকা কলির দিকে এগিয়ে গিয়ে কলির মাথায় হাত রাখতেই কলিয়ে গুঙিয়ে কেঁদে ওঠে। এতদিনে চোখে, মনে জমাট বাঁধা কংক্রিটের আস্তরণ যেন নিমিষেই গলে গেল। ড্রয়িংরুম থেকে বাবা মেয়ের কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বেশি বয়সী অভিমান যখন হুট করে ভেঙে পড়ে তখন এমন শব্দ করেই হুড়মুড়িয়ে ভাঙে। মুহুর্তেই ভেতরে ভেতরে লালন করা দীর্ঘদিনের জমা ক্ষোভ আর অভিমান কোনো এক জাদুবলে নিমিষেই মিটে গেলো।
বাবা মেয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে বললেন, তুমি নিজের ইচ্ছেয় একটা ভুল করেছ, বাবা হিসেবে আমিও একটা ভুল করার অধিকার রাখি। আমার ভুল হিসেবে তুমি কাদেরকে বিয়ে করো মা। সে খুব বড়ো চাকরি করে না তবে তার মন বড়ো। দেখতে সুদর্শন না তবে ব্যক্তিত্ববান, চরিত্রের ব্যাপারে অন্য পুরুষদের মতো উদাসীন না। আমি প্রতিদিন আল্লাহর কাছে চেয়েছি তুমি ভালো একটা সঙ্গী পাও, মনে হচ্ছে আল্লাহ কাদেরকে পাঠিয়েছেন তোমার জন্য।
কলির আজ নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে, চাইলেও মুখের ওপর না বলার যে শক্তি এতদিন তার ভেতরে ছিল সে শক্তিটা হুট করেই উধাও হয়েছে কোথায় যেন৷ কলিকে যেন সম্মোহনী শক্তি দিয়ে বশ করে রেখেছে তার বাবা আফসার হোসেন। কলির হুট করে মনে হলো তার মায়ের কথা।কলি নরম গলায় বলল, মা কী চান?
আফসার হোসেন ধরা গলায় বললেন, তোমার মা আব্দুল কাদেরকে এখনই ছেলের মতো দেখতে শুরু করেছেন।
কলি চোখ মুছতে মুছতে বলল, ঝাল মুরগি আর পাতলা ডাল রান্না করি তোমার জন্য?
আফসার হোসেন নাছোড়বান্দার মতো বললেন, আগে বলো তুমি আমার প্রস্তাবে রাজি কি না?
কলি শিউলিকে বুকের কাছে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে বলল, বিয়ে করা না করা এই দুইয়ের প্রতি আমার কোনো কৌতূহল নেই বাবা। তবে তুমি চাইছো যখন তখন আমি করব৷ তার আগে আমি কাদের সাহেবের সাথে একটু কথা বলতে চাই।
আফসার হোসেন বেশ শান্তি অনুভব করলেন মেয়ের কথা শুনে। শিউলিকে নিয়ে কলির রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে আব্দুল কাদেরকে কলির রুমে পাঠালেন।
কলি একটা চেয়ার টেনে আব্দুল কাদেরকে বসতে দিয়েছে। দুজন চুপ হয়ে আছে। নিরবতা ভেঙে কলি বলল, আপনি কিন্তু জেনেশুনে নিজেকে ঠকাতে চলেছেন কাদের সাহেব। আমি বহুদিন পর আমার বাবাকে পেয়েছি, বাবার সাথে সম্পর্ক জোড়া লাগাতে আপনি আমার কাছে একটা উপায় মাত্র, তাই বাবাকে হ্যাঁ বলেছি আমি। তবে আপনার হাতে এখনো সুযোগ আছে নিজেকে জেনে-বুঝে জলে না ভাসানোর। আপনি যেখানে কোনোরকম হিসেব না করেই আমাকে ভালোবাসতে চাইবেন আমি ঠিক তার উলটো দিকে হাজারবার হিসেব করব আপনাকে ভালোবাসব কি না কিংবা কতটুকু বাসব৷ এই হিসেব কষাকষির মাঝে আপনি ক্লান্ত হয়ে যাবেন, পালাতে চাইবেন। খামাখা নিজেকে নিয়ে কেন বাজি ধরবেন?
আব্দুল কাদের কলির চোখে চোখ রেখে বললেন, আপনি মানুষটা প্রচণ্ড রকমের সৎ। ছলচাতুরী কিংবা ভাণ করে কোনোকিছু অর্জন করতে চান না। আপনার হাতে অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আপনি নিজেকে বিকিয়ে দেননি কোনো কিছুর কাছে। উচিত কথা মুখের উপর বলতে গেলে সাহস থাকতে হয় সেটা আপনার আছে, আর উচিত কথা হজম করতে পাকস্থলী পুরোট হতে হয়, সেটা আমার আছে। আমি কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই আপনাকে চাই। সম্পর্কে সমান সমান থিওরিতে আমি বিশ্বাসী না, পৃথিবীর কোনো সম্পর্কই সমতায় চলে না৷ হোক তা মায়ের সাথে সন্তান কিংবা স্বামীর সাথে স্ত্রীর। একজনকে সবসময়ই বেশি ইফোর্ট দিতে হয়, দিতে হয়েছে, হবেও। আমি সেই বেশিটাই দিতে চায়, পরিণতি নিয়ে ভাবতে চাই না। কারণ ঐ যে ক্যালকুলেশনে আমার আস্থা নেই, আমার আস্থা মানুষের উপর, নিজের উপর।
কলি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সবার জন্য রান্না করব, খেয়ে যাবেন। আর আপনাকে সাবধান করার দায় ছিল আমার, আমি তা পালন করেছি। বাকিটা আপনার নসিবে যা আছে তাই হবে৷
আব্দুল কাদের জবাবে কেবল মৃদু হাসলেন।
কোনো আড়ম্বর ছাড়াই কলি কাদেরের বিয়ে হলো। কলির মেকি, কর্পোরেট হাসি ধীরেধীরে বিলীন হতে শুরু করেছে৷ খুঁটিনাটি বিষয়ে শিউলি, কাদেরের সাথে কলিও প্রাণ খুলে হাসতে শুরু করেছে।
তিনজনের সংসারে প্রাণভোমরা হয়ে উঠেছে আব্দুল কাদের, মা মেয়ে রাত জেগে বসে থাকে খাবার টেবিলে তার অপেক্ষায়, খুঁটিনাটি সব বিষয়েও তার উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে স্বাধীনচেতা কলি। মাঝেমাঝে তার হুশ ফেরে, হুশ ফিরলে সে নিজেকে জিজ্ঞেস করে, আমি কি কাদেরের উপস্থিতিতে নির্ভার নাকি অলস হয়ে উঠেছি? কলি এবার চূড়ান্ত আলসেমি করে উত্তর খোঁজে না।
কাদের না চাইতেও কলি তার শার্ট, প্যান্ট ধুয়ে দেয়, মাঝেমধ্যে জুতাটাও কালি করে রাখে। কাদের মৃদু প্রতিবাদ জানালেও কলি তা কানে তোলে না। অফিসে গেলে আজকাল অস্থির লাগে তার, কখন বাড়ি ফিরবে এই ভাবনায়। কাদেরও ঠিক একইভাবে অস্থির হয়ে ওঠে বাড়ি ফিরতে।
আব্দুল কাদের বেশ প্রশান্তি অনুভব করে, সে মানুষ ঠিকই চিনেছে৷ তাদের স্বামী স্ত্রী সম্পর্কে বেশি যত্নটা কলিই নিচ্ছে। বুকে যারা অসীম প্রেম নিয়ে জন্মায় তারা চাইলেও সে প্রেম লুকিয়ে রাখতে পারে না। এজন্যই কলিরা একটু প্রেমের দেখা পেতেই বুক ঢেলে সমস্ত প্রেম উগড়ে দিতে কার্পণ্য করে না কখনো।
বিয়ের বয়স যেদিন সাত মাসে পা দিলো সেদিন সকালে অফিসের জন্য রেডি হওয়া আব্দুল কাদেরের সামনে কলি প্রেগন্যান্সি কিটটা ধরতেই আব্দুল কাদের উল্লাসে ফেটে পড়লেন, কলিকে বুকে টেনে এলোপাথাড়ি চুমুতে সারা মুখ ভরিয়ে দিয়ে আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ বলে কলিকে ছেড়ে শিউলে কোলে টেনে নিয়ে তাকেও অজস্র চুমু খেলেন। অফিসের কথা বেমালুম ভুলে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, আমি মিষ্টি নিয়ে আসি শিউলি, তোমরা মা মেয়ে মিষ্টি না খেয়ে স্কুলে যাবে না।
কলির গলায় কিছু একটা আটকে গেলো আব্দুল কাদেরের এমন উচ্ছ্বাস দেখে। দ্রুত বাথরুমে ঢুকেই পানির ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল কলি। এই মুহুর্তে কলির চোখের সামনে ভেসে উঠল সেদিনের হাসপাতালের কথা।
তার প্রাক্তন স্বামী মামুনের পরিবার নির্দয়ভাবে শর্ত দিয়েছিল কলিকে হয় আ্যবোরশন করাতে হবে না হয় বাপের বাড়ি চলে যেতে হবে। কলি সেদিন বিস্ময় আর ঘৃণা নিয়ে মামুনের মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমার বাচ্চাটা আপনাদের কি ক্ষতি করবে? কলির মা নির্লিপ্তভাবে বলেছিল, বেকার ছেলে আর ছেলের বউকে বসিয়ে খাওয়াচ্ছি, উটকো ঝামেলা আর নিতে পারব না। মামুনের চাকরিবাকরি হোক তবে বাচ্চা নিও।
কলি টিউশন করে হলেও বাচ্চাটা আনতে চেয়েছিল, মামুনের পরিবার রাজি হয়নি৷
কলি যখন মামুনের মত চেয়েছিল তখন মামুন ঠাণ্ডা গলায় বলেছিল, বাচ্চা আবার হবে, সময় সুযোগ বুঝে বাচ্চা নেয়া যাবে, মা যা বলছে তাই করো। আমি এখন কোনো নতুন বার্ডেন নিতে চাই না।
কলি ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে কেবল ফেলফেল করে চেয়েছিল, প্রেমিকের চোখে কখন সে বার্ডেন হয়ে উঠেছে টেরই পায়নি ভেবে নিজেকে খুব বোকা মনে হচ্ছিল তার।
এরপরেও নানা চেষ্টা করে লাভ হয়নি। একদিন সাহস করে, অন্তত সংসার টিকিয়ে রাখার নেশায় হাসপাতালে একা একা গিয়ে আ্যবোরশন করে এসেছিল সে। মামুন কাজের অযুহাত দিয়ে কলির সাথে হাসপাতাল পর্যন্ত যায়নি। আদর আহ্লাদে আর বাবার ছায়ায় বড়ো হওয়া কলি জীবনের সবচেয়ে ট্র্যাজিডিময় দিনটাতেও তাকে পায়নি যার জন্য সে ঘর ছেড়ে পথে এসে দাঁড়িয়েছিল।
সেদিন হাসপাতালের নার্সগুলা কেমন যেন ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে ছিল তার দিকে। একজন তো বলেই ফেলেছিল, অবৈধ সম্পর্ক জেনেশুনে করার সাহস দেখান, তবে অবৈধ বাচ্চার বেলায় সাহস দেখান না কেন আপনারা?
কলি লজ্জায়, অপমানে কোনো জবাব না দিয়ে কেবল নিরবে চোখের জল ফেলেছিল।
কলি ভেবেছিল আ্যবোরশনের পর ছোটোগল্পর পরিণতির মতোই অত:পর তাহারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল এমন একটা কিছু তার সাথেও হবে। তবে হলো উল্টোটা। একটা সময় পর মামুনের মায়ের হাত উঠতে লাগল কলির উপর, কলি প্রথম দিকে সয়ে গেলেও একদিন প্রতিবাদ করে বসলো। বাসায় গোল টেবিলে সালিশ বসলো, কলি কাউকে সেদিন ছাড় দিলো না। সবার কথার জবাব দিলো। কলির প্রতিবাদ অপমানের মতো লাগলো মামুনের বাবা মায়ের কাছে, মামুন বাবা মায়ের অপমানের শোধ তুলতে কলির গায়ে হাত তুলল, কলির উপর সেদিন কী যেন ভর করেছিল, কলিও জবাবে মামুনের গালে কষে এক চড় বসিয়ে দেয়।
অত:পর কলির ঘোর ভাঙল, বুঝে গেল সংসারে সং সেজে সব হজম করার ধৈর্য তার ফুরিয়ে গেছে, এ আর চলবে না। পরদিন সকালেই কলি সব পিছুটান ফেলে বেরিয়ে এলো মামুনদের বাড়ি থেকে।
বাথরুমের দরজায় নক করছে শিউলি৷ পানির ট্যাপ বন্ধ করতেই শোনা গেল শিউলি বলছে, মা তাড়াতাড়ি বের হও, বাবা দেখো কত মিষ্টি নিয়ে এসেছে।
সমাপ্ত