#মায়াতলীর_মোড়ে – [০৫]
লাবিবা ওয়াহিদ
মাহারিন যে স্পৃহার বাড়িতে ছিল সেটা নাকি মাহারিনের মা স্পৃহার মায়ের থেকে শুনেছে। পথিমধ্যে স্পৃহা মাহারিনকে কল করে তা জানায়। এতে মাহারিনের কিছুই বলার থাকে না। মাহারিন ভেবেছিল বাড়ি ফিরে মায়ের থেকে বেশ বকা খাবে। সেই প্রস্তুতি নিয়েই মূলত ঘরে প্রবেশ করেছে সে। কিন্তু আয়েশা বেগমের তেমন কোনো সাড়াশব্দ নেই। সে নিজের ঘরে নিজের মতো করে পড়ে আছে। মাহারিন ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘর খুঁজতেই দেখল মা রান্নাও বসায়নি। মাহারিন বুঝে গেল আজ ঘরে চুলো জ্বলবে না। আয়েশা প্রায়ই এই কাজ করে। যদি ঘরে কোনো কারণে জটলা বাঁধে তাহলে সে ঘরবন্দী হয়ে বসে থাকে। মায়ের পুরাতন স্বভাব মনে করেই মাহারিন রান্না করতে দাঁড়িয়ে গেল। মাহারিন বরাবরের মতোই ভোজন রসিক, খাবারের প্রতি কখনোই রাগ দেখায় না। তাই মায়ের এই স্বভাবের জন্য তাকে একপ্রকার বাধ্য হয়েই রান্না শিখতে হয়।
মাহারিনের রান্নার সময়েই আয়েশা রুম থেকে বের হলো। ধুপধাপ খাবার টেবিলে কী যেন করে শেষমেষ চিটাইঙ্গা ভাষায় বলল,
–“ছাদত হড় গড়জ্ঞুই, কেই আনন ফইত্তু ন।তোরাত্তে বউত টিয়া, টিয়ার গরম দেহাইয়েনে যেইল্লে মনো হ এল্লে গড়দ্দেনে।”[ছাদে কাপড় গড়াগড়ি খাক, কারো আনা লাগবে না। তোমাদের তো অনেক টাকা, টাকার গরম দেখিয়ে যা খুশি করতেছ।]
আয়েশা বেগম সব কথা ছেড়ে আবারও ঘরের দরজা লাগিয়ে বসে রইলেন। মাহারিন তখন হতভম্ভ হয়ে কিচেনের বাইরে তাকিয়ে। সে চট্টগ্রামের মেয়ে হলেও এই আঞ্চলিক ভাষা এখনো তার বুঝতে সময় লাগে। বলতেও পারে কম। মাহারিনের রাগ হলো। মা তো চাইলেই সাধারণ ভাবেই বলে যেতে পারত ছাদ থেকে কাপড় আনতে হবে। মাহারিন চুলোর আঁচ কমিয়ে দিয়ে ছাদে চলে যায় শুকনো কাপড় আনতে।
রশি থেকে যখন কাপড় নিচ্ছিল, তখনই কই থেকে এক ঢিল এসে পড়ল মাহারিনের পায়ের কাছে। মাহারিন চমকে গিয়ে আশেপাশে তাকাল। দেখল তাদের এপার্টমেন্ট থেকে বেশ কিছুটা দূরে এক বাড়ির ছাদ থেকে একজন ছেলে লুকিয়ে গেল। মাহারিনের এতে চরম রাগ হয়। সে ঢিলটা হাতে নিয়ে তাকাল সেই ছাদে। মাহারিন বাবার রাগ সেই ঢিলের উপর পুরোপুরি ঝেড়ে আবারও সেই ছাদে ফেরত পাঠাল। কিন্তু এতে ঘটনা উলটে যায়। কাকতালীয় ভাবে সেই ছেলে মাথা উঠাতেই সেই ঢিল গিয়ে লাগল তার কপালে। যা মাহারিন চলে আসায় টেরও পেল না।
রাতের বেলা পুরো পরিবার একসাথেই খেতে বসেছে। আয়েশা তখনো গোমড়া মুখে বসে। মোরশেদ সাহেব খেতে খেতে মাহারিনের উদ্দেশে বললেন,
–“বান্ধবীর বাসায় যাবা, সমস্যা নাই। তাই বলে বাসায় বলে যাবা না?”
মাহারিনের মুখে কুলূপ। সহসা বলল না এই ব্যাপারে। কিছুটা নীরবতা পালন করে কী ভেবে বলল, “তাহমিদ সাহেবকে তুমি পাঠিয়েছ স্পৃহার বাড়ি?”
তাহমিদের কথা শুনে আয়েশা বেগম নড়েচড়ে বসলেন। তিনি উৎসুক চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন। মোরশেদ সাহেব খাওয়া বজায় রেখে বললেন,
–“হুঁ। বিয়ের আগে পরিচিত হলে তোমাদের নতুন সম্পর্ক সহজ হবে।”
–“আমি তাহমিদকে বিয়ে করব না বাবা।”
মোরশেদ সাহেব এবার চট করে তাকালেন মেয়ের দিকে। মাহারিনের তেজ এবার কিছুটা দমে এলো। বাবা মিশুক, তা ঠিক। তবে তার সরল চোখের চাহনি মাহারিনকে ভয় পাইয়ে দেয়। যেমন এখন দিচ্ছে। মোরশেদ সাহেব বললেন,
–“তাহলে তাহমিদের চাইতেও ভালো ছেলে আমার সামনে এনে দাঁড় করাও। কথা দিচ্ছি, তোমার পছন্দেই বিয়ে করাব তোমাকে, মা।”
বাবার এরকম এক কথা শুনে দুশ্চিন্তায় মাহারিন সারা ঘরময় পায়চারি করছে। সে কীভাবে কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। বাবার থেকে তো সে চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিল যে তাহমিদের থেকেও ভালো চয়েজ এনে দাঁড় করাবে। কিন্তু এসব কী বললেই হয় নাকি? প্রেমঘটিত ব্যাপারে বরাবরই ফেইল সে। যদিও বা কখনো কখনো প্রেমের ফুল ফুটেছিল মনে, তাও সেসব ছেলেরা প্রেম করা পর্যন্তই। বিয়ে করার মতো যোগ্য তারা নয়। মাহারিনের মাথায় বারবার তাহমিদের চিন্তা মাথায় আসছে। তাহমিদ দেখতে ভালো, প্রফেশনালিও ভালো। আর পরিবারও মোরশেদ সাহেবের পূর্ব পরিচিত। নিঃসন্দেহে মোরশেদ সাহেব মাহারিনের ভালো চাইছে, তাই এরকম এক প্রস্তাব তিনি হাতছাড়া করেননি। কিন্তু মাহারিন তার বাবার প্রতি জমা চাপা রাগের জন্য চাইলেও সোজা ভাবে এই বিয়েতে মত দিচ্ছে না। কারণ বারবার মনে হচ্ছে সে মত দিলেই বাবা-মেয়ের দ্বন্দ্বের মধ্যে সে হেরে যাবে।
মাহারিনের আকাশ-পাতাল ভাবনার মাঝে তাহমিদের মেসেজ এলো। মাহারিন ফোন চেক করল। তাহমিদ লিখেছে,
–“আগামীকাল ফ্রি আছেন?”
মাহারিনের ভ্রু কুচকে যায়। বলল,
–“কেন? নতুন করে জ্বালানোর ফন্দি আঁটছেন?”
পরপর মেসেজ এলো,
–“আমি আর জ্বালালাম কই? আমি তো সারা জীবনের জন্য জ্বলে যাওয়ার পথ ধরেছি। মা বলল আপনাকে নিয়ে শপিং যাবে আগামীকাল বিকালে। সেজন্যই মেসেজ করা।”
মাহারিন চোখ পাকিয়ে তাকাল তাহমিদের মেসেজটার দিকে। নাহ, এই লোক চরম বাজে। এর সাথে সংসার করা যাবে না। মাহারিনেরই একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
মাহারিন নিজেকে সামলে বলল,
–“ঠিক আছে। লোকেশন জানিয়ে দিবেন।”
পরেরদিন শপিং যাওয়ার কথা থাকলেও কোনো এক কারণে শপিং এ যাওয়া ক্যান্সেল হলো। তাহিয়া নাকি ছিল না বাড়ি। সে নাকি ঢাকা গিয়েছে। এতে মাহারিন স্বস্তি পায়। সে ভার্সিটির উদ্দেশে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুদূর যেতেই একটি যুবক তার পথ আগলে দাঁড়াল। মাহারিন ভ্রু কুচকে তাকায় সেই ছেলের দিকে। ছেলেটা সোজা বলল,
–“গতকাল বিকালে আপনি ছাদে ছিলেন?”
–“হ্যাঁ, তো?”
যুবকটি ফুঁসে উঠে বলল,
–“আপনি জানেন আপনি কী করেছেন?”
–“কী?”
–“আপনি আমার ছোটো ভাইয়ের মাথা ফাটিয়েছেন। তার মাথায় এখন ব্যান্ডেজ বাঁধা।”
মাহারিনের হঠাৎ গতকালকের কথা মনে পড়ল। মাহারিন এতে করে যুবকের উদ্দেশে বলল,
–“আপনার ভাই কী করেছে সেটা শুনবেন না?”
থতমত খায় যুবকটি। তবে সে নিজেকে সামলে বলল,
–“যাই করুক, আপনি মাথা ফাটাবেন কেন?”
–“আপনার ভাই কোথায়? আমায় নিয়ে চলুন তার কাছে।”
যুবকটি তাই করল৷ মাহারিনকে নিয়ে যায় নিজের বাড়ি। মাহারিনের পরিচিত সেই ঢিল মারা ছেলেটির মা। এজন্য ভদ্রমহিলা সহসা হাসি-মুখে বসতে বললেন মাহারিনকে। মাহারিন সৌজন্যতা বজায় রেখে কিছুটা কুশল বিনিময় করল। পরপরই খুলে বলতে লাগল তার ছোটো ছেলের কীর্তি। ছেলেটার নাম ইব্রাহিম। এবার ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। ইব্রাহিমের তাদের ছাদে ঢিল মারার স্বভাব আছে। তবে এই স্বভাবটা তুলির জন্য। এই ইব্রাহিম তুলিকে পছন্দ করে। তুলি প্রায় সময়ই ছাদে উঠে। ইব্রাহিম সেই পায়তারা করে ঢিল মেরে নিজের উপস্থিতি জানান দিত। একসময় ইব্রাহিম ঢিলের সাথে একটা কাগজ পাঠায় তুলির জন্য লাভ লেটার হিসেবে। সেটা আবার বর্ষার হাতে পড়ে যায়। বর্ষা সোজা মাহারিনের হাতেই ধরিয়ে দেয়। মাহারিন এর সুরাহা করবে করবে করে আর করতেই পারেনি, বিয়ের প্যাচে পড়ে যাওয়ায়। এখন যেহেতু সুযোগ পেয়েছে মাহারিন সব ঝড়ঝড় করে জানিয়ে দিল। সব শুনে ইব্রাহিমের মা হতবাক। মাহারিন সব বলা শেষে বলল,
–“আন্টি দেখেন, ইব্রাহিমের মাথায় ঢিল লাগাটা এক্সিডেন্ট ছিল.. তার জন্য আমি দুঃখিত। তবে ইব্রাহিমকে একটু বোঝাবেন। মাত্র ওদের বয়সটা শুরু, এখনো অনেক দূর এগোতে হবে। তাই আমার বোনের আশেপাশে যাতে ওকে না দেখি সেটা খেয়াল রাখবেন। আপনাকে সম্মান করি বলেই আপনাকেই বলে গেলাম। আসি আন্টি।”
বলেই মাহারিন বিদায় নিয়ে চলে যায়। ভদ্রমহিলা কিছুটা আহত হন ছেলের এসব কাণ্ড শুনে। তবে ইব্রাহিমের মা ছোটো ছেলেকে আগে না ধরে বড়ো ছেলের মাথায় চাটি মারে। শায়ন এতে মাকে বলল,
–“মা! আমাকে মারছ কেন?”
–“ছোটোটায় এসব করে বেড়ায় তুই দেখিস নাই এতদিন? তুই ওই কম্পিউটার ছাড়া আর কী বুঝোস? ছোটোটার আগে তো তোকে ধরে পেটানো উচিত। ফাজিল! জানিস এই মেয়ে কার মেয়ে? পুলিশের মেয়ে। পুলিশদের বাড়ির মেয়ের পিছে এসব কী বাঁদরামি করে বেড়াইছে সে?”
শায়নের মুখে কোনো কথা নেই। সে জানত ওই বাড়ির মালিক পুলিশ। কিন্তু ইব্রাহিম এতদিন পুলিশের মেয়েদের পিছে পড়ে ছিল জানত না। রাগ এবার তার নিজেরও লাগছে। মা চলে গেলে শায়ন মাহারিনের কথা ভেবে আপনমনেই বলল,
–“ইন্টারেস্টিং।”
বিকালে মাহারিন যখন ফিরছিল শায়ন আবারও মাহারিনের পথ আগলে দাঁড়াল। মাহারিন এতে ভীষণরকম বিরক্ত হয়। বলল,
–“আপনার ভাইয়ের মাথা কী বেশি ফেটেছে? নাকি আপনার স্বভাব মেয়েদের পথ আগলে দাঁড়ানো?”
শায়ন এতে হেসে বলল,
–“আপনার তেজ আমার ভালো লেগেছে। তাই পরিচিত হতে ইচ্ছে হলো।”
মাহারিনের বিরক্তির মাত্রা যেন আরও বাড়ল। শায়ন নিজে নিজেই বলল,
–“আমার নাম শায়ন। এবার অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ছি। আপনি নিশ্চয়ই অনার্স ফার্স্ট বা সেকেন্ডে আছেন?”
মাহারিনের এই পর্যায়ে এসে না চাইতেও হাসি পেল। মানুষ মাহারিনকে বাহিক্য ভাবে দেখে এই একটা দিকেই ভুল করে বসে। মাহারিন হেসে বলল,
–“আমি মাস্টার্সের ছাত্রী ছোটো ভাইয়া। আপনার ভাইয়ের মাথা বেশি ফাটলে আমাকে বলবেন, আমার উড বি অর্থোপিডিক্স। তার সাথে দেখা করিয়ে আনবেন। আর হ্যাঁ, আপনার সেই হাঁটুর বয়সী ভাইকে সাবধানে রাখবেন। আমার বোনের আশেপাশে দেখলে পরেরবার হাতও ভেঙে দিব।”
শায়ন বোধ হয় কিছুটা আহত হয় মাহারিনের কথা শুনে। মাহারিন কি না তার বড়ো? আবার মাহারিনের বিয়েও ঠিক? শায়ন কই ভাবল পুলিশের মেয়ের সাথে প্রেম করে বন্ধুদের সামনে নিজেকে বড়ো দাবি করবে। সব পরিকল্পনায় যেন মুহূর্তেই জল পড়ে গেল। মাহারিন শায়নের পাশ কেটে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। বাড়ির কাছাকাছি যেতে যেতে মাহারিনের মনটা আবারও বিষিয়ে গেল। সে কেন ফট করে তাহমিদকে উড বি হিসেবে পরিচয় দিল? না দিলেও তো পারত। এভাবে চলতে থাকলে যে মাহারিনের কপালে কেউ-ই জুটবে না। কী করবে এখন সে? প্রেম করার বয়স তো তার পেরিয়ে গেছে। সময়ও হাতে কম। মাহারিন আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে বাসায় চলে গেল।
———————–
মাহারিনের হাতে একটি ঘুমের ট্যাবলেটের পাতা। সঙ্গে জ্বলজ্বল করছে হাতের অনামিকাতে তাহমিদের মায়ের দেওয়া আংটিটা। একটু আগেই আয়েশা বেগম তাকে পরিয়ে দিয়ে গেছেন।মাহহারিন যতবার এই আংটিটা খুলেছে ততবারই আয়েশা বেগম তা পরিয়ে দিয়েছেন মেয়ের হাতে। একে তো তাহমিদের ত্যাড়াব্যাকা রূপ, তার উপর বাসার কেউ যেন থামছেই না। এছাড়াও একজন তার মনের মতো হয়েছিল। ছেলেটার সাথে দুইদিন আগে পরিচয়, এক বান্ধবীর ভাই হয়। বেকার, পরিবারের অবস্থানও ভালো। মাহারিনকে সে প্রপোজ করল। মাহারিন প্রেম করবে না সাফ জানিয়ে দেয়, মাহারিন এও বলল ছেলেটাকে মাহারিনের বাবার সঙ্গে দেখা করতে। তার বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে। ছেলেটা এক বাক্যে রাজি। মাহারিন এতে হাসলেও মনের মধ্যে তার শঙ্কা। তবুও শঙ্কা পাশে রেখে সে একেই বাবার সামনে দাঁড় করাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। দুইদিন টুকটাক কথা হয় তাদের মাঝে। হুট করে ছেলেটা বাহানা দিতে শুরু করে। মোটকথা সেই ছেলে মাহারিনের বাবার সাথে দেখা করবে না। এতে মাহারিন রাগের চটে ছেলেটার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দেয়। মনে মনে বকে, কাপুরুষের দল।
মাহারিনকে এবার কোনো বাঁধা দেয়নি মোরশেদ সাহেব। তবুও মাহারিনের এবারের ইচ্ছেটাও ভঙ্গুর হলো। এখন মাহারিন যেহেতু পছন্দের পাত্র বাবার সামনে এনে দাঁড় করাতে পারেনি সেহেতু এই বিয়ে তো যেকোনো মূল্যে হবেই। আজ রাতে মাহারিনের দুশ্চিন্তায় ঘুম হবে না যেন। সবকিছু ভেবে-চিন্তে সে ঘুমের ট্যাবলেটটা হাতে নিয়েছে। সব খাবে না, একটাই খাবে। ফার্মেসী থেকে সংরক্ষণ করা যেন কষ্টসাধ্য ছিল। তবুও পরিচিত একজনের সাহায্যে নিতে পেরেছে। মাহারিন একটা ট্যাবলেট খেল। কিন্তু দশ মিনিট পার হলেও ঘুম ধরা দিচ্ছে না। রাগে অন্ধ হয়ে মাহারিন আরও দুইটা ঘুমের ওষুধ একসাথে খেয়ে বিছানায় টানটান করে শুয়ে পড়ে। ঘুমানোর আগে অবশ্যই ট্যাবলেটটা লুকিয়ে রেখেছে।
মাহারিন এক নজরে সিলিং এর দিকে চেয়ে রইলো, ঘুমের অপেক্ষায়। কানে ভাসছে তাহমিদের বিরক্তিকর কথাগুলো। আগের যুদ্ধটা ছিল বাবার সঙ্গে। অনাকাঙ্ক্ষিত এই যুদ্ধটা এবার তাহমিদের সাথেও করতে হবে। তাহমিদ কেন তার পেছনেই পড়ে রইলো? আকাশ পাতাল ভাবার সুযোগ পেল না মাহারিন। ঘুমের দাপটে চোখ বুজে আসে খুব দ্রুত।
যখন চোখ মেলে তাকায়, তখন সে হসপিটালের বেডে। চট করে উঠে বসতে গিয়েও পারলো না। মাথা ঝিমঝিম করছে, ভার হয়ে আছে। যেন মস্ত বড়ো এক পাথর মাথার উপর চেপে দেওয়া হয়েছে। প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে না পারলেও ধীরে ধীরে সবকিছু মনে পড়ে তার। কয়টা বাজে মাহারিন সেটাও জানে না। আশেপাশে তাকাতেই সে দেখল আয়েশা বেগম শুকনো মুখে দূরের এক সোফায় বসে আছে। মিনমিন করে তসবিহ পাঠ করছেন তিনি। হাতের তসবিহটাও নজরে এলো তার। মাহারিন অধর নাড়িয়ে ডাকল মাকে। আয়েশা চমকে তাকাল মাহারিনের দিকে। মাহারিনের জ্ঞান ফিরেছে দেখে তিনি সহসা উঠে আসলেন মেয়ের কাছে। চোখ-মুখে রাগ ফুটিয়ে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিলেন মাহারিনের কাঁধে। মাহারিন ক্যানেল লাগানো হাতে কাঁধ ধরে অস্ফুট স্বরে বলল,
–“আহ, মা। আমি বড়ো হয়ে গেছি, এখনো এভাবে মারো কেন?”
আয়েশা বেগমের সবসময়ই মুখের চাইতে হাত চলে বেশি। সে ধপাধপ মাহারিনের পিঠে, কাঁধে, মাথায় লাগিয়ে দেন। মেয়ে বড়ো হয়েছে তো কী হয়েছে, বুদ্ধি তো এখনো হাঁটুতেই পড়ে আছে। আয়েশা চেঁচিয়ে বললেন,
–“কচুর বড়ো হয়েছিস তুই! এত বড়ো হলে এই ধরণের বোকামী মানুষ করে? কাণ্ডজ্ঞান নেই? নাকে এত রাগ কেন? নাক একদম কেটে দিব তোর। বেয়াদব মেয়ে! জানিস কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম?”
মাহারিনের মুখ ছোটো হয়ে যায় মায়ের কথা শুনে। সে এখন অনুধাবন করতে পারছে সে কী বোকামীটা করে বসেছে। ঘুমের ওষুধ একটার বদলে খেয়েছে তিনটা। আয়েশা আবার ধমকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
–“কেন খেয়েছিস এতগুলো ঘুমের ওষুধ?”
মাহারিন বাচ্চাদের মতো মুখ বলে বলল,
–“এতগুলো কোথায়? মাত্র তিনটা।”
–“তিনটা কম লাগে? বিয়ে করবি না ভালো কথা, এ বলে জান দিয়ে দিবি? আমাদের প্রতি কোনো মায়া দয়া নেই?”
মাহারিন এবার বিরক্তির স্বরে বলল,
–“ধুর মা। জান কেন দিতে যাব? ঘুম আসছিল না বলে খেয়েছি।”
আয়েশা বেগম চোখ রাঙালেন মেয়েকে। তিনি ভেবেই হতভম্ভ হয়ে যাচ্ছেন। মাস্টার্স পড়ুয়া মেয়ে কী করে এই ধরণের অকাজ করতে পারে? মেয়েটাকে ম্যাচিওর ভেবেছিল। মেয়েটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে এত রাগ? আয়েশা বেগম এবার তেজী কণ্ঠে বললেন,
–“বিয়ের আগ অবধি তোর বাইরে টো টো একদম বন্ধ। খুব মাথায় তুলেছি। এবার তাহমিদই তোকে সোজা করবে।”
আবারও তাহমিদ! মাহারিন এবার উঠার চেষ্টা করে বলল, “বিয়ের কথা বললে আরও তিনটা ওষুধ খাব আম্মা।”
আয়েশা বেগম মাহারিনের মাথায় আরেক চড় দিয়ে দিলেন। মাহারিনের এতে ঘাড়ের রগ টান খেল। ইস, কী অসহ্যকর ব্যথা। অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, “ওহ মা।”
–“এবার ঘুমের ট্যাবলেট তুই কই পাস আমিও দেখব। একদম ঠ্যাং ভেঙে ঘরে বসিয়ে দিব। ভুলে যাস না তুই পুলিশ অফিসারের মেয়ে হলে আমিও পুলিশ অফিসারের বউ।”
চলবে—