#মায়াতলীর_মোড়ে – [০৯]
লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
রাইমার ভাগ্য আজ সহায় ছিল। মোর্শেদ সাহেব অন্যমনস্ক থাকায় রাইমার কথা কিংবা ফোনের ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি। মোর্শেদ সাহেব অল্প করে কিছু প্রশ্ন করেই চলে গেলেন। এতে রাইমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে নিলেও তা গলা অবধি আটকে যায়। সামনে মাহারিন বসে আছে, নজর তার এখনো তীক্ষ্ণ। রাইমা হালকা করে ঢোক গিলে কিছু বলার প্রস্তুতি নিতেই মাহারিন বলল,
–“মিথ্যে বাহানা দিয়ে লাভ নেই। আমি কানে কম শুনি না।”
রাইমার মুখখানা লজ্জায় ছোটো হয়ে যায়। মাহারিন চুমুর শব্দ শুনেছে। গা ঘিনঘিন করে ওঠে মাহারিনের। প্রেম করছে, বিয়ে তো করেনি। এভাবে কেউ করে? ভাগ্যিস মোর্শেদ সাহেব কিছু বুঝতে পারেননি। রাইমা তৎক্ষনাৎ মাহারিনের পায়ের কাছে বসে পড়ে। মাহারিন চমকে নিজের পা জোড়া চেয়ারের উপর তুলে নেয়। চোখ রাঙিয়ে বলল,
–“হচ্ছে কী রাইমা?”
রাইমা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
–“প্লিজ আপু, কাউকে কিছু বলিও না। মাকে তো একদমই না। দোহাই লাগে, ওকে আমি খুব ভালোবাসি। মাকে এখন জানালে মা আমাকে মেরে দিবে একদম। প্লিজ আপু শোনো, প্রেমে কী কেউ বুঝেশুনে পড়ে?”
রাইমার বিরতিহীন কথায় মাহারিন বিরক্ত হলো। বলল,
–“হয়েছে, ওঠ এখন। বলব না কাউকে।”
রাইমা স্বস্তি পেল। ফট করে উঠে মাহারিনের পাশের চেয়ারটাতে আয়েশ করে বসলো। মাহারিন নাক কুচকে বলল,
–“এ তোদের কিসের প্রেম রাইমা? মানে, ফোনের ওপাশ থেকে..”
রাইমা মাহারিনের মুখ-ভঙ্গি দেখে হো হো করে হেসে উঠলো। রাইমা বরাবরের মতোই ঠোঁটকাঁটা স্বভাবের। কিছু মুখে আটকায় না তার। তার উপর মাহারিনের বিয়ে, তাকে তো না ক্ষেপিয়ে ছাড়বে না সে। রাইমা বলল,
–“চুমু দিচ্ছিল আমাকে, রাগ ভাঙিয়েছি বলে। কালকে তো তোমারও বিয়ে, দুলাভাই তো তোমাকে চুমু খাওয়ার সার্টিফিকেট পেয়ে যাচ্ছে।”
মাহারিন ক্ষেপে গিয়ে রাইমার কাঁধে শক্ত কিল দিলো। রাইমা এতে ব্যথা পেয়ে বলল,
–“সত্য কথা বললে মারো কেন?”
–“দুইদিনের মেয়ে প্রেম করছিস, এখন আবার অসভ্যের মতো বাজে বলছিস। তোকে কী জড়িয়ে ধরা উচিত ছিল?”
রাইমা বেশ ভাব নিয়ে বলল,
–“তাও তো করছি, তুমি তো তাও করতে পারোনি। এজন্যই বিয়ের জন্য তোমাকে ট্রেনিং দিচ্ছি।”
মাহারিন আবারও নাক কুচকালো। বলল,
–“তোর এসব ফালতু ট্রেনিং এর দরকার নেই। তোর মতো ফালতু প্রেমও করার ইচ্ছে ছিল না কখনো। ছেলেটাকে বল দ্রুত বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দিতে। নয়তো আমি যেকোনো সময়ই মামীকে জানিয়ে দিব।”
রাইমা চমকে যায়। কিছুটা ভয় পেয়ে চটপট মাথা নাড়িয়ে বলল,
–“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।”
–“কোন ক্লাসে পড়ছে ছেলেটা?”
–“ফাইনাল.. অনার্স ফাইনালে।”
মাহারিন অদূরে চেয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল।
–“আমার ছোটো।”
–“বয়সের দিক থেকে বড়ো হতে পারে, তবে স্টাডিসে জুনিয়র।”
মাহারিন নীরব হয়ে গেল হঠাৎ। মাথায় বাবার বলা কথাগুলি একে একে হানা দিচ্ছে। রাইমা এবার মাহারিনের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,
–“আচ্ছা আপু, শোনো!”
–“হুঁ?”
–“দুলাভাই চুমু দিলে ফার্স্ট এক্সপেরিয়েন্সের কথা আমাকে জানিও। আমি তোমাকে হেল্প করতে সদা প্রস্তুত। শিহাবও যখন আমায় কিস করলো..”
রাইমা আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না। মাহারিন উঠে দাঁড়িয়ে হাতে চেয়ার তুলে নিয়েছে। চোখ থেকে যেন চুইয়ে চুইয়ে রাগ বেরুচ্ছে। এবার রাইমা সত্যি ভয় পেয়ে গেল। মাহারিন চেয়ার ছুঁড়ে মারার আগেই রাইমা বারান্দা ছাড়ল! রাইমা যেতেই শব্দ করে মাহারিন চেয়ারটা নামালো। এত সিরিয়াস মুহূর্তে আজেবাজে বকে কানটা গরম করে দিয়ে গেছে। মাহারিন ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। বাবার কথা ভাবার বদলে কানে রাইমার উলটো পালটা কথা ধাক্কা দিচ্ছে। মাহারিন কপালে হাত চেপে আপনমনেই আওড়াল,
–“উফ, এই মেয়েটা!”
অর্ধেক রাত মাহারিনের ঘুম হলো না। যত সময় এগোচ্ছে তত তার ভেতরকার অস্থিরতা বাড়ছে, অস্বাভাবিক নার্ভাসনেসে জড়িয়ে যাচ্ছে। এরকমটা কী প্রত্যেক মেয়ের বেলাতেই হয়? মাহারিনের মতো কনফিডেন্টে ভরপুর মেয়েরাও বুঝি বিয়ের ক্ষেত্রে নাজুক বনে যায়?
মাহারিন প্রায় সারা রাত এপাশ ওপাশ করলো। শেষ রাতে গিয়ে ঘুমালো। পরেরদিন খুব ভোর থেকেই একেকজনের ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। মাহারিন জেদ চেপে বিছানাতেই লেপ্টে রইলো সাড়ে নয়টা অবধি। এরপর সবার ডাকাডাকিতে তাকে উঠতেই হলো। আকদের অনুষ্ঠান বিকাল থেকে। মাহারিনকে কোনোরকমে খাইয়েই রেডি করাতে হবে। মাহারিন অল্প করে খাওয়ার সুযোগ পেল। খাওয়া শেষ হতে না হতেই গোসলে ঢুকতে হলো তার। গোসল শেষ করে বের হতেই দেখলো পার্লারের তিন জন মেয়ে এসে হাজির। ওরাই আজ মাহারিনকে সাজাবে।
দীর্ঘ চার ঘণ্টার যুদ্ধের পর অবশেষে মাহারিনের মেকওভার শেষ হয়। এখন দুপুর আড়াইটা। সাদা রঙের মধ্যে অফয়েড কালার গাউন। গাউনের ওড়নাটা মাথায় সেট করে দেওয়া। খুবই হালকা জুয়েলারি, গলার সাদা অলংকার বেশি বড়ো নয়। মাহারিন আয়নায় অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে আছে। বউ রূপে মাহারিন, নিজেকেই যেন চিনতে পারছে না সে। ব্রাইডাল মেকওভারই এমন, নিজেকেই চেনা যায় না। এটা প্রত্যেক ব্রাইডদের ক্ষেত্রেই। বিয়েতে যেন তাদের মুখজুড়ে আলাদা লাবণ্য থাকে, যা ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে।
বর্ষা, তুলি ওরাও একজন মেয়ের থেকে সেজেছে। ওদের সাজ হয়েছে আগেই। দুই বোন মাহারিনকে অবাক চোখে দেখছে। তুলি তো বলেই বসলো,
–“তুমি কী সত্যিই মাহারিন আপু?”
রুম জুড়ে তখন হাসির শব্দ। হাসি কোনো রকমে থামিয়ে রুহি বলল,
–“আজ ভাইয়ার তো চোখই সরবে না। এক হাতে বউকে কেমনে সামলাবে সে?”
রাইমা সেই সুরে সুর মিলিয়ে বলল,
–“আসলেই তো চিন্তার ব্যাপার। মাহারিন আপু যেই মেয়ে, ভাইয়ার অন্য হাতটাও গলায় ধরিয়ে দিতে পারে।”
মাহারিন গরম চোখে তাকালো ওদের দিকে। বর্ষা সেই রাগ দেখে হাসতে হাসতে বলল,
–“তোমাকে রাগলেও সুন্দর লাগছে আপু। একদম বউ।”
বর্ষার মুখে “বউ” শব্দটি শুনতেই মাহারিনের ভেতরটা আবারও ধ্ক করে উঠলো। সে বউ হবে, তাহমিদের বউ।
আধঘণ্টার মধ্যেই মোর্শেদ সাহেব রুমে আসলেন। মেয়ের সাথে একা সময় কাটাতে চান বলতেই কেউই ঘরে থাকলো না, বাবা-মেয়েকে স্পেস দিয়ে চলে যায়। মোর্শেদ সাহেব তখন প্রাণ জুড়িয়ে একমাত্র মেয়েকে দেখছেন। তার মেয়েটা এমনিতেই মাশাআল্লাহ্ রূপবতী। এই রূপে মেয়ের দিক থেকে চোখই যেন সরছে না। মাহারিনের এই রূপে বাবার সামনে কেমন অদ্ভুত লাগছে, মাথাই তুলতে পারছে না। তা দেখে মুচকি হাসলেন মোর্শেদ সাহেব। মেয়ের মুখোমুখি বসে বললেন,
–“মা-শা-আল্লাহ্, আমার মেয়েটা। কারো নজর না লাগুক।”
মাহারিন নিশ্চুপ। মোর্শেদ সাহেব বললেন,
–“বাবার উপর এখনো রাগ করে আছ?”
মাহারিন ডানে-বামে মাথা নাড়ায়। কিছুটা ভারমুক্ত হন মোর্শেদ সাহেব। পরপর আবার বললেন,
–“বউ হয়ে যেহেতু বসেছই, সেহেতু তুমি বিয়েতে রাজি? রাজি না হলে যে আমার মেয়ে কখনোই এভাবে বউ সাজতে বসত না। কী মা? আমি কী ঠিক ধরেছি?”
মাহারিন হালকা করে হাসার চেষ্টা করলো। নজর নত করেই লম্বা এক নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
–“তোমার চয়েজে আমার কোনো সন্দেহ নেই। তাহমিদ সাহেব একটু ত্যাড়া মানুষ হলেও, ওনার পরিবার ভালো। সেই পরিবারটাকে ভালো লেগেছে বলেই হয়তো না করিনি।”
–“কিন্তু আসল যে তাহমিদ। আমি যতদূর জানি, তাহমিদ অত্যন্ত ভালো, ম্যাচিওর। এজন্যই আমার ওকে পছন্দ করা। যাক, ওটা তোমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে যাই হোক, তুমি রাজি হয়েছ এতেই আলহামদুলিল্লাহ।”
মোর্শেদ সাহেব চুপ করে রইলেন। কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না, কিছুক্ষণ বাদেই মেয়েটা আরেকজনের নামে হয়ে যাবে। এই মুহূর্তে কী বলা যায় মেয়েকে, তা মোর্শেদ সাহেব ভেবে পাচ্ছেন না। কিছুটা সময় অতিবাহিত হতেই মোর্শেদ সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। মেয়ের মাথায় অত্যন্তি স্নেহের সাথে হাত রাখলেন। তৎক্ষণাৎ শক্ত মাহারিনের কী যেন হলো, তার গলায় কান্না দলা পাকাতে লাগলো, চোখ ঝাপটে অশ্রু হানা দিতে চাইলো। নিজেকে সামলেও বিশেষ কাজ হলো না, হালকা ঝাপসা হয়ে এলো তার চোখ। মোর্শেদ সাহেব বললেন,
–“আমার মা-টা যেখানেই থাকুক.. সুস্থ, হাস্যোজ্জ্বল থাকুক। তুমি নিজেও জানো না, তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি মা। যেকোনো প্রয়োজনে সবসময় আমাকে সঙ্গে পাবে। ভেবো না, বিয়ে দিয়ে পর করে দিচ্ছি। বরং আল্লাহর হুকুম পালন করছি।”
বিকাল চারটা নাগাদ বরপক্ষ চলে এসেছে। মাহারিনের আত্নীয়-স্বজনদের মধ্যে চাপা গুঞ্জন। ছেলে হাড়ের ডাক্তার, অথচ সে নাকি হাত ভাঙা অবস্থায় বিয়ে করতে এসেছে। অনেকেই হাসছে, মশকরা করছে আবার অনেকেই ভ্রু কুচকে দেখছে তাকে। তাহমিদের গায়ে মেরুন রঙের পাঞ্জাবি, যেটা নিয়ে মাহারিনকে ক্ষেপিয়েছিল সে। সাদা পাজামার সাথে পাঞ্জাবিতে তাহমিদকে চমৎকার লাগছে। তাহমিদদের গেট ধরেছে মাহারিনের কাজিনরা। কিছু দিয়েই তবে তারা ঢুকতে পারবে। শেষে দিয়ে তারা তাহমিদের ভাই, বন্ধুদের সাথে কথা-কাটাকাটি করে কিছু দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। ভেতরে বসে হালকা কিছু আপ্যায়ন করা হলো তাদেরকে। হালকা অবশ্য নয়, শুকনো খাবারেই বিরাট আয়োজন। হরেক রকমের পিঠা, মিষ্টি, সরবত-মিষ্টি, ফলমূলসহ আরও কিছু আইটেম। বাকি খাওয়া-দাওয়ার পর্ব বিয়ের পর। আপ্যায়ন শেষ হতেই মুরুব্বিরা বিয়ে পড়ানোর ব্যাপারটা বললেন। অতঃপর সবার সম্মতিতেই তাহমিদকে এক আসনে বসানো হলো। তার সম্মুখেই ফুল এবং সাদা নেট কাপড়ে সাজানো পর্দা। পর্দার ওপার আরেকজনের বসার স্থান, যেখানে বসবে মাহারিন। তাহমিদ হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে ফেলল। সে নিজেও কিছুটা বিব্রত। পুরো পথজুড়ে বন্ধুরা কম ঠাট্টা, মশকরা করেনি।
তুলিসহ দুইজন গেল মাহারিনকে আনতে। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হবার পরেও ওরা আসলো না। আয়েশা নিজে মেয়ের ঘরের দিকে যেতে নিতেই তুলি হন্তদন্ত হয়ে ফিরলো সবার মাঝে। হাঁপাতে হাঁপাতে বেশ উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
–“আপুকে রুমে পাওয়া যাচ্ছে না, মনে হয় পালিয়েছে।”
চলবে—