মায়াতলীর মোড়ে পর্ব-১০

0
32

#মায়াতলীর_মোড়ে – [১০]
লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]

–“আপুকে রুমে পাওয়া যাচ্ছে না, মনে হয় পালিয়েছে।”

তুলির মুখে এরকম একটি কথা শুনে উপস্থিত সকলে চমকে যায়। চমকের বেশি মাত্রা মুখে ফুটলো মাহারিনের পরিবারের। তাহমিদের মুখজুড়েও বিস্ময়ভাব স্পষ্ট। চাপা গুঞ্জন, অস্থিরতার মাঝে হঠাৎ-ই মাহারিন এলো, বউ বেশে। সবাই যেন ভূতের মতো চমকে যায় মাহারিনকে দেখে। তাকে দেখতে পেতেই সবাই বাক্যহারা হয়ে পড়ল। সকলের এমন অদ্ভুত নজরে মাহারিন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়, এমন পরিস্থিতিতে সে বেকুব বনে যায়। কী হয়েছে, কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। হ্যাঁ, সে বউ.. তাকে সবাই দেখবে তাই স্বাভাবিক। কিন্তু আজ যে সবার চোখের ভাষা ভিন্ন।

তুলি মাহারিনকে দেখে বলে ওঠে,
–“তুমি পালাওনি আপু?”

মাহারিন হতভম্ভ। অস্ফুট স্বরে শুধায়, “আমি?”
পরপরই মাহারিনের সাথে এসে দাঁড়ায় স্পৃহা, আর তারই পিছু পিছু একজন ক্যামেরাম্যান। স্পৃহাও সবার মতগতি কিছু বুঝতে পারলো না। সবার মাঝে মোর্শেদ সাহেব এবার মুখ খুললেন। গম্ভীর গলায় বললেন,
–“কোথায় ছিলে তোমরা?”

স্পৃহা বলল, “আমরা তো ছাদে গিয়েছিলাম আঙ্কেল, মাহারিনের কিছু ফটোশুটের জন্য। কেন আঙ্কেল? কিছু হয়েছে?”

কম-বেশি সকলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তবে কঠিন বকা খেলো তুলি। কথায় আছে না, ছোটো মানুষ বুঝে কম, বলে বেশি? ব্যাপারটা সেরকমই হয়ে যায় এই বিয়ে বাড়িতে। চাচী তো তুলির কান একদম মলে দিয়ে বলল,
–“বেকুব মেয়ে কোথাকার! এভাবে না বুঝে কথা বলিস কেন যেখানে সেখানে? আজ তুই শুধু বাসায় চল, তোকে আমি দেখছি।”

তুলির মুখটা অপমানে চুপসে গেল। এতগুলো মানুষের সামনে মা তার সম্মানহানি করে দিলো। তুলিরই বা দোষ কিসে? মাহারিন যেভাবে বিয়ে করবে না বলে বলে যা করেছে, তাতে মাহারিনের রুমে না থাকাতে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবাটাই স্বাভাবিক।

এই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে মাহারিন মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে ফুলের পর্দার অপরপাশে বসলো। পাত্র-পাত্রী এক পলক নিজেদের দেখে নেয়। কাজীর ততক্ষণে বিস্তারিত লেখা শেষ। এখন সে বড়োদের অনুমতিতে বিয়ে পড়ানো শুরু করেছেন। শুরুটা বিব্রতকর হলেও এবার মাহারিনের হাত-পা কেমন নার্ভাসনেসে জমে আছে। বিয়ে যত পড়াচ্ছে তত মাহারিনের ভেতরকার অস্থিরতা ফুলে-ফেঁপে উঠতে শুরু করেছে। কেমন দম-বন্ধকর, বদ্ধ অনুভূতি। এই অনুভূতি বুঝি সকল মেয়ের মাঝেই দেখা যায়? মাহারিন তো সাহসী মেয়ে, তার বেলাতেও এমন হচ্ছে কেন? এই এক মুহূর্তেই বুঝি মেয়েদের সমস্ত সাহস, খুশি-অখুশি, মতামত মিইয়ে যায়? এই মুহূর্তে কী “বিয়ে না করলে হয় না?” চিন্তাটা সবার মধ্যেই নাড়া দেয়? মাহারিনের বলতে ইচ্ছে করছে, খুব করে। কিন্তু তার যেন কণ্ঠস্বর ঝিমিয়ে গেছে। মুখও অদৃশ্য টেপে যেন আটকে।

কাজী যখন বলতে বলল “কবুল”, তখন মাহারিন একটা ঘোরের মাঝে চলে যায়। ছোটো থেকে বড়ো অবধি বাড়িতে কাটানো সকল স্মৃতি জড়ো হয় চোখের সামনে। গলাটা কেমন ধরে এলো তার। এই একটা শব্দ বললেই বুঝি সে তার বাবা-মায়ের থেকে পর হয়ে যাবে? হঠাৎ মন বিষাদে বিষিয়ে যায়। কাজী দুইবার বলল। কিন্তু তা মাহারিনের কান অবধি পৌঁছালেও মস্তিষ্ক যেন অচল হয়ে গিয়েছে। মেয়ের অবস্থা বুঝে মোর্শেদ সাহেব এগিয়ে আসলেন। মেয়ের মাথায় হাত রাখতেই মাহারিন চমকে বাবার দিকে তাকালো। মোর্শেদ সাহেব চোখ জোড়ায় আশ্বাস ফুটালেন। মাহারিন এতে লম্বা এক নিঃশ্বাস ফেলল, পরপর তিনবার কবুল বলল। মাহারিন কবুল বলতেই চারপাশে কম-বেশি সবাই ” আলহামদুলিল্লাহ” বলে ওঠে।বিয়ে শেষ হতেই সকলে সকলের সাথে কোলাকুলি করলো, আনন্দ ভাগা-ভাগি করলো। মাহারিন তখন চোখ বুজে নিঃশ্বাস ফেলছে। চাচী এসে মাহারিনকে জড়িয়ে ধরে বলল,
–“আল্লাহ তোকে সমস্ত খুশি দিক মাহারিন। খুব দোয়া তোর জন্য।”

সকলের খুশি উদযাপন হলো। এবার তাহমিদের পালা ফুলের পর্দা সরিয়ে তার বউকে দেখা। এ নিয়ে তাহমিদের পাশে থাকা তার বন্ধু, কাজিনরা হাসি-ঠাট্টায় ব্যস্ত। তাহমিদ এক চিলতে হাসি দিয়ে পর্দার দিকে এগিয়ে যায়। বাম হাতের পাশাপাশি ভাঙা হাত দিয়ে হালকা নাড়িয়ে পর্দা সরালো। এতে করে মাহারিনের বুকের অস্বাভাবিক ওঠা-নামা বেড়ে গেল। সে বুঝলো না, এই ধুকপুক হঠাৎ অন্য সুর গাইছে কেন?

মাহারিনের ভাবনার মাঝেই মাহারিনের লাল রঙের লম্বা ঘোমটা তাহমিদ যত্ন করে তুললো। মাহারিন সম্বিৎ ফিরে তাহমিদের দিকে তাকাতেই দুজনের চোখা-চোখি হলো। মাহারিন সেই মুহূর্তে তাহমিদের গভীর চোখে মুগ্ধতা দেখতে পেল। চমকে যায় মাহারিন। তাহমিদ আচমকা এক কাণ্ড করে বসলো। সকলের সামনে মাহারিনের কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় সে। মাহারিন এতে পাথর বনে যায়, আর ইয়াংদের মধ্যে এ নিয়ে গুঞ্জন, হৈ-হুল্লোড় শুরু হলো। তাহমিদ মাহারিনের চোখে চোখ রেখে বলল,
–“তবে হয়েই গেলেন আমার বউ, মাহারিন।”

মাহারিন তখনো স্তব্ধ। এর মাঝে সকলেই মিষ্টিমুখ শুরু করে দেয়। তাহমিদের বন্ধুরা তো হাসি-ঠাট্টার মাঝে বলল,
–“আমাদের ভাবী লাখে একটা। নয়তো আমাদের এই রোগী বন্ধুকে এভাবে কে বিয়ে করত? তাহমিদ, তুই জিতছিস!”

ওদের কথা-বার্তায় মাহারিন কিছু লাজ অনুভব করলো। আড়চোখে তাহমিদের দিকে তাকালো সে। তাকাতেই কেমন চমকে যায়। তাহমিদ তার পছন্দ করে দেওয়া পাঞ্জাবিটাই আজ পরেছে। পরমুহূর্তেই মাহারিনের রাগ হলো, এতই যদি তার পছন্দ ভালো না হয় তাহলে একই পাঞ্জাবি আজ কেন পড়ল? সেদিন কী মাহারিনকে রাগাতেই ওসব বলেছিল? পরমুহূর্তেই কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দেওয়ার কথা মাথায় এলো। মাহারিন মিনমিন করে বলল,
–“ফালতু লোক।”

তাহিয়া হুট করে এসে মাহারিনকে জড়িয়ে ধরে। উচ্ছ্বাস করে বলল,
–“তুমি আমার ভাবী হয়ে গেলে। শীঘ্রই আমার কাছে তোমাকে নিয়ে যাব।”
মাহারিন নিজেকে দমিয়ে নেয়। আবারও তার চোখাচোখি হয় তাহমিদের সাথে।

সকলের জন্য খাবারের বড়োসড়ো আয়োজন করা হলো। কিন্তু সবার মধ্যে সমস্যায় পড়লো তাহমিদ। খাবারের এত আয়োজন, অথচ তারই ডান হাত ভাঙা। এ নিয়ে অবশ্য তাহমিদকে বিচলিত হতে দেখা যায় না। সে হেসেই বলল,
–“এতদিনে বাম হাতে চামচে খাওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে।”

সকলের খপ্পরে পড়ে মাহারিনকে তাহমিদের পাশেই বসতে হয়েছে। নতুন বর-বউ অবশ্য মাহারিনদের ঘরেই খেতে বসেছে। আর বাকিসব আত্নীয়-স্বজনরা সবাই নিচে চলে গেছে খেতে। তাহমিদদের সাথে হাতে গোণা কয়েকজন বসেছে খেতে। আকিব তো হাস্যরসে বলল,
–“সমস্যা কী, আজ নাহয় আমাদের ভাবী খাইয়ে দিবে বন্ধুকে।”

আকিবের কথায় মাহারিন যেন আকাশ থেকে পড়ে। মাহারিন চমকে তাকায় মায়ের দিকে। কিন্তু কী আশ্চর্য, এই বিষয়ে মায়ের কোনো হেলদোল নেই। মোর্শেদ সাহেব, আয়েশার সামনেই তাহমিদ বলল,
–“আমার কোনো সমস্যা নেই, বউয়ের হাতে খেতেই পারি।”

কথাটা মাহারিনের কানে অদ্ভুত সুরে বাজলো। চোখ রাঙিয়ে তাকালো সে তাহমিদের দিকে। সবার সামনে এমন নির্লজ্জপনার মানে কী? তাহমিদ গলা কিছুটা খাদে নামিয়ে বলল,
–“এভাবে চেয়ে থাকলে তোমার আমার পেট ভরবে? ভরলে বলো, চেয়ে থাকি অনন্তকাল। না ভরলে হা করছি, খাইয়ে দাও।”

মাহারিন আবার মায়ের দিকে চাইলো। মোর্শেদ সাহেব তাহমিদের বাবা তারেক সাহেবকে দেখার নাম করে চলে গিয়েছেন। মাহারিনকে চমকে দিয়ে আয়েশা বললেন,
–“এভাবে চেয়ে আছিস কেন? খাইয়ে দে। জামাইর হাত ঠিক থাকলে তো বলতে হতো না।”

তাহমিদ বাঁকা হেসে বলল, “একদম।”

মাহারিন গেঁয় ধরে বসে থাকতে চেয়েও পারল না। সকলের উস্কানিমূলক কথা-বার্তায় সে বাধ্য হলো তাহমিদকে খাইয়ে দিতে। তাহমিদ যখন প্রথম লোকমা মুখে তুললো তখন তার আবেশে চোখ বুজে আসে। বেশ সুখের শব্দ করে বলল,
–“বউয়ের হাতে খাবার খাওয়ার মজাই আলাদা।”

পাশ থেকে আকিব তা শুনতে পেরে বলল,
–“এজন্যই এতদিন যাবৎ বলছিলাম বিয়েটা কর, বিয়েটা কর।”

তাহমিদ তৎক্ষণাৎ আকিবের ঘাড়ে আক্রমণ করে বলল,
–“তোর জন্যই আমার এই হাল ইডিয়েট, বেশি ভালো সাজতে আসবি না।”

মাহারিন সরু চোখে চাইলো। হাত ভাঙা নিয়ে তাহমিদ সবসময় আকিবকে কেন দোষারোপ করে? সমস্যা কী?
মাহারিনের উপর কঠিন অত্যাচার চালিয়েই দমলো তাহমিদ। তাহমিদের এসব কর্মকাণ্ডে মাহারিন নিজেই বিরক্ত হয়ে গেল।

খাবার পর্ব শেষ হতেই নতুন বর-বউকে এক ঘরে আলাদা রাখলো। মাহারিন একপাশে চুপ করে বসে ছিল। তাহমিদ হাই তুলতেই মাহারিনের এতক্ষণে দমিয়ে রাখা সব রাগ এবার হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল। ক্ষেপে গিয়ে বলল,
–“আপনি তো দারুণ নির্লজ্জ আমাকে সকলের সামনে চুমু দিলেন। আমি অবাক হচ্ছি!”

তাহমিদ ভ্রু কুচকে বলল,
–“এখন তো সবার সামনে নেই। এখন চুমু দিলে চলবে?”

মাহারিনের পিলে চমকে ওঠে তাহমিদের এহেম কথাতে। মাহারিন অস্ফুট স্বরে বলল,
–“খবরদার।”

–“হোয়াট খবরদার? তুমি আমার বউ, সবার সামনেই হোক বা প্রাইভেটে.. তোমাকে আমি চুমু দিতেই পারি।”

–“আরেক হাত ভাঙার শখ হয়েছে?”

তাহমিদ বাঁকা হাসে। এগিয়ে গিয়ে বলল,
–“ভাঙবে? ভেঙে দেখাও।”

বলেই তাহমিদ দুই ধাপ এগিয়ে এলো মাহারিনের দিকে। মাহারিন এতে কিছুটা ঘাবড়ে যায়। দেয়ালের দিকে কিছুটা চেপে বসে সে। মাহারিনের কাণ্ডে তাহমিদ বলল,
–“সত্যি বলছি, তোমাকে কন্ট্রোল করার জন্য আমার এক হাতই যথেষ্ট।”

তাহমিদ আচমকা মাহারিনকে এক হাতে দাঁড় করালো। মাহারিন অপ্রস্তুত হয়ে চাইতেই অনুভব করলো কোমড়ে তাহমিদের হাতের অবাধ বিচরণ। মাহারিন কপাল কুঁচকে তাহমিদের উদ্দেশে বলল,
–“ছাড়ুন, এবার কিন্তু বেশি হচ্ছে।”

–“দাঁড়াও, ব্লক ব্লক খেলাটার ইতি ঘটাই।”

বলেই তাহমিদ মাহারিনের গালে চুমু দিলো। পরপর দুবার। মাহারিন এতে ছটফটিয়ে ওঠে। তাহমিদ তার খোঁচা খোঁচা দাড়ির কিছুটা অংশ মাহারিনের গাল ছুঁইয়ে দেয়। এতে তার আত্মাটা বেরিয়ে আসার উপক্রম। তাহমিদ তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
–“স্বীকার করতেই হয় তোমাকে বউরূপে অন্যরকম লাগছে। বিউটিফুল।”

চলবে—