মায়াতলীর মোড়ে পর্ব-১১

0
29

#মায়াতলীর_মোড়ে – [১১]
লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]

আকদের পরদিনই শবে ব-রাত। এবারের শবে-ব-রাতে বেশ কিছু আত্নীয় মাহারিনদের বাড়ি। রুহি, রাইমা সহ আরও কয়েকজন বোনেরা মাহারিনের সঙ্গেই আছে। বিকালের আগে আগে বড়োরা একটা চাল চেলে দিলো। যুবতী, তরুণী যারা আছে তারাই আজকে চালের রুটি বানাবে। হালুয়াটাও ওরাই বানাবে শুধু গোরুর মাংসসহ বাদ-বাকি রান্না বড়োরা করবে। এ কথা শুনে ছোটোদের মন বিষিয়ে যায়। পরশুদিন ওরা হাতে কোথায় মেহেদী করবে তা না, আজ নাকি বানাতে হবে রুটি, হালুয়া?

রুহি অসহায় গলায় বলল,
–“বাকি কাজ বাকি রাখলে কেন? ওগুলাও আমাদের দিয়ে দাও।”

রুহির মা অর্থাৎ মাহারিনের মামী বলল,
–“কাজের কাজ তো এমনিতেই করিস না, সারাদিন ফোনে হাই হ্যালো গাইজ করা ছাড়া। এবার এটুকু কাজ কর, দেখি তোদের ভিতর কত দম!”

তুলি এসবের মাঝখান থেকে বলল,
–“আমাকেও হাত দিতে হবে? আমি তো ছোটো!”

রাইমা পাশ থেকে তুলিকে মিনমিন করে বলল,
–“তুই এটলিষ্ট নার্সারির বাচ্চা না সোনা। তোর বয়সে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। ওরা সংসারে হাত দেয়।”

–“তাহলে তুমি কেন বিয়ে করোনি?”

মুখ ভোঁতা হয়ে যায় রাইমার। সবশেষে তুলি নিজেও ছাড় পেল না। অদ্ভুত ভাবে ছাড় পেল মাহারিন। কিন্তু এই তরুণীরা তা মানতে নারাজ। মাহারিনের বিয়ে তো কী হয়েছে? মাহারিনকেও এসবে হাত দিতে হবে। অতঃপর মাহারিনকেও ওদের দলে যোগ দিতে হয়। ওদের মধ্যে একমাত্র মাহারিন এবং আরেকজন কাজিন নাজিয়াই ভালো রাঁধতে পারে। আর বাকি সব রান্নাতে সর্বনিম্ন নম্বরপ্রাপ্ত।

সিরিয়ালে কয়েকজন রুটি বানাতে বসেছে। কিন্তু কারো রুটিই ঠিকমতো গোল হওয়া তো দূর, উলটো নকশা হয়ে যাচ্ছে। তুলি তো নিজেরটা দেখিয়ে বলল,
–“এই দেখো, বাংলাদেশের মানচিত্র।”

বর্ষা নিজেরটা দেখিয়ে বলল,
–“আমারটা তো নেপালের মানচিত্র।”

রুহি বলল,
–“তুই কী নেপালের মানচিত্র চিনিস? খেয়াল করে দেখেছিস কখনো?”

রুহির কথায় হাসির রোল পড়ল। তাদের এই হাসা-হাসির মধ্যে আয়েশা সহ মাহারিন চাচী মামী আসলো। একেকজনের রুটির নকশা দেখে আয়েশা দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
–“তুরারে মেয়েফুয়া ন বানাইর। গাইল হাইবের লে বানাই।” [তোদেরকে মেয়ে বানাচ্ছি না। বিয়ের পরে গালি খাওয়ার রাস্তা বানাচ্ছি।]

হাসি আড্ডার মাঝে সন্ধ্যা পেরুলো। মাগরিবের পরপরই হঠাৎ তাহমিদের বাড়ি থেকে শবে-ব-রাতের রুটি, হালুয়া পাঠানো হয়েছে। তা দেখে এ বাড়িতে আবার সে বাড়ি খাবার পাঠানোর ব্যস্ততা শুরু হলো।

মাহারিন ঘরে বসে বসে হালুয়া, গরুর মাংসের ঝোলের সাথে রুটি খাচ্ছে সে। তা দেখে সবাই একপ্রকার ঝাপিয়ে পড়ল। রাইমা অবাক হয়ে বলল,
–“আমরা এত কষ্ট করে রুটি হালুয়া বানালাম আর তুমি শ্বশুরবাড়িরটা পেতেই সেসব ফেলে খেতে বসে গেলে? এটা তো তোমার থেকে আশা করিনি আপু।”

মাহারিন আড়চোখে রাইমার দিকে তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর হাতে এক পোড়া ফ্রাইপেন নিয়ে এসে বলল,
–“এই তোদের হালুয়া বানানোর নমুনা?”

সবাই তাকাল রাইমার দিকে। রাইমার মুখ থমথমে হয়ে গিয়েছে। মাহারিন সেই ফ্রাইপেন রাইমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
–“তোর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে খাইয়ে আসিস, দুইদিনে ঝাটা-পেটা করে বের করে দিবে।”

–“অপমান করছ এভাবে?”

–“শুধরে দিচ্ছি।”

তুলি চট করে মাহারিনের থেকে খেয়ে দেখলো। হালুয়ার স্বাদই বলে দিচ্ছে এটা মাহারিনের রান্না। তুলির অন্তত মাহারিনের রান্না চিনতে ভুল হবে না। তুলি বলল,
–“রাইমা আপু, এটা তো আমাদেরই খাবার।”

মাহারিন তখন গ্লাস তুলে পানি খেলো। তার চোখে গতকালকের ঘটনা ভাসছে। এ নিয়ে তার মন-মেজাজ ভীষণ মন্দ আছে। তাহমিদের এত সাহস তাকে চুমু দেয়। মাহারিনের তো ইচ্ছে করছিল তাহমিদকে একদম ঝলসে দিতে। বদ লোক একটা। তাহমিদ কল দিলেও কল ধরছে না সে। এ নিয়ে তাহমিদ তাকে মেসেজ করেছিল,
–“ঠিক আছে, কাটিয়ে নাও সময় তোমার বাড়িতে। আমার বাড়িতে আসলে ইগনোর কাকে বলে বুঝিয়ে দিব।”
এটা হুমকি হলেও মাহারিন পরোয়া করছে না। বরং সেও ভেবে ক্ষান্ত হয়, তাকে বিয়ে করার শখ তাহমিদকে একদম হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিবে। খুব বলেছিল না বিয়েটা তার জন্যে এডভেঞ্চার? মাহারিনও সেই এডভেঞ্চার একদম অনুভব করিয়ে ছাড়বে।

শবে-ব-রাত শেষ হতেই মেহেন্দীর অনুষ্ঠানের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। মেহেন্দীর অনুষ্ঠানে মাহারিন গাঢ় সবুজের মধ্যে হালকা সোনালী পাড়ের ড্রেস পরেছে। মাথায় সবুজ পাথরের মাঝারি আকারের টিকলি। কানে, গলায় সবুজ-সোনালীর মধ্যে পাথরের সেট। আর দুই হাত ফাঁকা। মূলত মেহেদি পরানোর জন্যই।

কয়েকজন মেহেদি আর্টিস্ট এই প্রোগ্রামে আসে। দুইজন মাহারিনকে মেহেদি দিয়ে দিতে বসে আর দুজন বাকিদের এক এক করে মেহেন্দি পরাতে লাগল। রাইমাও মেহেদি পরাতে জানে, সেও মেহেন্দি টুকটাক দিতে বসে পড়েছে। স্পৃহা সকালেই এসেছে। সে বিভিন্ন কারণে চাইলেও মাহারিনের সাথে থাকতে পারে না। এখন যেহেতু টানা কিছুদিন অনুষ্ঠান চলবে সেহেতু আজ জামা-কাপড় গুছিয়ে এনেছে এই কয়েকদিন থাকার জন্য। মাহারিন তার এই সুন্দর সময়ে স্পৃহাকে সঙ্গে পেয়ে খুশি হয়েছে।

নাচ-গান, আনন্দানুভবের মাঝে দিয়েই হঠাৎ তাহমিদ উপস্থিত হলো। তাহমিদের সঙ্গে দুজন চারজন আছেন। প্রত্যেকেই তাহমিদের বোন এবং একজন মামী। তাহিয়া তো এসেই মাহারিনের কাছে চলে গিয়েছে। মাহারিন আজ এত চমকিয়েছে যে নড়তে ভুলে গেছে। এমন অবস্থায় তাহমিদ এসে সারপ্রাইজ দিবে তা সে কেন, কেউই ভাবতে পারেনি। মাহারিনের হাতে মেহেন্দি পরা তখন শেষের দিকে। হাতের তালুতে তাহমিদের নাম আরবিতে এখন মেয়েটা নাম লিখবে। তাহমিদ আজ গাঢ় সবুজ রঙের পাঞ্জাবি পরেছে, দেখতে যে কী দারুণ লাগছে। শুধু একটাই দাগ, গলায় হাতটা ঝুলে আছে। এছাড়া বাদ-বাকি সে বেশ ফিটফাট। কে বলবে সে একজন অর্থোপিডিক্স?

যেহেতু এখানে বড়ো কেউ নেই সেহেতু তাহমিদ কাউকে তোয়াক্কা না করে মাহারিনের পাশে গিয়ে বসলো। এতে মাহারিনের গা মৃদু শিউরে ওঠে। তাহমিদ বেশ মনোযোগের সাথে মেহেন্দিতে রাঙানো হাত জোড়ায় নজর বুলিয়ে মাহারিনের দিকে তাকালো। মাহারিন তখন চোরা চোখে তাহমিদের দিকে তাকাতেই তাহমিদ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। মাহারিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
–“আমাকে বিয়ে করবে না বলে তো কত কিছু করলে। এখন আমার নামেই মেহেন্দি পরছ? ব্যাপারটা কিন্তু মন্দ নয়।”

মাহারিন ঘোরের মাঝে থাকলেও তাহমিদের গা জ্বালানো কথায় হুঁশ ফিরল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“দুইটা দিন যেতে দিন, আপনার বিয়ের শখ আমি মেটাচ্ছি।”

তাহমিদ হো হো করে হেসে ওঠে। হাসি থামিয়ে বলল,
–“কেন, আরেকটা হাত ভাঙার চিন্তা করছ নাকি? করো, সমস্যা নেই। কয়েকদিন পর এমনিতেও এই হাতের প্লাস্টার খুলে ফেলব। আরেকটা হাত নাহয় আমার প্লাস্টারে জড়াব। এরপর চিরতরে ইতিহাসে খোদাই করে লেখা থাকবে, ‘হাড়ের ডাক্তারের হাত ভেঙে দিয়েছে তার নিজেরই বউ।’

তাহমিদ আসায় অনুষ্ঠান আরও হাসি-খুশিতে ভরে ওঠে। তাহমিদও মুখে হাসি নিয়ে সবার সাথে বিনয়ের সাথে মিশছে। তাহিয়া জানালো, এখানে নাকি বড়োদের অনুমতিতেই তারা এসেছে। তাহমিদের বাড়িতে কোনোপ্রকার মেহেন্দির অনুষ্ঠান করা হয়নি, এখানে আসবে বলে।

মাহারিনের বরাবরের মতোই বিশেষ কৌতুহল তাহমিদের ভাইকে নিয়ে। কালকে এত বড়ো অনুষ্ঠান অর্থাৎ আকদ গেল, তাও তাহমিদের ভাই তো এলো না। দুই ভাইয়ের মধ্যে কোনো সমস্যা আছে নাকি? তাহিয়ারা যতই বলুক তার সেই ভাই অসুস্থ। তাই বলে একবারের জন্যেও ভাইয়ের বিয়েতে আসবে না? আশ্চর্য।

মেহেন্দি দেওয়া শেষ হলো। মাহারিন এক মনে মেহেন্দি রাঙানো হাতে চেয়ে আছে। ডান হাতের তালুতে জ্বলজ্বল করছে তাহমিদের নাম। নামটা ইংরেজিতে বেশ ডিজাইন করে লিখেছে। আর অপর পিঠেই আরবি হরফে নাম। মাহারিন মিনমিন করে আওড়ালো,
–“তাহমিদ?”

তাহমিদ মাহারিনের কাছে এসেছে তখন। মাহারিনের মুখে নিজের নাম শুনে আওড়াল,
–“হুঁ, তোমার বর।”

চলবে—