#মায়াতলীর_মোড়ে – [২১]
লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
জোনিরার জীবনের গল্পটা একটু কঠিন। সে মাকে হারানোর পর অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছে, খুব বাজেভাবে। প্রথম যখন বাবার হাতে হাত রাখতে আরেকজন মহিলাকে দেখেছে তখনো সে কষ্ট পায়নি। সে আহত হয়েছিল বাবার এড়িয়ে চলাতে, তাকে সময় না দেওয়াতে। মাকে হারিয়ে যেই মানুষটাকে তার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, যাকে পাশে চেয়েছে সে ছিল না। সে তাকে বরাবরের মতো অবজ্ঞা, অবহেলা করে গিয়েছে। জোনিরার জীবনের একটাই দুঃখ, যাকে ভালোবাসে সেই তার জীবন থেকে হারিয়ে যায়। এজন্য সে একলা বাঁচতে শিখেছে।
মনকুঠুরিতে আর কাউকে জায়গা দেয়নি, যাকে তার হারিয়ে ফেলার ভয় হবে। এজন্য ত্রিশ বছরের এই জীবনে জীবনসঙ্গীর কথা ভাবেনি সে। মামারা তাকে কয়েকবার বিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু বিয়ের কথা আসলেই তার বাবার কথা মনে পড়ে যায়। তার বাবাও তো তার মাকে কতটা ভালোবাসত। মাকে ছাড়া যার চলতই না সে দ্বিতীয় স্ত্রী, সন্তান নিয়ে দিব্যি খুশি। যেখানে তার বাবাই বিশ্বাস, ভরসা ভেঙেছে সেখানে সে কী করে অন্য পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করার মতো কঠিন কাজটা করতে পারে? বাবাকে ছেড়ে আসার পর বাবা তার খোঁজ নিয়েছে হাতে গোণা কয়েকবার। তাও মন থেকে খোঁজ নেয়নি, খোঁজ নেওয়া উচিত ভেবে নিয়েছে। তার বাবাও তাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিল, জোনিরা তাকে কৌশলে এড়িয়ে গিয়েছে।
জোনিরার এই সাদা-কালো জীবনে আচমকা তানভীর হানা দেয়। তাকে প্রথমে বিরক্ত লাগলেও এই ছেলে কী সেসব থোরাই কেয়ার করত? কোনো ট্যুরে যাওয়ার আগে কল দিবে, ট্যুরে পৌঁছালে কল করবে। যেখানে আছে সেখানের ছবি পাঠাবে। জোনিরা তার কল না ধরলে সোজা হসপিটাল চলে আসবে। এসে তুলকালাম বাঁধাবে যে কেন কল ধরেনি। হাসপাতালে এখন তানভীর পরিচিত মুখ হয়ে গিয়েছে। নার্সরা নিজেদের মধ্যে জোনিরা-তানভীরকে সুইট কাপল বানিয়ে ফেলেছে। জোনিরা তাকে শতবার এড়িয়ে গেলে তানভীর সহস্রবার এগিয়ে এসেছে। জোনিরার মতো ভাঙাচোরা মানুষ আর কতই বা তাকে অপছন্দ করে থাকবে? ছেলেটার ছোটোখাটো বিষয়গুলো খেয়াল রাখা, সময়ে-অসময়ে তার যত্ন করা, মন খারাপে তাকে আচমকা খেপিয়ে দেওয়া সব যেন স্বপ্নের মতো তার জন্য।
কিন্তু সে স্বপ্নের দিকে হাত বাড়াতে পারে না। তার বিবেক তাকে সেই সম্মতি দেয় না। একে তো তানভীর তার কাজিন, তার ওপর ছোটো। তানভীরের মতো হাসি-খুশি প্রাণকে কী করে তার মতো দুঃখ ছুঁয়ে দিবে? তানভীর বেস্ট লাইফ পার্টনার ডিজার্ভ করে। আর মামনিরও তানভীরকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন। যে মানুষটা তাকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসে তাকে সে মানুষটাকে তানভীরের বউ হয়ে কষ্ট দিতে পারবে না। থাকুক না তানভীর তার অন্তরে, গোপনে। সব ভালোবাসা পেতেই হবে এমন ত নয়। তানভীর অবুঝপনা করলে সেও করবে তা হয় নাকি? তাকে তো শক্ত হতেই হবে, অন্তত সবার ভালোর জন্য। তার ভালোতে কারই বা আসে যায়? এজন্য সে বারংবার তানভীরের থেকে দূরে সরে যায়, তানভীরকে শাসন করে। কিন্তু তার মনটাও আজকাল ভীষণ লোভী হয়ে যাচ্ছে, সে তানভীরের সান্নিধ্য পেতে মরিয়া হচ্ছে। এটা কিছুতেই ভালো লক্ষণ হতে পারে না। দু’বছর নিজেকে এভাবেই সামলে যাচ্ছে সে।
—————————–
আজ জোনিরার পেশেন্টের অবস্থা বেশ করুণ। প্রসব যন্ত্রণায় পেশেন্ট আর্তচিৎকারে থিয়েটার ঘর মুখোরিত করে রেখেছে। জোনিরাসহ নার্সদের মুখজুড়ে চিন্তার ভাঁজ। যুবতী মেয়েটি জমজ বাচ্চা জন্ম দেবে। একে তো মেয়েটির বয়স কম, দূর্বল। তার ওপর এত বড়ো রিস্ক। সব মিলিয়ে জোনিরা আল্লাহকে ডাকছে। প্রায় অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পর দুজন বাচ্চাকে একত্রে রাখা হলো। একজন শব্দ করে কাঁদছে আরেকজন নিশ্চুপ! জোনিরা কিছু একটা আঁচ করতে পেরে দ্রুত তার ব্যবস্থা নেয়। অবশেষে সব শঙ্কা পেরিয়ে দ্বিতীয় বাচ্চাটিও কেঁদে উঠল। আর খুশিতে জোনিরা কেঁদে ফেলল। আজকের পরিস্থিতি কতটা শক্ত ছিল সে নিজেও ভাবতে পারছে না। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। এটা তার অর্জন। যুবতী মেয়েটি তার দুই বাচ্চাকে দূরে দেখে নিজের সমস্ত দুঃখ, ব্যথা-যন্ত্রণা ভুলে যায়। জোনিরা ততক্ষণে ওদের পরিষ্কার করে একসাথে দুই হাতে দুই বাচ্চাকে নিল। দুজনই ছেলে। ওদের মধ্যে কিছুটা অসুস্থ বাচ্চাটার দিকে অপলক চেয়ে রয় জোনিরা। ওকে দেখে কেন যেন তানভীরের কথা মাথায় আসছে। আজকের কেসটা একদম তাহমিদ-তানভীরদের মতোই। জোনিরা তাই বেশ খুশি।
জোনিরা কিছুটা ফ্রি হতেই কী ভেবে যেন তানভীরকে কল দেয় সে। তানভীর কল রিসিভ করতে এক মুহূর্ত সময় নেয় না। কল ধরেই অভিমানী সুরে বলল,
–“এটা ঠিক না জোনিরা! আপনি কিছু না বলে-কয়ে চলে গেছেন কেন? আমি কিন্তু ব্যাপারটা একদম পছন্দ করিনি।”
জোনিরা আপনমনে হাসল। তানভীরের সমস্ত অভিমান এড়িয়ে বলল,
–“আজ দুজন সুস্থ জমজ বাচ্চা জন্ম নিয়েছে। ফুটফুটে ছেলে বাচ্চা।”
–“ছেলে বাচ্চা? তাই বুঝি আমার কথা মনে পড়ল?”
জোনিরা নিশ্চুপ। কথাটা সত্যি হলেও সে স্বীকার করতে অনিচ্ছুক। এজন্য কিছুটা চুপসে রইলো সে। তানভীর যেন নীরবতার ভাষা এক লহমায় পড়ে ফেলল। সে শীতল গলায় আওড়াল,
–“জোনিরা?”
–“হুঁ?”
–“বাচ্চারা কী সুস্থ আছে?”
–“হ্যাঁ, বাচ্চারা এবং ওদের মা সুস্থ আছে।”
–“যাক, তবে আপনি খুশি।”
জোনিরা চুপ রইলো, কেন যেন তার তানভীরকে ভীষণ ভালো লাগছে। তার কথাই শুনতে ইচ্ছে করছে। জোনিরা দুই মিনিট নীরব থেকে বলল,
–“আমি ডিউটিতে আছি, বাই।”
বলেই তানভীরকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দেয়। সত্যি বলতে তার ডিউটি প্রায় শেষ। তবুও সে থম মেরে নিজের চেম্বারের ডেস্কে বসে রইল। চেম্বারের মধ্যকার এসি টানা চলছে। রুম অনেকটাই শীতল হয়ে গিয়েছে। ঠান্ডায় জোনিরার নাক লাল হয়ে আছে যা সে টেরই পেল না। বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হতেই আচমকা তানভীরের কল এলো। জোনিরার ধ্যান ভাঙতেই সে ফোনের স্ক্রিনে তাকাল। পরপর কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তানভীর বলল,
–“আপনার ডিউটি শেষ, তবে আমায় মিথ্যে বললেন কেন? জানেন না আমাকে মিথ্যে বললে পার পাবেন না আপনি?”
জোনিরা চমকে যায় তানভীরের কথা শুনে।
–“তুমি কোথায় এখন?”
–“কোথায় আবার, রিসিপশনের আশেপাশে। দ্রুত নিচে আসুন, আমি অপেক্ষা করছি আপনার জন্য।”
–“তুমি হসপিটালে কী করছ?”
–“আপনার মনের ডাক শুনতে পারি যে আমি। আপনি ডাকলেন তাই চলে এলাম।” তানভীরের কথায় দুষ্টুমির সুর।
জোনিরা কোনোরকমে তৈরি হয়ে নিচে নেমে গেল। আসলেই তানভীর এসেছে। বহুদিন পর তানভীর তার আসল রূপে ফিরে এসেছে। এতদিন পা ভাঙা থাকায় ঘরকুনো হয়ে ছিল বেচারা। তবুও এই ছেলে শোধরাবে না। জোনিরা এগিয়ে এসে তানভীরকে শক্ত ধমক দিয়ে বলল,
–“পা ঠিক হতে না হতেই আবার টো টো করা শুরু করেছ!”
–“কী আর করব বলুন, আপনাকে না দেখলে আমার অশান্তি অশান্তি লাগে।”
–“এতদিন ত দিব্যি ছিলে। এখন নাটক শুরু করেছ?”
–“উপায় না থাকলে আপনার থেকে আমাকে দূর করার সাধ্যি কার ছিল?”
জোনিরা এ প্রসঙ্গে কিছু না বলে বলল,
–“এবার বাড়ি যাও। আমিও যাচ্ছি।”
–“উহু। আপনায় সঙ্গ দিতে এসেছি, বাড়ি ফিরতে নয়।”
–“আমার সঙ্গ লাগবে তোমায় কে বলল?”
–“কারো বলার হলে আমার অনুভূতির আর কী দরকার? আমি যে আপনার না বলা কত কথাই বুঝে ফেলি।”
জোনিরা তানভীরের চোখ-জোড়ায় তাকাল। আবার নজর নেতিয়ে ফেলল দ্রুত। তানভীর আবার বলল,
–“অনেকদিন আপনার সঙ্গে ল্যাম্পপোস্টের আলো ধরে হাঁটা হয়নি। চলুন ইচ্ছেটা পূরণ করে ফেলি।”
জোনিরার বারণ শোনার আগেই তানভীর তার হাত ধরে বেরিয়ে গেল। হসপিটালের সামনেই হাইওয়ে রাস্তা। এই পথটা খুব সুন্দর। দুপাশে ফুটপাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ল্যাম্পপোস্টের আলো গাছ-গাছালির ফাঁকফোকর দিয়ে সেসব ফুটপাতে প্রবেশ করছে। রাতের বেলায় এই পথ দিয়ে প্রায়ই কপোত-কপোতী হেঁটে যায়। তানভীরও জোনিরার হাত ধরে হাঁটছে। জোনিরা হাত ছাড়ানোর হাজার চেষ্টা করেও পারছে না ছাড়াতে। এতে তানভীর অল্প হেসে বলল,
–“এই হাত ছাড়ার জন্য ধরিনি মিস। সারাজীবন আগলে রাখব বলেই ধরেছি।”
–“বাজে কথা বলা বন্ধ করো। এটা কখনোই সম্ভব নয়!”
–“কে বলেছে সম্ভব নয়? যেখানে মিঁয়া-বিবি রাজি, সেখানে ক্যায়া কারেগি কাজী?”
–“তানভীর, তুমি এতটাও ছোটো নও যে তোমাকে আমার অবস্থা হাতে ধরে বোঝাতে হবে।”
তানভীর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলার ভং ধরে বলল,
–“ভাগ্যিস বললেন ছোটো নই। নয়তো আমার যা বয়স হয়েছে, এতদিনে বাবা দুজনের ‘দাদা’ ডাক শুনত। চলেন বাবাকে দাদা বানানোর ব্যবস্থা করি?”
–“শাট আপ ইডিয়েট!”
তানভীর হো হো করে হেসে দিল। শীতল আবহাওয়া, ফাঁকা রাস্তায় তানভীরের হাসিটা কী সুন্দর করে বিঁধছে তার কানে। জোনিরা একপলক তানভীরের দিকে তাকাল। তানভীর হাসি থামিয়ে জোনিরাকে আজকের অভিজ্ঞতার গল্প শুনতে চাইল। জোনিরাও সহজ গলায় সব একে একে বলতে শুরু করে। ওরা ততক্ষণে এক দোকানে এসেছে। সেখান থেকে তানভীর দুই কাপ দুধ চা নিয়ে নেয়। তানভীর সব শুনে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল,
–“আমাকে ছোটো থাকতে না বাঁচালেই হয়তো ভালো হতো। অন্তত ভালোবাসা না পাওয়ার আক্ষেপ হতো না।”
জোনিরা আঁতকে উঠে তানভীরের কথায়। সে রেগে ধমক লাগাল,
–“ধাক্কা দিয়ে পথে ফেলে দিব তোমাকে। ম” রার শখ জেগেছে অনেক?”
তানভীর হেসে বলল,
–“ম*’রছি আমি প্রতিনিয়ত জোনিরা। আত্মার মৃ/ত্যুই দেখে সবাই— মনেরটা কেউ কেন দেখে না?”
–“ফালতু কথা বলবে না একদম।”
–“কেন? কষ্ট হচ্ছে?”
–“কষ্ট হবে কেন?”
–“তবে আপনি কী করে বুঝবেন আমার ক্ষতগুলো?”
–“ছোটো মানুষদের আমার এজন্যই পছন্দ না। কিছু না বুঝে শুধু ম*রার কথা বলে। অথচ সন্তানকে যেই বাবা-মা এত কষ্ট করে বড়ো করল, তাদের কথা একবারও ভাবে না।”
তানভীর হাসে। হাসতে হাসতে বলল,
–“আচ্ছা, যান। আমি এখন থেকে বাঁচব। শুধুই বাঁচব। খুশি?”
জোনিরা মুখ ভাঙায়। চাটা রাস্তার একধারে ফেলে দিতেই তানভীর অস্ফুট স্বরে বলল,
–“চা ফেললেন কেন?”
–“তোমার মতো ইডিয়েটের সাথে চা খেতে বাঁধছে আমার।”
–“এই ইডিয়েটই আপনার ভবিষ্যৎ বর, এটা মনে রাখবেন।”
—————————
আজ তাহমিদের প্লাস্টার খুলবে। তাই তাহমিদের সাথে হসপিটালে মাহারিনও এসেছে। মাহারিন কালো বোরকা, হিজাবে আবৃত। তাহমিদ বারবার তাকে চেয়ে চেয়ে দেখছে। মাহারিন তা দেখে বলল,
–“এভাবে কী দেখছেন?”
–“তোমাকে কালো হিজাবে এত সুন্দর কেন লাগছে সেটাই ভাবছি।”
–“কেন সুন্দর লাগছে?”
–“তুমি যে এই হ্যান্ডসাম তাহমিদের বউ, তাই।”
মাহারিন মুখ বাঁকিয়ে বলল, “ঢং।”
তাহমিদ, মাহারিনদের সাথে তানভীরও এসেছে। তানভীর হসপিটাল এসে এদিক ওদিক শুধু জোনিরাকে খুঁজছে। মাহারিন অবশ্য তাহমিদের হাত ভাঙার কাহিনী জানতে পেরেছে। তাহমিদের বন্ধু আকিবের জন্যই মূলত এই এক্সিডেন্টটা হয়েছে। তখন তানভীর পা ভেঙে ঘরে বসা, তাই না চাইতেও তার তাহমিদের সাহায্য নিতে হয়েছে। সাহায্যটা এরকম, তাহমিদের সাহায্যে সে তার গার্লফ্রেন্ডকে বাড়ি থেকে তুলে আনবে। সেটা অবশ্য মেয়ের সম্মতিতেই। তাহমিদ এটা শুনে শুরুতে সাফ না করে দেয়। তবুও আকিব হার না মেনে তাহমিদকে একপ্রকার বাধ্য করে তার সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেখানে গিয়ে সব ঠিক থাকলেও তাহমিদের গুরুতর এক্সিডেন্ট হলো উঁচু দেয়াল থেকে পড়ে। যার ফলস্বরূপ হাড়ের ডাক্তার নিজেই হাতে প্লাস্টার ঝুলালো।এতে তাহমিদ দিনে দুই বেলা গালি দিত আকিবকে। আকিব অবশ্য সেদিনই বিয়ে করে নিয়েছে তার প্রেমিকাকে। কিন্তু রোগী হয়ে যায় তাহমিদ। তবে বিয়ের পর মাহারিনের এত সেবা পেয়ে তার আক্ষেপ কেটে গিয়েছে। ভাগ্যিস হাত ভেঙেছিল, নয়তো মাহারিনের এত যত্ন পেত কী করে? মেয়েটাকে সে এই হাতের অজুহাতেই তো এতটা কাছে পেয়েছে, তাও এত দ্রুত।
তাহমিদ মাহারিনকে তানভীরের সাথে রেখে কোথাও একটা চলে গেল। তানভীরের সাথে মাহারিনকে আবার দেখে ফেলল নার্স তামান্না। সে ছুটতে ছুটতে জোনিরার কাছে চলে যায় এ খবরটা দিতে। জোনিরা তখন নিজের চেম্বারে বসে কফি খাচ্ছিল। নার্স তামান্না এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
–“ম্যাম, তানভীর স্যারকে এক মেয়ের সাথে দেখলাম। খুব হেসে হেসে কথা বলছে।”
এ কথা শুনে জোনিরার গলা দিয়ে আর কফি নামল না। সে ভ্রু কুঁচকে বলল,
–“মানে?”
–“হ্যাঁ। মেয়েটাও খুব সুন্দরী। না জানি তানভীর স্যার আবার কার পাল্লায় পড়ল।”
তামান্নার কথাতে জোনিরা বসতে পারল না। সে নিজে চলে গেল তানভীরকে দেখতে। সেও দেখতে চায় কোন সুন্দরী মেয়ের কথা বলছে নার্স! কিন্তু ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখল মেয়েটা মাহারিন। আর ওখানে গিয়েই জানতে পারল আজ তাহমিদের হাতের প্লাস্টার খুলবে। সব দেখে-শুনে জোনিরা নিজেকে ধিক্কার জানাল। নার্স তামান্নার কথায় ফেঁসে যাওয়া উচিত হয়নি। তানভীর তো সময় কাল ভুলে বলল,
–“আমাকে মিস করছিলেন নাকি জোনিরা?”
জোনিরা স্বভাবতই চোখ রাঙায় তানভীরকে। এই ছেলেটার মুখে লাগাম নেই কেন? তামান্না বোকা চোখে ওদের দেখছে। জোনিরা নার্সের উদ্দেশে নিচু গলায় বলল,
–“উনি ড. তাহমিদের মিসেস, আমাদের ভাবী। তুমি কী ভেবেছিলে?”
নার্স নিজের বোকামিতে লজ্জিত হয়ে জিভ কাটল। মিনমিন করে বলল,
–“সরি ম্যাডাম। আমি আসলে বুঝতে পারিনি।”
প্লাস্টার খোলা শেষ হতেই তাহমিদ ধীরে ধীরে হাত নাড়াচ্ছে। এই প্রথম তাহমিদকে সুস্থ স্বাভাবিক দেখে মাহারিনের অদ্ভুত লাগছে। এতদিনে তাহমিদকে এক ভাবে দেখে চোখের অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। তাই হয়তো এরকম লাগছে। তাহমিদ ডাক্তারের থেকে বিদায় নিয়ে মাহারিনের সাথে হাঁটছে। তানভীর জোনিরার পিছু পিছু চলে গিয়েছে তাকে জ্বালাতে। এমন অবস্থায় হঠাৎ তাহমিদের ডাক পড়ল। তাহমিদ মাহারিনকে একপাশে দাঁড়াতে বলে সে চলে যায় কথা বলতে। বেশ কিছুটা দূরে দুজন পুরুষ মানুষ দাঁড়ানো। মাহারিন দাঁড়িয়ে যখন তাহমিদের অপেক্ষা করছিল তখনই তার দেখা হয়ে যায় একজনের সাথে। এটা সেই ছেলে, যে কিনা মাহারিনকে প্রপোজ করার অপরাধে মোর্শেদ সাহেব তাকে জেলে ভরেছিল। কাপুরুষটাকে দেখতেই মাহারিনের নাক কুঁচকে যায়। জেলের ভয়ে মাহারিনের থেকে দূরে দূরে থেকেছে, তার ভালোবাসার কোনো মূল্যই নেই। ছেলেটা মাহারিনকে দেখে শুকনো হেসে বলল,
–“কেমন আছ মাহারিন?”
মাহারিন জবাব দিল না। তার মুখজুড়ে প্রকাশ পাচ্ছে সে কথা বলতে আগ্রহী নয়। ছেলেটা হাসে। মাহারিনের অভ্যাস এখনো বদলায়নি। সে বরাবরের মতোই কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। তার এটিটিউডই আলাদা। তাই হয়তো একসময় মাহারিনের প্রেমে পড়েছিল সে। মাহারিনকে তার এখনো ভালো লাগে। তাই ভাবল, সুযোগটা হাতছাড়া করা যায় না। ছেলেটা বলল,
–“আমি এখন মাল্টিমিডিয়া কোম্পানিতে ভালো একটা জব করছি। আত্নীয় অসুস্থ বলে দেখতে এলাম।”
মাহারিন এবারও পাত্তা দিল না। সে এই ছেলের কথা শুনতে ইন্টারেস্টেড নয়। ছেলেটা আবারও কিছুটা সময় নিয়ে বলল,
–“আমি এখনো বিয়ে করিনি।”
মাহারিন এবার তীক্ষ্ণ নজরে তাকাল যুবকের দিকে। সে থতমত খায় মাহারিনের নজরের তেজে। মাহারিন এবার মুখ খুলল,
–“তো আমি কী করব?”
–“তুমি যদি চাও, তবে তোমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে চাই। অতীতের কাণ্ডে আমি ভীষণ লজ্জিত। জেলের ভয়ে মোটেও তোমার থেকে দূরে সরে যাওয়া উচিত হয়নি। সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে আমি, বুঝতেই পারছ কেমন দেখায়।”
তাহমিদ তৎক্ষনাৎ ঘটনাস্থলে এসে চেঁচাল,
–“কী হচ্ছে এখানে?”
ছেলেটা চমকে পাশে তাকায়। দেখল লম্বা-চওড়া, সুদর্শন একজন তার সামনে দাঁড়ানো। সুপুরুষের মুখজুড়ে রাগের আভা। মাহারিন কোনোপ্রকার ভণিতা না করে বলল,
–“আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে। অতীতে আমার জন্যই জেলে গিয়েছে সে।”
এ কথা শুনে তাহমিদ যেন বেশ রেগে যায়। সে শুনেছে এই ছেলের কথা। এই ছেলে যেই হোক, এখন মাহারিন তার স্ত্রী। অন্য ছেলের সাহস কী করে হয় তার স্ত্রীর দিকে নজর তুলে তাকানোর? সেই ছেলে বলল,
–“উনি কে মাহারিন?”
তাহমিদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“আমি একজন অর্থোপিডিক্স, আর মাহারিনের একমাত্র হাসবেন্ড। আমি হাড় যেমন জোড়া লাগাতে জানি, তেমনই হাড় ভাঙতেও জানি। আর কোনো পরিচয়ের দরকার আছে?”
ছেলেটা অবাক হয়, সাথে ভয়ও পায়। সে আসলেই বুঝতে পারেনি মাহারিনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে বিদায় নেয়। তবে তাহমিদের রাগ তখনো কমে না। সে মাহারিনের হাত ধরে টান দিয়ে বলল,
–“চলো।”
মাহারিন মুচকি হাসল তাহমিদকে রাগতে দেখে। এজন্য সে অবুঝ হবার ভান ধরে বলল,
–“আপনি এভাবে টানছেন কেন? ছেলেটা তো বিয়ের প্রস্তাবই দিয়েছে। প্রস্তাব দিলেই কী বিয়ে হয়ে যাবে নাকি?”
–“বিয়ে হোক বা না হোক, ওর সাহস কী করে হয় তোমার দিকে নজর দেওয়ার?”
–“আপনার এত পুড়ছে কেন হুঁ?”
তাহমিদ দাঁতে দাঁত চেপে মাহারিনকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে বলল,
–“ভালোবাসি তোমায় মাহারিন, আমি পুড়ব না তো কে পুড়বে?”
তাহমিদের স্বীকারোক্তি সহজ হলেও মাহারিনের হজম হতে কষ্ট লাগল। সে নিজেকে সামলে তাহমিদকে আরও নানানভাবে জ্বালাতন করতে লাগল। গাড়িতে উঠেও সে থামল না। এতে তাহমিদের মেজাজ বহুগুণে বিগড়ে যায়। সে পার্কিং এ আবার গাড়ি পার্ক করল। এতে মাহারিন থেমে যায়। মাহারিন পাশ ফিরে তাহমিদকে কিছু বলতে যাবে ওমনি তাহমিদ ড্রাইভিং সিট থেকে উঠে তার কাছে এগিয়ে আসে। এতে ভীষণ রকম ভড়কে যায় মাহারিন। আটকে যাওয়া গলায় বলল,
–“কী হচ্ছে কী? সিটবেল্ট তো লাগিয়েছি, এগিয়ে আসছেন কেন? নিজের সিটে গিয়ে বসুন, যান।”
তাহমিদ তার সমস্ত কথাকে অবজ্ঞা করে তার খুব ঘনিষ্ঠ হয়। এরকম পরিস্থিতিতে, ঘরের বাইরে তাহমিদ এই ঘটনা ঘটাবে সে ত ভাবতেই পারেনি। মাহারিন নিজের ঠোঁট ছাড়ানোর চেষ্টা করল। তাহমিদ তার বেপরোয়া হাতের বাঁধাকে পাত্তা দেয় না, সে আরও ঘনিষ্ঠ হয়। নিজের সমস্ত রাগের সমাপ্তি ঘটিয়েই মাহারিনকে ছাড়ে সে। মাহারিন লজ্জায় নাজুক হয়ে পড়েছে। তা দেখে তাহমিদ বলল,
–“কিছু করার ছিল না। আমার রাগ একমাত্র তোমার ছোঁয়াতেই ঝড়বে। এটা এখন থেকে আমার জীবনের রুলস। তাই খবরদার, আর এসব উলোট পালোট কথা বলে রাগাবে না। রাগালে কী হবে বুঝতে পারছ তো?”
চলবে~~~