#শ্যামাবতী_প্রেয়সী
#পর্বঃ ১৫
#জেসমিন_জেমি
সকাল ১১ টা।
এখনো রিপ্তীর কোনো খোজ পাওয়া যায়নি। শিকদার মহলে নেমে এসেছে ঘোর অমানিশা। মেয়েটার চিন্তায় বাড়ীর তিন কর্তীর অবস্থা নাজেহাল। মেয়ের চিন্তায় রুমি বেগমের আহাজারি বাড়তেই লাগলো। বাড়ীর দুই কর্তা লিভিংরুমে পায়চারি করছে। পরী আমিরাও লিভিংরুমে বসা । মেহতাব, মিরাজ শিকদার, মায়ান আবারও বের হয়েছে। এখন ওদের ফেরার অপেক্ষায় আছে সবাই। এরপর যদি মেয়ের খোঁজ না পাওয়া যায় কি করবে? কোথায় খুঁজবে মেয়েটাকে? কোথায় গেলো? মেয়েটার সাথে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তখন? এসব আর ভাবতে পারছে না পরী। মাথায় ঘুরছে কতশত চিন্তা। লিভিং রুমে পিনপিনে নিরবতা। মাহদুল শিকদারের ফোন টুংটাং আওয়াজে বেজে উঠলো। মেহতাবের কল, কল রিসিভ করে মাহদুল শিকদার বললো,
– বলো মেহতাব।
সবাই এগিয়ে এলো অপাঁশ থেকে মেহতাব কি বললো কেউ শুনলো না তবে মাহদুল শিকদার হুংকার ছেড়ে বললো,
আমাদের মেয়ের কোনো ক্ষতি করলে আমি ছেড়ে কথা বলবো না মেহতাব।
মাহমুদ শিকদার এগিয়ে এসে ভাইজানের পাঁশে দাঁড়ালো। ব্যস্ত গলায় বললো,
ভাইজান কি হয়েছে? রিপ্তীর খোঁজ পেয়েছে?
তখনি বাহিরে গাড়ীর শব্দ শোনা গেলো। সবাই ছুটলো সেদিকে গাড়ী থেকে নেমে এলো মেহতাব সারারাত দৌড় ঝাপ, নির্ঘুম রাত চোখ মুখে ক্লান্তি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এলোমেলো উশখো খুশখো চুল। তার পিছনে পিছনে নেমে এলো মিরাজ শিকদার আর মায়ান তারপরই নেমে এলো রিপ্তী। পড়নে টকটকে লাল বেনারসি। ফর্সা মুখশ্রী কেমন যেনো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। আপাতত সেদিকে কারো নজর পড়লো না সবাই ছুটে গেলো মেয়েটার কাছে। পরী ছুটে গিয়ে জড়িয়ে নিলো রিপ্তীকে ,রুমি বেগম রিপ্তকে জুলেখা বেগমের কোলে দিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে নিলো এতোক্ষণে মায়ের মন শান্ত হলো বোধহয়। শব্দ করে কেঁদে উঠলো। মায়ের বুকে মুখ গুজে নিশ্চুপ রইলো রিপ্তী। রুমি বেগম মেয়ের কপালে, গালে চুমু এঁকে দিলো। কান্না গলায় বললো,
কোথায় ছিলি? কোথায় গিয়েছিলি মা?
রিপ্তী কিছু বললো না শুধু তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে পরপর বাড়ীর সবার দিকে আয়রা বেগম রিপ্তীর মাথায় হাত রেখে বললো,
কি হয়েছিলো? কোথায় ছিলি আম্মা। কত চিন্তা হচ্ছিলো জানিস?
রিপ্তী বড়মাকে জড়িয়ে ধরলো । বাড়ীর মেয়ে বাড়ীতে ফেরায় তিন কর্তীর আহাজারি কমলো। মেয়েকে নিয়ে বাড়ীর ভিতরে যাবে এমন সময় শিকদার বাড়ীর গেটে দেখা গেলো আনানকে পড়নে খয়েরী শার্ট, ব্লাক জিন্স, ফর্সা মুখশ্রীতে ঝুলছে সয়তানি হাসি। বাম হাতে এখনো ব্যান্ডেজ লাগানো। হালকা খুড়িয়ে হাঁটছে। আনান হালকা চেঁচিয়ে বললো,
কোথায় যাচ্ছিস? বাপ মা পেয়ে জামাইকে ভূলে গেলি নাকি?
রিপ্তী দাঁড়িয়ে গেলো। শিকদার বাড়ীর সবাই যেনো আঁকাশ থেকে পড়লো। জামাই? কার জামাই? আর এ ছেলে শিকদার বাড়ীতে আসার সাহস কি করে পায়? রিপ্তী আনানের দিকে তাকিয়ে পরীর হাত চেপে ধরলো শক্ত করে। পরীও অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আমিরাও রিপ্তীর সাথে দাঁড়ানো। আনান রিপ্তীর পাঁশে এসে দাঁড়িয়ে পরীকে উদ্দেশ্য বিশ্রী হেসে বললো,
পরী কেমন আছো তুমি?
পরী কথা বললো না। এ লোকটাকে দেখলে পরীর রাগ লাগে, ঘৃণা হয়। আনান নামক মানুষটা একজন বিশ্রী মানুষ, জগন্য একটা মানুষ। পরী মুখ ফিরিয়ে নিলো আনান বাঁকা হাসলো। রিপ্তীর হাত পরীর হাত থেকে টেনে শক্ত করে চেঁপে ধরলো। রিপ্তী বাড়ীর সবার দিকে তাকালো হাত ছাড়ানোর জন্য চেষ্টা করলো আনান মেহতাবের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো। সে এটা বুঝাতে চাচ্ছে বলেছিলি না তোদের বাড়ীর মেয়ের দিকে হাত বাড়ালে হাত কে/টে ফেলবি? নে এবার কে/টে দেখা।
মেহতাব হাত মুষ্টিবদ্ধ করে এগিয়ে আসতে নিলেই মাহদুল শিকদার ছেলের হাত টেনে ধরলো। রুমি বেগম তেড়ে এসে আনানের থেকে মেয়েকে ছাড়িয়ে নিয়ে তেজিকন্ঠে বললো,
অসভ্য ছেলে, বউ? কার বউ? ছাড়ো আমার মেয়েকে।
আনান সয়তানি হেসে বললো
– মামি, উফ শাশুড়ী আম্মা আপনার মেয়ে আমার বউ। দুমাস চুটিয়ে প্রেম করার পর কাল বিয়ে করেছি। বিশ্বাস হচ্ছে না তাই তো? রিপ্তী, তুই বল আমি তোর কে?
বলেই রিপ্তীর দিকে তাকালো সবাই অধির আগ্রহে রিপ্তীর দিকে তাকিয়ে আছে। মাহদুল শিকদার, মিরাজ শিকদার বাড়ীর মেয়ের জবাবের আশায় মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। রিপ্তী সবার দিকে তাকিয়ে রইলো কোনো কথা বললো না কি বলবে সে? এটা বলবে যে হ্যা এই লোকটা ওর বিয়ে করা বর। এটা বলবে? লোকটা যা বলছে সব সত্যি?
রিপ্তী নিজের হাত আনানের থেকে ছাড়ানের জন্য চেষ্টা করলো। এবার শুধু হাত ধরা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলো না আনান সবার সামনে রিপ্তীর গালে শব্দ করে চুমু বসিয়ে দিলো পরপর বললো,,
উফফ বউ নড়াচড়া করে না।
আনান আবারো বললো
কি রে বলছিস না কেনো? বল এই বাড়ীর কাউকে ভয় পাওয়ার দরকার নেই তোর।
মিরাজ শিকদার এগিয়ে এসে আনানের গালে সজোরে থাপ্পড় বসাতেই আনান ছিটকে পড়লো দূরে। মেহতাব এগিয়ে এসে কয়েকটা ঘুষি বসাতেই রিপ্তী চেঁচিয়ে উঠে বললো,
বাবা, মেহতাব ভাই উনার গায়ে হাত তুলবে না প্লিজ। উনি যা বলছে সব সত্যি।
মাহমুদ শিকদার মেহতাবকে টেনে সড়িয়ে নিলো। মেয়ের এহেন কথায় মিরাজ শিকদার যেনো পাথর হয়ে গেলো। আনান ঠোট বাকিয়ে হাসলো। রুমি বেগম এগিয়ে এসে মেয়ের গালে সপাটে চড় বসালেন আবার চড় বসাতে নিলে আনান শাশুড়ীর হাত ধরে নিলো। বললো,
মামি উফস সরি শাশুড়ী আম্মা আমার বউয়ের গায়ে হাত তুলবেন না প্লিজ।
পরী অবাক চোখে রিপ্তীর দিকে তাকিয়ে আছে। কদিন আগেও এই লোকটার নাম শুনলে রেগে যেতো রিপ্তী আজ এই অসভ্য লোকের হয়ে কথা বলছে? এতে পরিবর্তন? একদিনে এতো পরিবর্তন? মিরাজ শিকদার দ্বিতীয় বারের জন্য মেয়ের দিকে তাকালো না। আনান ক্রুর হেসে বললো,
নতুন জামাইকে কি বাসায় নিবেন না?
কিভাবে আপ্যায়ন করতে হয় জানেন না?
বাড়ীর গেটে লোকজনের আনাগোনা। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে বিনামুল্যে নাটক দেখছে। কেউ কেউ কানাঘুষা করছে। এতোক্ষন যাবৎ মাহদুল শিকদার একটা কথাও বলে নি এবার ধীরকন্ঠে বললো,
ছোট বউ ওদের বাড়ীর ভিতরে নিয়ে যাও।
মিরাজ শিকদার, মেহতাব রাগীস্বরে বললো, ভাইজান! বাবা!
মাহদুল শিকদার হাত উঠিয়ে বললো,
চুপ করো।
আনান মেহতাবের দিকে হাসলো বিশ্রী সেই হাসি। মিরাজ শিকদার বাড়ীর ভিতরে চলে গেলো। মেহতাব বাড়ীর বাইরে চলে গেলো। রাগে তার চোখ দুটো লাল হয়ে উঠেছে। সেদিন এই সয়তানের বাচ্চাটাকে একদম মে/রে ফেলা উচিত ছিলো। বড্ড বড় ভূল করেছে সে আর এহতিশাম। রুমি বেগম রিপ্তকে কোলে নিয়ে বাসায় ঢুকলো। জুলেখা বেগম অনিচ্ছা সত্ত্বেও আনানকে বাড়ীর ভিতর নিয়ে গেলো। সবার আড়ালে পরী রিপ্তীর হাত টেনে বাগানের দিকে নিয়ে গেলো ওদের সাথে সাথে আমিরাও ছুটলো।
রিপ্তী পরীর দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
আপা তুমি কি কিছু বলবে? আনান অপেক্ষা করবে আমার জন্য।
পরী অবাকের উপর অবাক হচ্ছে আমিরা রিপ্তীর মাথায় গাট্টা মেড়ে বললো,
প্রেম ছিলো? চুটিয়ে প্রেম করেছিস? কই আমি তো জানি না? মিথ্যা বলছিস? ওই আনান সয়তানটা ,,
কথা শেষ করতে পারলো না আমিরা রিপ্তী চোখ মুখ কুচকে ফেললো রাগীস্বরে ধমকে উঠে বললো,
ফালতু বকবক করবি না।
কে তুই? সব কথা তুই জানবি এমন তো কোনো কথা নেই তাই না?
আমিরা চুপ করে গেলো। রিপ্তী? রিপ্তী ওর সাথে এমন করে কথা বলছে? পরী রিপ্তীর গালে হাত রেখে ধীরকন্ঠে বললো,
সোনা বোন আমার কি হয়েছে তোর? কি হয়েছে পরী আপাকে বল। এসব কি করে হলো? কি করেছে ওই অসভ্য লোকটা? বল আমায়।
রিপ্তী বিরক্তি প্রকাশ করলো পরীর হাত গাল থেকে সড়িয়ে দিয়ে তেজিকন্ঠে বললো,
ধূর! তখন থেকে এক কথা বলে যাচ্ছো কেনো ?
বলেই রিপ্তী দ্রুত পায়ে বাসায় ঢুকলো। পরী অবিশ্বাস্য নজরে রিপ্তীকে দেখলো। এটা সেই রিপ্তী না যে রিপ্তী পরী আপা বলতে পাগল। রিপ্তী পালটে গেছে। পরী দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
আমিরা পরীর পাশে চুপটি করে দাড়িয়ে ছিলো।
আমিরা আর এক মুহুর্ত দেড়ি করলো না বাগান থেকে বের হয়ে গেলো। সারারাত রিপ্তীর চিন্তায় পা/গ/ল হয়ে উঠেছিলো আমিরা। নিজেই নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করছিলো। মনে হচ্ছিলো ও কলেজে গেলে এসব কিছ হতো না। রিপ্তী মিসিং হতো না। আমিরা যখন ছুটে গেট দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিলো তখনই মেহতাবের সাথে দেখা হলো। মেহতাব দেখলো মেয়েটার চোখ চিকচিক করছে। মেয়েটা কি কোনো কারনে কাঁদছে? কিন্তু কেনো? রিপ্তীর জন্য? মেহতাব ও আমিরার পিছু পিছু গেলো।
চলবে???