#প্রিয়তে_তুমি_প্রাণ💜
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১৮
আট দশ মিনিট বাদে প্রান্তিকের কেবিনে ঢুকল আরিনা। প্রান্তিক তাকে দেখে বিন্দুমাত্র অবাক হলো না। সে জানত আরিনা আসবে। ওত পেতেই যেন ছিল, কখন সে অফিসে এসে। এই কারণেই তো ছুটে চলে এলো। সোজা এসে বসে পড়ল চেয়ারের উপর। প্রান্তিকের মুখোমুখি। আজ তাকে যেন একটু বেশিই খুশি লাগছে।
প্রান্তিকের সাদা শার্ট লেপ্টে আছে শরীরের সাথে। গলার টাই আজ পরা হয়নি। চুলগুলো ঠিকঠাক নেই, মুখটাও ফ্যাকাশে। ভীষণ অগোছালো লাগছে তাকে দেখতে। এর কারণ ধরতে বেশিক্ষণ লাগল না আরিনার। গতকাল যে আ’গুন সে জ্বা’লিয়েছে তা এখনো ভালো করেই জ্বলছে বোঝা যায়। পোড়া পোড়া গন্ধ এখান থেকেই পাচ্ছে সে। আরিনাকে আজ খুশি খুশি লাগছে। প্রান্তিকের এমন উদাসী মনই যেন তার খুশির কারণ। প্রান্তিক এবার নড়েচড়ে বসল। তার চোখের নজর সরছে না আরিনার উপর থেকে। ক্ষো’ভ, ঘৃ’ণা, অভি’মান সবকিছু সেখানে উপস্থিত।
আরিনার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিল বছর খানেক আগে। আরিনার পর আর কারো সাথে সম্পর্ক হয়ে উঠেনি। আরিনা থাকতে আবার নতুন কেউ! তাদের সম্পর্ক গভীর ছিল, যথেষ্ট গভীর! আরিনা তাকে ভালোবাসতো। একটু বেশিই কি না বাসতো। প্রান্তিকের স্বভাব চরিত্র নিয়ে বহু আগে থেকেই জানাশোনা ছিল। এরপরেও প্রান্তিকের সাথে সে সম্পর্কে জড়িয়েছে। সবটুকু দিয়ে ভালোবেসেছি, ব্যতিক্রমী ও হয়েছে। সবার চাইতে ভিন্ন। কিন্তু তবুও তার মনে ভয়ের বাসা বাঁধতো। এই মনে হতো প্রান্তিক তাকে ছেড়ে দিচ্ছে। ভয় হতো কেবল। প্রান্তিক যদি তাকে ছেড়ে দেয় তখন কি হবে? সম্পর্কে আসে সন্দেহ আর অভিমান। কোনো সম্পর্কে সন্দেহ আসলে তা বেশিদিন টিকতে পারেনা। আরিনা সন্দেহের যথেষ্ট কারণ ছিল কিন্তু সে ভুলে গেল। ভালোবাসায় সন্দেহ থাকতে নেই। ভালোবাসতে হয় মন প্রাণ দিয়ে।
তবু কতোখানি সহ্য করা যায় এসব। প্রান্তিক যে অভ্যস্ত ছিল না। বার বার ফোন করে কোথায় আছো জিজ্ঞেস করা, কার সাথে আছো, কি করছো? কোন মেয়ের সাথে কথা বলছো, এতো কেন মিশছো? এসবের উত্তর দেবার মতো মনোভাব তার তখনো হয়ে উঠেনি। অকারণে ঝগ’ড়া আর অপ’মানে অতিষ্ঠ হয়ে প্রান্তিক শেষমেষ এই সম্পর্ক ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়।
অথচ তার মনে কিছু ছিলনা এমনটাও নয়। বউ হিসেবে আরিনা খারাপ হয়না। এরমধ্যে আরিনার সাথে সম্পর্ক এতো গভীর হওয়ায় একটু দুর্বল যেন সে হয়েই গেছিলো। দাদাজান কেও বলেছিলো আরিনার কথা। তিনি অবশ্য আগে থেকেই আরিনাকে চিনতেন। আরিনার বাবার সুবাদে। খোঁজখবর নেবার পর তিনি এককথায় না করে দিলেন। তার কঠোর নিষেধ, এই মেয়ে এই বাড়ির বউ হতে পারবে না। তিনি কি জেনেছিলেন তা জানা নেই তবে তার মনে ভয়ের বাসা বেঁধেছিল। এই মেয়েকে মিসেস ক্যারির সাথে গুলিয়ে ফেলছিলেন তিনি। এক মেয়ের জন্য ছেলে হারিয়েছেন। আরেক মেয়ের জন্য একমাত্র নাতিকে হারাবেন। সম্ভব না! এমন মেয়েকে বাড়ির বউ বানিয়ে আনলে সংসার জোড়া লাগার বদলে ভা’ঙবে আরো। আবেগ দিয়ে কি সংসার হয়? ছেলে ভালোবেসে বিয়ে করে আনেনি। কতোদূর চলল সম্পর্ক? সবই তো দেখলেন। তার ছন্নছাড়া নাতিকে শুধরানোর জন্য যেমন মেয়ে দরকার তেমনি পেয়েছিলেন প্রিয়তার মধ্যে। তাই তো আরিনার থেকে প্রিয়তাকে তার উপযুক্ত বলে মনে হলো।
দাদাজানের না বলার পর প্রান্তিক আর কথা বাড়াল না। তার নিজের ও মনে হলো, এই সম্পর্ক জোড়া লাগলেও বেশিদিন টিকবে না। আরিনার যেমনি তাকে সন্দেহের চোখে দেখে, এই সংসারে কোনো শান্তি থাকবে না। নিজের মা বাবাকে দেখে যথেষ্ট বুঝেছে সে। তবে বলে না, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। এবার, প্রিয়তা সবকিছু জানার পর তাকে বিশ্বাস করতে পারবে তো?
মানুষ হিসেবে আমরা নিজেদের একটু বেশিই চালাক ভাবি। অথচ অনেক ভেবেচিন্তে আবার ভুল সিদ্ধান্তকেই বেছে নিই। আরিনা এসেছে ২ মিনিট হলো। সেই প্রথম হেসে জিজ্ঞেস করল,
“কেমন আছো?”
“খুব ভালো!”
“তোমাকে দেখতে অনেক ক্লান্ত লাগছে।”
“লাগতেই পারে কিন্তু বিশ্বাস করো তুমি আমার শান্তি নষ্ট করতে পারবে না। কিছুদিনের জন্য হয়তো অশান্তি হবে কিন্তু আমার বিশ্বাস সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”
আরিনা কিঞ্চিত হাসল। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল অদ্ভুত ভাবে। চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসল আরাম করে। বলল, “একটা মেয়ে সবকিছু ভাগ করে নিতে পারে কিন্তু নিজের পুরুষকে নয়। প্রিয়তা মেনে যাবে এমনটা কেন ভাবছো?”
“চা খাবে?”
“না কফি। কিন্তু তোমার চায়ের নেশা কবে থেকে হলো?”
প্রান্তিক মৃদু হেসে বলল, “আমার বউ খুব ভালো চা বানায়, ওর থেকেই অভ্যাস হয়ে গেছে!”
ঠোঁটে লেগে থাকা হাসিটা উধাও হয়ে গেল নিমিষেই। ছোট করে বলল, “ওহ”।
কফি আর চা এসেছে। প্রান্তিক নির্বিকার ভঙ্গিতে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। কিন্তু চা তার মন মতো হয়নি। প্রিয়তা অনেক দারুণ ভাবে চা বানায়। আরিনা অবাক হয়ে দেখল একপলক। অতঃপর নিজের কফি মগে চুমুক দিল। প্রান্তিক চায়ের কাপ রেখে বলল,
“এটা কি খুব দরকার ছিল?”
“আমায় জিজ্ঞেস করছো? তোমার কি মনে হয়? আমি তোমায় এতো ভালোবেসেছি অন্যের সাথে সুখে দেখবো বলে?”
“এটা তোমার কেমন ভালোবাসা আরিনা, যেখানে তুমি তোমার ভালোবাসার মানুষের সুখই দেখতে পারো না?”
কফির মগখানা কেঁপে উঠল। কেঁপে উঠল আরিনার হাত। প্রান্তিক তাঁর চোখে চোখ করে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠলো, “যা কিছু হয়েছে সবটাতে দোষ কি কেবল আমার? তোমার কনট্রিবিউশন কি নেই? আমরা এডাল্ট আরিনা। আমি থার্টি প্লাস পুরুষ। তুমি আমি একসাথে রাত কাটালে সেখানে কি হতে পারে তা সবারই জানা। কিন্তু তাই বলে এভাবে? আমি তো তোমাকে জোর করিনি। তুমি কি বলবে? আমি তোমার ফায়দা নিয়েছি?”
আরিনা একটু বিচলিত হয়ে উঠল। কফি মগ রেখে আচমকা বলে উঠলো, “আমি সে কথা কখন বললাম!”
“বলোনি। যা বলেছো তা আ’গুন লাগানোর জন্য যথেষ্ট। প্রিয়তাকে তুমি চিনো না। তোমার কথায় সে কতোটা কষ্ট পেয়েছে আমি সেটাও তোমাকে বলতে চাই না। ব্যস এতো টুকু বলি, আমাদের ক্ষ’ত সারাজীবন তাজা থাকে না। শূন্যস্থান বলে কিছু নেই, একসময় না একসময় তা পূরণ হয়ে যায়। তুমি কি ভাবছো? তোমার সারাটে জীবন আমায় ভালোবেসে কেটে যাবে? অসম্ভব! হতেই পারে না। সময়ের সাথে সাথে সব ক্ষত শুকিয়ে যাবে। তোমার জীবনেও তুমি আবার কাউকে ভালোবাসবে। তার সাথে জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখবে। কি হবে? তখন যদি আমি গিয়ে তোমার আর আমার অতীতের রঙিন দিনের কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দিই। ভালো লাগবে? ততোদিন না আসা অবধি তুমি আমার পরি’স্থিতি বুঝতে পারবে না!”
কথাটুকু শেষ করে ঘড়ির দিকে চোখ গেল প্রান্তিকের। এবার তাকে উঠতে হবে। উঠে দাঁড়াল সে। আরিনা এতোক্ষণ কেবল মনোযোগ দিয়ে সমস্তটা শুনল। নরম স্বরে বলে উঠলো, “কি হবে যদি তা কখনো না হয়? আমি কখনো তোমাকে ভুলে না যাই। সারা জীবন তোমাকে ভালোবাসতে থাকি!”
প্রান্তিক নিজের চেয়ার জায়গামতো রাখল। হেটে দরজার কাছ অবধি এলো। এক হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে বলল, “তাহলে আমি বলব আমি লাকি। তোমার সাথে এতোবড় অ’ন্যায় করার পরেও তুমি আমায় ভালোবাসো, এর জন্য নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবতেই পারি। আবার দু’র্ভাগাও! তোমার সেই ভালোবাসা আমার কপালে নেই আছে কেবল তোমার মনে। যে নিঃস্বার্থ ভালোবাসতে পারে আমরা তাকেই মহৎ বানিয়ে দিই। তবে এই আমাদের শেষ দেখা। চাইব আর কখনো আমাদের দেখা না হোক। যা ছিল এখানেই শেষ হয়ে যাক।”
কথাগুলো বলে বেরিয়ে গেল প্রান্তিক। আরিনার কথা শোনার জন্য আর দাঁড়ালো না সে। আর কিছু যেন তার শোনার নেই।
#চলমান
#প্রিয়তে_তুমি_প্রাণ💜
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১৯
আরমিশা একটু চিন্তিত। গতকাল থেকে আপার সাথে কোনো কথা হয়নি। সকাল থেকেই ফোনটা আবার বন্ধ। রোজ সকাল ১০ টার দিকে আপা একবার হলেও কল করে। আবার কল করে রাতের দিকে। কিন্তু এখন অবধি কোনো কল এলো না। এর মধ্যে কল করেও পাচ্ছে না। খানিক চিন্তা বাড়ল তার। মা একবার বললেন জামাইয়ের ফোনে কল করতে। তাহলেই তো হয়ে যায়। হ্যাঁ হয়েই তো যায়। ব্যাপারটা আগে মাথায় আসেনি। এবার আসতেই সময় নষ্ট না করে কল করে ফেলল আমরিশা। ওপাশ থেকে রিসিভ করতে বেশিক্ষণ লাগল না।
“হ্যালো ভাইয়া, কেমন আছেন?”
“হ্যাঁ ভালো। তুমি বলো তোমাদের খবর কি?”
“ভালো ভাইয়া। আপুর ফোনটা তো রাতের থেকে বন্ধ। কল করে পাচ্ছি না।”
গাড়ির স্পিড কমিয়ে দিল প্রান্তিক। গতরাতে প্রিয়তা ফোনটা সরিয়ে রেখেছে সে। বার বার এক অনাকাঙ্ক্ষিত ভয় এসে আঁকড়ে ধরে তাকে। গলার স্বর স্বাভাবিক রেখেই বলল, “ওই ওর ফোনটা হাত থেকে পড়ে ন‘ষ্ট হয়ে গেছে। ঠিক করতে দিয়েছি সময় লাগবে। আমি বাসায় গিয়েই তোমার সাথে কথা বলিয়ে দিচ্ছি আমরিশা।”
“ঠিক আছে!”
ফোন রেখে দিল আমরিশা। তার মন আনচান করছে। ভাইয়া তো নতুন একটা ফোন কিনেই তো দিতে পারতো। এতে তো অসুবিধা হবার কথা নয়। ব্যাপার কি অন্যকিছু নাকি?
মাকে কথা কথাটা বলার পর মাও তাই বললেন। কিন্তু আমরিশাই তখন আবার সাফাই গাইলো। হতেই পারে ফোনে ইম্পর্ট্যান্ট কিছু আছে। সেটাই লাগবে। নিজের বোনকে সে চিনে। বাজে খরচ করার স্বভাব নেই তার। হাতে এখন অঢেল টাকা থাকলেও সেই অভ্যাস বদলানোর নয়। বোধহয় একটু বেশিই ভাবছে সে। ফোনটা টেবিলে রেখে ব্যাগটা গুছিয়ে নিচ্ছে। ভার্সিটির জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ফোনের স্ক্রিনে একটা মেসেজ ভেসে উঠল। মান্নাতের মেসেজ, “ভার্সিটিতে যাচ্ছো আজ?”
আমরিশা খানিকক্ষণ চেয়ে রইল। জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করল না। লোকটা বেশ কিছুদিন ধরে তার ভার্সিটির আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করে। তার মতলব আমরিশা বুঝেনি এতোটাও অবুঝ নয় সে। কিন্তু এই মতলব কতোটা সৎ!
——–
বাড়িতে ফিরার পরই নিজের ফোন দিয়ে কথা বলিয়ে দিল আমরিশার সাথে। দুই বোনের মধ্যে কি আলাপ চলল তা শোনবার জন্য প্রান্তিক অপেক্ষা করল না। তাহলে ফোনটাই বা সরিয়ে রাখল কেন? কিসের এতো ভয় তার? কথা বলা শেষ করে প্রিয়তা রুম থেকে বের হতে গিয়ে দেখল প্রান্তিক তার কাছেই আসছে। প্রিয়তা ফোনটা এগিয়ে দিল। কিছু জিজ্ঞেস করল না। মুখে কুলুপ এঁটে আছে যেন। তার এই নিশ্চুপতা প্রান্তিকের ভ‘য় কে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
নিজের মনকে প্রশ্ন করল, সে কি বাড়াবাড়ি করছে? সবার তো নিজ নিজ স্বাধীনতা আছে। তার সাথে কে থাকবে না থাকবে এতে দুই পক্ষের মতামত তো দরকার। কিন্তু প্রিয়তা মাঝে চলে এলেই যেন স্বার্থপর হয়ে উঠে প্রান্তিক। ঘাড়ের রগ গুলো স্প‘ষ্ট হয়ে ফুটে উঠে। চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায়। পেশিবহুল হাতের মুঠোয় রা‘গ সংযত করতে ব্যর্থ হয়ে পড়ে। রাগ পুরোটাই নিজের উপর। চরিত্রের উপর দাগের জন্য স্বয়ং সে নিজেই দায়ী। কেন যে নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। তাহলে তো আজ এমন হতো না। প্রিয়তার সামনে মাথা নিচু করে রাখতে হতো না। যেই ভালোবাসা নিয়ে এতোদিন খেলায় মেতে ছিল, যেই ভালোবাসাকে এতোদিন তুচ্ছ মনে হচ্ছিল সেই ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আজ সে এতো উতলা।এই উতলা মনকে কিভাবে বুঝাবে সে।
প্রিয়তা রান্না করেছে। অভিমানে রান্নাঘরে পা দেওয়া উচিত হয়নি। তবুও দিয়েছে। তার বরমশাই গতরাত থেকে না খেয়ে আছে। সকালে দুপুরে কেন খায়নি সে কারণ খুলে বলতে হবে না। রাতে বসার ঘরের সোফার উপর বসে থেকেই দেখেছে প্রিয়তা রাঁধছে। এবার সে খেতে বসেছে। কিন্তু প্রিয়তা আজ স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেনি। নিজের খাবার টুকু বেড়ে টেবিলের শেষ মাথায় বসে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে খেতে বসেছে। টেবিলের এই প্রান্তে বসে প্রান্তিক নিষ্পলক দৃষ্টিতে দেখছে তাকে। হৃদয়ে রক্ত‘ক্ষরণ হচ্ছে। এমনটা কখনো হয়নি। প্রথমে প্রান্তিক কে খাবার না দিয়ে নিজে কখনো খায়নি। সবসময় বসেছে প্রান্তিকের পাশের চেয়ারে। অথচ আজ কতোটা দূরে। এই যে টেবিলে এতো দূরত্ব রেখে বসাটা কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে প্রিয়তা। তাদের দূরত্বের! চাইছে আর কতো দূরে চলে যাওয়া যায়। যেতে পারলে চলে যেত।
প্রিয়তা খেয়ে উঠে গেল। নিস্তব্ধ পায়ে উঠে চলে গেল উপরের ঘরে। তার ভাবভঙ্গি খুব স্বাভাবিক। প্রান্তিকের কোনো কিছুতে তার যেন আগ্রহ নেই। বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। কিন্তু পুরোপুরি ভাবে প্রান্তিক কে সে অগ্রাহ্য করতে পারেনি। উপরে উঠার পরেও উঁকি মেরে দেখেছে প্রান্তিক খেয়েছে কি না। রান্নাঘরে যে মেয়েটিকে ইশারা দিয়ে এলো খানিকবাদেই সে খাবার নিয়ে হাজির হলো। প্রান্তিক খাবারের থালা নিয়ে বসে আছে। খাচ্ছে না। আজ একটিবারের জন্যও প্রান্তিকের মুখের দিকে ফিরে চায়নি সে। ফিরে চায়নি ভয়েতে। ফিরে চাইলেই যে কপালের দাগ কাটা ক্ষ‘ত স্থানে চোখ বুলাবে বার বার। বুকের মধ্যে তীব্র যন্ত্র‘ণা হয়। তার নিজের দেওয়া আঘাত নিজেই সইতে পারে না প্রিয়তা। ভালোবাসা খুব সহজ। কিন্তু যেই মানুষকে ভালোবেসেছি তাকে ঘৃণা করা যে বড্ড কঠিন। প্রান্তিক না খেয়েই উঠে গেছে দেখে প্রিয়তা ছুটে ঘরে ঢুকে গেল। এদিকে প্রান্তিক উঠে আবারো বসল। খেতে শুরু করল।
ভালোবাসা অদ্ভুত, বিচিত্র! মন প্রাণ দিয়ে একবার ভালোবাসলে মুছে ফেলা কঠিন। ভালোবাসা সবকিছুকে নিচে নামিয়ে দেয়। আত্মসম্মান মূর্ছা যায় ভালোবাসা নামক শব্দটির কাছে। জীবনে প্রথমবার কাউকে ভালোবেসে চরমভাবে ঠ‘কে যাওয়ার কষ্ট কেবল সেই মানুষই বুঝে। আবার যখন যাকে ভালোবাসো তাকেই ঘৃণা করতে হয় তখন বাঁধে বিপিত্তি। দুটি কাজ যে একসঙ্গে করা খুব মুশকিল। মায়ার বাঁধনে আটকে গেল রক্ষা করবে কার সাধ্যি। জীবনে প্রথম ভালোবাসা যে বারবার কেন কাঁদায় সেটা চরম ভাবে বুঝতে পারল সে। প্রথম ভালোবাসা কি সবসময় ভুল মানুষের সাথে হয় নাকি ভুল সময়ে সঠিক মানুষকে ভালোবেসে ফেলার চর‘ম শা‘স্তি পেতে হয়!
কিন্তু আত্মসম্মানের চেয়ে বেশি কিছু নয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা যেন এই আত্মসম্মান নিয়েই বেঁচে থাকে। তারা ধনী না হোক আত্মসম্মানবোধের দিক দিয়ে ধনীদের ও ছাড়িয়ে যায়। যতই ভালোবাসা আর ঘৃণার মাঝে পার্থক্য খুঁজে বেরাক না কেন? আত্মসম্মান বোধ মাথা থেকে বেরিয়ে যায় নি। যাবেও না! ক্ষণিকের জন্য হলেও এই মানুষটি তাকে ঠকিয়েছে এই কথা বারবার তার কানে বুলায় অদৃশ্য কিছু। গা গুলিয়ে আসে তখন। নিজেকে কাঁদার সাথে লেগে থাকে নোংরা নর্দমার মতো মনে হয়। অন্য কারো সাথে কিভাবে যুদ্ধ করবে প্রিয়তা। সে তো নিজের মন, মস্তিষ্ক আর বিবেক বোধের কাছে হেরে বসে আছে। তার আর প্রান্তিকের মধ্যে চলছে নিরব যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কে জিতবে জানা নেয় তবে হার’টা যেন দু’জনেরই হবে।
আমাদের সমাজে ডির্ভোসি মেয়েদের কোনো সম্মান নেই। সেদিকে প্রিয়তার বিয়ের ৬ মাস ও এখনো হয়নি। এখনই বাপের বাড়ি ফিরে গেলে কম ঝড় সইতে হবে না। আঙ্গুল তো তার উপরই উঠবে। সূর্যের তেজ হাজারো থাকলেও কলঙ্ক তো চাঁদেরই হয়। সে কেন বেঁচে যাবে?
ঘরে তিনটে বোন এখনো যুবতী। বাবা মা আজ বুকে টেনে নিবে বছর ঘুরতেই তাঁরাই আবার স্বার্থ‘পর বলে বেড়াবে না তার কি ঠিক আছে? এরই মধ্যে তার বাবা বিছানায় পড়া পঙ্গু মানুষ সত্যিই কি এতো স্বার্থপর হতে পারে প্রিয়তা। লোকে বলে যাই হয়ে যাক না কেন? মেয়ে মানুষের উচিত স্বামীর বাড়িতে মাটি কামড়ে পড়ে থাকা। নাহলে মান সম্মান হারাতে হয়। হার মেনে ডুক‘রে কেঁদে উঠল। মাথার মধ্যে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কোনোটার উত্তর নেই। নিজের মনের সাথে লড়ে লড়ে ক্লান্ত প্রিয়তা। জীবনের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর সিদ্ধান্ত খুব সামলে নিয়েছিলো সে অথচ এতো বড় সিদ্ধান্তে এতো অবহেলা করল। বাবার উপর বিশ্বাস করে রাজী হয়ে গেল। মা বাবা কি আর খারাপ চায়। তারা এসব জানলে আর কি কখনো বিয়ে দিত!
নিজের উপর চরম রাগ‘ হচ্ছে তার। কেন এতো ভালোবাসতে গেলো? কিছুদিন কি সবুর করতে পারত না। মনের মানুষ পেয়ে সব ভালোবাসা উপড়ে দিয়ে দিল। ভেবেও দেখল না কার চরণে ভালোবাসার ফুলের অঞ্জলি দিচ্ছে। কার স্বপ্নে মালা গাঁথছে। একটু সবুর করে ভালোবাসলে যেন এতো কষ্ট পেতে হতো না। বড্ড তাড়াহুড়ো করে ফেলল। কিন্তু আবেগ কি আর এসব বুঝে? হৃদয় তো বুঝে না মস্তিষ্কের কথা। সে এসব শুনতেও চায় না। দুজনে বিপরীত ধর্মী। তাদের মতামত ও যে আলাদা ধরণের।
নোনাজলের অশ্রু হাতের উল্টো পিঠে মুছে ফেলল। অশ্রু মুছে দেবার কেউ নেই। নিজেকে আজ বড্ড নিঃসঙ্গ লাগছে। কারো সাথে মনের কথা খুলে বলতে পারছে না। কাকেই বা বলবে এসব? এই বাড়ি ছেড়ে একবার বেরুতে পারলে গেলে দূরে কোথাও চলে যাবে সে। একদম দূরে কোথাও। আর ফিরে আসবে না। মা বাবার কাছেও ফিরবে না। তাহলে কারো বোঝা হতে হবে না। সমাজের মুখোমুখি হতে হবে না। সেটাই তবে ভালো। মন্দ তো নয়। কিন্তু প্রান্তিক কে ছাড়া বাকিটা জীবন চলা সহজ হবে তো তার পক্ষে।
————
ঘরের সমস্ত আলো নিভানো। এই ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে হুট করে দরজা খোলার শব্দ। প্রিয়তা তটস্থ হয়ে উঠল। প্রান্তিক তবে আসছে। আবারো সেই অন্ধকার জগত। এই জগত তার ভীষণ অন্যরকম মনে হয়। সেই দিনকার মতো প্রান্তিক তার পায়ের কাছে বসেনি। বসেছে তার বিপরীতে বিছানার পাশে। পুরোটাই প্রিয়তার অনুভব থেকে বলছে। গুটিসুটি মেরে রইল বিছানার এক কোণে। চোখের শেষ বিন্দু কণাও যেন পড়ল বালিশের উপর। প্রিয়তা টের পাচ্ছে প্রান্তিক তার পাশেই শুয়ে পড়ছে। চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করল। প্রান্তিকের সাথে কোনো কথা বলতে চায় না সে। আচমকা হেঁচকা টানে প্রান্তিক তাকে নিজের টেনে আনল।
প্রিয়তা ছটফট করল না, প্রতিবাদ করল না। ঠিক যেমনটি ছিল তেমনটি রয়ে গেল। প্রান্তিক তাকে বুকের সাথে মিশিয়ে জড়িয়ে ধরল। আবারো সেই ঘ্রাণ! পারফিউমের সুবাস। প্রিয়তাকে পাগল করা সেই সুবাস প্রিয়তার চারদিকে কেবল উড়ে বেড়াচ্ছে। প্রান্তিকের গরম নিঃশ্বাস পড়ছে তার মুখের উপর। এতোটাই কি প্রান্তিকের কাছাকাছি সে।
হাত দিয়ে মাথার চুল গুলো বুলিয়ে দিচ্ছে প্রান্তিক। আচ্ছা সে কি জেনে প্রিয়তা জেগে আছে। কেবল ঘুমের ভান ধরছে। প্রান্তিক কি সবটা বুঝে গেল। তাহলে এবার তাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করবে। অনেক কথা বলবে। কিন্তু প্রিয়তা যে কিছু শুনতে চায় না। দুর্বল যে আর সে হতে পারে না। এতো দুর্বল হয়ে পড়লে ছেড়ে যাবে কি করে?
মস্তিস্কে ঘণ্টার মতো বেজে উঠল। এবার ছটফটানি শুরু করল প্রিয়তা। না, তাকে এই বাঁধন থেকে রেহাই যে পেতে হবে। এভাবে বাঁধনে আটকা পড়লে হবে না। কিন্তু দৃঢ় পুরুষালি কণ্ঠস্বর পেতেই থমকে গেল সে। আবারো সেই কণ্ঠস্বর। সেই অচেনা কণ্ঠেই বারবার তার বুক কেঁপে উঠে।
“একটু কথা বলো আমার সাথে বউ। আর কতোক্ষণ কথা না বলে থাকবে।”
প্রিয়তা ভাবল জবাব দিবে না। কিন্তু পরক্ষণেই মাথায় কি চেপে বসল। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো, “সারাজীবন!”
“যাক, তবুও এই অজুহাতে সারাজীবন আমার সাথে থেকে যাও। কথা দিচ্ছি কষ্ট দিবো না তোমায়। কখনো কষ্ট দিবো না। তুমি সারাটে জীবন কথা না বললেও চলবে। আমি কেবল তোমায় দেখব!”
“ছাড়ুন, আমার কষ্ট হচ্ছে!”
“আমি ছেড়ে দিলে কি কষ্ট কমে যাবে!”
প্রিয়তা সময় নিল। ভেতর থেকে ঝ‘ড়ের বেগে আসা কান্না টুকু গিলে নিয়ে বলল, “হু!”
“মিথ্যে বলো না।”
“বলছি না।”
প্রান্তিক কথা বাড়ল না। আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিল তাকে। আড়ষ্ট হয়ে রইল দুই দেহ। বেশ কিছু নিরবতায় কেটে গেল। প্রিয়তা প্রান্তিকের টি শার্ট হাতের মুঠোয় খামচে ধরে আছে। কান্না আটকানোর জন্য ঠোট চেপে আছে। প্রান্তিক এবার নরম স্বরে বলল,
“আমায় কি ক্ষমা করা যায় না প্রিয়তা!”
প্রিয়তা নাক টানল। কিছুক্ষণ পর স্পষ্ট কণ্ঠে বলে উঠলো, “আপনি বলুন, আমায় গায়ের গন্ধের সাথে তাদের গন্ধ মিলিয়ে ফেলেন না!”
প্রিয়তা ভেবেছিলো এই প্রশ্ন করার পর প্রান্তিক তাকে ছেড়ে দিবে। ঠিক আগেরবারের মতো। কিন্তু এবার বাঁধন আলগা হলো না। একবিন্দু নড়চড় হলো না। প্রান্তিক বলে উঠলো,
“কখনোই না। তুমি তোমার সাথে তাদের তুলনা করছো?”
“কেন করব না? আমরা তো একই। একই দেহ। পার্থক্য কোথায়?”
“পার্থক্য আছে প্রিয়তা। তোমার মাথা এখন গরম বুঝতে পারবে না।”
“আপনি আমাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছেন!”
“দিচ্ছি বুঝি! বিশ্বাস করো আমি ভালো নেই। তোমায় কষ্ট দিয়ে আমি ভালো থাকতে পারি না। খুব স্বার্থ‘পরের মতো কাজ করছি। এই প্রথমবার এমন করছি। করে দেখি তোমায় আটকে রাখতে পারি কি না!”
ভেতর থেকে ছিটকে আসা কান্না আর আটকে রাখতে পারল না প্রিয়তা। প্রান্তিকের টি শার্ট খামছে ধরে কেঁ‘দে উঠল হুড়মুড়িয়ে। প্রান্তিক নিশ্চুপ হয়ে তার কা‘ন্না শুনছে। আবারো হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মাথায়। তবু বাঁধন আলগা হলো না। প্রিয়তা কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো,
“আপনি, আপনি খুব স্বার্থপর! খুব বেই‘মান। শুধু নিজের টা বুঝেন আমারটা বুঝতে পারছেন না। আমি থাকব না আপনার সাথে। এখানে থাকলে দম বন্ধ হয়ে মা‘রা যাবো। আমার নিঃশ্বাস আট‘কে যায় এখানে। আমি থাকতে পারব না এখানে!”
কান্নার মাঝে তার কথাগুলো আরো এলোমেলো লাগল। তার কান্না ক্ষতবি‘ক্ষত করে দিচ্ছে প্রান্তিকের হৃদয়। তার বুকে মাথা রেখেই তার প্রেয়সী কাঁদছে। কাঁদছে তার জন্যই। সেই কাঁদাচ্ছে তাকে। এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কি হতে পারে? কিন্তু প্রান্তিক কিভাবে বুঝায় সে তো কখনো স্বার্থ‘পর ছিল না। নিজের জীবনে কখনোই কাউকে জোর করে আটকে রাখেনি। এবার রাখতে চাইছে। ভালোবাসা তাকে স্বার্থ‘পর বানিয়ে দিচ্ছে। সে কি করে বুঝায়।
———
সারারাত দুজনের কেউই ঘুমাতে পারেনি। শেষ রাতে দুজনের চোখ লেগে গেল। প্রান্তিক তার বাঁধন ছাড়েনি। শক্ত বাঁধনে আঁকড়ে ধরে আছে প্রিয়তাকে। কিন্তু ঘুমের ঘোরে কতোক্ষণই বা আগলে ধরে রাখতে পারে। ঘুম যখন ভাঙল তখন ভোর ৬ টা বাজে। বিছানার পাশে বউকে না পেয়ে তাজ্জব বনে গেল সে। হুড়মুড়িয়ে নামল বিছানা থেকে। এদিক ওদিক পুরো বাড়ি তল্লা‘শি করল। রাগে তার চোয়া‘ল শক্ত হয়ে গেল। পেশিবহুল হাতের রগ ফুলে উঠেছে। সদ্য ঘুম থেকে উঠায় চোখ গুলো লালচে হয়েছিল তা এবার রক্তিমে পরিণতি হলো। স্থির দৃষ্টিতে থমকে দাঁড়িয়ে রইল। তার পুরো পৃথিবী যেন তার তছনছ হয়ে গেছে। ঝড়ের মতো ঠান্ডা বাতাস তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরছে। মস্তিষ্কের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছিলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য তা আবার চলাচল করতে শুরু করেছে। কানে কেবল বাজছে একটি কথা, প্রিয়তা পালি‘য়েছে!
——
খুব ভোর! এতো ভোরে রাস্তায় কাকপক্ষী ছাড়া আর কারো দেখা মিলার কথা নয়। কেই বা এতো ভোরে রাস্তায় বের হয়? চায়ের টংয়ের দোকানগুলো অবধি বন্ধ পড়ে আছে। তেরপাল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে সমস্ত কিছু। এরই মাঝে রাস্তার মাঝে দৌড়ে ছুটে যাচ্ছে এক যুবতী মেয়ে। পরনে সাদা রঙের সালোয়ার কামিজ, বুকের উড়না দুহাতে আকড়ে ধরে ছুটে যাচ্ছে গন্তব্যহীন উদ্দেশ্যে। খালি পায়ে কতো বাঁধা পেরিয়ে ছুটছে। কিন্তু কার কাছ থেকে ছুটে পালাচ্ছে। নিজের ভালোবাসার মানুষ থেকে। কতোটা অ‘সহায় হলে মানুষ এমনও করতে পারে। ছুটতে ছুটতে বার বার চোখ ভরে উঠছে গরম নোনা জলে। প্রিয়তা তা ঠেকিয়ে রাখার সর্বস্ব চেষ্টা করছে। মেইন রাস্তার উপর ছুটতে ছুটতে পায় অনেকদূর এসে গেল। হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল রাস্তার উপর। হামাগুড়ি খেয়ে উঠে দাঁড়াল। ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠলো সে। আর যে পারছে না নিজের সাথে লড়াই করতে। হাঁপিয়ে উঠেছে সে। এতো ভোরে রাস্তার উপর বসে কোনো যুবতী কাঁদছে, ভৌ‘তিক ছাড়া ব্যাপারটা আর কিছুই নয়। প্রিয়তার জীবনীশক্তি ফুরিয়ে আসছে। মনোবল ভেঙে যাচ্ছে। হৃদয় বলছে ফিরে যেতে। তার হৃৎপিণ্ডে চলাচলকারী রক্ত কণিকা গুলো কেবল প্রান্তিকের নাম জপ করছে। অথচ মস্তিষ্ক বলছে ছুটে পালিয়ে যেতে দিগন্ত পেরিয়ে। আর ফেরত না আসতে এই পথে। একবার ফিরে গেলে যে নিজের সত্তাকে হারিয়ে ফেলবে। দ্রুত বেগে একটা গাড়ি এসে থামল প্রিয়তার সামনে। নাক টেনে কান্না থামিয়ে সামনে তাকাল। ঝাপসা ঝাপসা চোখে কাউকেই ঠিক করে ঠাওর করতে পারল না। কিন্তু সে আর যাই হোক প্রান্তিক ছিল না। এতো টুকু চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারে সে। দেখতে দেখতে তার চোখ বুজে আসছে। শরীর অসাড় হয়ে উঠল। অতঃপর…
——–
নিজের ইজি চেয়ারে দোল খাচ্ছে প্রান্তিক। চোখ বন্ধ করে ভাবছে কিছু। রাফি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে নক করল। প্রান্তিক জবাব দিলো না তবুও সে ভেতরে এলো। বলতে লাগল,
“খোজ করছি স্যার, ম্যাম কে খুব জলদি পাওয়া যাবে!”
প্রান্তিক দোল খাওয়া থামিয়ে রাফির দিকে ফিরে তাকাল। তার স্থিরমনি দুটো ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। ঠোঁটের কোণে একটু হাসির রেখা ঝলমল করছে।
“কথা ছিলো ২৪ ঘণ্টা বাড়ি পাহাড়ায় থাকবে। প্রিয়তা যেন বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে না পারে। এমনটাই তো আমি বলেছিলাম রাফি।”
রাফির মাথা নিচু। চোখ মেলে তাকাল না সে। কেবল একটি ঢোক গিলল। প্রান্তিক বলে উঠলো, “বারো বারো চব্বিশ জনকে আমি গার্ডে রেখেছি। তার সাথে তুমিও ছিলে। রাতের মধ্যে ২৪ জন উধাও হয়ে গেল। কিন্তু তুমি তো ছিলে। রাফি, তুমি আমায় এভাবে ঠকা‘লে। তোমার থেকে তো আশা করিনি। তুমি তো সব জানতে তবুও আমায় ঠকা‘তে তোমার বাঁধলো না!”
রাফির মুখটা শুকিয়ে এসেছে। কোন ছুতোয় সে মাফ চাইবে খুঁজে বুঝতে পারল না। মেইন গেইটের চাবি কেবল তার আর স্যারের কাছেই থাকে। সেই গেইট খুলে দিয়ে প্রিয়তা কে বের হতে সাহায্য করেছে প্রান্তিকের তা জানতে ঘণ্টাখানেক ও লাগল না!
#চলমান