প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব-২২+২৩

0
2

#প্রিয়তে_তুমি_প্রাণ💜
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২২

গু’লির একটি শব্দে রাতের পাখিদের কি ডানা ঝাপটানি। ভয়ে সকলে উড়ে চলে যাচ্ছ ডানা ঝাপটে। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে চাঁদের এক টুকরো আলো। তবুও ঘন কালো জঙ্গলের ভেতর সেই আলোও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। প্রিয়তা ছুটছে চোখ বন্ধ করে। হাতের মুঠোয় বুকের উড়না চেপে ছুটছে এক মনে। তার মন বলছে, প্রান্তিক এখানে। গু’লি তার উপরই চলেছে। আবারো সেই চিরচেনা স্বর। সেই ডাক! যে ডাকে নিজেকে বিভোর মনে হয় প্রিয়তার।‌ প্রতিবার আকৃষ্ট হয় সেই ডাকে। প্রাণপণে ছুটে গেল সেই ভালোবাসার মানুষটির কাছে। তার ছুটে চলার পথ দীর্ঘ। বেশ দীর্ঘ। ওপাশ থেকেও কেউ বুঝি ছুটে আসছে। আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রিয়তা এবার ভয় পেলো না। থেমেও গেলো না। তার মন তাকে বলছে এটা প্রান্তিক। তার বর মশাই। সেই তো ছুটে আসছে তার দিকে।

ঘন জঙ্গলের পথ পেরিয়ে এসে থমকে দাঁড়াল সে। দাঁড়াল অপরপক্ষ ও। হাঁপিয়ে উঠেছে দুজন। অন্ধকারের মাঝে চোখাচোখি করার বৃথা চেষ্টা। তবুও তো আভাস পাচ্ছে। এই অনুভূতি মিথ্যে নয়। অন্ধকারের আবছা আলোয় দেখার চেষ্টা করছে দুজন। চাঁদের আলোয় অবশেষে মুখের আবছা ছায়ার দেখা মিলল। দূরত্ব বেশি নয়। এই তো কয়েক হাত। প্রিয়তা এক মূহুর্ত অপেক্ষা না করে ছুটে গেল তার দিকে। আঁকড়ে ধরল দু হাতে। শক্ত, বিশাল সুদেহে নিজেকে জড়িয়ে নিল ভীষণ অবলীলায়। কান্নার ভঙ্গিমা আরো ভয়া’বহ। ঘন জঙ্গলের মধ্যে এক রূপসী রমণীর কান্নার আওয়াজ ভৌ’তিক ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই নয়। তার বুকের মধ্যে নিজেকে চেপে কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করছে সে। হচ্ছে না, সম্ভব না। প্রান্তিক জড়িয়ে ধরেছে সেই কখন। অশ্রু রেখা তার নয়ন থেকেও পড়ছে ঝর্ণার পানির মতো। দুজনের কেউই আজ অভিমান করল না, কথা কাটাকাটি করল না, কথা বাড়ালও না। দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল কেবল। অভিমান কি এই অশ্রু কণার সাথেই মূর্ছা যাবে তাহলে।

ভালোবাসার মানুষের কাছে ভালোবাসার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা খুব মুশকিল। কেলবই ভয় হয়, কোনো এক সময় ভালোবাসার মানুষ তার অস্তিত্ব ভুলে যাবে। তাকে ভুলে যাবে। দীর্ঘ দিন এক খাবার খেয়ে যে কারো মুখ ফিরে আসে। ভালোবাসা কি অতো সস্তা বাপু। ভালোবাসায় ফিকে শব্দটি তো আসতে দিতে নেই। নিত্য নতুন ভাবে ভালোবাসতে হয়। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয়। এই যেমন পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মানুষ কতো শক্ত কাজই না করে। আর তুমি তো কেবল একটি মানুষের জীবনে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে। এতোই কি শক্ত কাজ? তা কি পারা যায় না? ভালো কি বাসা যায় না। কেন এতো ছলনা, কেন এতো কষ্ট। শান্তিতে কি ভালোবাসা যায় না?

———–

তারা ফিরে এসেছে। দুজনেই ফিরে আসে। হেলিকপ্টারে করে প্রায় ৬ ঘণ্টার জার্নি করে ঢাকায় ফিরেছে দুজন। যখন ফিরেছে তখন ভোর হয়ে গেছে। এতোক্ষণ এতোটুকু কথা হয়নি দুজনের মাঝে। দুজনেই কেবল চুপ থেকেছে। কোনো শব্দ ছাড়াই একজন অপরজনের মনের কথা বুঝতে পেরেছে। প্রান্তিক শক্ত করে তার হাতটা চেপে ধরে আছে। প্রিয়তাও কম না। দু হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে মাথা রেখে চোখ বুজে ছিল। ঘুমিয়েই পড়ল শেষে। যখন চোখ খুলল তখন সে ঢাকায়। হেলিকপ্টার এসে থেমেছে চৌধুরী বাড়ির ছাদে। বিশাল এই ছাদের এক কোণায় খুব সহজেই হেলিকপ্টার নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। মান্নাত, রাফি দুজনেই ছিল তাদের সাথে। বাকিরা ফিরছে গাড়ি করে। ফিরতে সময় লাগবে বুঝি আরো।

নামবার সময় তাকে কোলে করে নামাতে গিয়েই প্রিয়তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। নিজেকে প্রান্তিকের কোলে আবিষ্কার করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। পরক্ষনেই মান্নাত আর রাফিকে দেখে নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নিল। একটু লজ্জা যেন পাচ্ছে সে।

প্রান্তিক তাকে নিয়ে সোজা এলো প্রিয়তার ঘরে। হ্যাঁ প্রিয়তার ঘরেই। অভিমানের পাল্লা যেন এখান থেকেই শুরু হলো। বিছানায় তাকে বসিয়ে দিয়ে নরম সুরে বলল, “ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি আসছি!”

প্রিয়তা জবাব না দিয়ে হাত পা গুটিয়ে নিল। প্রিয়তার পায়ের জখম খেয়ালে এলো তখন। হাত পা তেও আ’ঘাতের ছড়াছড়ি। এগিয়ে এসে দুই হাতে তার মুখটা আঁকড়ে ধরে কপালে চুমু খেল। চুলগুলো সব কানের কাছে গুঁজে দিয়ে বলল, “প্লিজ ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি আসছি!”

প্রান্তিক বেরিয়ে গেল। মনটা খা খা করছে। কি যেন নেই। কিন্তু প্রান্তিকের কথাও তো ফেলে দেবার নয়। অভিমান ভুলে উঠে দাঁড়াল। আলমারি থেকে একটা শাড়ি বের করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে ছুটল সে।

ভালোই একটা গোসল সেরে বের হলো। প্রান্তিক তখনো এসে পৌঁছায় নি। হাতের তোয়ালে দিয়ে কোনোমতে মাথা মুছে ঘর ছেড়ে বেরুলো প্রিয়তা। মিটিমিটি পায়ে হেঁটে প্রবেশ করল প্রান্তিকের ঘরে। ঘরে ঢুকতে গিয়ে পা থমকে গেল তার। দরজার পর্দা আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল শক্ত পায়ে। নরম, শীতল মুখখানা দ্রুতই কঠোর হতে লাগল। প্রিয়তা হতবাক! বাকরুদ্ধ হয়ে গেল দ্রুত। কেবল স্থির দৃষ্টিতে দেখছে। উদাম শরীরে উল্টো হয়ে বসে আছে প্রান্তিক। পাশেই চশমা পড়া সাদা শার্ট ওয়ালা লোকটা তার জ’খমে চিকিৎসা করছে। প্রিয়তার সামনেই একহাতে ছু’রি দিয়ে অন্যহাতে সরু একটা নলের মতো কিছু একটা দিয়ে প্রান্তিকের বাঁ হাতের বাহু থেকে একটা গু’লি বের করে রাখল পাত্রে। প্রিয়তার মনে হলো তার পায়ের মাটি সরে গেছে। কেমন গোঙানির মতো শব্দ করল সে। প্রান্তিক পিছন ফিরল। প্রিয়তার রক্ত’শূন্য মুখ দেখে চমকে উঠল সে। রাফি আর মান্নাত ও সেই ঘরেই উপস্থিত। সকল লাজ ভেঙে প্রিয়তা ছুটে এলো প্রান্তিকের কাছে। প্রান্তিক নিশ্চুপে তার হাতটা আগলে ধরল। প্রিয়তা দুই হাতের মুঠোয় হাতটা নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল। প্রান্তিক ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল কেবল। চোখ দিয়ে আশ্বাস দিচ্ছে সে ঠিক আছে!

ঠিক আছে? বুঝ দিচ্ছে তাকে? সে বুঝি জানে না গু’লির খাওয়ার কষ্ট কি? এতোটাই কি অবুঝ নাকি। তাহলে তখন গু’লি ঠিকই লেগেছিলো। গু’লির শব্দ তো সে পেয়েছিল। কেবল প্রান্তিক কে স্বচক্ষে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিভাবে ভেবে নিল সে একদম ঠিক আছে! কিছু হয়নি তার। গত ৬ ঘণ্টা কিভাবে এই আ’হত শরীর নিয়ে তাকে আঁকড়ে রাখল। কিভাবে বা তাকে কোলে তুলে নিল। কষ্ট হয়নি বুঝি তার। বুঝাচ্ছে তাকে? এতো কষ্ট কিভাবে সইলো প্রান্তিক। একবারও তো উহ্ শব্দ টুকু করল না। প্রিয়তা তো বুঝে নিত তার কষ্ট হচ্ছে। লোকটা কেন এমন? কেন কষ্ট বুঝতে দেয় না। সবসময় দূরে দূরে রাখে। কিসের এতো অভিমান তার?

ডাক্তার ব্যান্ডেজ করিয়ে দিলেন সেখানে। প্রিয়তা ঠোঁট কামড়ে কান্না চেপে রেখেছে। সকলের সামনে পারছে না প্রান্তিকের বুকে লেপ্টে কাঁদতে। তবে বুঝি একটু শান্তি লাগত। ডাক্তার কে দাঁড়াতে দেখে দাঁড়িয়ে গেল সেও। প্রান্তিক তার হাত জড়িয়ে রেখেছে। প্রিয়তা নিজেকে সামলে বলল,

“একটাই গু’লি? দুটো গু’লি যে তবে…”
প্রান্তিক হেসে বলল, “সেটা রাফি করেছিলো লোকটার উপর। রাফি আমায় আবারো ঋণী করে দিল!”
আবারো মানে? গু’লি কি এর আগেও খেয়েছিল সে। প্রিয়তা চোখ মুখ কুঁচকে তাকালো প্রান্তিকের দিকে। প্রান্তিকের দৃষ্টি নেমে যাচ্ছে। চোখের পাতা কাঁপছে। দেখতে দেখতে প্রিয়তার সামনেই মূর্ছা গেলো সে। প্রিয়তা চেঁচিয়ে উঠলো আবারো। মান্নাত ও ঘাবড়ে গেল কিছুটা। রাফি দেখছে ডাক্তারকে। ডাক্তার সাহেব নিরস মুখে বললেন,

“অতিরিক্ত রক্ত’ক্ষরণের কারণে এমনটা হয়েছে। শরীর ও দুর্বল। প্রেসার লো! আমি তো বললাম তাকে হাসপাতালে ভর্তি করান। র’ক্ত দিতে হবে। দু ঘণ্টার মধ্যে র’ক্ত না দিলে এরপর আমার হাতে কিছু থাকবে না।”

অশ্রুসিক্ত নয়নে বিচলিত হয়ে প্রিয়তা তাকাল রাফির দিকে। প্রান্তিক মাথা তখন প্রিয়তার কোলে। লোকটা পুরোপুরি শরীর ছেড়ে দিয়েছে। রাফি শক্ত কণ্ঠে বলল,

“স্যার হাসপাতালে যাবেন না বলে দিয়েছে। আপনি আমার সাথে আসুন। এখানেই র’ক্ত দেবার ব্যবস্থা করছি।”

প্রিয়তার ইচ্ছে করল প্রতিবাদ করবে। এসব কি ধরণের পাগলামি। কেমন জেদ। হাসপাতালে গেলে কি হবে? কিন্তু এসব বলে সময় নষ্ট করল না সে। রাফি ভাই ছোটাছুটি করছে। যত দ্রুত সম্ভব রক্ত দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রিয়তা তার মুখটা আগলে ধরে ফের কান্না করে নিল। এই লোকটা কেন এতো য’ন্ত্রণা দিচ্ছে তাকে। কেন এমন করছে। মান্নাত চাঁপা স্বরে বলল,

“ভাবী কাঁদবেন না। চিন্তা করবেন না, আমরা দেখছি!”
সত্যি সত্যি চোখের পলকের মধ্যে সবকিছু হয়ে গেল। ডাক্তার নার্স সব এলো একে একে। প্রান্তিকের বড় বেডরুম টা কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসপাতালের ছোট একটা কেবিনে রূপ নিল। তাকে র’ক্ত দেওয়া হচ্ছে। কোনো জটিলতা সৃষ্টি হলো না। রাফি যেন আগে থেকেই সমস্ত টা ঠিক করে রেখেছিল। প্রিয়তার প্রান্তিকের পাশে বসে রইল চুপটি করে। এক মূহুর্তের জন্য সরল না। তার হাত ও ছাড়ল না। উদাম শরীরে চাদরের ঢাকা দিয়ে শুয়ে আছে লোকটা। প্রিয়তা তাকে দুচোখ ভরে দেখছে। মুখশ্রী তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ঘর খালি পেয়ে চুমু খাচ্ছে তার চোখে মুখে। কখন যে জ্ঞান ফিরবে সেই প্রতিক্ষায় প্রহর গুনছে সে।

#চলমান

#প্রিয়তে_তুমি_প্রাণ💜
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৩

দিনের সমস্ত আলো শুষে নিচ্ছে পশ্চিমা অস্ত। আগুনরাঙা সন্ধ্যা। লাল আভা এসে ভীড় করছে জানালার ফাঁকে দিয়ে। পর্দা গুলো আলতো ভাবে নেচে বেড়াচ্ছে। বিছানার নরম বালিশে প্রান্তিক চোখ বুজে শুয়ে আছে। ডাক্তার বলেছে কোনো ভয়ের ব্যাপার নেই। দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। রাত্রির মধ্যেই জ্ঞান ফিরবে।

রক্ত দেবার জন্য যেই হাতে সুচ ফুটিয়েছিল প্রিয়তা সেই হাত আলতো করে ছুয়ে রাখল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আছে এখানে। মানুষটিকে একটি নজর দেখার প্রয়াস কেবল। ঘরের মধ্যে স্নিগ্ধ নিরবতা। বাতাসের শো শো শব্দ আর ঘড়ির টিক টিক শব্দের মাঝে দুজন মানবীর শ্বাস প্রশ্বাসের ধ্বনি গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। প্রিয়তার চোখ বুজে আসছে। ধকল কি তার কম গেছে। দুদিন ধরে খাওয়া দাওয়া কিছু নেই। রাফি ভাই এসে বার বার খাবারের জন্য সেধে গেছে। কিন্তু প্রিয়তার এক কথা, প্রান্তিক আর সে একসাথে খাবে। ঘটল তবে বিপত্তি। কখন স্যারের জ্ঞান ফিরবে কখন তারা খাবে। রাফি হার মেনে চলে গেল।

প্রিয়তা চোখে ঝাপসা ঝাপসা দেখছে। তার বোধহয় ঘুম আসছে। এই অসময়ে ঘুম কেন আবার। মাথা নাড়িয়ে চেষ্টা করল জেগে থাকার। ঠকঠক করে একগ্লাস পানি ও খেল। ঘুমের তেজ কমেনি। বেড়েছে বরং। মনে হচ্ছে কেউ ঘুমের ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে তাকে। চোখ দুটো খুলে রাখা খুব মুশকিল।

আঁটসাঁট হয়ে কারো বাহুডোরে আবদ্ধ সে। তার গায়ের গন্ধ প্রিয়তার খুব পরিচিত। যতবার গন্ধ নাকে আসে ইচ্ছে করে মিশে যেতে। কি নেশাধরানো গন্ধ। প্রিয়তা একটু মুচরে উঠল। পুরোপুরি ঘুম ভাঙেনি তার। প্রান্তিক ছোট ছোট চোখ করে তার মুখশ্রী দেখল। মৃদু হেসে চুমু আকল ললাটের মাঝে। চুল গুলো কানে গুঁজে দিয়ে বুকে টেনে নিল তাকে। আচমকা প্রিয়তা লাফ দিয়ে উঠে গেল। বড় বড় চোখ করে এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝতে পারল সে প্রান্তিকের বাহুডোরে আবদ্ধ। প্রান্তিক তাকে দেখে হাসছে। প্রিয়তা বিস্ময়ে হতবাক! আকস্মিক তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। প্রান্তিক নিজেও ভাবেনি প্রিয়তা এতোটা রিয়েক্ট করবে। শরীর ক্লান্ত। তাই একটু কাঁদতেই ক্লান্ত হয়ে গেল। প্রান্তিক তাকে কাছে টেনে চোখের অশ্রু মুছিয়ে দিল। দু হাতে চুলগুলো কানে গুঁজে দিল। প্রিয়তা নাক টেনে শুধাল, “এখন কেমন লাগছে? ব্যাথা করছে খুব? জ্ঞান কখন ফিরল আপনার?”

“যখন তুমি ঘুমিয়েছিলে তখন। তোমার মনে নেই, আমি ডাকলাম আর তুমি কি সুন্দর আমার বুকের মধ্যে লুকিয়ে গেলে।”

প্রিয়তা মনে করতে পারল না কিছু। সত্যিই কি এমন হয়েছিল নাকি? লাজে তার মুখ রক্তিম হয়ে উঠল। প্রান্তিকের ক্ষত স্থানে হাত বুলিয়ে বলল,

“ব্যাথা করছে?”
প্রান্তিক হাতটা সরিয়ে তার উদাম বুকের বাঁ পাশে চেপে বলল, “এখানে ব্যাথা করছে খুব!”
প্রিয়তা নাক টানলো আবারো। লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে মাথা নিচু করে নিল। হাত সরিয়ে বলল, “আপনি আমায় আগে বললেন না কেন? এতোক্ষণ আপনার সাথে ছিলাম আপনি বুঝতে দিলেন না। আমায় এতো কষ্ট কেন দিন বলুন তো?” চোখে অশ্রু জমে এসে ভিড় করল আবারো। কান্না কাটি বোধহয় আরেকদফা হবে।
প্রান্তিক দু হাতে আলতো ভাবে তার গাল চেপে ধরে বলল, “এসব কি বলছো? তোমার কষ্ট হবে বলেই তো বলিনি। একি? আবারো কাঁদছো? থামো এবার। চোখ দুটিকে একটু বিশ্রাম তো নিতে দাও। সেই কখন থেকে তোমার কান্না দেখে দেখে আমি অস্থির। এতো ছিচকাঁদুনে তুমি? আগে তো জানতাম না।”

প্রিয়তার অভিমান হলো। পাতার উপর জমা শিশিরের মতো সেই অভিমান। এই ছুঁয়ে দিলে পড়ে যায়। প্রান্তিক তা টের পেয়ে তাকে বুকে আগলে নিল ফের। অভিমান করতে দিলে এবার চলবে নাকি। এই তো সুযোগ। এই সুযোগ হারালে কাঁদতে হবে সারা জীবন।

প্রিয়তা উঠার জন্য ছটফট করছে। তার এক কথা, এভাবে তাকে শুয়ে বসে থাকলে হাতের ব্যাথা আরো বাড়বে। এতো আদর সোহাগের এতো কি দরকার এখন?
প্রান্তিক চট করে তার কোলে মাথা রেখে বলল, “অবশ্যই দরকার। আমি অসুস্থ, তোমার একটা চুমু আমায় সুস্থ করে দিতে পারে, জানো। নাও একটা চুমু খাও। কিস মি! এর চেয়ে বড় কোনো ঔষধ নেই।”
“আমার এখন ভাত খাওয়া উচিত। এরপর ওষুধ খাবেন। এসব বাড়াবাড়ি রাখুন‌।”
“রোজ তো ডাল ভাত খাই। আজ না হয় তোমার চুমু খাবো।”
প্রিয়তা চোখ মুখ কুঁচকে নিল। প্রান্তিক মুখটা উঁচু করে আছে। তার এতটুকু কোলের মাঝে তার মাথা। প্রিয়তা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আলতো করে চুমু খেলো তার কপালের মাঝে। প্রান্তিক চোখ মুখ শক্ত করে বলল, “চাইলাম বিরিয়ানি দিচ্ছ এলাচি। কি কাজ তোমার? অসুস্থ মানুষকে এতো কষ্ট দেওয়া ঠিক?”
“আপনি অসুস্থ তাই রেস্ট নিন। এসব এখন রাখুন। আমায় যেতে দিন। খাবার নিয়ে আসি!”
“এতো দারুণ খাবার থাকতে অন্য কিছু আজ খেতে ইচ্ছে করছে না। এই যে তুমি নরম নরম হাত দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছ, তোমার তুলতুলে নরম ঠোঁট আমায় ইশারা করে ডাকছে, তোমার দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিললেই যে খায়েল হয়ে যাচ্ছি এরপর আর কি দরকার? আমি পেট ফুলে ঢোল হয়ে আছে!”

প্রিয়তা মিটমিট করে হাসছে। আজ কতোদিন পর তারা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে। হাসতে হাসতে কথা বলছে তার বর মশাইয়ের সাথে। এই দিনটি যে কল্পনার ও অতীত ছিল। প্রিয়তা উঠে যেতে নিলে প্রান্তিক তার হাতটা চেপে ধরল। নিজের হাতের মুঠোয় নিয়মিত নরম স্বরে আবদার করল, “থাকো কিছুক্ষণ!”

প্রিয়তা বসল কিছুক্ষণ। প্রান্তিক তার হাত নিয়ে খেলা করছে। বাঁ হাত একভাবেই রেখেছে। মনে হচ্ছে অবশ হয়ে যাচ্ছে। প্রিয়তা তার মাথায় হাত বুলিয়ে শুধাল, “আরিনার এখন কি অবস্থা? জানেন কিছু?”

প্রান্তিক আরিনার খবর শুনেছিল। এরপর আর কিছু জানে না সে। খোঁজ নিলে খুব সহজেই জানা যাবে। কিন্তু খোঁজ নেওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। প্রিয়তার সাথে এতো বড় ঘটনা না ঘটলে অকপটেই চলে যেত দেখা করতে। কিন্তু এখন তা সম্ভব না। শক্ত গলায় বলল, “জানি না।”
“আপনি কি রেগে আছেন? আরিনার সাথে যা হয়েছে তা কিন্তু একদম ঠিক না।”
“তাহলে তোমার সাথে যা হয়েছে তা সব কি ঠিক প্রিয়তা।”
“কোনো কিছুই ঠিক হচ্ছে না। এসব ঠিক ভুলের শুরু যদি করতে যাই তাহলে আপনি যে দোষী হয়ে যাবেন। আমি আর এই কষ্ট সইতে পারব না।”

প্রান্তিক উঠে বসল। প্রিয়তা সামনে, কাছাকাছি হয়ে বসল সে। শুকনো ঢোক গিলে আঙুলের সাহায্যে প্রিয়তার চুলগুলো কানের কাছে গুঁজে দিল। আচমকা দমকা হাওয়ায় পুরো ঘর কেঁপে উঠল। প্রিয়তার চোখের পাতা কাঁপছে। শীতল দৃষ্টি একরোখা হয়ে দেখছে কেবল একজনকে। তার সামনের পুরুষকে। দৃষ্টির সামনে সে থাকলে বাকি সব ঘোলাটে যায়। এতো শত কিছুর মাঝে তার চোখ আটকে থাকে ঠিক এই লোকটার দিকে। তার মুখশ্রীর দিকে। প্রান্তিকের চোখ গুলো পুরোপুরি কালো নয়। কেমন খয়েরী রঙটা মিশে আছে এখানে। বাদামী বলব কি? বুঝিয়ে বলতে পারছি না। সে যেই হোক, চোখের রঙ কি তা জানার কি দরকার। চোখের মণি আঁটকে আছে যেই রমণীর নেশায় তাকে কিভাবে তুচ্ছ করা যায়।

প্রান্তিকের গলার কণ্ঠ নড়বড়ে বেশ। হাত গিয়ে ঠেকল তার গালের কাছে। তার শীতল ছোঁয়ায় চোখ বুজে নিল প্রিয়তা। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে তার। মূহুর্তের মধ্যেই একজোড়া প্রজাপতি এসে ঘিরে ধরল তাকে। কল্পনার সেই প্রজাপতি নেচে বেড়াচ্ছে চারদিকে। প্রেম প্রেম একটা আবরণে ঘিরে যাচ্ছে চারদিক। আচ্ছা প্রেমের রঙ কি?

“আমার কাছে তোমার চেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট আর কেউ নেই বউ। কেউ নেই।”
বউ ডাকটা কতো চরম ভাবে প্রিয়তা যে মিস করছিলো বলার মতো নয়। প্রান্তিকের মুখে বউ ডাক তার ভীষণ প্রিয়। প্রান্তিকের চাঁপা স্বরে আবারো কথা ভাসছে। কালচে ঠোঁট দুটো আবারো নড়ছে, “আমার মা যখন আমায় ছেড়ে চলে গেলো আমি তাকেও আটকায়নি, আবার বাবাকেও বলেনি তুমি আমার সাথে থেকে যাও। যাকে চোখ বন্ধ করে ভালোবেসেছি তাকেও একটিবার অনুরোধ করিনি। পুরো জীবনের মধ্যে তুমি একমাত্র তার কাছে আমি অনুরোধ করছি প্রিয়তা। থেকে যাও না। এই বিগড়ে যাওয়া, পাগল, চরিত্রহীন ছেলেটার সাথে থেকে যাও। সত্যি বলছি আমি সব ছেড়ে দিয়েছি।”

চোখ দুটো বেইমানি করল। রাশি রাশি জলের কণা এসে ঝাপসা করে দিল তার প্রিয় পুরুষকে। দেখা যাচ্ছে না ঠিক করে। প্রান্তিক ফের বলল। তার ভারী কণ্ঠস্বর। “আমায় একবার সুযোগ দাও বউ। আমি সত্যি বলছি, অভিযোগের কোনো সুযোগ থাকবে না। আমি আমার অ’ন্যায় গুলোকে জাস্টিফাই করছি না। তুমি সব জানো। কিছু মিথ্যে নয়। আমি পারিনি মিথ্যে বলে তোমার মন নিয়ে খেলতে। আমার ভীষণ কষ্ট হয় তোমায় কষ্ট দিলে। ছেড়ে যেও না। থেকে যাও। সারাটি জীবনের জন্য। এই প্রান্তিক চৌধুরী তোমার অনুভূতির সাথে মিশে যেতে যায়। তোমাকে দেখার পর থেকে আমার হৃৎস্পন্দনে কেবল তোমার বিদ্রোহ হচ্ছে। আমি কি করে আটকাবো নিজেকে। আমার মন যে মানতে চায় না, তুমি আমার না। তুমি আমার বউ, আমার অর্ধাঙ্গিনী। জীবনসঙ্গী! আমার বেঁচে থাকার একমাত্র প্রয়াস। আমি ম’রে যাবো তোমায় ছাড়া। বিশ্বাস করো!”

প্রান্তিকের আকুতি ভরা কথাগুলো এসে ঠেকছে প্রিয়তার হৃদয়ে এসে। এই লোকটাকে কিভাবে ছেড়ে থাকবে সে। অসম্ভব ভালোবাসে যে তাকে। সারাজীবন বাঁধা পড়ে গেছে তার সাথে। তারা যে এক হয়ে গেছে আরো আগেই। গলা জড়িয়ে ধরে আচমকা কেঁদে উঠল প্রিয়তা। তার এই কান্না থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। সারাটি জীবন একসাথে থাকার প্রতিশ্রুতি। প্রান্তিক চৌধুরী ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। দ্রুত মুছে নিল সে। পুরুষ মানুষের চোখে অশ্রু যে বড্ড বেমানান। আবার অনেকে বলে, যে পুরুষ তার নারীর জন্য চোখের জল ফেলে তারা খুব ভাগ্যবতী হয়।

প্রান্তিক তার কোমর জড়িয়ে আছে একহাতে। আ’হত হাত দিয়ে চোখের অশ্রু মুছে দিয়ে বলল, “কথা দিচ্ছি আমার জন্য আর কখনো কাঁদবে না তুমি। প্রান্তিক চৌধুরী থাকতে তার বউ সোনার চোখে কখনো পানি আসতে দিবে না।”

অশ্রুসিক্ত নয়নে আচমকা হেসে উঠল প্রিয়তা। আজ মুখ ফুটে একটি কথা না বললেও তার প্রতিটি অশ্রুকণা হাজারটা কথা বলে ফেলেছে। চোখ ও যে কথা বলে এ তবে মিথ্যে নয়। তার গালে হাতের পরশ বুলিয়ে বলল, “দেখো, কখনো চুমু খেতে বললে এভাবে চুমু খাবে!”

তার নরম তুলতুলে ঠোঁটে আক্র’মণ করে বসে আচমকা। অনেক আগে থেকেই লোভ হচ্ছিল তার। কেবল সৎ সময়ের অপেক্ষায় ছিল। খানিক বাদেই ছেড়ে দিয়ে একটু দম নিল। আবারো আঁকড়ে ধরল সে। এবার একটু শক্ত করেই জড়িয়ে ধরল। তুমুল অত্যা’চার চলল অধর জোড়ার উপর। এতো দিনের ক্ষুধার্ত প্রান্তিক আরো ক্ষুধার্ত হয়ে উঠল মুহূর্তে। প্রিয়তার পুরো শরীর রোমাঞ্চকর হয়ে উঠল। এতো গভীর চুম্বন এর আগে কখনো হয়নি যে। মান অভিমান শেষে চুম্বনের স্বাদ একটু বেশিই যেন মধুর হয়!

#চলমান