#প্রিয়তে_তুমি_প্রাণ💜
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৪
ভোর হতেই চৌধুরী বাড়ি মানুষে ভরে গেল। দাদাজানের অবর্তমানে ঢাকায় এতো কিছু ঘটেছে এসব জানতে পেরে তিনি রাজশাহী থেকে ছুটে এসেছেন। প্রিয়তা পাওয়া গেছে শুনে তার বাবা মা ও ছুটে এসেছে। বোন তিনটে এসেই জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। তাদের কান্না থামার নাম নেই। প্রান্তিক চৌধুরী এমন শরীর নিয়েও নিচে নেমে এসেছে। প্রিয়তা তার অসুস্থতার কথা বলতেই যাচ্ছিল, অমনি প্রান্তিক তার হাত চেপে ধরল। ইশারায় বারণ করে দিলো কিছু না বলতে। একেই তো একজনকে নিয়ে সকলের চিন্তার শেষ নেই এরপর তার অবস্থা শুনলে নিশ্চিত কিছু ঠিক থাকবে না। আপাতত বিপদ কেটে গেছে এই জানতে পেরে সকলের মনে শান্তি চলে এলো। মান্নাত ও হাজির হয়ে গেলো এক ফাঁকে। তার আর আমরিশার চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিল সে। কিছু একটা যেন হয়েছে তাদের মাঝে।
বিপদ কেটেছে বলেও যেন কাটেনি। প্রান্তিক চৌধুরী ভাবল তার আর প্রিয়তার মাঝে এখন আর কেউ আসবে না। আর কিছু তো নেই, কোনোকিছুর ভয় এখন আর সে পায় না। যা ছিল লুকিয়ে সব তো সামনে চলেই এলো। এরপর আর কি বাকি থাকতে পারে? পারে! ভাগ্য কখন কি করে বসে তার ঠিক নেই।
ঘরের ভেতর ঢুকতে গিয়ে থেমে দাঁড়াল সে। ভিতরের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। প্রান্তিক আড়ি পেতে শুনলো। তার শাশুড়ি মা তার উপর ভীষণ বিরক্ত। তিনি মেয়েকে বলছেন,
“তুই কি চাস প্রান্তিকের থেকে আলাদা হয়ে যেতে? আমায় বল সে কি করেছে তোর সাথে? কেন তুই বাড়ি ছেড়ে ওভাবে চলে গেলি।”
প্রিয়তা কি বলবে ভেবে পেলো। কথা ঘুরানো যেন খুব দরকার। বলল, “মা বাদ দাও না। কিছু না! সব মিটে গেছে।”
“না প্রিয়তা। তুই আমায় বল, সুখে আছিস তো?”
“তুমি কি আমায় দেখে বুঝো না মা।”
“বুঝি। বুঝি বলেই বলছি। যদি ভাবিস তোর বাবা পঙ্গু, মা অক্ষম, তিন বোনের জীবনের জন্য নিজেকে বিসর্জন দিবি তাহলে ভুলে যা। ওদের তিনজনের মতো তুই ও আমার মেয়ে। তিন মেয়েকে বাঁচাতে এক মেয়ের জীবন নিয়ে খেলব এমন মা আমি নই। শুরু থেকে এই বিয়ের অমতে ছিলাম। বড়লোকের ছেলে আমার পছন্দই না। তোর বাবার কারণে রাজী হয়েছি। ছেলে নাকি তোকে যত্নে রাখবে, ভালো রাখবে। এখন দেখছি তো নমুনা।”
“মা চুপ করো। উনি এখনি চলে আসবে। এসব শুনলে কি ভাববে?”
মনসূরা বেগম দাঁড়িয়ে গেলেন। নিজের মত জানিয়ে বললেন, “তোকে এখানে মুখ বুজে পড়ে থাকতে হবে না প্রিয়। তোর মা এখনো বেঁচে আছে। কোনো সমস্যা হয়ে থাকলে আমায় বল। আমার মেয়েকে যেমনি এই বাড়িতে পাঠিয়েছি, তেমনি ফেরত নিয়ে যাবো। আমার কোনো অভিযোগ থাকবে না। শুধু তুই ঠিক থাকলেই হলো।”
বলতে বলতে তার গলা ধরে আসছিলো। প্রিয়তা মা কে আগলে ধরল। শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলল, “আমি সুখে আছি মা। ঠিক আছি। এখানে এখন আমার খুব দরকার। তাকে আমার দরকার! অভিমানের পালা সবে শেষ হয়েছে। আমি চাই না নতুন করে কিছু হোক। তুমি চিন্তা করো না মা, তিনি থাকতে আমার কিছু হবে না। কিছু না!”
প্রান্তিক চৌধুরী সবটা শুনল। দরজার আড়াল থেকে সরে দাঁড়াল সে। তার প্রতি প্রিয়তার বিশ্বাস দেখে একটু বিচলিত সে। এই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারবে তো সে। সুখী করতে পারবে তাকে?
.
মান্নাত আর আমরিশা দুজনেই বসার ঘরে বসে আছে। কিন্তু দূরে দূরে। অভিমান চলছে এদের মধ্যেও। আমরিশা সোজাসুজি তাকে বলে দিয়েছে, আমাকে বিরক্ত করবেন না। ব্যস, মান্নাত কথা শুনেছে। তাকে এখন আর বিরক্ত করে না। ফোন দেয় না , বাড়ির সামনে ও ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে না। না রাতের পর রাত তাকে ফোন করে। এসব ঘটনা প্রিয়তা হারিয়ে যাবার আগেরকার।
আমরিশার এক বলায় মান্নাত সবকিছু বন্ধ করে দেয়। আমরিশা এখন বুঝতে পারে মান্নাতের শূন্যতা। সে কি তবে লোকটার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই দুর্বলতা কি ঠিক? মন ঘুচ ঘুচ করছে কথা বলার জন্য। লজ্জায় পা ফেলছে না। নিজেই না করে আবার নিজেই আগ বাড়িয়ে কথা বলবে? তা হয় কি করে?
চায়ের কাপ দেওয়া হয়েছে অনেকক্ষণ আগে। মনসূরা বেগম প্রিয়তার সাথে গেছেন। প্রান্তিক চৌধুরী উপরের দিকে গেল। সিদ্দিকুর রহমান দাদাজানের সাথে বাগানের দিকটায় গেছেন। একটু আগেও আফরিন আর পূরবী এখানে ছোটাছুটি করছিলো। আচমকা হাওয়া হয়ে গেল। মান্নাত দূরে বসা ছিল। এবার এগিয়ে এলো। বসল আমরিশার মুখোমুখি। আমরিশা আরো গুমরে মুচরে গেল। আশপাশ মানুষের শূন্যতা। মাঝের সোফায় তারা দু’জন বিপরীত দু প্রান্তে। মান্নাত চায়ের কাপ তুলে নিল। ঠান্ডা হয়ে গেছে তবুও চুমুক দিল। আমরিশা উঠি উঠি করছে। কিন্তু যাবে কোথায়?
মান্নাতের নজর তার দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রবল ভাবে আকর্ষণ করছে। রুক্ষ স্বরে বলে উঠলো, “সেদিন ওই ছেলেটা কে ছিল?”
আমরিশা চমকে উঠল। দু’দন্ড ফিরে তাকাল। চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিল। উসখুশ করছে। কোন ছেলে? কার কথা বলছে? ফের সেই তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে হৃদয়ে কম্পন অনুভব করল।
“সেদিন যার সাথে ভার্সিটির পর ঘুরতে গেছিলে, সে! তার কথা বলছি।”
মস্তিষ্কে জোর দিল। কোন ছেলে? কোন দিন? ওহ হ্যাঁ, সমাপ্ত খানেক হবে বোধহয় কিংবা তার কম। ছেলেটি তার ব্যাচমেট। নাম জায়ান। তার সাথে বেরিয়েছিলো। ঠিক বেড়ানো না, কথা বলছিলো। তাদের প্রেজেন্টেশন নিয়ে। এজন্য একটা কফি শপে বসেছিল দুজন। লোকটা জানল কি করে? তিনি কি ফলো করছেন তাদের?
ভ্রু কুঁচকে সন্দেহের বশে তাকাল আমরিশা। মান্নাত ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। সহ্য করতে না পেরে চায়ের কাপ রেখে দিল। এগুলো খাওয়া যায় না। মান্নাত উঠে এবার তার দিকেই এগিয়ে আসছে। আমরিশার বুকটা দুরুদুরু করে কাঁপছে। লোকটা কিছু কি করবে? কেউ দেখে ফেললে কি ভাববে? মা তো মে’রেই ফেলবে। ভয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। চলেই যাবে এখান থেকে। আচমকা তার হাত ধরে ফেলল মান্নাত। ভয়ে কুঁকড়ে উঠে সে। লাফালাফি করছে। এদিক ওদিক চাইছে চোরের নজরে। চাপা স্বরে বলছে, “প্লিজ প্লিজ হাত ছাড়ুন, মা দেখলে রক্ষে থাকবে না। প্লিজ!”
মান্নাত হাসল। সুযোগ তবে একটা পেয়েছে। দয়ার শরীর তার। বলতেই ছেড়ে দিল। কিন্তু মুখে এখনো হাসিটা লেগে আছে। শয়তানি হাসি। বলে বসল, “বসো তবে কথা বলি। কথা বললে তো আর সমস্যা নেই। বসো।”
আমরিশা ভয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে। বারংবার শুকনো ঢোক গিলে বলছে, “না থাক। আমরা পরে কথা বলব।”
“এখুনি বলব। বসো বলছি!”
ধমকে উঠল সে। আমরিশা ধপ করে বসে পড়ল। মান্নাত পেছনের সোফায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল। দুই হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে বেপরোয়া ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বলল, “বললে না তো ছেলেটি কে?”
“ব্যাচমেট আমার!”
“বন্ধু?”
আমরিশা মাথা দুলিয়ে বলল, “হ্যাঁ ওই!”
“এর বেশি কিছু না?”
চোখ রাঙিয়ে তাকাল আমরিশা। লোকটা আসলে চাইছে কি? দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দিলো, “না!”
“ভালো। ফোন কেন ধরছিলে না।”
“আপনি কি ফোন দিয়েছিলেন?”
“না দেয়নি! তুমি অপেক্ষা করছিলে বুঝি।”
বুকটা ধক করে উঠল। সে কি তবে অপেক্ষা করছিলো। বোধ হয় করছিলো। তবু বলে উঠল, “না!”
মিথ্যে কি মান্নাত ধরে ফেলল? মনে হয় না। দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “একবার তো ফোন করলে না?”
“আমি করব!”
“তো আমি করলে ধরবে না, আমায় ফোন করতে দিচ্ছ না দয়া করে তুমিই একবার ফোন করে ফেলতে। ফোন করলে কি হতো? খেয়ে তো তোমায় ফেলতাম না। বলতে, ভুল করেই ফোন দিয়েও। তাও দিতে পারতে!”
আমরিশার বলতে ইচ্ছে করল, কেন? আপনি দিতেন পারলেন না ভুল করে। আমায় কেন সাধছেন?
মান্নাত বুঝি মনের কথা টের পেলো। নরম গলায় শুধাল, “ছেলেরা বাহানা দিতে পারে না আমরিশা। তুমি পারতে। মেয়েরা খুব বাহানা দিতে পারে। ছলচাতুরি ও জানে। আমার কথা কি তুমি বিশ্বাস করতে? কখনো না!”
সত্যিই তো তাই। সে কি কখনো বিশ্বাস করত। মান্নাত আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল। পা বাড়াচ্ছে তার দিকে। শ্বাসরোধ করে চেয়ে রইল আমরিশা। লোকটা কেন তার দিকে আসছে? ওরা কেউ চলে এলে কি হবে?
মন বড় চঞ্চল হয়ে উঠল। মান্নাত তার কাছে দাঁড়িয়ে খানিকটা ঝুকে গেল। প্রাণ টা যেন চলেই যায় তার। সে কানে ফিসফিসিয়ে বলছে, “কাল বিকাল ৫ টায় কফি শপে দেখা করো। কোন কফি শপ জানো তো?”
জানে বৈকি! কয়েকবার দেখা করেছে সেখানে। একথা দূর থেকে দাঁড়িয়ে বললেও সে শুনতে পারতো। এতো কাছে আসার কি দরকার ছিল? কাছে আসার কারণ ছিল। টুশ করে গালে চুমু খাওয়ার লোভ মান্নাত সামলাতে পারল না। আমরিশা হতভম্ব! হতবাক নয়নে চেয়ে রইল। মান্নাত তার সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে। সিঁড়ি বেয়ে মা আর আপা নামছে। তারা কি দেখে ফেলল? ছিঃ ছিঃ! এখন কি হবে? ভয়ে তার চোখের মণিকোঠায় স্থির হয়ে আছে। মাথা নিচু করে বসে রইল কেবল। আশপাশ আড়চোখে তাকিয়ে দেখল মান্নাত নেই। চলে গেছে। আচ্ছা একটা লোক তো। তাকে একা বিপদে রেখে চলে গেল।
মা আর আপা এদিকেই আসছে। আজ তুই শেষ আমরিশা। মা তোকে এবার জ’বাই করবে। কে বলেছিলো এখানে আসতে? কেন এলি তুই! চোখ বন্ধ করে বিরবির করছে কেবল। প্রিয়তা এসে ধাক্কা দিয়ে বলল, “বসে বসে কি করছিস? আয় খেতে আয়। নাস্তা করবি।”
মা এদিকে নেই। ওদিকে টেবিলের কাছে গেল। বাবা আর দাদাজান ও চলে এসেছে। পূরবী আর আফরিন ছোটাছুটি করছে আবারো। ভাইয়া ও ওখানে। সবাই হঠাৎ একসাথে কিভাবে চলে এলো। আর ওই লোকটা, হ্যাঁ ওই লোকটা ভাইয়ার সাথে কথা বলছে। চোখে চোখ পড়তেই আবার হাসল। বে’হায়া, অস’ভ্য লোক। লুই’চ্চা ল’ম্পট! মেয়ে মানুষ একা পেলেই চুমু খেতে ইচ্ছে করে। কাল পেয়ে নিক, ভালো মতো ধো’লাই দিবে। আজ শুধু আপার শ্বশুর বাড়িতে ছিল বলে বেঁচে গেল। কাল বাঁচবে না!
#চলমান
#প্রিয়তে_তুমি_প্রাণ💜
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৫
সকলের রোদের ঝিলিমিলি আলো পর্দা ভেদ করে আছড়ে পড়ছে মেঝেতে। হালকা মৃদু হাওয়ায় জানালার দু ধারের পর্দা নেচে উঠছে খানিক বাদে বাদে। চৌধুরী বাড়ির পিছনের দিকে বাগান নেই তবে বড় বড় দুটো পেয়ারা গাছ আছে। আফসোসের বিষয় সেই গাছে এখন অবধি কোনো পেয়ারা হয়নি। যাও হয়েছিল কস কস। খাওয়া যায় না। তবে সেখানে পাখিরা বাসা বানিয়েছে। সেই পাখির গুঞ্জন রব প্রান্তিকের কান ভেদ করে মস্তিষ্কে প্রবেশে বাঁধা পড়ছে। তার মস্তিষ্কে বিচরণ করছে অপরূপা এক রমণী। যে এই মুহূর্তে বালিশ ছেড়ে তার বাহু আঁকড়ে ঘুমাচ্ছে। বাচ্চাদের তার ঠোঁট দুটো উল্টে আছে। স্বপ্ন টপ্ন দেখছে বোধহয়। চোখের পাতা নড়ে উঠছে বারংবার। একটু নড়েচড়ে উঠতেই মুখ ঢেকে গেল নিকষ কালো কেশে। আনমনে হেসে উঠল ওপ্রান্তে থাকা ব্যক্তিটি।
আলোর তেজ বেড়েছে। উদাম পিঠের উপর আলোর রশ্মি এসে চিকচিক করছে। বালিশে মাথা নেড়ে আঙুল নাচিয়ে খেলছে তার নিকষ কালো চুলের সাথে। চোখের পাতা ফেলে ফেলে সে দেখছে মুগ্ধ দৃষ্টিতে। অ্যালার্ম ঘড়িটা বেজে উঠল। শরীর আলস্যে ভরে উঠল। উঠতে ইচ্ছে করছে না যে। হাতড়ে অ্যালার্ম বন্ধ করে করল সে।
কিন্তু তার ঘুম যে বড্ড কাঁচা। কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর শব্দ হতেই চোখ মিনিমিনি করল সে। ওপাশের ব্যক্তিটি তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করে বালিশে মাথা গুঁজল। অভিনয় পাক্কা খেলারি। উঠে বসল সে। ঘাড় ব্যথা করছে খুব। কে যে বলেছিলো শখ করে বালিশ ছেড়ে এদিকে ঘুমাতে। প্রেমে পড়লে মানুষ পাগলের সাথে সাথে গাধাও হয়ে যায়। ঘুম ঘুম চোখে এদিক ওদিক ফিরে তাকাল সে। ঘুমন্ত মানুষটির মুখখানি দেখতে পেয়ে সমস্ত কষ্ট ভুলে গেলে চট করে। শরীর আবারো এলিয়ে দিলো বিছানায়। উপুড় হয়ে দেখতে লাগল তাকে। হাতের আঙ্গুল দিয়ে ঘুরিয়ে নাচিয়ে দেখছে তাকে।
চেহারার চারদিকে আঙ্গুল দিয়ে নাচিয়ে যাচ্ছে কেবল। দেখতে দেখতে আঙুল এসে ঠেকল ঠোঁটের কাছে। লজ্জায় শিউরে উঠল পুরো শরীর। মুখ টিপে হেসে উঠল সে। লজ্জা শরমের মাথা না খেয়ে হাত সরিয়ে নিতে গেল। তৎক্ষণাৎ হাত কাম*ড়ে ধরল সে। আঁ*তকে উঠল আচমকা।
মুখ ফুটে উচ্চারণ করল “ইশ”! হাতের আঙ্গুল অন্য হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল। ভ্রু যুগল কুঁচকে আছে তার। ব্যথাই বোধহয় পেয়েছে। এভাবে কাম*ড়ে ধরে কেউ!
বেপোরোয়া ভঙ্গিতে হাসছে সে। চোখ মুখ কুঁচকে উঠল আরো। অভি*মানী হয়ে উঠছে ভীষণ। মুখে অন্ধকার নেমে এলো। চলেই যাবে সে। আচমকা হেঁচকা টানে তাকে কাছে আনল সে। তার উদাম বুকের উপর আছড়ে পড়ল সে। দুহাতে শক্ত করে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিল তাকে। মুখে দুষ্টু মিষ্টি হাসি। এবার যাবে কোথায় তুমি?
নরম মসৃণ বুকের উপর হাতটা রাখল শক্ত করে। ছাড়িয়ে নেবার বহু চেষ্টা ইতোমধ্যে ব্যর্থ। এতো বড় একটা ভালু*কের সাথে তার পিচকুর পেড়ে উঠা যায় না। বুকের মধ্যে মার*ল কয়েকটা কি’ল ঘু’ষি। মুখের রঙ বদলে গেলো। ছেড়ে দিয়ে আঘাতের স্থান আঁকড়ে ধরল। ভাব টা এমন ব্যা*থা পেয়েছে খুব।
বিচলতি হয়ে উঠল তার মুখখানি। রমনীর চঞ্চল দৃষ্টি এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। অ*পরাধ বোধে চোখে অ*শ্রু জমছে দ্রুত বেগে। সে কি আর ব্যথা দিতে চেয়েছিল নাকি। প্রিয় সোনা বউয়ের চোখের জল তার সহ্য হলো না। ফিক করে হেসে উঠলো সে। আহ্লাদী সুরে বলল,
“আহ মজা করছিলাম। কি করো কি? এই সকাল সকাল আমার সোনা বউয়ের চোখের জল দেখবো নাকি। থামো বলছি, এই বউ!”
প্রিয়তার অভি*মানী মন মানতে চায় না। আ*ঘাতের জায়গাটা হাতের নরম স্পর্শে একটু পরখ করে দেখে নেয়। ফিরে চায় সেই মুখখানির দিকে। হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে কপালের সেই ক্ষত আওড়ায় গভীর যত্নে। মনের মধ্যে ব্যাথার দানা যেন দল বেঁধে ছোটাছুটি করে। মুখটা নামিয়ে চাঁপা স্বরে বলে উঠে,
“আমার জন্যে আপনি সবসময় কষ্ট পান তাই না। কতো গুলো আ*ঘাতের চিহ্ন। বার বার আমিই আঘা*ত দেই আপনাকে!”
না! সকালটা বেশ ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছে। এই মেয়ে এবার নির্ঘাত ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ফেলবে। এসব হতে দেওয়া যায় না। উঠে বসল সে। দুই হাতে তার মুখশ্রী আগলে নিল শক্ত দুই হাতের নরম তালুতে। সা*পের মতো বেঁকে বেঁকে যাচ্ছে তার দেহ। পরম যত্নে বলে উঠলো,
“আ*ঘাত গুলোই দেখছো? ভালোবাসা দেখলে না! আমার সারাজীবনে যেই ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ছিলাম তা যে তুমিই পূরণ করলে। ওসবের কি দাম নেই?”
চোখের অশ্রু টলমল। এই কেঁদে দিলো বলে। যা! এমন সকাল সে চায়নি। দ্রুত চোখের অশ্রু মুছিয়ে নিল। আলিঙ্গন করে নিল পুরো দেহকে। স্নিগ্ধ স্বরে বলে উঠলো, “প্লিজ বউ কেঁদো না! তোমার ভারী ভারী মুখ দেখলে আমার দিনটাই মাটি হয়ে যাবে!”
অগত্যা তাকে কান্না থামাতে হলো। নিজের জন্য না হলেও তার জন্য। প্রান্তিক চৌধুরী তিন আঙুলে তার থিতুনিতে হাত রাখল। চুমু খেল চোখের পাতায়। কোন এক অলৌকিক শক্তি টানছে তাদের। চুম্বকের ন্যায় আগাচ্ছে সে। আসন্ন ঘটনার উপস্থিতি পেয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিল সেই। দুই প্রান্তের অধর ছুঁই ছুঁই। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো ঘর কাঁপিয়ে!
মুডের বারোটা বেজে গেল চট করে। ফোন আসার আর সময় পেলো না। শুভ কাজটা এই হতো বলে। ওমা দেখো! তার সোনা বউ খুশিতে আবার হাসছে। এতো খুশির কি আছে? তাকে না জ্বা*লিয়ে তার শান্তি হয়না। অতঃপর একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফোন ধরল। না হলে তা থামবে না।
রাফির ফোন! ধরার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। ফেলে আসা কাজ পূরণে অদ্ভুত আকাঙ্ক্ষা তাকে ঘিরে রেখেছে। কে শুনে কার কথা। ফোন তো বেজেই যাচ্ছে। রাফিও আস্ত একটা নাছোড়বান্দা। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে ঝড়ের গতিতে সে বলে উঠলো,
“আরিনা শেখের জ্ঞান ফিরেছে!”
কথাটা এতো জোরেই বলল যে প্রিয়তা অবধি শুনল। সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। এক অন্যরকম বাহানা তার চোখে মুখে। প্রান্তিক চৌধুরী না করবে কিভাবে?
———-
হাসপাতালের বাইরে দুজন। প্রিয়তা তার বাহু আঁকড়ে ধরে আছে। মোটামুটি ভাবে তাকে জোর করিয়েই আনা হয়েছে। নাহলে প্রান্তিকের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না আসার। ওসব ঘটনার পর তার মুখ দেখলেও মাথা গর*ম হয়ে যাবার কথা। সেখানে তার বউ ধরে বেঁধে নিয়ে এসেছে। মানা করতে পারবে না। গলায় কাঁটা বেঁধে যাবে যে!
তবে এসেও ভালো হয়েছে। একজনের সাথে আলাপের বেশ ইচ্ছে আছে। ইজান শিকদার! নিশ্চয়ই সেও আসবে এখানে!
দুজনেই একসাথে এগিয়ে যাচ্ছে। পা মিলিয়ে হাঁটছে প্রান্তিক। তার চোখ নিচের দিকে প্রিয়তার হাঁটার পথ দেখছে। সে আরেকটু দ্রুতই হাঁটে কি না! পা মিলিয়ে সমান তালে হাঁটতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।
আচমকা থেমে গেল সেই পা। প্রান্তিক চৌধুরী পা থেকে মাথা অবধি পরখ করে চোখে চোখ মিলিয়ে ভ্রু নাচালো। অর্থ “কি হলো?”
প্রিয়তার চোখ মুখ স্বাভাবিক। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে খুব অস্থির। আজ এখানে এসেছে একটা হেস্তনেস্ত করতে। এভাবে হয় না। আজ আরিনা শেখের সাথে কথা বলে একটা মিটমাট তাকে করতেই হয়। নয়ত ক’দিন চলবে এই খেলা।
আবারো শুধায়! এবার ইশারায় নয় মুখেই বলে, “কি হয়েছে?”
“আমায় কথা দিন!”
“কি কথা?”
“ইজান শিকদারের সাথে আপনি কিছু করবেন না!”
তাচ্ছিল্য করে হাসল সে। অন্য হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে দিল। সাদা শার্টের উপর কালো ব্লেজার পরা সে। ব্লেজারের ফাঁক দিয়ে সাদা শার্ট উঁকি দিচ্ছে। মুখে ফিকে হাসি!
“পাগল হলে?”
“না, আপনি কথা দিল। যা হয়েছে হয়ে গিয়েছে। আমি চাই আর কিছু হোক। এবার আপনি তাকে কিছু করবেন, সুযোগ বুঝে সে আবার আপনার ক্ষ’তি করবে। এভাবে করে পালা চলতেই থাকবে। একজনকে তো থামতে হবে!”
মুখে মেকি হাসিটা সে বজায় রাখল। মুখ ঘুরিয়ে নিল সামনে। ঠিক ধরেছে! ইজান শিকদার তো তার সামনেই। মুখোমুখি শ’ত্রু আবারো! দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলো, “আর ম*রে গেলে! ম*রে গেলে তো শত্রু রইল না, একবারে খত*ম!”
রীতিমতো আঁ*তকে উঠল সে। এক ঝটকায় হাত ছেড়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে গেল। চোখ মুখ শুকিয়ে এসেছে। বিবর্ণ ফ্যাকাশে তার দৃষ্টি। কোটরে মণি দুটি নিশ্চল, প্রাণহীন! এতো ভয়ং*কর কথা কেউ বলতে পারে বুঝি। অতঃপর…
#চলমান