#প্রেমের_সমর
#পর্ব_০৫
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
স্বচ্ছ, আবির আর সাদাফ তিনজনই ভোর ভোর এসে বাসার সামনের মোড়টায় বসে আছে। দৃষ্টি স্বচ্ছর রুমের ঠিক নিচের বেলকনিটাতেই। অথচ যে কারণে তারা তিনজনে মিলে বেলকনির দিকে তাকিয়ে আছে তাহার দেখা কিছুতেই মিলছে না। তারপর অনেকটা সময় পরই গিয়ে বেলকনিটায় দেখা মিলল এক যুবতী মেয়ের। ফোলা ফোলা চোখে আড়মোড়া ভেঙ্গেই বসে পড়ল একটা টুলে। স্বচ্ছ মনোযোগ দিয়ে দেখে মেয়েটাকে। কাল সে চারজনের মধ্যে এই মেয়েটাকে দেখে নি। কোন ভাবে কি এই মেয়েটাই সুহাসিনী? ঘুমের অযুহাত দিয়ে লুকিয়ে ছিল মেয়েটা? স্বচ্ছ যখন মনকে প্রশ্ন শুধাতে ব্যস্ত তখনই পাশ থেকে আবির বলে উঠল উচ্ছাস নিয়ে,
“ দোস্ত? দেখ, দেখ! এই মেয়েটাই আমাদের ভাবি? কিউট দেখতে না বল? আমার মনে হচ্ছে এটাই আমাদের ভাবি! ”
স্বচ্ছ চোখ সরু করে তাকায়। হতাশ শ্বাস ফেলে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে,
” বুঝব কিভাবে এটাই তোর ভাবি নাকি অন্য কেউ। উপায় রেখেছে ঐ মেয়ে? ”
সাদাফ উপদেশের ন্যায় ভঙ্গিমা করে বলে উঠল,
“ মেয়েটাকে ইশারা দে। কেমন রিয়্যাক্ট করে দেখি?
আবির সঙ্গে সঙ্গেই বলল,
“ এটা করাই যায়। কিন্তু করে লাভটা কি? রিয়্যাক্ট দেখে বুঝব কিভাবে এটা স্বচ্ছর বউই কিনা?”
সাদাফ সঙ্গে সঙ্গেই বলল,
“ উহ, কথা বলার সুযোগ তো পেতে পারি।রেগে হয়তো নিচে এসে কথা বলতে পারে?”
সঙ্গে সঙ্গেই সাদাফ আর আবির দুইজনেরই কি হলো জানা নেই তবে শিষ বাজিয়ে উঠল৷ স্বচ্ছর রাগ হলো।সে এতক্ষনকে সুহাকে কল দিচ্ছিল। দেখছিল মেয়েটা বেলকনিতে থাকা অবস্থায় কল রিসিভড করে কিনা। কিন্তু এই বন্ধুদের পাল্লায় পরে এই প্ল্যানটাও বরবাত।মনে মনে ভাবল, যদি নিজের বউ হয় এই মেয়েটা?তাহলে নিজের বউকে বন্ধুরা এভাবে শিষ বাজিয়ে বিরক্ত করছে চোখের সামনে তা স্বচ্ছর সহ্য হবে? স্বচ্ছ কিড়মিড়িয়ে বন্ধুদের পিঠে কিল বসাতেই উপরে বেলকনিতে বসে থাকা মেয়েটা তখন রেগে ভ্রু সোজা করে তাকায়।একটা পরিচিত মুখ আর দু দুটো অপরিচিত মুখ দেখে রেগে তড়িৎ বেগে উঠে পড়ে। পরপরই হন হন করে রুমে ডুকে পড়ে।স্বচ্ছ তা দেখে। বিড়বিড়িয়ে বন্ধুদের বলে উঠে,
“ তোদের কি এসব করতে এনেছি শা’লা?”
আবির বোকার মতো মুখ করে বলল,
“ তোর ভালোর জন্যই তো করলাম! এখন আমাদের দোষ?”
স্বচ্ছ সাথে সাথে আবিরের ভোলাবালা গালে চড় বসাল। বেচারা আবির মুখে হাত দিয়ে সেভাবেই বসে থাকল। কিছুই করবে না সে আর বন্ধর জন্য। কিছুই না!
.
বেলকনিতে যে বসে ছিল সে রাহা। সুহার ছোটবোন হয় মেয়েটা। এবার অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে।রাহা চোখ গোলগোল করে নিজের বোনের বরের এহেন দৃশ্য দেখেই রুমে এসে সুহাকে ডাকতে লাগল। সুহা তখনও ঘুমে। বোনের ডাক শুনে চোখ মেলে তাকাতেই রাহা চেঁচিয়ে বলে উঠল,
“ আপু? তোর অস্বচ্ছ ব্যাটায় তো বখাটেপনা শুরু করে দিয়েছে! সাতসকালে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে শিষ বাজাচ্ছে বন্ধুবান্ধব নিয়ে। ছিঃ ছিঃ! ”
সুহা যেন বুঝে উঠে নি। চোখ ডলতে নিয়ে বলল,
“ কি করেছে? ”
“ বোধহয় তুই ভেবে আমায় দেখে শিষ বাজাল।বুঝলাম না।”
সুহা বিরক্ত হয়। স্বচ্ছর উপর রাগ ও জম্মে। কি শুরু করেছে কি এই বেয়াদব লোক? এখন কি যাকে তাকে বউ বানিয়ে ফেলবে?সুহা বিরক্ত নিয়ে উঠে বসল। বালিশের পাশে পড়ে থাকা নিজের পুরাতন ফোনটা সাইলেন্ট হয়ে আছে।কিন্তু আলো জ্বলছে।সুহা সাধারণত ফোনটা ব্যবহার করে না। শুধু স্বচ্ছর সাথে কথা বলার জন্যই ফোনটা রেখেছে সে।তাই তো আলো জ্বলতেই ফোনটার দিকে তাকাতেই দেখল স্বচ্ছ কল দিচ্ছে। সুহা রাগে গিজগিজ করতে করতেই কল তুলল। মুখে ওড়না ভাজ করে চেপে রাগে কিড়মিড় করতে করতে বলে উঠল,
“ এসব কি অস্বচ্ছ সাহেব? এমনি এমনিই কি অস্বচ্ছ বলি আপনাকে? সাতসকালে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে শিষ বাজাচ্ছেন কেন? এটা আপনার স্বচ্ছ নামের পরিচয়? ”
স্বচ্ছর মুখচাহনি নিভে এল। দোষ করল বন্ধুরা আর দোষী হলো সে? আবার অন্যদিকে মনের মাঝে ভাবনা আসে যে এতক্ষন মেয়েটা বেলকনিতে ছিল দেখেই হয়তো কল রিসিভড করে নি। এখন রুমে গিয়েই হয়তো কল রিসিভড করেছে। তার মানে বেলকনিতে যে মেয়েটা ছিল সেই স্বচ্ছর বউ? স্বচ্ছ মুহুর্তেই প্রশ্ন ছুড়ল,
“ তারমানে তুমিই সে? বেলকনিতে যে বসে ছিলে সেই তুমি সুহাসিনী? ”
সুহার ইচ্ছে হয় বেআক্কল লোকটার মাথায় পাথর ছুড়ে মারতে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে টানটান স্বরে জানায়,
“ সে হলে কি করবেন? রাস্তায় দাঁড়িয়ে বন্ধুদের নিয়ে উত্যক্ত করবেন? শিষ বাজাবেন?”
স্বচ্ছ মোটেই শিষ বাজায়নি। তবুও তাকেই জবাবদিহি করতে হবে কেন? স্বচ্ছ গম্ভীর স্বরে জানাল,
“ শুধু শুধু দোষারোপ করবে না সুহাসিনী শিষ কেবল আবির আর সাদাফইই বাজিয়েছে। আমি না। ”
“ প্রমাণ কি? দুইজন যেহেতু বাজিয়েছে আপনি ও বাজিয়েছেন নিশ্চয়।”
স্বচ্ছ রাগ হলো। সে বলেছে করেনি তবুও বিশ্বাস করছে না এই মেয়ে?মিথ্যে মিথ্যে দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে তার ঘাড়ে? রাগ নিয় বলল,
” আমি বলছি যেহেতু এটা বিশ্বাস হয় না?”
স্বচ্ছর রাগকে আরেকটু বাড়াতে সুহা জবাব দিল,
“ আপনাকে বিশ্বাস হয় না এখন আর। ”
“কেন? ”
“ তা জানেন আপনি। ”
স্বচ্ছ তবুও জেদ নিয়ে বলে উঠল,
“বলো তুমি। ”
সুহা মৃদু হাসে এবারে। দীর্ঘশ্বাস টেনে উত্তর দেয়,
“ বিশ্বাস ভেঙ্গেছেন স্বচ্ছ। দারুণভাবেই শিক্ষা দিয়ে গিয়েছিলেন যে কাউকে যাতে বিশ্বাস করতে দুবার ভাবি। তারপরও না ভেবেই বিশ্বাস করব? তাও আপনাকে? ভাবলেন কি করে? ”
স্বচ্ছ দৃঢ় স্বরে জানায়,
“ কারণ তুমি সুহাসিনী! আর আমি স্বচ্ছ। খুব ভুল না হলে তুমি এখনও আমার প্রতি দুর্বল সুহাসিনী!”
সুহা জানতে চায়,
“ এটাকে কাজে লাগাতে চাইছেন?”
স্বচ্ছ আপসোস নিয়ে বলল,
“ সুযোগ পাচ্ছি কই?”
“এবার সুযোগ পাবেন ও না স্বচ্ছ।”
“ আমি সুযোগ খুঁজে নিব। ”
সুহা বলে,
” খুঁজে নিন, নিষেধ করছি না। তবে রাস্তাঘাটে বন্ধুবান্ধব নিয়ে দাঁড়িয়ে, বাসায় চলে এসে বিরক্ত করে আমার সাথে সাথে অন্য মেয়েদেরও বিরক্ত করবেন না। ”
স্বচ্ছ ফোঁসফোঁস স্বরে বলে,
“ আর তুমি যে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছো আমায়?”
“ ঘুরতে তো বলিনি অস্বচ্ছ সাহেব। চাইলে না ঘুরে এই খেলার সমাপ্তিটাও টেনে নিতে পারেন৷আপনার ইচ্ছে! ”
“ স্বচ্ছ এত সহজে হেরে যাবে? ”
সুহা তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসে। উত্তরে বলে,
“ চার বছর আগে যখন ফেলে রেখে গিয়েছিলেন ওটা তো আপনার হার ছিল না । বরং বিজয় ছিল। এবারও নিশ্চয় হার হবে না এটা। ”
স্বচ্ছ বাঁকা হেসে জানায়,
“ খেলার অপর প্রতিদ্বন্ধীকে না দেখেই খেলার সমাপ্তি টানতে পারব না সুহাসিনী! আগে দেখা হোক ,পরিচয় হোক। তারপর তো আসল খেলাটা শুরু হবে।”
সুহা বলে,
“ আপনি যে চালটা দেওয়ার অপেক্ষায় আছেন সে চালটা এবারে ফলবে না অস্বচ্ছ সাহেব। একবার ভালোবেসে ঠকেছি। দ্বিতীয় বার একই মানুষের প্রেমে পড়ে জেনেশুনেই ঠকতে যাব আমি? ”
স্বচ্ছ হাসে। আত্মবিশ্বাসের সহিত বলে উঠল,
“ মানুষের মন আর মস্তিষ্ক সবসময় এক পথে চলে না সুহাসিনী। আমার মন বলছে তোমার মস্তিষ্ক বারবার তোমায় সতর্কবাণী দেওয়া স্বত্তেও তোমার মন শেষমেষ আমাতেই ঝুঁকবে। আমাকেই চাইবে। আমি ভুল না হলে তোমার ওসব প্রেমিক ট্রেমিক সবই তোমার গুঁটি কেবল। তুমি আসলে আমাতেই আকৃষ্ট !”
সুহা মেনে নেয়না। বিপরীতে স্বচ্ছকে জবাব দেয়,
“ একটু বেশিই কনফিডেন্স আপনার!দেখা গেল শেষ মুহুর্তে আপনার সব কনফিডেন্স ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল।একটা উপদেশ দিই? এত বেশি ওভার কনফিডেন্স রাখবেন না। পরে কষ্ট হবে।”
কথাগুলো বলেই কল রাখল সুহা৷ স্বচ্ছ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে তাকায় সে একই বেলকনিতেই।বিড়বিড় স্বরে বলে,
“ আমার কষ্ট দিয়ে তুমি সুখে থাকবে সুহাসিনী?আমি হতে দিব? যেভাবেই হোক তোমাকে আমি আমার জন্য মরিয়া বানাবই ডিয়ার! জাস্ট ওয়েট…”
.
স্বচ্ছ, সাদাফ, আবির আর নিধি চারজনই সকালের ব্রেকফার্স্ট সেরর বিল্ডিংয়ের গেইটের সামনে চেয়ার পেতে বসে আছেে।উদ্দেশ্য ঐ পাঁচজন মেয়ের যারা যারাই বাইরে যাবে সবাইকেই আটকিয়ে হাত চ্যাক করবে। মোবাইলে সুহার পাঠানো সেসব হাতের ছবির সাথে মিলিয়ে দেখবে কোনটা স্বচ্ছর বউয়ের হাত৷ হলোও তাই।প্রথমেই নামল নিতু৷ গেইট পেরোনোর আগেই চার চার জন মিলে তাকে নাস্তানাবুদ বানিয়ে হাত চ্যাক করেছে। তারপর ছেড়ে দিয়েছে। নিতুর ঠিক মিনিট দুই পরই বাসা থেকে বেরিয়েছে সুহা। নিতু যখন ছাড়া ফেল ঠিক তখনই কল করে সুহাকে বলল,
“কি আশ্চর্য দোস্ত!তোর অস্বচ্ছ ব্যাটায় কি শুরু করেছে? এখন শুরু করেছে হাত চ্যাক ক…..”
সুহা কলে শুনছিল কথা।ফোনটা কানে নিয়েই গেইট পেরিয়ে যেতেই সামনে এল আবির। অত্যন্ত বিনীত স্বরে বলে উঠল,
“ আপু? দয়া করে আপনার হাতটা একটু দেখতে পারি আমরা? প্লিজ আপু! আমাদের হেল্প করুন আপনার হাতটা দেখিয়ে।”
সুহা ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। আবিরের বাম হাতে দেখতে পেল মোবাইল। যাতে দেখা যাচ্ছে সুহার পাঠানো সে হাতের ছবিগুলোই। সুহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বুঝল এরা হাতের ছবি মেলানোর মিশনে নেমেছেে।কিন্তু বুঝে উঠল না সে হাত দেখাবে কিনা। এখন যদি হাত দেখাতে ভনিতা করে তাহলে নিশ্চয় সন্দেহ করবে চারজনই? আশ্চর্য! কি শুরু হয়েছে? কি শুরু করেছে এই পাগল লোক?
#চলবে…