প্রেমের সমর পর্ব-১৫+১৬+১৭

0
1

#প্রেমের_সমর
#পর্ব_১৫
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি

সন্ধ্যের কিছুটা পরই স্বচ্ছর শরীর কাঁপিয়ে জ্বর নামল।জ্বরটা ঠিক কেন নামল স্বচ্ছ বুঝে উঠে না। একটু আগেই বিকালে সুহার দাদাজানের সাথে তার কঠিনরকমের এক আলোচনা হয়েছে। যে আলোচনায় এটা স্পষ্ট যে দাদাজান তাকে নাতজামাই হিসেবে দ্বিতীয় সুযোগটা মোটেও দিবে না। তিনি নাতনির জন্য পাত্র দেখছেন। সুযোগ পেলেই এই ছেলের সাথে ছাড়াছাড়ি করিয়ে অন্যত্র বিয়েটা দিয়ে দিবেন। অপরদিকে স্বচ্ছর পরিবারের সবার সাথে কঠিন রকমের আলোচনা হয়ে গিয়েছে এইনিয়ে। দুই পরিবারের তাদের ডিভোর্স হওয়াতে সম্মতি আছে। এমনকি তার বাবা বিকাল থেকে বার কয়েক কল দিয়ে তাকে হুমকিও দিয়েছে যাতে সে বাসায় ফিরেই পুণরায় দেশের বাইরে চলে যায়। সুহাদের বিরক্ত যাতে না করে। নাহলে স্বচ্ছকে উনি মরা ছেলে হিসেবে গণ্য করবেন। কেন ছেলের জন্য সব জায়গায় এতটা অপমানিত হবেন উনি? স্বচ্ছ বাবার সাথে খুব ফ্রি হলেও বাবাকে মান্য করে। বাবার কথা মেনে চলে। তবে এইক্ষেত্রে সে ভেবেছে।এই প্রথম বুঝি সুহাকে হারানোর ভয় পেল সে। একটা অস্পষ্ট হারানোর অনুভূতি টের পেল সে। স্বচ্ছ বুঝে না উঠে তার বাবা এবং দাদাজান দুইজনের কাছেই সময় চেয়েছে। জানিয়েছে দিন পনেরো পরও যদি সুহা ডিভোর্সই চায় তবে সে ডিভোর্স দিয়ে দিবে। এই সম্পর্কের ইতি টানবে। আর আকস্মিক কথাটা বলে ফেলার পর থেকেই স্বচ্ছর মনে হারানোর ভয়টা তীব্র হলো। প্রথমে চ্যালেঞ্জ জেতার যে আক্রোশটা ছিল এখন সে আক্রোশটা আর কাজ করছে না আর। স্বচ্ছ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।বিকালে সে কথাটা বলে ফেলার পর থেকেই সে ছটফট করেছে। কি ভীষণ অসহ্য এক চিন্তা মাথায় নিয়ে ছটফট করেছে।বারবার ভেবেছে সুহা ঘৃণীত চোখের চাহনী।সত্যিই তো!সুহা তো তাকে ঘৃণা করে, অবিশ্বাস করে, একটুও ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই।তবে? তবে কিভাবে স্বচ্ছ দিন পনেরোতে সুহার মন জয় করবে? সদাসর্বদা মেয়েদের মন জিতে আসা স্বচ্ছ এই প্রথম কোন রমণীর প্রেম হারানোর ভয় পেল।আর তারপর থেকেই শরীরের উত্তাপ! স্বচ্ছ চিলেকোঠার ফ্লোরে কোনরকমে পড়ে থেকেই চোখ বুঝে থাকল। মাথাটাও ব্যাথায় ছিড়ে যাচ্ছে। চোখজোড়া জ্বলছে। জ্বরে আর শরীর ব্যাথায় যখন বেহাল দশা ঠিক তখনই এক মেয়েলি ছায়া অবয়ব এসে দাঁড়াল চিলেকোঠার ঘরের দরজায়। কিয়ৎক্ষন স্বচ্ছকে নিরব দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে ছোট শ্বাস ফেলে সুহা৷ হাতের নাস্তাটা এগিয়ে দিতে রুমে ডুকে বলে,

“ চলে যেতে বলেছিলাম স্বচ্ছ। যাননি কেন? এই আবছায়ায় বসে বসে মশার কাঁমড় খাবেন বলে? ”

স্বচ্ছ তাকায়। হলদে লাইটের আলোয় সুহাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। আদুরে চেহারাটা হৃদয়ে হিম স্রোত বইয়ে দিতে সক্ষম। স্বচ্ছ সেভাবেই কপালে হাত রেখে কিয়ৎক্ষন তাকিয়ে থাকল।তবে একটুও বুঝতে দিল না সে অসুস্থ। যেন শরীরের ব্যাথাটা সে সয়ে নিতে দক্ষ অনেক! অথচ বাবা মায়ের আদরে আদরে বড় হওয়া বাঁধর ছেলেটা যে একটু থেকে একটুতেই নেতিয়ে যায় তা কি জানা আছে? জ্বরের দরুণ চোখ গুলো ও লাল দেখাচ্ছে একটু।স্বচ্ছ বেশ গম্ভীর গলাতেই বলল,

“ আমিও তো বলেছিলাম মেনে নাও আমায়। মানলে না তো সুহাসিনী। ”

সুহা বিরক্ত স্বরে বলে,

“ সেই এক কথা! ”

স্বচ্ছর তখন শরীর পোড়ানো জ্বর।উষ্ণ শরীরে বিশ্রী এক অনুভূতি নিয়েই সে সুহার দিকে চাইল। অনেকটা সময় চুপ থেকে চোখ বন্ধ করে ফের। ভাবুক স্বরে বলল,

“ আমি বোধহয় ভালোবাসা শব্দটার সাথে পরিচিত হচ্ছি সুহাসিনী। কষ্ট পাচ্ছি। দমবন্ধ লাগে। আমি বোধহয় চারবছর আগে খুব জঘন্য একটা ভুল করেছিলাম সুহাসিনী। সে ভুলের কি আসলেই কোন ক্ষমা হয় না?আসলেই আরেকটা সুযোগ পাওয়ার যোগ্য নই আমি?”

সুহা তাচ্ছিল্য নিয়ে তাকায়। অথচ সে যদি স্বচ্ছ লাল হয়ে উঠা চোখজোড়ার দিকে চেয়ে সে দৃষ্টির অর্থ বুঝার চেষ্টা চালাত তাহলে বোধহয় বুঝত স্বচ্ছর গহীণেও তাকে হারানোর সহস্র বেদনা লুকিয়ে আছে।সুহা তাচ্ছিল্য করেই বলল,

“ আশ্চর্য!শরীর ঠিকাছে তো আপনার? নাকি আমায় ভুলানোর নতুন কৌশল এটা? ”

স্বচ্ছ আক্ষেপ হয়। কি বাজে অনুভূতি। নিজের ভেতরের কষ্টগুলো প্রকাশ করলেও বিশ্বাস করে না। আক্ষেপ নিয়েই বলল,

“ আমার কোন কথাই বিশ্বাসযোগ্য ঠেকে না তাই না?”

“ কি করে ঠেকবে? পূর্ব অভিজ্ঞতা তো বলে আপনি মিথ্যে বলতে খুব ওস্তাদ অস্বচ্ছ সাহেব।”

স্বচ্ছ এই পর্যায়ে করুণ চাহনিতে তাকায়। জ্বরের উত্তাপে যখন শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পুড়ে ছাঁই হচ্ছে ঠিক তখনই নিজের ইগো, অহংকার সব একপাশে রেখে বলে,

“ আমাকে ক্ষমা করে দাও।আরেকটা সুযোগ দাও সুহাসিনী!প্লিজ!”

“ বাদ দিন সে টপিক। আপনার পরিবার, আমার পরিবার কেউই চায় না এই সম্পর্কটা থাকুক অস্বচ্ছ সাহেব।তিক্ততা চলে এসেছে এর ভেতর। দাদাজান এবং আপনার আব্বার মাঝে বিরোধ চলছে। কাজেই এই সম্পর্কটা পুণরায় হওয়ার নয়।”

স্বচ্ছ রুমের ওপরের দেয়াল তাকায়।স্মিত হেসে বলে,

“মাথা ভর্তি তুমিময় জট পাকানো যন্ত্রনা ডুকে গেছে,বুঝলে? আমি বোধহয় ভয়ংকর রকমের অসুস্থ হয়ে পড়ছি সুহাসিনী। ছুঁয়ে দেখো? তোমার উত্তাপে আমি পুড়ছি।”

সুহা ঠোঁট এলিয়ে হাসে। বলে,

“ কাব্যিক হওয়া শিখছেন? ভাবছেন আমি গলে যাব?গলব না। এবার আর ভুলেও গলব না অস্বচ্ছ সাহেব। ”

স্বচ্ছ এই পর্যায় রাগ হলো।এতোটা নির্দয় রমণী তার কপালেই থাকতে হলো? বলল,

“ ভালো।গলতে হবে না। ”

“ গলাটা ফ্যাঁকাশে শোনাচ্ছে। ”

স্বচ্ছ ত্যাড়া গলায় বলে,

“ শোনালে শোনাক।

সুহা ছোট শ্বাস ফেলে বলে,

“ আপনার আম্মু কল দিয়েছেন, ছোটবোন সিয়া কল দিয়েছে। আপনার খেয়াল রাখতে বলল।”

“যাক, ওদের কথা রাখতে হলেও আমার খেয়াল রাখার দায়িত্বটা নিয়েছো। নাহলে তো নিতেই না।”

“ আমাদের বাসাতে থাকছেন । সে হিসেবে অবশ্যই খেয়াল রাখতাম আপনার। অতোটা অমানবিক নই আমরা। ”

স্বচ্ছ চুপ থাকে। তারপর অনেকটা সময় পর বলে উঠে,

“তোমার দাদাজান আমার সাথে খেলায় নেমেছেন। তুমি বলো? এই খেলায় কাকে বিজয়ী করার ইচ্ছে তোমার? ”

“ যাকেই হোক আপনাকে নয়। ”

স্বচ্ছ রাগ এই নির্দয়, পাষন্ড রমণীর উপর। বলে,

“গুড, এখন এখান থেকে চলে যাও। ”

“ নাস্তাটা করে নিবেন,রাতে খাবার দিয়ে যাবে দাদাজান।”

স্বচ্ছ হেসে বলে,

“ বেলায় বেলায় খাবার দেওয়াটা কেমন ভিখিরি ভিখিরি অনুভব করাচ্ছে আমায়। অথচ আমি এই বাসার জামাই। কোথায় জামাই আদর করবে তা নয়! ”

সুহা টানটান স্বরে জানায়,

“ জামাই আদর পাওয়ার মতো কাজ যদি করতেন তাহলে এই বাসার প্রত্যেকটা লোকই আপনাকে মাথায় তুলে রাখত স্বচ্ছ৷ আপনি তো সেটা করেননি। ”

স্বচ্ছর রাগে নাক লাল হয়ে উঠেে।কন্ঠে শীতল রাগ বসিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,

“ তো এখন কি করব?নিজের করা সে ভুলটার জন্য এখন মরে যাব? বলছি তো ভুল করেছি। ক্ষমা করে দাও। নতুন করে সুযোগ দাও। ”

” সম্ভব নয়। ”

.

রাতে সুহার দাদাজান দরজায় ঠকঠক আওয়াজ করলেন।হলদেটে আলোয় স্বচ্ছকে দেখে বলে,

“এই হতচ্ছাড়া ছেলে? মরার মতো পড়ে আছো নাকি? ”

স্বচ্ছ জ্বরে বেহুশ অনেকটা। দাদাজান ফের বলে,

“ এই ছেলে? শোনো! তোমার খাবার। খেয়ে নিও। পরে না খেয়ে আমাদের বদনাম করো না। ”

স্বচ্ছ এই পর্যায়ে চোখ মেলে তাকায়। মাথা চেপে ধরে হেসে বলে,

“ দাদাজান, আমি বোধহয় আপনার নাতনির অনুপস্থিতিতে অসুস্থ ফিল করছি। আমায় সুস্থ করার ব্যবস্থা করুন। আপনার নাতনিকে পাঠিয়ে দিন না একটু সেবা করতে। ”

দাদাজান চোখ পাকিয়ে তাকায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“ এই ছোঁকড়া মার চিনেছো? এখানে থাকতে দিচ্ছি এই অনেক। আমি এমনিতেও আমার নাতনির সঙ্গে তোমার সংসার হতে দিব না। নতুন করে বিয়ে দিব অন্য জায়গায়। ”

স্বচ্ছ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,

“আমি চুপচাপ মেনে নিব নাকি? ”

“ যায় করো, শেষমেষ আমি আমার নাতনির বিয়ে অন্যত্র দিবই! ”

.

সকাল তখন দশটা। সুহা বোধ করল যে স্বচ্ছ দেরি করেই ঘুম থেকে উঠবে তাই দেরি করেই ছাদের উদ্দেশ্য পা বাড়াল। হাতে মায়ের দেওয়া নাস্তার প্লেট। সুহা অতি যত্ন নিয়েই নাস্তার প্লেট খানা নিয়ে চিলেকোঠার ঘরে গেল। দরজা ঠেলে স্বচ্ছকে দেখতে নিতেই চোখে পড়ল চিৎ হয়ে শুঁয়ে থাকা স্বচ্ছকে। চিলেকোঠার একটা পাতলা ময়লা কাপড় জড়িয়ে আছে। যেন খুব শীত করছে! সুহা কপাল কুঁচকে তাকায়৷ মেঝেতে কালকের সন্ধ্যা এবং রাতের জন্য পাঠানো খাবারগুলো ঠিক একইভাবে পড়ে থাকতে দেখেই কপাল কুঁচকাল। বিরক্ত নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,

“ খাবার পাঠিয়েছি কি ফেলে রাখার জন্য? নাকি বড়লোকি মুখে লাগেনি এই খাবারগুলো? খান নি কেন? ”

স্বচ্ছ উত্তর করল না। সুহা ফের বলল,

“এই যে? দিনের দশটা বাজে।এখনও ঘুমে এতোটাই বিভোর যে কথাও কানে যাচ্ছে না।”

এই পর্যায়েও স্বচ্ছ উত্তর করল না৷ সুহা এগিয়ে যায়। স্বচ্ছর কানের কাছে গিয়েই বলে,

“ আশ্চর্য!ডাকছি আমি অস্বচ্ছ সাহেব। কানে কথা ডুকছে না আপনার? ”

স্বচ্ছ চোখ মেলে তাকায় না।তবে জেগেছে। বলে,

“ সুহাসিনী? তুমি? আরেকটু ঘুমাই?শীত করছে অনেক। একটা কম্বল দিবে? ”

সুহা ভ্রু কুঁচকায়। সকাল দশটা হলেও বাইরে ফকফকা রোদ। বলে,

“ শীত করবে কেন। বাইরে ফকফকা রোদ উঠেছে।”

কথাটা বলেই পরমুহুর্তেই কিছু বুঝে উঠতে পেরেছে এমন ভাবে বলে উঠল,

” জ্বর আপনার? ”

স্বচ্ছ এবার তাকায়।অনেক কষ্টে। মাথা যন্ত্রনা করছে তার। এই যন্ত্রনাতেও হেসে মজা করে বলে,

” একটু কপাল ছুঁয়ে দেখোই না। তোমার ছোঁয়ায় হয়তো জ্বরটা সেরে যাবে সুহাসিনী।”

সুহা সত্যিই বসে পড়ে ফ্লোরে। ঝুঁকে গিয়ে স্বচ্ছর কপালে হাত রাখল। মুহুর্তেই অনুভব করল ছেলেটার শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। তীব্র উত্তাপ। সুহার অনুশোচনা হয়। কাল সন্ধ্যায়ও স্বচ্ছ বলেছিল সে অসুস্থ। সুহা বিশ্বাস করেনি। কিন্তু সত্যিই স্বচ্ছ অসুস্থ ছিল। সুহা নিরাস স্বরে বলে,

“শরীর পুড়ে যাচ্ছে তো!কবে থেকে? ”

স্বচ্ছর সুহার হাতটা কপালে চেপে ধরে বলে,

“ বললাম তো বিকালে, বিশ্বাস করলে না। নির্দয় রমণী!”

সুহা ছোটশ্বাস ফেলে বলে,

“ কাল থেকে না খেয়ে আছেন? আশ্চর্য! সবকিছুতে মানুষ এতোটা ছন্নছাড়া কি করে হয়? অসুস্থ বোধ করছেন জানার পরপরই তো আপনার উচিত ছিল ঔষুধটা নেওয়া। তা না করে অসুখটাকে আরো জটিল না করলে শান্তি হয় না? ”

স্বচ্ছ তাকায়। মিনমিনে দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে সেভাবেই বলল,

“ সুহাসিনী? আমি বোধহয় তোমাকে চাইছি। আমার বোধহয় তোমাকে লাগবে। আমি কি এক বিশ্রী জালে ফেঁসে গেছি সুহাসিনী! চ্যালেঞ্জ জিততে এসে, তোমাকে জব্দ করতে এসে আমিই বিশ্রী ভাবে ফেঁসে গেছি! তোমার চোখে আমার জন্য ঘৃণা দেখলেই আমার অসহ্য লাগছে। তুমি আর কখনো আমার কাছে ফিরবে না ভাবলেই নিজের উপর সহস্র রাগ জমছে।এটা কি ভালোবাসা? ”

সুহা মুহুর্তেই হাত সরায়। স্বচ্ছ দৃষ্টি থেকে দৃষ্টি সরায় তৎক্ষনাৎ।বলে,

” এটা জেদ। স্রেফ আপনার জেদ। ”

স্বচ্ছ বোকার মতো করে বলে,

“ জেদ? ”

“ হ্যাঁ, জেদ!”

#চলবে…

#প্রেমের_সমর
#পর্ব_১৬
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি

স্বচ্ছর এই হঠাৎ আসা তীব্র জ্বরের কারণেই বোধহয় সুহার মনে একটু মায়া জাগল। শরীরের উত্তাপ বুঝে কিয়ৎক্ষন থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে নিচে গেল পানি আর একটা কাপড় আনতে। যাতে কপালে জল পট্টি দিতে পারে। অতঃপর নিচে গিয়ে কাপড় আর পানিও আনল। স্বচ্ছকে মাথাটা সোজা করতে বলে যখন স্বচ্ছর পাশেই বসতে নিবে ঠিক তখনই স্বচ্ছ হাসল।বলল,

“বউ হিসেবে বউয়ের মতো সেবা করতে এসেছো সুহাসিনী? ”

সুহা তপ্তশ্বাস ফেলে। সে মোটেও বউয়ের মতো সেবা করতে আসেনি। তবে তার মন বলছিল এই ছেলেটার সেবা করতে। এই অসুস্থ ছেলেটাকে এভাবে ফেলে যেতে তার নিজেরই মায়া হচ্ছিল। হয়তো চার বছর আগের ভালোবাসার রেশের টানেই এই মায়া। সুহা তপ্তশ্বাস ফেলে জানায়,

“ আমাদের বাসায় এসে জ্বর বাঁধিয়েছেন। দায়িত্ব পালণ করছি শুধু। ”

স্বচ্ছর চোখ মেলে তাকাতেই কষ্ট হয়। মাথা ভার হয়ে আছে। চোখ জ্বলছে। তবুও চোখ খুলে তাকায় সুহার দিকে। মেয়েটাকে তার ইদানিং বিনা কারণেই দেখতে মন চায়। হয়তো অদৃশ্য একটা টান ও কাজ করে। অথচ স্বচ্ছ এমনটা চায়নি। সে চেয়েছিল মেয়েটাকে তার টানে ফেলতে। শেষ পর্যন্ত সেই ফেঁসে গেল। বিষয়টা বুঝে উঠেই বলে,

“ শুধুই দায়িত্ব? ”

সুহা বিরক্ত হয় যেন। একটা মানুষের জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। তার উপর খাবারটুকু পর্যন্ত খায়নি। চোখগুলো লাল হয়ে আছে কেমন জ্বরের তাড়নায়। সুহা বলে,

“ চুপ করে শুঁয়ে থাকুন। জ্বর আপনার। দুপুরের মধ্যে জ্বর না কমলে দাদাজানকে ডক্টর আনার কথা বলতে হবে। ”

স্বচ্ছ চুপ থাকে এবারে৷ সুহা কথা না বাড়িয়ে জলপট্টি দেয় কপালে। একবার, দুইবার, তিনবার। যতবারই দিল স্বচ্ছ সেভাবেই শুঁয়ে থেকে তার দিকেই তাকিয়ে থাকল।সুহা কিছুই বলল না। অবশেষে স্বচ্ছই বলল নিরস স্বরে,

“ এই যে আমি এখানে পড়ে আছি। মায়া হচ্ছে না কিঞ্চিৎ?”

সুহা দৃঢ় গলায় জানাল,

“ না! ”

স্বচ্ছর মন খারাপ হয়। পুণরায় বলে,

“ এই যে আমি অসুস্থ, জ্বরে পুড়ে যাচ্ছি। কষ্ট হচ্ছে না? ”

“ কেন হবে? ”

স্বচ্ছ মুখটা চুপসে গেল কেমন যেন। বিড়বিড় করে বলে,

“ নির্দয় রমণী! ”

কথাটুকু বলেই চোখ বুঝল স্বচ্ছ। বেশ কিছুটা সময় চুপ থেকেই হুট করে চোখ বন্ধ রেখে বিড়বিড় করে বলল,

“ সুহাসিনী? তুমি আমার জীবনে আচমকায় ঝড়ো হাওয়ার ন্যায় আসা এক অনুভূতি। এই অনুভূতিটা অদ্ভুত। বুঝে উঠি না। কি এক বিভৎস অনুভূতি তুমি তৈরি করে দিলে বলো তো?”

সুহা গলল না কথাগুলোতে। বরং রেগে গেল বেশ এমন ভঙ্গিতে তাকাল। জলপট্টি সরিয়ে বাটিতে রাখতে রাখতেই রাগ নিয়ে বলে উঠল,

“ জ্বরের ঘোরেও বসে বসে নাটক করবেন না। এসব নাটক এখন স্বস্তা লাগে। ”

স্বচ্ছর এবার ফুঁসে উঠে। অথচ উত্তর করে না। এই একটা মেয়ে যার সামনে সে সত্যিকারের আবেগ প্রকাশের চেষ্টা করে। কষ্ট বুঝানোর চেষ্টা করে। অথচ এই একটা মেয়েই তাকে কি যাচ্ছেতাই ভাবে অপমান করে, অবিশ্বাস করে আর অবহেলা করে। সে চুপ থাকে। সিদ্ধান্ত নেয় এই মেয়েটার সামনে সে দ্বিতীয়বার আর আবেগ প্রকাশ করবে না। তাই তো চিৎ হয়ে সোজা মতো শুঁয়ে থাকল। সুহা সেভাবে শুঁয়ে থাকতে দেখে বলে,

“উঠুন, মাথায় পানি দিব। ভালো লাগবে।”

স্বচ্ছ টানটান স্বরে উত্তর দেয়,

“প্রয়োজন নেই।”

“ জ্বর সারবে?”

ত্যাড়া স্বরে উত্তর দেয় সে,

“ না সারুক। ”

সুহা এবারে শক্ত স্বরে উত্তর দেয়

“ জেদ করবেন না। আমি আপনার আব্বু আম্মু নই যে আপনার জেদ শুনব। ধরে কাকভেজা করে গোসল করিয়ে দিব বলে দিলাম। ”

স্বচ্ছ উত্তর দেয়না। সুহা এবারে জোরালো স্বরেই বলে উঠে,

“ কি হলো? কথা কানে যায় না আপনার? ”

“ গেছে।”

“ তাহলে উঠুন। ”

স্বচ্ছ উঠে এবারে। সুহার কথা জবাব না দিয়ে ছাদে গিয়ে বসে। সুহা ততক্ষনে বালতি করে পানি এনেছে। স্বচ্ছ মাথা নুয়াতে বলেই পানি ঢালে। তারপর পানি দেওয়া শেষে বিপত্তি বাঁধে চুল মোঁছা নিয়ে। সুহা জিজ্ঞেস করে,

“ তোয়ালে আছে? ”

স্বচ্ছ ততক্ষনে ভার গলায় উত্তর দেয়,

“ কি করে জানব তোমরা এভাবে অনাদরে দূরে সরিয়ে চিলেকোঠার ঘরে থাকতে দিবে? জানলে তো আনতাম। যায় হোক, তোমার ওড়না দিয়েই মুঁছিয়ে দাও না। ”

সুহা ছোটশ্বাস ফেলে।তাকিয় দেখে স্বচ্ছর ভেজা চুল বেয়ে পানি পড়ছে কপালে। নিঃসন্দেহে স্বচ্ছকে এই রূপে সুন্দর লাগছে। বোধহয় একটু বেশিই।তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। তবুও সুহা নজর সরাল।স্বচ্ছর কথা মতো নিজের ওড়নার এককোণা দিয়ে স্বচ্ছর চুল মুঁছতে লাগল। ঠিক তখনই পেছন থেকে দাদার লাঠির ঠকঠক আওয়াজ শোনা গেল। বললেন,

“ কি করছো? ঐ ছোখরার মাথা তুমি কেন মুঁছে দিচ্ছো? ছোট বাচ্চা ও? ”

সুহা হাত সরিয়ে নেয়। দাদাজানের দিকে চেয়ে উত্তরে বলে,

“ জ্বর উনার। ”

স্বচ্ছ তখন বিড়বিড় স্বরে বলে,

“ চলে এসেছে এই ইভিল দাদাজান। কাছাকাছি দেখলেই গা জ্বলে তার।”

দাদাজান অবশ্য শুনতে পেল না কথাটা। সুহাকে বলল গম্ভীর গলায়,

“ তাতে তোমার কি এসে যাচ্ছে? ”

স্বচ্ছ এবারে উত্তর করে,

“আমার জ্বরে আমার বউয়ের এসে যাবে না তো কি আপনার এসে যাবে ডিয়ার দাদাজান? ”

দাদাজান রেগে তাকায়। চোখগুলোতে তাকিয়ে থেকে সন্দেহী স্বরে জানায়,

“ চুপ করো বেয়া’দব ছেলে। চোখ দুটো দেখে তো লাগছে নেশা করেছো। আমার বাসায় কিন্তু নেশাপানি দেখলেই সোজা উষ্ঠা মেরে ছাদ থেকে ফেলে দিব। ”

স্বচ্ছ এবারে বাঁকা হাসে। ঠোঁট এলিয়ে শুধায়,

“ মনে হচ্ছে দাদাজানের নেশা সম্পর্কে খুবই ভালো অভিজ্ঞতা আছে। কি বলুন দাদাজান? ”

দাদাজান সোজা লাঠি তাক করে। বলে,

” এই ছেলে? লাঠি দেখেছো? পিঠের চামড়া উঠিয়ে নিব।”

স্বচ্ছর দাঁত কিড়মিড় করে। শুধায়,

“ আপনার জিনগুলাই আমার বউয়ের ডিএনএ তে ভর করেছে। নয়তো আমার বউ এতোটা নির্দয় হওয়ার কথা নয়।কখনোই নয়। ”

.

ছুটি নিরবে বসে আছে। বাইরে ঠান্ডা আবহাওয়া। আকাশ অল্প মেঘলা। প্রকৃতি বোধহয় বর্ষণ চাইছে। ছুটি নিরবে বসেই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল প্রকৃতিটাকে। ভাবে, শীতের পর প্রথম বৃষ্টির মতোই তার কাছে একটা বার্তা এসেছিল। তার আবির ভাই তাকে ভালোবাসে। ছুটি সে বার্তাটা পেয়ে যতটুকু খুশি হয়েছিল এখন ঠিক ততোটাই উদাস। কারণ আবির ভাই হুট করেই আবার উধাও হয়ে গিয়েছে। সুহার থেকে শুনেছে সুহাদের বাসাতে কেবল স্বচ্ছই গিয়েছে। অর্থ্যাৎ আবির যায়নি।গেল কোথায়? ছুটির মন খারাপ হয়। যাও ছেলেটাকে দুয়েক পলক দেখা মিলত এখন তাও হবে না।ছুটি কয়েকবার ম্যাসেজ ও করেছেে।জানতে চেয়ে কি অবস্থা। অথচ আবির বরাবরের মতোই তাকে পাত্তা না দিয়ে রিপ্লাই করেনি। ছুটি এই পর্যায়ে উদাস হয়েই বাসা ছেড়ে বের হলো। বন্ধুরা সহ গেল কফি খেতে। সেখানে সাদ ও ছিল। তিনজন মেয়ে এবং একটা ছেলে কফির মগ নিয়ে ছবি তুলে স্টোরি দিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। তারপর চলল ঘন্টা তিন- চার আড্ডা। অথচ এই তিন চার ঘন্টাতেই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা কোন এক যুবক যে নাক ফুলিয়ে রাগ ফুসছে তা কি ছুটির জানা ছিল? ছুটি জানত না। যখন বাসায় ফিরল তখন দেখল তার আবির ভাই তাকে কল দিয়েছিল। তাও তার ফোন সাইলেন্ট থাকা অবস্থাতে। ছুটির আপসোস হলো। পরমুহুর্তেই বারকয়েক কল দিতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল এক ধমক,

“ বলদের মতো এভাবে কল দিচ্ছিস কেন বারবার? যখন কল দিয়েছি তখন তুলেছিস?”

ছুটি অভিমান নিয়ে শুধাল,

“ আপনাকেও তো যখন ম্যাসেজ দিয়েছি ম্যাসেজের রিপ্লাই দেননি আবির ভাই। ”

“ আমারটা আর তোরটা এক নয়। ”

“ তাহলে ভিন্ন? ”

আবির এক ধমকে বলে,

“ আমি তোর চাইতে বড়৷ ”

ছুটি কিভাবে যেন সাহস করে বলে ফেলল,

“ তাতে কি? ”

ব্যস! আবিরের রাগটা যেন আরেকটু বাড়ল। বলল,

“ ঐ ছেলেকে একবার মেরেছি না? হাড়গোড় ভাঙ্গে নি? আবার ঐ ছেলের সাথে মিশতে গেছিস কেন? ”

ছুটির গলা নেমে আসে এবারে। বুঝতে পারে আবিরের রাগের কারণ। নরম স্বরে উত্তর দেয়,

“ বন্ধু হয় ও কেবল। ”

আবির রেগে শুধায়,

“ ছেলেবন্ধু রাখবি কেন? ”

“ ও শুধু বন্ধুই। আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন?”

ফের রাগ নিয়ে বলে,

“ আমি রাগলে তোর কি? ”

ছুটি এবারে ছোটশ্বাস ফেলে। আবির কিছু না বলতেই বলে উঠে,

“ঠিকাছে, এরপর সাদ এর সাথে আর মিশব না আবির ভাই। ”

#চলবে…

#প্রেমের_সমর
#পর্ব_১৭
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি

বিকালের দিকে স্বচ্ছর অবস্থার আরেকটু অবনতি ঘটল। হুশই নেই ছেলেটার তখন। বাধ্য হয়ে স্বচ্ছকে ছাদের চিলেকোঠার ঘরটা থেকে বাসার একটা রুমেই থাকার অনুমতি দিলেন দাদাজান। স্বচ্ছর বাবা মাকে খবর দেওয়ার পাশাপাশি ডক্টর আনলেন বাসায়৷ ডক্টর ঔষুধপত্র দিয়ে চলে যেতেই সুহা নিরবে চেয়ে থাকে। উপরে উপরে রাগ দেখালেও এই মুহুর্তে এসে তার সত্যিই মায়া হচ্ছে। দুদিনেই বোধ হচ্ছে ছেলেটার মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। চোখজোড়ায় সে চঞ্চলতা কিংবা অহংকারী ভাবটা চোখে আসে না যেন। সুহা তাকাল। দু পা বাড়িয়ে যখন স্বচ্ছর মাথায় হাত বুলাতে হাত বাড়াল ঠিক তখনই দাদাজান হুংকার ছুড়লেন,

“ ঐ ছেলের থেকে দূরে দূরে থাকবে। যা নাটকবাজ ছেলে দেখা গেল জ্বরটাও ঐ বাঁধর ছেলের নাটকই। ”

সুহার ভালো লাগল না কথাটা। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে ছেলেটার। হুশজ্ঞানই নেই। সে ছেলে এই অবস্থাতেও নাটক করবে? বলল,

“জ্বরে বেহুশ হয়ে আছে দাদাজান। এটা নিশ্চয় নাটক না। ”

দাদাজান বিশ্বাস করলেন না কথাটা৷ ব্যঙ্গ করে বললেন,

“ আবার নাটকও হতে পারে। দিন পনেরোর মধ্যে তোমার মনে জায়গা করতে অনেক কিছুই করতে পারে। আমি এই ছোখরাকে বিশ্বাস করি না।”

কথাটা বলেই দাদাজান রুম ছেড়ে বাইরে গেলেন। সুহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। খাটের এককোণায় বসে হাত ছোঁয়ায় স্বচ্ছর কপালে। এখনও উত্তাপ।কপালে পগে আছে এলোমেলো চুল। কতোটা মায়াময় লাগছে মুখটা। সুহা যখন তাকিয়ে থাকে মুখপানে ঠিক তখনই রাহা পেছন থেকে বলে উঠে,

“ আপু? দুলাভাই কি কিউট ভাবে ঘুমায় তাই না? ঘুমালে কি সুন্দর লাগে দেখ। ”

রাহার মুখে চঞ্চল হাসি। সুহার রাগ হয়। স্বচ্ছকে অন্য কেউ কেন সুন্দর বলবে? অন্য কেউ কেন ওর ঘুমানো মুখটা দেখে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকবে? সে নিজের বোন হোক বা অন্য কেউ। সুহা নিজের বোনের প্রতিই এই ইর্ষাবোধে বিরক্ত হয়। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে,

“ তো? তোর কি? বিয়ে করবি?”

“ ছিঃ আপু, তোমার বর তো। তোমার বর না হলে নাহয় বিয়ে করার জন্য আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতাম। কারণ ভাইয়া সুন্দর। ”

সুহা চুপ থাকে। দাদাজানকে সে এতকাল দমিয় রেখেছিল। স্বচ্ছর সাথে না হওয়া সংসারটা টিকিয়ে রাখার আপ্রান চেষ্টাটাও এতকাল সেই করেছিল। দাদাজান তো শুরু থেকেই স্বচ্ছর তেমন কাজ পছন্দ করেনি। রাগ ফুসেছিল। সুহা এতকাল দমিয়ে রাখতে পারলেও শেষ সময়ে যখন দাদাজানের রাগের দাবানলে পড়তে হয় তখনই স্বচ্ছকে জ্বালানো শুরু করেছিল সে। ভেবেছিল স্বচ্ছ ফিরবে শুধুই তার জন্য। স্বচ্ছ ফিরেই তাকে চাইবে। অথচ তা হলো না। স্বচ্ছ দেশে ফিরেও বাউন্ডুলে পনা দেখাল। চ্যালেঞ্জ জেতার নেশা দেখাল। যা দাদাজান জানার পর থেকেই দ্বিগুণ রাগ ফুসছেন। শুধু প্রকাশ করতে পারছেন না। সুহা জানে, দাদাজান স্বচ্ছকে কখনোই মেনে নিবে না। এখন তো আরও না। ছোটশ্বাস ফেলেই বলে,

“ দুদিন পর তো আর আমার বর থাকবে না। দাদাজান ভেঙ্গে দিবেন তো সম্পর্কটা৷ তখন তুই বিয়ে করে নিস। শান্তি?”

রাহা ভ্রু বাঁকিয়ে তাকায়। বলে,

“ এভাবে বলছিস কেন? তুই কি রেগে যাচ্ছিস আপু? ”

“ রাগব কেন? রেগে যাওয়ার মতো কিছু বলেছিস নাকি?আশ্চর্য!”

রাহা ঠোঁট উল্টায়। বোনের পাশে বসেই কৌতুহল নিয়ে শুধায়,

“ আচ্ছা, তুই কি সত্যিই ভালোবাসিস না ভাইয়াকে? আমার কেন যেন মনে হয় যে তুই ভালোবাসিস দুলাভাইকে? ”

সুহা শান্তস্বরে উত্তর দেয়,

“ ভালোবাসলেও ভালোবাসার মর্যাদা তো উনি রাখেন নি তাই না? যদি রাখতেন আমি নিজেই নিজেকে সমর্পন করতাম তার তরে।”

রাহা মন খারাপ করে পুণরায় বলে,

“ আমার তো মনে হয় দুলাভাইও তোকে ভালোবাসে৷ নাহলে কি এতদূর ছুটে আসত?”

“ ওসব তার জেদ আর অহংকার!জয়ী হওয়ার নেশা!”

.

স্বচ্ছর সেবা করার দায়িত্বটা নিল সুহা নিজেই। শতহোক নিজের ভালোবাসার মানুষ বলে কথা! শখের পুরুষ তো।মায়া ভুলে থাকা যায় না। তাই তো জলপট্টি দেওয়া হতে, ঔষুধ খাওয়ানো সহ খাবার খাওয়ানো সবটাই সুহা করল। অবশেষে স্বচ্ছ যখন রাতে জেগে উঠে সুহা তাকায়। কপালে হাত রেখে বুঝে জ্বর পড়েছে এখন। দ্রুত পায়ে পুণরায় রান্নাঘরে গিয়ে স্বচ্ছর জন্য খাবার আনে। বলে,

“ খেতে হবে। ”

স্বচ্ছ এদিক ওদিক তাকায়। মুখ তেঁতো ঠেকছে তার। খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। শরীর মেঝমেঝ করছে। স্বচ্ছ বুঝে না উঠেই, এদিক ওদিক চেয়ে বলে,

“ আম্মু কোথায়? আম্মুকে একটু ডেকে দিবে সুহাসিনী?”

সুহা সরু চোখে তাকায়৷ উত্তরে বলে,

“ আম্মু নেই।আমি আছি, আমার কথা শুনতে হবে। ”

” আম্মুর হাতে খাব।”

সুহা তপ্তশ্বাস ফেলে। বলে,

“ আমি খাইয়ে দিব। হবে?”

স্বচ্ছর শরীর ক্লান্ত। উঠে বসার শক্তিটুকুও বোধহয় পাচ্ছে না সে। তবুও উঠে বসার চেষ্টা চালাতে লাগল। বলল,

“ তুমি? ”

স্বচ্ছ উঠতে পারল না। বরংআগের মতোই শুঁয়ে থাকল।বলল,

“ এনার্জি পাচ্ছি না। কি করেছো আমার যে এনার্জি সব হারিয়ে গেছে হুহ?কোন যাদু টাদু করে ফেলো নি তো?”

সুহা দাঁতে দাঁত চাপে। একটা মানুষ এতোটা অসুস্থ হওয়ার পরও কি করে এমন ঢং করতে পারে বুঝে না সে। বলে,

“জানি না। এবার বলুন,আমার হাতে খাওয়া যাবে নাকি?”

স্বচ্ছ ক্লান্ত মুখে আলতো হেসে বলে,

“ তুমি আমায় বিষ মিশিয়েও খাইয়ে দিতে পারো সুহাসিনী। তোমাদের পরিবারটাই ভয়ংকর নির্দয়।দাদাজান আর তোমার তো স্টোন হার্ট! অসম্ভব কিছু নয়।”

সুহা এবারে রেগে তাকায়। বিরক্ত হয়ে বলে,

“ এর নাকি এত জ্বর। জ্বরে উঠে বসতে পারছে না পর্যন্ত। অথচ ফটর ফটর করে কথা বলেই যাচ্ছে। ”

স্বচ্ছ প্রশ্ন ছুড়ে,

“ কথা অফ রাখব? ”

“ চুপচাপ খাবেন এখন। তারপর ঔষুধ খাবেন। ”

স্বচ্ছ যেন সুহা সামনে অনুভূতি দেখাতে চাইল না। বরং জেদ নিয়ে বলল,

“ আমি নিজের হাতে খেতে পারি। ”

সুহা খাবার ঠেলে দিল। বলল,

“ তাহলে নিজের হাতেই খান। ”

স্বচ্ছ উঠে বসতে চাইল। অথচ শরীর দুর্বল। সুহা তা দেখেই বলল,

“ উঠে বসারও তো শক্তি দেখছি না। টানা একদিন না খেলে তো এমনই হবে তাই না? সবকিছুতে পন্ডিতগিরি না দেখালে তো আবার আপনার চলবে না। ”

স্বচ্ছ কেমন করে তাকায়। যেন চোখজোড়ায় কত অভিমান ছোচ বাচ্চাদের ন্যায়। সুহার এই প্রথম এই চাহনি দেখে হাসি পেল। অথচ হাসল না।স্বচ্ছ বলে,

“ সবসময় রেগে রেগেই কথা বলো কেন? ভালোবেসে কথা বলা যায় না?”

“ না যায়না!”

.

স্বচ্ছর জ্বরের খবর পেয়ে ওর আম্মু এসেছে ছুটে। তবে আব্বু আসেনি। স্বচ্ছর আম্মু সাহেদা খানম এসেই ছেলেকে ঘুমোতে দেখে হাত বুলালেন চোখেমুখে। ঝুঁকে আলতে চুমু দিলেন কপালে। তারপর দাদাজানের করা কর্মকান্ড সমূহ রাহার কাছ থেকে শুনেই সাহেদা খানম নিরবে রাগ পুষলেন। শত হোক! ছেলে তো! যে ছেলেকে তিনি কোলে কোলে বড় করেছেন সে ছেলেটাকে ধূলোবালিতে চিলেকোঠাতে তাও মেঝেতে থাকতে দেওয়া হলো?এতোটা অনাদর? সাহেদা খানম দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এসে পর্যন্ত এখানে কোনকিছুই না খেয়ে ছেলের পাশে বসে থাকলেন। অবশেষে যখন স্বচ্ছ চোখ খুলল তখন সাহেদা খানম হাসেন। জানতে চান কেমন লাগছে?অথচ উনাকে নিরাশ করে দিয়ে স্বচ্ছ জানায়,

“ আম্মু? আমার জ্বরটা হুট করে কেন নামল জানো? ঐ মেয়েটার জন্যই। ওর কথা ভেবে ভেবেই আমি অসুস্থ হয়ে গেলাম আম্মু। সব দোষ ঐ মেয়ের!”

কথাগুলো বলেই পরমুহুর্তেই মায়ের কোলে মাথা রাখল স্বচ্ছ। হতাশ স্বরে জানায়,

“ আম্মু!তোমরা কি নির্দয় এক রমণীর সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছো আমার। এই নারীর মন পাথরের চাইতেও কঠিন।আমি কখনোই এই নারীর মনে জায়গা করতে পারব? ”

স্বচ্ছর মা ছেলের এতগুলা কথার বিনিময়ে একটাও উত্তর করলেন না। বরং ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নিরব স্বরে শুধায়,

“ কাল আমার সাথে বাসায় ফিরবে স্বচ্ছ। ”

স্বচ্ছ তৎক্ষনাৎ নিরাশ স্বরে জানায়,

“ অসম্ভব! পনেরো দিনের পরীক্ষা আমার। উর্ত্তীর্ণ না হলে বউ ফসকে যাবে? ”

স্বচ্ছর মা শান্ত হয়ে তাকায়। ছেলের কপালে হাত রেখে শান্ত হয়ে বলে,

“ ও এমনিতেও ফসকে গেছে স্বচ্ছ। ওর দাদাজান তোমায় পছন্দ করেন না। এই কথাটা আমাদের বারংবার বলেছেন উনি। তবুও এতদিন সম্পর্কটা ছিল শুধু মাত্র সুহার কথাতে। কিন্তু এখনতো তুমি সুহার কথা বলার কোন জো রাখোনি। ”

স্বচ্ছ কৌতুহল নিয়েই শুধায়

“ কি করেছি?”

“ দেশে এসেও মেয়েটাকে গুরুত্ব না দিয়ে তোমার বলদ বলদ কাজকারবার উপহার দিয়েছো।এটাই কি যথেষ্ট নয়? ”

#চলবে…