প্রেমের সমর পর্ব-৩৫+৩৬+৩৭+৩৮

0
3

#প্রেমের_সমর
#পর্ব_৩৫
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি

আবির আর ছুটিকে নিয়ে যখন আবিরদের বাসায় আসা হলো তখন রাত। আবিরদের বাসার সকলের মুখেই তখন উপছে পড়া আনন্দের রেশ।অথচ যে দুইজন ছেলে মেয়ের বিয়ের কারণে তারা এত আনন্দিত সে দুইজনের মুখেই হাসির রেশ অব্দি নেই।তবুও সবাই খুশি। কারণ সবারই ধারণা ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবেন৷ এরমধ্যে স্বচ্ছ,ছোটন, ফিহা এরাও বসে থাকল না ভদ্র বাচ্চার মতো। এতরাতে বাসায় এসেও হুট করে কোথায় থেকে তাড়াহুড়ো করে ফুল নিয়ে আসল। যতটুকু সম্ভব আবিরের ঘরটা সাঁজিয়ে আরাম করে বসল তিনজনে। স্বচ্ছ অবশ্য উঠে গিয়ে আবিরের পাশে বসল। দাঁত কেলিয়ে আবিরকে বলে উঠে,

“বাসর ঘর সাঁজানো ডান বন্ধু। যদিও আমার এখনও বাসরটা কপালে জুটেনি তবে তোর জন্য শুভকামনা। ”

আবির ততক্ষনে ক্ষেপা বাঘের মতো চাইল যেন। হাতে চিনচিনে ব্যাথা তার। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। স্বচ্ছকে মেরে আধমরা করে রাখবে যেন এমন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠে,

“ তোর কি মনে হচ্ছে আমি বাসর করার মুডে আছি? বেয়াদব!”

স্বচ্ছ ভ্রু বাঁকিয়ে তাকায়। আবিরের পিঠে চাপড় মেরে বাঁকা স্বরে শুধায়,

” মনে তো হচ্ছে না তুই বউ কাছে পাওয়ার ধান্ধায় নেই। বরং এটাই মনে হচ্ছে যে কাছে পেলেই মেয়েটাকে চেপে ধরবি নিরীহ অবলা প্রাণীর মতো। ”

আবির ফোসঁফাঁস শ্বাস টানে। বড্ড বিরক্ত এমন ভাবে বলে উঠে,

“ হুরর!ঐ মেয়ের সাথে আমার কথাই নেই। ও কি ভেবেছে? আমি ওর সাথে নিজে থেকে কথা বলব?জীবনেও বলব না। ওর অন্য ছেলেকে বিয়ে করার শখ জেগেছে যেহেতু থাকুক ও অন্য ছেলে নিয়ে! ”

“ তো এত হম্বিতম্বি করে বিয়ে করলি কেন শা’লা? ঐ ছেলেটার সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেই তো হতো তাহলে। ”

আবির এবারেও রেগে তাকাল। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে উঠে,

“ ওর ভাগ্য ভালো ঐ ছেলেকে আমি মেরে ফেলিনি। ”

স্বচ্ছ বিদ্রুপ স্বরে শুধায় এবারে,

“ কোথাকার কোন বীরযোদ্ধা এলেন। ঐ ছেলেকে মারতি তুই?আজীবনের ভদ্র ছেলে যে সে আবির?”

আবির বিরক্ত গলায় বলে উঠল,

“ মাথা খারাপ করছিস। বলেছি তোদের ঘর সাঁজাতে? সাঁজালি কেন? ”

স্বচ্ছ ব্যঙ্গ স্বরে ফের বলল,

“ তুই বলবি আর আমরা সাঁজাব এমন মনে হয় নাকি? ”

.

স্বচ্ছ আবিরদের বাড়িতে আবিরকে বাসর ঘরে ডুকানো পর্যন্ত ছিল। শেষমেষ ওদের বাড়ির লোকেদের জোরজবরদস্তি স্বরূপ খেয়েও নিল। অবশেষে ওখান থেকে যখন বাসায় এল তখন রাত একটা। স্বচ্ছ উশখুঁশ করে। অবশেষে পুরোটা দিন কাঁটিয়ে বউকে জড়িয়ে ধরতে পারবে। অবশ্য সে যাওয়ার সময় সুহাকে বলে যায়নি। কারণটাও বলে যায়নি। সারাদিনের ব্যস্ততায় সুহার সাথে ফোনেও কথা বলা হয়ে উঠে নি তার। তবে একটা চিরকুট লিখে গিয়েছিল পাশ দিয়ে। সুহা কি তা দেখেছে? যদি না দেখে? এসব ভাবতে ভাবতেই সুহা দরজা খুলল। স্বচ্ছ আগাগোড়া দেখে নিয়ে টানটান স্বরে উত্তর করল,

“রাত কটা বাজে স্বচ্ছ? ”

স্বচ্ছ বেখেয়ালি ভাবে উত্তর দিল,

“ হু? কটা বাজে? খেয়াল করিনি তো। ”

এই পর্যায়ে এসে সুহার কান্না পেল। রাগে চোখ লাল হয়ে উঠল মেয়েটার। দুদিন আগে ও এই ছেলে অসুস্থ ছিল। এইতো কয়েকটা সপ্তাহ আগে এত বড় একটা এক্সিডেন্ট ঘটাল। সুহার বুঝি চিন্তা হয় না? হারানোর ভয় হয়না? স্বচ্ছর কি উচিত ছিল না এবার একটু দায়িত্ববান হওয়া? উচিত ছিল তাকে একটু জানানো কোথায় যাচ্ছে, কখন ফিরবে। সুহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শুধায়,

“ আপনি আসলেই ছন্নছাড়া স্বচ্ছ। সবসময়ই ছন্নছাড়া!

স্বচ্ছ বোকা বোকা হাসে। পায়ের জুতো খুলতে খুলতে শুধায়,

“ বুঝিনি। ”

সুহা নিরবে তাকিয়ে থাকে। শান্ত ভঙ্গিতে উত্তর করে,

“বুঝতে হবে না। খেয়েছেন? খাবার বাড়ছি, আসুন। ”

“ আমি তো…. ”

কথাটা স্বচ্ছ সম্পূর্ণ করার আগেই সুহা বুঝে নিল উত্তরটা কি হতে পারে। এই পর্যায়ে যেন কান্নাটা আরো দলা পাকিয়ে আসল। ভ্রু উঁচিয়ে স্মিত হেসে বলল,

“ খেয়ে এসেছেন? ”

স্বচ্ছর কেন জানি না এবারে বোধবুদ্ধি ফিরে এল। সুহার মুখের দিকে তাকিয়েই হুট করে মনে হলো এই মেয়ের চোখ জোড়ায় হাজার দুঃখ। স্বচ্ছ এগোয়। সুহার মুখ আগলে নিয়ে সর্বপ্রথম চুমু বসায় সুহার কপালে। উত্তরে বলে,

“ আমার জন্য খাও নি সুহাসিনী?আসলে আবি্… ”

এবারও পুরো বাক্যটা সম্পূর্ণ করার আগেই দৃঢ় গলায় উত্তর এল,

“ খেয়েছি। ”

“ মিথ্যে বলো কেন সুহাসিনী? ”

সুহা হাসে। বলে,

“ যখন আপনি ছিলেন তখন কি আমি খেতাম না? নাকি না খেয়ে এতবছর কাঁটিয়ে এসেছি আমি? ”

স্বচ্ছ মুখ গোল করে শ্বাস ছাড়ে। সুহার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট এলিয়ে হেসে বলে,

“ মনে হচ্ছে রেগে আছো। মিস টিস করলে বুঝি আমায়? ”

সুহা হেসে শুধায়,

“ মিস করার প্রয়োজন বোধ করিনি। ”

“ সত্যিই?”

সুহা এই পর্যায়ে সরে দাঁড়ায়। রুমের দিকে পা বাড়িয়ে যেতে যেতে বলে উঠে,

“ মিথ্যে বলে লাভ? ”

স্বচ্ছ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। আবারও তার বউ রেগে গিয়ছে। আবারও আগের ফর্মে!কিভাবে রাগ ভাঙ্গাবে?এতসব ভাবনা যখন মাথার ভেতর তখনই এসে দাঁড়ালেন শাহরিয়ার সাহেব। গম্ভীর স্বরে শুধালেন,

“ এত রাত অব্দি কোথায় ছিলে? কোন রাজকার্যটা উদ্ধার করলে সারাদিনে? ”

স্বচ্ছ মুহুর্তেই উত্তর করে,

“ আবিরের বিয়ে দিয়ে এলাম। ”

শাহরিয়ার সাহেব ব্যঙ্গ স্বরে বললেন,

“ নিজের বিয়েটাই তো এখনো পাকাপোক্ত করলে না। আবার অন্য জনের বিয়ে নিয়ে নাচ করছো? ”

স্বচ্ছ কটমট করে তাকায়। শুধায়,
“ অপমান করছো আব্বু?”

উনি দ্বিগুণ রাগ দেখিয়ে বলেন,

“তোমার উচিত ছিল না কোথায় যাচ্ছো বলা যাওয়া? ওভাবে ভোর ভোর চলে গিয়েছো, তাও কাউকে না জানিয়ে। চিন্তা হয় না কারোর? ”

“ তোমরা কেউ তো জানতেও চাও নি।জানতে চাইলে তো অবশ্যই বলতাম আব্বু।”

“ তোমাকে আমরা যেতে দেখিইনি স্বচ্ছ যে জিজ্ঞেস করব। দুদিন আগে এক্সিডেন্ট করেছো, বেঁচে এসেছো মৃত্যুর সাথে লড়াই করে। চিন্তা হওয়াটা স্বাভাবিক ছিল না আমাদের? ”

স্বচ্ছ এবারে কৌতুহলি হয়ে তাকায়। হেসে কৈাতুহলি স্বরে বলে উঠে,

“ তোমাদের একমাত্র বউমা চিন্তা করেছে কি আব্বু? ”

“ কি মনে হচ্ছে? ”

“ বুঝে উঠছি না ঠিক! ”

উনি এবারে থাপ্পড় বসালেন ছেলের গালে। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে যেতে যেতে বললেন,

“ গর্দভ! তোমার আসলেই সংসার করা উচিত না স্বচ্ছ।”

স্বচ্ছ গালে হাত দিয়ে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকল। এভাবে মারাটা কি প্রয়োজন ছিল? কান ঝা ঝা করছে তার। স্বচ্ছ মুুখ বাঁকিয়ে নিজের ঘরে এল। সুহাকে ঘুমিয়ে থাকার ভান করতে দেখে ছোট শ্বাস ফেলে। কাছে গিয়ে ডাকে,

“ সুহাসিনী? খাবার খাব। খাবার বেড়ে দাও৷”

সুহা ওভাবেই উত্তর করে,

“ খেয়ে এসেছেন আপনি।মিথ্যে নাটক করবেন না। ঘুমোলাম। ”

স্বচ্ছ কথা বাড়াল না। কোনমতে ওয়াশরুমে গিয়ে গোসলটা সেরে এসেই পা পেলে রান্নাঘরে গেল। কাঁচা হাতে থালায় খাবার বেড়ে নিয়ে ঘরে এল।শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,

”খাবারও বেড়ে নিতে পারি না৷ সুহাসিনী? দেখোতো হলো কিনা? ”

সুহা চোখ মেলে তাকায়। খাবার বাড়ার নকশা দেখে ভ্রু কুুচকে বলে উঠে,

“ মা বাবার আদরের ছন্নছাড়া ছেলে ছিলেন বলে কথা। ”

স্বচ্ছ ফোঁস করে শ্বাস টানে। ভাতের গ্রাস সুহার দিকে এগিয়ে দিয়েই নতমুখী হয়ে বলে,

“ আমার কিন্তু দোষ নেই সুহাসিনী। তুমি কি একটা চিরকুট পেয়েছো? রেখে গিয়েছিলাম আমি পানির গ্লাস নিচে। ”

কথাটা বলেই স্বচ্ছ আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখাতেই সুহা সেদিকে তাকায়। চিরকুটই তো৷ স্বচ্ছ কি এটা এখন রাখল? হয়তো না। সুহা এগিয়ে নিল। গুঁটি গুঁটি অক্ষরে লেখা,

“ সুহাসিনী? তোমায় ঘুমন্ত দেখে চুমু দেওয়ার ইচ্ছেটা সামলানো গেল না। বড্ড আদুরে যে তুমি। এই আদুরে বউকে রেখে যাওয়াটা কষ্টকর! তবুও যেতে হচ্ছে। শত হোক তোমর বান্ধবী তো তোমারই মতো হবে তাই না? আমার বন্ধুটিকে আজীবন দেবদাস হয়ে কাটানোর প্ল্যান বানিয়েছে। আমি কি তা হতে দিতে পারি? তাই যাচ্ছি। নয়তো বউ ছেড়ে আমি এক পাও নড়তাম না। বিশ্বাস করো। ”

সুহার কেন জানি না শেষের পড়াটুকু পড়ে হাসি পেল।কিন্তু হাসল না। গম্ভীর মুখ করে স্বচ্ছর বাড়িয়ে দেওয়া খাবারটুকু মুখে নিল শুধু। স্বচ্ছ নিজেও মুখে খাবার নিল। বলল,

“ আমাদের বিয়ের কত বছর হলো সুহাসিনী?”

সুহা মুহুর্তেই প্রশ্ন ছুড়ে,

“ হুট করে এই প্রশ্ন? ”

স্বচ্ছ মুখটা ফাঁটা বেলুনের ন্যায় করে বলে,

“কারণ এত বছরেও আমার বাসর করা হলো না।”

.

তখন মধ্যরাত। ছুটি বহুক্ষন ধরেই আবিরের দিকে সূক্ষ্ম নজর ফেলে চেয়ে আছে।কি সুন্দর ফুলগুলো একপাশ করে টানটান হয়ে কপালে হাত রেখে শুঁয়ে আছে ছেলেটা। যেন সে ছাড়া এই ঘরে আর দ্বিতীয় কোন জীব অবস্থিত নেই। ছুটি বেশ কিছুটা সময় সেভাবে চেয়ে থাকে। বড্ড ঘুম পাচ্ছে তার।মাথাটা যন্ত্রনা হচ্ছে যে বড্ড!শরীর চাপিয়ে কেবল ক্লান্তি। ছুটি আচমকাই ফোঁস ফোঁস শ্বাস টানল। তার অকারণেই কান্না পাচ্ছে। কেন পাচ্ছে বোধহয় সে নিজেও জানে না। চোখ টলমল করছে। এই মুহুর্তে এসে দাঁড়িয়ে তার নিজেকে একটা খেলার পুতুল পুতুল লাগছে কেবল! সামনের পুরুষটির প্রতি চাপা ক্ষোভ কাজ করছে। কান্নায় টলমল করছে চোখ। হয়তো যেকোন সময়ই কেঁদে ফেলবে। তাই তো দ্রুত পায়ে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। নিরবে চোখের পানি ফেলে বহুটা ক্ষণ!কাঁদতে কাঁদতে ফুঁফিয়ে উঠতেই আচমকা টের পেল তাকে কেউ কোলে তুলে নিচ্ছে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে যখন ভয়ে চোখ কুঁচকে নিবে তখনই বোধ হলো এটা আবির। কোলে তুলে এনে বিছানায় রেখেই নিজেও শুঁয়ে পড়ল অন্য পাশে। একদম অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই মুখ ঘেষে রাখল ছুটির ঘাড়ে। দুইহাতে জড়িয়ে নিয়ে সেভাবেই চোখে বুঝে নিয়ে শাসিয়ে বলে উঠে,

“ এভাবে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কেঁদে কি বুঝাতে চাইছিস? আমি তোকে মেরেছি? অত্যাচার করেছি? চুপচাপ ঘুমা বেয়াদব! ”

ছুটি তখন যান্ত্রিক রোবটের মতো তাকিয়ে থাকল অন্যদিকে। কি হচ্ছে? আবির ভাই তাকে জড়িয়ে ধরেছে?ঘাড়ে মুখ ঘেষছে?অথচ তার কোন অনুভূতি হচ্ছে না!

#চলবে…

#প্রেমের_সমর
#পর্ব_৩৬
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি

ছুটি জড় পদার্থের ন্যায়ই শুঁয়ে থাকল চোখ গোলগোল করে। তখনও আবিরের বাহু বন্ধনীতে অবস্থান তার। যেন এই মুহুর্তে তার চলনফেরনের বোধটুকু সে হারিয়েছে।ঠিক মিনিট কয়েক পরই সে যেন বোধ ফিরে পেল। সামান্য ফিরে আবিরের দিকে চাইল কেমন চোখে। তখন মুখে কান্নাগুলো শুঁকিয়ে এসেছে যেন। মলিনতা ঢেকে রেখেছে সারা মুখ। ছুটির বড্ড জানতে ইচ্ছে হয় আবির ভাইকে। কি তার মনে? যদি রাহাকেই ভালোবেসে থাকে তবে বিয়েটা কেন করল তাকে? ছুটি শুকনো ঢোক গিলে। কিয়ৎক্ষন তাকিয়ে থেকেই প্রশ্ন ছুড়ে,

“ আবির ভাই? বিয়েটা করার পেছনে আসলে উদ্দেশ্যটা কি বলুন তো? আমি সত্যিই জানতে চাই। ”

আবির তখনও চোখ বুঝেই থাকল। জেগে আছে অথছ নড়চড় হলো না। শুধু আলিঙ্গনটা দৃঢ় হলো।গম্ভীর স্বরে উত্তর করল,

“ তুই জানতে চাইলেই যে জানাব আমি কোথাও লিখা আছে এমনটা? ”

ছুটি ছোটশ্বাস টানে। আবির যেন একেবারে গায়ে সেঁটে আছে ভেবেই হাঁসফাঁস করে এবারে। সরার চেষ্টা করবে কি করবে না ভাবতে ভাবতেই বলে,

“আপনি হয়তো নিজের স্বার্থে বিয়েটা করেছেন কিন্তু প্রয়োজনটা কি ছিল জানতে পারব না আমি?”

আবির এই পর্যায়ে চোখ খুলে। ছুটির দিকে তাকিয়ে নিরব দৃষ্টি ফেলে। অথচ সেই দৃষ্টিই যেন ছুটিকে নিরব সতর্কবার্তা উপহার দিল। শাসাল নিভৃতে। অতি শান্ত, শীতল দৃষ্টি ফেলেই ছুটির থুতনিতে আঙ্গুল বুলিয়ে শুধায় আবির,

“সত্যিই জানিস না ? ”

ছুটি কাঁটকাঁট হয়ে তাকায়। থুতনিতে আঙ্গুল বুলানোর দরুণ শরীর শিরশির করছে তার। সাথে শখের পুরুষের মারাত্মক দৃষ্টি খাতা।একটু লালচে হয়ে আছে চোখজোড়া।দৃষ্টিতে যেন সহস্র প্রেম লুকিয়ে। ছুটি নজর সরিয়ে দ্রুত শুধায়,

“জানলে এতক্ষনে বুঝতে পারতাম। অথচ আজ এতক্ষন ভেবেও আমি উত্তর পাইনি। ”

আবিরের রাগ হয় এই পর্যায়ে। সে যে ছুটিকে ভালোবাসে এটা ছুটি বুঝে না?এতকালেও বুঝে নি? এমনকি আজকের পরেও না? মেয়েটা নিশ্চয় এতোটাই বোকা নয়। আবির রাগে ক্ষোভে থুতনি চেপে বলে,

“ তো ঐ ছেলের সাথে বিয়ে হলে উত্তর খুঁজে পেতি? ঐ ছাগলের প্রতি খুব দরদ না?আমায় চড় মারতেও হাত কাঁপেনি তাই না? ”

“ অতিরিক্ত করছিলেন। ছেলেটার ফিজিক্যাল স্ট্রাকচার নিয়ে ব্যঙ্গ করছিলেন কেন?”

আবির ফের সরাসরি নজর ফেলে শাসিয়ে বলল,

“ খুব দরদ না? অনুভূতি এসেছে ঐ ছেলের প্রতি? অথচ এতকাল তো আমায় ভালোবাসিস বলতি। নাটক করতি সেসব? ”

ছুটিও তাচ্ছিল্য হাসে। শুধায়,

“আপনারা নাটক করে ভালোবাসতে পারেন আবির ভাই। আমি পারি না। ”

আবিরও বাঁকা কন্ঠে শুধায়,

“ তাই নাকি? তাহলে আমি এতোটা আদর মিশিয়ে বলে যাওয়ার পরও তুই পরপুরুষের হওয়ার চিন্তা করিস কি করে?

ছুটি ফের হেসে বলে,

“ আপনি কখনো আমায় ভালোবাসেননি আবির ভাই! বলুন না সত্যি করে, বিয়েটা কেন করলেন আবির ভাই? কোন স্বার্থে?”

বারবার স্বার্থ কথাটা আবিরের লাগে। রাগ হয়। সে কি স্বার্থ নিয়ে এই মেয়েটাকে চেয়েছিল?স্বার্থের কারণে ভালোবেসেছিল? তবুও বারবার এই শব্দটা তাকে কেন শুনতে হচ্ছে? আবির হিসহিসিয়ে শুধায়,

“ কি মনে হচ্ছে? তোকে নাটক করে বিয়ে করে পাচার টাচার করে দিব?এই স্বার্থে বিয়ে করেছি? ”

ছুটি চুপ থাকে কিয়ৎক্ষন এবারে। পরমুহুর্তে বেশ ক্ষাণিকটা সময় পর কাঁপা গলায় শুধায়,

“ আমায় নিশ্চয় ভালোবাসেন না আপনি? ”

আবির হাসে। কন্ঠের কম্পন বলে দিচ্ছে মেয়েটা এর উত্তর পেয়ে কতোটা অনুভূতিসিক্ত হবে। একটু খানি মুখ নামিয়ে ছুটির দিকে তাকায় সে। নাকে নাক ঘষে সেভাবেই বলে,

“ আমার সম্পূর্ণ জীবনটাই তোর অনুভূতি নিয়ে খেলা যাক ভাবলাম। এই চুক্তি করেই বিয়েটা করেছি। শান্তি?এবার ঘুমা বোকা! ”

ছুটি বুঝে উঠল না কি বলা উচিত বিনিময়ে। শুধু বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল আবিরের চোখে হাসার দৃশ্যের দিকে।

.

সুহা স্বচ্ছর হাতে খাবার খাচ্ছে ঠিকই তবে মুখে গম্ভীর ভাবটা এখনো বর্তমান। মনে হচ্ছে চাপা রাগ বিরাজ করছে। স্বচ্ছ বুঝে উঠে না কি করবে। কিছুটা সময় বউয়ের মুখের দিকে চেয়ে থেকে হুট করেই শুধায়,

“ বিয়েটা করে নিই আমরা সুহাসিনী?”

সুহা তাকায়। খেতে খেতেই ভ্রু উঁচিয়ে বলে,

“ কবার করব বিয়ে? ”

স্বচ্ছ উশখুশ স্বরে উত্তর করে মুহুর্তেই,

“মানে বিয়ের অনুষ্ঠানটা। ”

সুহা তাকায় স্বচ্ছর দিকে। ছোটশ্বাস ফেলে জানায়,

“ প্রয়োজন কি? ”

স্বচ্ছর মুখ চুপসে যায়। ফাঁটা বেলুনের মতো মুখ করে বলে উঠে,

“ বিয়ে বিয়ে ফিলিংস দেখাতে হবে না? আগের বার বিয়েটাতো এমনিই করেছিলাম।”

সুহা মুহুর্তেই উত্তর করল ত্যাড়া স্বরে,

” বলেছিলাম এমনি করতে? ”

স্বচ্ছ ফোঁস করে শ্বাস ফেলে। এই মেয়ে দেখছে ভালোই রেগে আছে। কি করে রাগ কমাবে? বুঝে উঠে না। শান্ত গলায় সুহার ঠোঁটে লেগে থাকা ঝোল টুকুুু মুঁছে দিতে দিতে বলে,

“ তখন তো জানতাম না এই মেয়েটাতে আমি ফেঁসে যাব এত কঠিন ভাবে। ”

“ ফেঁসে যেতেও বলিনি। ”

স্বচ্ছ হাত ধুঁয়ে খাবার প্লেটটা রেখে দেয় ততক্ষনে। ফের বিছানায় বসতে বসতে তোয়ালেতে হাত মুঁছে। অতঃপর সুহার গাল আগলে ধরে বলে,

“ বলোনি, কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত ফেঁসে তো গেলামই। কি করি বলো? যাই শাস্তি দাও মাথায় পেতে নিব সুহাসিনী, বিনিময়ে ভালোবাসা দাও। ”

সুহার হাসি পায়। তবে হাসে না৷ স্বচ্ছর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ সারাদিন টইটই করে রাতদুপুরে কাব্যিকতা দেখাচ্ছেন?প্রেম ঝরে পরছে এখন হুহ? ”

স্বচ্ছ ঠোঁটে ঠোঁটে চেপে শুধায়,

“ এমন একটা বউ থাকলে প্রেম ঝরে পরবে না? দেখলেই তো ইচ্ছে হয় প্রেমে পরি। কিন্তু কপাল দেখো। বউ পেয়েছি চারবছর,অথচ বউকে কাছে পাওয়া হলো না আমার এখনো।”

সুহা মুহুর্তেই শুধাল,

“ এসবই চিন্তা করছিলেন এতক্ষন?

স্বচ্ছ হাসে দাঁত কেলিয়ে। একদম আচমকায় মাথাটা এলিয়ে দেয় সুহার কোলে। আঁকড়ে ধরে সুহার কোমড়। মাথা গিয়ে ঠেকে সুহার পেটে। শান্ত স্বরে শুধায়,

“ আবির বিয়ে করেছে। ওর বাসর ঘর সাঁজালাম আজ আমি।আর, এইদিকে দেখে, আমি নিজেই এখনো বাসর ঘরে পা রাখা তো দূরের কথা দেখলামই না সুহাসিনী। বিয়ে করলাম চার চারটা বছর! ”

সুহা স্থির বসে রইল। অন্যদিন স্বচ্ছর মাথায় হাত বুলালেও আজ বুলিয়ে দিল না। শক্ত হয়ে বসে থেকে শুধাল,

” দোষ আমার? ”

স্বচ্ছ বউয়ের রাগ বুঝে আরেকটু শক্ত শক্ত করেই জড়িয়েই ধরে। সুহার হাতটা জোরপূর্বকই রাখে নিজের চুলের ভাজে। অথচ তাতেও যখন সুহা আগ্রহ দেখাল না তখনই অবাধ্য কাজ করে বসল। হাত গিয়ে ঠেকল সুহার কামিজের নিচ দিয়ে কোমড়ের ত্বকে। শুধাল,

“ ভালোবাসলে রাগ কমবে সুহাসিনীর? ”

সুহা কথাটা শুনেই নিরবে তাকায়। টলমল করে তার চোখজোড়া।ঠোঁটজোড়া কাঁপছে আকস্মাৎ। বোধহয় অভিমান টুকু একটু আদুরে স্বর পেয়েই গলতে যাচ্ছে। সুহা কান্না দমাল না। কম্পমান ঠোঁটজোড়া চেপে রেখে কাঁপা স্বরে শুধাল,

“ আপনার ভালোবাসার প্রয়োজন নেই। সারাদিনে এতগুলো ফোনকল, এতগুলো ম্যাসেজ আপনার চোখে পড়েনি স্বচ্ছ। আপনি খুবই দায়িত্বহীন প্রেমিক! ”

স্বচ্ছ এই পর্যায়ে সুহার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হাসে। সুহার টলমল করা আঁখিদ্বয়, কম্পমান ঠোঁটের দিকে চেয়ে নির্নিমেষ। তারপর হুট করেই যেন কি হলো তার। উঠে বসল স্প্রিংয়ের ন্যায়। মেয়েটার মুখ আগলে নিয়ে সর্বপ্রথম চুমু বসাল লাল হয়ে উঠা নাকের ডগায়। পরমুহুর্তেই কপালে চুম্বন এঁকে শুধায়,

” প্রয়োজন না থাকলেও ভালোবাসব। এবং আমার ভালোবাসা অবশ্যই নিতে হবে তোমায়। বুঝলে সুহাসিনী? না করার সুযোগ হবে না। ”

সুহা সেভাবেই কেঁদে উঠে অভিযোগ জানিয়ে বলতে লাগল,

“ সারাদিন চিন্তায় রেখে ভালোবাসা দেখাবেন না।এটাকে ভালোবাসা বলে না…”

বাকিটুকু বলার অবশ্য সুযোগ হলো না মেয়েটার। এর আগেই নিজের ঠোঁটজোড়ার অস্তিত্ব টের পেল একজোড়া পুরু ঠোঁটের দখলে।অতি নিকটে যে পুরুষটি সে পুরুষটিরই উম্মত্ত ঠোঁটজোড়ার অধীনে। সুহার চোখ ভেজা। ভেজা চোখজোড়া বন্ধ হতেই স্বচ্ছ কিছুটা সময় পর ঠোঁট ছেড়ে চুমু আঁকে সুহার ভেজা চোখে পাতায়। বিড়বিড়িয়ে বলে,

“ তুমি ভুল, এটাকেই ভালোবাসা বলে সুহাসিনী।”

#চলবে….

#প্রেমের_সমর
#পর্ব_৩৭
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি

আশপাশের আবহাওয়া ঠান্ডা। স্নিগ্ধ পরিবেশ।সূর্য তখনে নিজের উত্তাপের পরিচয় দেয়নি ধরণীর বুকে।আশপাশে তখন ফুরফুরে হাওয়া। সময়টা তখন বেশ সকালের।আর এ সকাল সকালই নিজের বাবার সাথে হাঁটতে বের হলো স্বচ্ছ। বের হওয়ার পেছনে অবশ্যই তার একটা নিখুঁত উদ্দেশ্য আছে।স্বচ্ছ বাবার সাথে হাঁটতে হাঁটতে হাসে। রাস্তা দিয়ে এক মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকাতে বাবাকে ইঙ্গিত দিয়ে বলে,

“ দেখলে আব্বু? মেয়েরা কিভাবে আমায় দেখে? এভাবে হলে তো আমার বউ কষ্ট পাবে বলো? ”

শাহরিয়ার সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে চাইলেন। ঠোঁট চেপে বললেন,

“ নিজেই তো নিজের বউকে হাজারটা কষ্ট তাও৷ তার বেলায়? ”

স্বচ্ছ নিজের তাগিদেই হাঁটতে হাঁটতে ভাব নিয়ে শুধায়,

“ বউকে কষ্ট দিলে সে কষ্ট মুঁছে নিতেও পারব আমি। তুমি বারবার এটা মনে করিয়ে কি বুঝাতে চাও?আমি আমার বউকে কেবল কষ্টই দিই? ভালোবাসি না? ”

শাহরিয়ার সাহেব এবারে চোখ গরম করে তাকালেন। রাগত স্বরে বলে উঠলেন,

“থাপ্রে গাল লাল করে দিব বেয়াদব। ”

স্বচ্ছ এই পর্যায়ে হাঁটা থামায়। চোখ মিনমিনে করে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ আব্বু? আমার মনে হয় বিয়েটা আবার করা উচিত। পাড়া মহল্লার অর্ধেক মানুষ এখনো জানেই না যে স্বচ্ছ বিবাহিত।জানলে কি মেয়েরা তাকিয়ে থাকত বলো? ”

শাহরিয়ার সাহেবের এই পর্যায়ে রাগে ফেঁটে পড়ার জোগাড় হলো যেন। ছেলে আবার বিয়ে করতে চাইছে বিষয়টা তার মেজাজ খারাপ করে দিল এক মুহুর্তেই।গম্ভীর স্বরে টানটান গলায় বললেন তিনি,

“ সরাসরি বলো যা বলার। ”

স্বচ্ছ দাঁত কেলিয়ে হেসে শুধাল,

“ বিয়ে বিয়ে অনুভূতি নিতে চাইছি আবার। ”

কথাটা বলার সাথে সাথেই স্বচ্ছর গালে দানবীয় এক চড় পড়ল। যেন কান জাঁ ঝাঁ করে উঠল এক মুহুর্তেই। শাহরিয়ার সাহেব স্থান কাল ভুলে ছেলেকে চড় মেরেই বলে উঠলেন,

“ সুহার জন্য পাগলামি করে এখন অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাইছো বেয়াদব? তুমি আসলেই একটা অকর্ম আর কুৎসিৎ মনের সন্তান। আমার সম্মান ডুবাতে… ”

স্বচ্ছ মুহুর্তেই গালে হাক রেখে উত্তর করে,

“ তোমার বউমাকেই তো বউ হিসেবে চাইছি আব্বুজান। শুধু শুধু চড়টা মারলে।”

এইবারে রাগ কমল বোধহয় শাহরিয়ার সাহেবের। থমথমে মুখে বললেন,

“গর্দভের মতো কথা বলো কেন? ”

স্বচ্ছ হাসে। বলে,

“ বউকে বউ সাঁজে দেখা হয়নি সেবার ভালো করে। এখন দেখতে চাইছি খুব করে। ব্যবস্থা করো আব্বু। ”

“ চলে গিয়েছিলে কেন সেবার? করব না ব্যবস্থা।সেবার সংসারটা করলে এতদিনে নিশ্চয় আমার বাসায় দুটো ক্ষুদে নাতি-নাতনির মুখ দেখতাম আমি। ”

স্বচ্ছ আপসোস সুরে শুধায়,

“ আব্বু! ব্যবস্থা না করলে তোমার নাতি নাতনি পেতেও দেরি হবে। তুমিই বুঝো এবার, কি করবে? ”

কথাটা শুনেই শাহরিয়ার সাহেব কেঁশে উঠলেন। চোখ রাঙ্গিয়ে বললেন,

“ বেয়াদব কোথাকার।মেরে মুখ ভেঙ্গে দেওয়া উচিত তোমার। ”

“ খারাপ কি বলেছি? আমি আসার পর থেকে তেমরা যা নিষ্ঠুরতা আমার সাথে দেখাচ্ছো মনে হচ্ছে তুমি কোনদিন বউয়ের পিছনে ছুটোনি।”

দাঁতে দাঁত চাপা স্বরে উত্তর এল,

” তোমার মতো বেখেয়ালি কাজকর্মও করে বেড়ায়নি। ”

স্বচ্ছ মুখ গোল করে বলে,

“ যা বলার ক্লিয়ারলি বলো আব্বু। তুমি আমার আনুষ্ঠানিক বিয়ে,আনুষ্ঠানিক বাসরের ব্যবস্খা করতে চাইছো না তাই তো?”

শাহরিয়ার সাহেব এই পর্যাযে ছেলের নির্লজ্জ্বতা দেখে দ্রুত হাঁটলেন যাতে ছেলের থেকে এগিয়ে যায়। যেতে যেতে বললেন,

“ চুপ, সুহার দাদার সাথে কথা হবে। ”

.

স্বচ্ছ যখন বাসায় ফিরল দেখতে পেল সোফায় বসা তিহানকে। সাথে অবশ্য বসে আছে রোহানও। হাতে মিষ্টির প্যাকেট৷ স্বচ্ছকে দেখামাত্রই রোহান দাঁত কেলিয়ে হেসে উঠে। এগিয়ে এসে একটা মিষ্টি এগিয়ে বলে উঠে,

“ বড়ভাই? মেয়ে দেখতে যাচ্ছি আজ। দোয়া করবেন যাতে বিয়েটা হয়ে যায় আমার৷ তাহলে অন্তত আপনাকে জ্বালানো কমাই যদি! ”

স্বচ্ছর মেজাজ জ্বলে উঠে যেন। কেন জানি না এই রোহান ছেলেটাকে দেখলেই তার মেজাজ খারাপ লাগে।হাত পা নিশপিশ করে। মুখ চোখ শক্ত হয়ে আসে। এবারেও হলো তা। স্বচ্ছ তাও দাঁতে দাঁত চেপে উত্তে করল,

“ দোয়া করি তোর মতো কু’ত্তার কপালে যাতে একটা মেয়েও না জুটে। ”

রোহান হাসে। ফের বলে,

“ এভাবে বলছেন? আপনার বউকে তো আর চাইনি ভাই। ”

স্বচ্ছ ফের শুধায়,

“ যাকেই চাস না কেন তোর মতো ছ্যাঁ’চড়া ছেলেকে আর কে বিয়ে করবে? ”

” অপমান করছেন বড়ভাই? ”

স্বচ্ছও গলা শক্ত করে উত্তর দেয়,

“ একশো একবার করব। ”

কথাটা বলেই হুড়মুড় করে পা বাড়ায় স্বচ্ছ। পথে একবার কিচেনের দিকে মুখ ঝুঁকিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,

“ আম্মু? বাসায় এসব পোলাপাইনকে কেন ডুকতে দাও? যদি আমার বউ টউ চেয়ে বসে আবার? ”

স্বচ্ছে মা হেসে উঠে ছেলের কথা শুনে। শুধায়,

“ চেয়ে বসলেই তোমার বউ চলে যাবে না স্বচ্ছ। আপাতত ও অতিথি হিসেবেই এসেছে বুঝলে? ”

স্বচ্ছ বুঝদ্বার ছেলের মতো গম্ভীর গলায় বলল,

“বুঝলাম। কিন্তু এ ছেলেকে তাড়াতাড়ি বিদায় করো বলে দিলাম। ”

অতঃপর আর এক মুহুর্তও দেরি না করে দ্রুত গেল নিজের ঘরে। রুমে নিজের একমাত্র নারীটির অস্তিত্ব না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে রয়। ঠিক তার পরমুহুর্তেই দেখা গেল ওয়াশরুম থেকে গোসল সেরে বেরিয়ে এল তার একমাত্র বউটি। পরনে হালকা নীল রংয়ের একটা সুতির শাড়ি যার আঁচলটা গুঁজে রাখা আছে কোমড়ে। চুলগুলো মুঁছড়ে রেখেছে তোয়ালে দিয়ে।স্নিগ্ধ মুখটায় বিন্দু বিন্দু পানির কণা। স্বচ্ছ পলক না ফেলেই চেয়ে থাকে। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় একদম সুহার সামনেই৷ অতঃপর সুহার স্নিগ্ধ আর্দ্র কোমড়ের ত্বকটায় হাত ছুঁইয়ে সর্বপ্রথম শাড়ির আঁচল মেলল। পরমুহুর্তেই তোয়ালে ছেড়ে মেলে দিল ভেজা চুল গুলো। স্বচ্ছ হাসে। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,

“ সকাল সকাল গোসল সারলে? কারণ কি শুনি সুহাসিনী? ”

সুহা আকস্মিক ছোঁয়ায় হতবিহ্বল হয়ে শিউরে উঠলেও স্বচ্ছর সামনে দেখাতে চাইল না যেন। কেমন করে চেয়ে বলে উঠে,

“ আপনি যেমন কোন কারণ ছাড়াই আজকাল সকাল সকাল না বলে হাওয়া হয়ে যান তেমনই সকাল সকাল গোসল করতে ও নিশ্চয় কোন কারণ লাগে না? ”

স্বচ্ছ ঠোঁট কাঁমড়ে হাসে৷ আজও না বলে বেরিয়ে যাওয়াতে বোধহয় রাগ করেছে তার বউ। বিষয়টা ভেবে হেসেই কোমড় আঁকড়ে একটানে নিজের কাছে নিয়ে নেয় স্বচ্ছ। ঝুঁকে গিয়ে সুহার কপালে কপাল ঠেকিয়ে শুধায়,

“ তাই বলে এত ভোরে? আমাদের মাঝে নিশ্চয় কিছু হয়ে উঠে নি বলো?

কথাটায় স্পষ্ট রসিকতা। সাথে স্বচ্ছর মুখে মিটমিট করা চাপা হাসি! সুহা সেদিক পানে তাকিয়েই লজ্জায় লাল হয়ে যেতে যেতে শুধায়,

“ অস্বচ্ছ মনমানসিকতা! ”

স্বচ্ছ ঠোঁট কাঁমড়ে শুধায়,

“ স্বচ্ছ হয়ে লাভ কি? স্বচ্ছকে তো ভালো টালো বাসো না খুব করে। ”

সুহা এবারে তড়াক করে চায়। স্পষ্ট স্বরে বলে,

“ অস্বচ্ছ হয়ে কত মেয়ের প্রেম কুড়িয়েছেন মনে হচ্ছে? ”

স্বচ্ছ আপসোস করে বলে,

“ কত মেয়ে? একটা মেয়েরই তো প্রেম কুড়াতে পারলাম না সুহাসিনী! কপাল খারাপ আমার। ”

“কে বলল পারেননি? আপনি যখন দেশের বাইরে ছিলেন এই পাড়ার অনেক মেয়র কাছেই তো আপনার রূপের প্রশংসা শুনেছি। ধারণা অনুযায়ী তারা রীতিমতো আপনার প্রেমে হাবুডাবু খাচ্ছিল। আবার আমার ফ্রেন্ডরাও তো আপনাকে দেখে আপনার রূপের কত গুণগাণ গাইল!”

স্বচ্ছ করুণ চাহনিতে তাকাল। কোমড় আঁকড়ে চেপে ধরে সেভাবেই বলে,

“ শুধু গাইলে না তুমি। নিষ্ঠুর! ”

সুহা সরতে চায়৷ কিন্তু পারে না। উত্তরে বলে,

“তাতে কি? মেয়ের কি অভাব আছে প্রশংসা করার? ”

স্বচ্ছ ভ্রু নাচিয়ে শুধায়,

“ এখন কি আমার উচিত ওদের প্রেমগুলো কুড়িয়ে নেওয়া? ”

সুহা মুহুর্তেই জানাল,

“ কেন উচিত নয়? ”

“ শিওর? ”

সুহা ত্যাড়া স্বরে উত্তর করে,

”অবশ্যই শিওর! পারলে আমি সহ সাহায্য করব।”

স্বচ্ছ ঠোঁট চেপে হাসে। বলে,

“ থাক, লাগবে না। বুঝে গেছি। ”

“ ভালো। এবার ছাড়ুন। বাইরে যাচ্ছি। ”

কথাটা বলেই সুহা স্বচ্ছর হাত সরিয়ে চলে যেতে লাগছিল তখনই ফের কোমড় চেপে ধরল স্বচ্ছ। শরীরের সাথে মিশিয়ে রেখে শুধাল,

“ উহ, যাবে না।মাত্র গোসল সেরে শাড়ি পড়ে তো একদমই যাবে না রুমের বাইরে। ”

সুহা বুঝে উঠে না। বাইরে কি এমন আছে যে যাওয়া যাবে না?আশ্চর্য! ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে বলে উঠে,

“ কেন? আম্মুকে বলেছিলাম গিয়ে নাস্তা বানাব, তারপর ছুটির কাছে যাব৷দেরি হয়ে যাবে তো নাস্তা বানাতে না গেলে। ”

স্বচ্ছ সেভাবেই থেকেই জানাল,

“ দরকার হলে আজ নাস্তা বানানো হবে না, তবুও যাবে না। ”

” এটা কি ধরণের পাগলামো দেখাচ্ছেন? যেতে হবে স্বচ্ছ। ছাড়ুন। ”

” ওকে, যেতে পারো। শাড়ি চেঞ্জ করো। ”

সুহা কপাল কুঁচকায়। বলে,

“ মানে?”

“শাড়ি খুলবে তারপর যাবে…”

সুহার ইচ্ছে হয় স্বচ্ছর মাথা ফাঁটাতে। কত যত্ন করে সে শাড়িটা পরেছে তাও শুধুই স্বচ্ছর জন্য। স্বচ্ছর থেকে শাড়ি সাঁজের কোন প্রশংসা পাবে বলে। অথচ স্বচ্ছ কিছু তো বললই না বরং শাগি চেঞ্জ করতে বলছে। আচ্ছা? সুহাকে কি শাড়িতে খুব বিশ্রী দেখায়?খুব খারাপ লাগে? স্বচ্ছ এমন কেন করে?সুহাকে ভাবতে দেখে স্বচ্ছ ফের গম্ভীর দৃঢ় স্বরে বলে,

“কি হলো? চেঞ্জ করে আসো। ”

সুহা নরম স্বরে শুধায়,

“ জরুরী কি চেঞ্জ করাটা?”

“ অবশ্যই। ”

সুহার জেদ হলো। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল সে আর শাড়ি পরবে না দ্বিতীয় কোনদিন। বলল,

“ ঠিক আছে! ”

কথাটা বলেই দ্রুত ওয়াশরুমে গেল। ভেজাচুলগুলোই হাতখোপা করল বিরক্তি নিয়ে। কান্নায় টলমল করছে কেন জানি না চোখজোড়া।তবুও কান্না দমাল সুহা। অনেকটা সময় নিয়ে নিজেকে ওয়াশরুমের আয়নায় দেখে খুঁত বের করতে লাগল?কোথায়? শাড়িতে পরে এতোটা তো বাজে লাগছে না তাকে৷ তাহলে?সুহা দাঁতে দাঁত চাপে। চোখ বুঝে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এক মুহুর্তেই পরন থেকে শাড়িটা খুলে নিয়ে টের পেল সে জামা আনে নি পরার জন্য। হুড়মুড় করেই চলে এসেছে।সুহা ছোটশ্বাস ফেলে এবারে শাড়িটা দিয়ে কোনরকমে শরীর জড়িয়ে বের হয়ে এল। উদ্দেশ্য জামা নিয়ে যাওয়া। স্বচ্ছ তা দেখে ভ্রু উঁচিয়ে শুধাল,

“ কি হলো?চেঞ্জ করলে না? ”

সুহা নিরস স্বরে উত্তর করে,

“ করছিলাম, ড্রেস নিয়ে যাইনি। এই কারণে”

কথাটা বলেই আলমারি থেকে ড্রেস নিতে যায়। স্বচ্ছ তাকিয়ে দেখে সুহা কোনভাবে শাড়িটা জড়িয়েছে কেবল। পিঠময় এবং পেটের কিছুটা অংশ দৃষ্টিতে আসছে যার দরুণ। স্বচ্ছ হাসে। শুকনো ঢোক গিলে ততক্ষনে। দুয়েকবার নজর সরিয়ে পরমুহুর্তেই কি বুঝে এগিয়ে গেল। আচমকাই সুহার পেছনে গিয়ে কানের কাছে ফিসফিস স্বরে বলে,

“ তুমি বোধহয় খেয়াল করোনি যে তোমার পিঠময় শাড়ি জড়াও নি সুহাসিনী। ”

কথাটা বলেই সুহাকে কোলে তুলে স্বচ্ছ।আর তখনই কোনরকমে জড়িয়ে রাখা শাড়িটা গড়িয়ে পড়ল ফ্লোরে। মুহুর্তেই ব্লাউজের নিচাংশে দৃশ্যমান হলো সুহার ফর্সা পেট৷ স্বচ্ছ হাসে সেদিকে তাকিয়ে। কিছু বলতে নিতেই সুহা দ্রুত হাত রাখে স্বচ্ছর চোখে। বলে,

“এবার কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে স্বচ্ছ। চেঞ্জ করতে বলেছেন করতেই নিচ্ছি.. ”

স্বচ্ছ ঠোঁট চেপে হাসে। কিছুই বলে না। ওভাবেই সুহাকে বিছানায় নিয়ে গিয়ে শোয়াল। নিজেও কিছুটা ঝুঁকে গিয়ে সুহার কানের কাছে চুলগুলো ফুঁ দিতেই সুহা বলে,

“ কি করছেন? ”

স্বচ্ছ ঠোঁট ছোঁয়ায় সুহার গালে। কানের কাছে কেমন করা স্বরে বলে,

“ নিজেকে সামলানো কঠিন ঠেকছে আজকাল। কি করা উচিত আমার? সামলানো নিজেকে?নাকি যা মন চাচ্ছে তাই করা? ”

স্বরটা কেমন ঠেকে। কন্ঠটা অন্যদিনের তুলনায় ভিন্ন। সুহা লোমকূপ অব্দি শিহরিত হয়। কিছুটা কম্পিত স্বরে শুধায়,

“ হ্ হু?”

স্বচ্ছ এবারে গভীর দৃষ্টিতেই তাকায়। বলে,

“ তোমাকে প্রয়োজন সুহাসিনী। ”

এবারে সুহার কথা আসতে চাইল না। বুকের ভেতর তীব্র কম্পন। সব ঝগড়ক, কঠিন স্বর তখন মিইয়ে গেছে। বহু কষ্টে তবুও শুধাল,

“ ক্ কি?”

স্বচ্ছ মুহুর্তেই মুখ ডুবায় সুহার গলার দিকে। নিজের ঠোঁটের এবং খোঁচা দাঁড়ির স্পর্শ সুহার গলার দিকে জানান দিতে দিতে শুধায়,

“ তোমার মাঝে হারাতে….”

ঠিক তখনই বাইরে থেকে স্বচ্ছর মায়ের ডাক শোনা গেল,

“ সুহা!”

সুহা চোখ গোল গোল করে তাকায়। সচেতন স্বরে বলে উঠে,

“ আম্মু ডাকছে। ”

স্বচ্ছর নড়চড়ে নাম নেই৷ সেভাবেই মুখ ডুবিয়ে আছে সুহার গলায়। নিজের মনোযোগ থেকে এইটুকুও নারসরে বরং বলে,

“ আম্মু জানে তার পুত্রবধূ এখন ব্যস্ত থাকবে৷ ”

সুহার তখন মরন দশা যেন। চোখ বুঝে আছে। পুরুষালি অধরের স্পর্শে অজানা অনুভূতির যোগান। তবুও রোধ হওয়া কন্ঠস্বরে জানায়,

“ ছে্ ছেড়ে দিন.. ”

স্বচ্ছ মুখ তুলে তাকায়। ঠোট কাঁমড়ে বলে,

“ ছেড়ে দিব?”

সুহা ঘনঘন শ্বাস ফেলছে৷ অস্থির ঠেকছে তার। বলল,

“বাইরে যাব আমি।”

স্বচ্ছ বাঁকা হাসে। বলে,

“ আমায় এভাবে সিডিউসড করে যাব আমি বলাটা মানাচ্ছে সুহাসিনী?”

কথাটা বলেই স্বচ্ছ ফের ঠোঁট ছোঁয়াল সুহার গলায়।দুয়েকটা চুম্বন এঁকে শক্তপোক্ত এক কাঁমড় বসাতেই ওপাশ থেকে দরজার আওয়াজ আসল। শোনা গেল,

“ ভাইয়া? ”

স্বচ্ছর মেজাজ খারাপ লাগে। ওভাবে থেকেই বলে,

“ কি? ”

“ ভাবির বান্ধবীরা এল তো। ছুটি আপুর বাসায় যাবে না? ঐ কারণে আম্মু বলল ডেকে দিতে… ”

স্বচ্ছ বিড়বিড় স্বরে শুধায় এবারে,

“ খালি ডিস্টার্ব!”

কথাটা বলেই ভদ্রবাচ্চার মতো উঠে দাঁড়াল সে। দরজা খুলে নিয়ে সিয়াকে দেখে যেতে যেতে বলল,

“ তোর ভাবী আসছে, যা।”

সিয়া তবুও গেল না। যেন খবরটা তার ভাবিকে দেওয়া লাগবেই লাগবে। পা বাড়িয়ে রুমে আসতেই দেখা গেল সুহা শাড়ি পরার চেষ্টা চালাচ্ছে। সিয়া মিনমিনে স্বরে জানায়,

“ ভাবি? তুমি শাড়ি পরছো? ”

সুহা কোনকিছু না করেও চোরের মতো থাকল। লজ্জায় গাল লাল হয়ে আসছে অকারণেই। এই যে সিয়াকে দেখল এখনও মনে হচ্ছে সে ধরা পড়ে গিয়েছে। সাক্ষাৎ চোর যেন সে। সুহা কাঁপা স্বরে বলল,

“ হ্ হু?শাড়ি পরতে পারছিলাম না আসলে তাই। ”

সিয়া মেনে নিল। পরমুহুর্তেই বোম ফাটানোর ন্যায় বলে উঠল,

” তোমার গলায় লাল… ”

সিয়ার পুরো কথাটা শেষ হওয়া লাগল না৷ তার আগেই সুহা সেখানটা হাত চেপে ধরল যেখানটা স্বচ্ছ কামঁড় বসিয়েছে। দ্রুত তোতলানো স্বরে বলে উঠল,

” ক্ কি?কই?কিছু না,কিছু না। পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছি। ”

স্বচ্ছ তখন রুমে আসছিল ফের৷ সুহার মিথ্যে রূপী বোকা বোকা কথা শুনে তার পেট ফেঁটে হাসি ফেল যেন। সিয়া ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে তখনও। পড়ে গিয়ে কেউ গলায় ব্যাথা পায়?গলায় লাল দাগ হয়?সিয়া অবাক হয়ে বলে,

“ পড়ে গিয়ে গলায় ব্যাথা পেয়েছো ভাবি?অদ্ভুত!”

স্বচ্ছ হাসিতে ফেটে পড়ার অবস্থা। তবুও বহু কষ্টে হাসি চাপিয়ে সিয়াকে শুধাল,

“ না না! তোর ভাবির এলার্জির প্রবলেম তো তাই এমন হয়েছে। ”

#চলবে…

#প্রেমের_সমর
#পর্ব_৩৮
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি

অন্যসব প্রভাতের থেকে আজকের সকালটা ছুটির কাছে ভিন্ন। সম্পূর্ণই আলাদা৷ আশপাশের আলোয় তখন আবিরের মুখটা দৃশ্যমান। ছুটির অবস্থান হয়েছে আবিরের বাহুবন্ধনীতে। মাথা গিয়ে ঠেকেছে পুরুষালি বক্ষে। ছুটি নড়চড় করে না। ঘুম ভেঙ্গে চোখজোড়া মেলেই যখন এই সুপুুরুষের মুখখানা চোখ ভাসল তখনই স্তব্ধ হয় চেয়ে থাকল। সুন্দর! নিঃসন্দেহে তার চোখে এই পুরুষটিই পৃথিবীর সর্বোত্তম সুন্দর পুরুষ! ছুটি ফ্যালফ্যাল করেই চেয়ে থাকে। অল্প নড়চড় করে ওপাশ ফিরতে নিতেই আবির তার হাতের বন্ধন আরেকটু দৃঢ় করল। ঘুম জড়ানো স্বরে শুধায়,

“ সমস্যা কি? এমন করছিন কেন? ”

ঘুমজড়ানো স্বরটায় অদ্ভুত মাদকতা! ছুটি শুনে তাকায়। আবির তখনো চোখ বুঝে আছে। কোনরকমে জড়তা নিয়ে উত্তর করে,

“ দেরি হয়ে যাচ্ছে, উঠব। ”

আবির মুহুর্তেই নাকোচ করল কথাটার অর্থ। সেভাবেই দুই হাতে মেয়েটাকে জড়িয়ে নিয়ে শুধায়,

“ এখন না। ”

ছুটি চুপ থাকে এবারে। পরমুহুর্তেই ঘড়ির দিকে চেয়ে বুঝে সময়টা বহু পেরিয়েছেে।বেলা এগারোটা প্রায়! ছিঃ! মানুষজন কি ভাবছে তাকে নিয়ে? ছটি এই পর্যায়ে ফের বলে,

“ সকাল অনেক হয়েছে। এগারোটা বাঁজল আবির ভাই।”

আবির চোখ মেলে বিরক্তে কপাল কুঁচকায়।কিছুটা উপর হয়ে শুয়ে ছুটির এক হাত চেপে রাখে বিছানার সাথে। শুধায়,

“বাঁজলে বাজুক,আমার ঘুম শেষ হয়নি আপাতত। সুতারাং তোর কাজ হলো চুপচাপ এভাবেই আরো কিছুক্ষন আমার সাথে এভাবে পড়ে থাকা। ”

ছুটি ফের বলল,

“ আপনি ঘুমালেই তো হলো আবির ভাই,আমায় ছেড়ে দিন। ”

আবির হাসে এই পর্যায়ে। ছুটির গালে হাত রেখে পরমুহুর্তেি ঠোঁট ছোঁয়ায় মেয়েটার কপালে। একটা গভীর চুম্বন এঁকে শান্ত স্বরে ফিসফিস করে শুধায়,

“ না, হলো না। তোকে বিয়ে করার চক্করে কালকের দিনটা সারাদিন ঝামেলা সয়ে গিয়েছি। এর আগেরদিন ও ঘুম হয়নি তোর কান্ডকারখানা শুনে। সুতারাং এই মুহুর্তে শান্তিতে ঘুমানোটা জরুরী৷বুঝলি? ”

ছুটি ফ্যালফ্যাল করে শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। কখনো কখনো মনে হয় আবির ভাই তাকে সত্যিই ভালোবাসে।সত্যিই মন থেকে চায়। কখনো মনে হয় সবই মিথ্যে। নাটকীয়তাই কেবল। এইযে এখন কপালে চুম্বন আঁকল, শান্তস্বরে এতগুলো কথা বলল ছুটির মনে হলো এই মানুষটা সত্যিই তাকে চায়। সত্যিই ভালোবাসে। আবির ছুটির তাকানো দেখে অল্প হাসে। পরক্ষণেই ফের সন্দেহী স্বরে বলে,

“ তোর এত শান্তরূপও হজম হচ্ছে না আমার। আগের মতো মনে মনে কিছু প্ল্যান করে ফেলছিস না তো? সত্যি করে বল। ”

ছুটি তাকিয়ে থাকে। কিয়ৎক্ষন সময় নিয়ে শুধায়

“ আমার কাছে এই সংসারটা ভিত্তিহীন লাগছে আবির ভাই। অথচ এক সময় আমি এই সংসারটা কত করে চেয়েছিলাম৷ কত আশা ছিল আমার এই একটা সংসার নিয়ে।”

আবিরের সুন্দর, মধুর মেজাজটাকে বিগড়ে দেওয়ার জন্য বোধহয় এই দুটো লাইনই যথেষ্ট ছিল। দাঁতে দাঁত চাপে সে। রাগে শরীর চিড়বিড় করলেও অত্যন্ত শান্ত দেখাল তাকে। একহাতে ছুটির থুতনিটা তুলে ধরল। শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে শুধায়,

“ এখন নেই? ”

“ এখন আর আপনার জন্য পাগলামি আসে না আমার। ”

“ ভালোবাসা মরে গেছে? ”

ছুটি সময় নিয়ে ঠোঁট এলিয়ে হেসে বলে,

“ ভালোবাসা মরেনি তবে ভালোবাসা প্রকাশ করতে আজকাল আমি খুবই ব্যর্থ! বিশেষ করে আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি না আর। ”

আবির দীর্ঘশ্বাস টানে। বুকের ভেতর কোথাও এই কথাগুলো রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে। বোধহয় যন্ত্রনা হচ্ছে তার। তবুও শান্ত স্বরে শুধায়,

“ কারণ? ”

ছুটি তাচ্ছিল্য হেসে বলে,

“ আমি আপনার প্রতি দুর্বল। আর সে দুর্বলতা যে আপনি কাজে লাগাচ্ছেন না তার কোন নিশ্চায়তা আমার কাছে নেই৷ ”

আবিরের রাগটা এবারে প্রকাশ্যে এল। মুখ চোখ লাল দেখাল। চোয়াল শক্ত করে শুধাল,

“ তো এই কারণে শান্তশিষ্ট মনোভাব দেখিয়ে মনে মনে প্ল্যান করছিস যে আমায় ছেড়ে চলে যাবি? খবদ্দার ছুটি, ছেগে যাওয়ার কথা ভেবেছিসও যদি মেরে হাত পা ভেঙ্গে বন্দি করে রাখব। মাইন্ড ইট। ”

ছুটি ভয় পায় না। বরং নির্নিমেষ চেয়ে থেকে বলে,

“ কেন জানি না কখনো মনে হয় আপনি আমায় ভালোবাসেন, আবার কখনো মনে হয় সবটাই মিথ্যে।”

আবিরের নিজের মাথা নিজেই ফাটাতে ইচ্ছে হয়। এত কেন অবিশ্বাস? কেন ছুটি বুঝে না তাকে? এতোটাই অবুঝ মেয়েটা?আবির ছোটশ্বাস টানে। বলে,

“ মিথ্যে মনে হওয়ার পিছনে কোন যুক্তিযুক্ত কারণ বল। সময় এক মিনিট। ”

ছুটি বলে,

“ অবহেলা! ”

“ আর? ”

“ মুখ চোখের সেই বিরক্তি আপনার। ”

“ আর? ”

“ গুরুত্বহীনভাবে পড়ে ছিলাম মাসের পর মাস, বছরের পর বছর!”

“ তারপর?

ছুটি এই পর্যায়ে চুপ থাকে। আবির লাল রক্তিম চোখ নিয়ে তাকাতেই ফের বলে উঠ,

“ আপনি যে আমার অনুভূতি নিয়ে খেলছিলেন, স্বার্থ পূরণ করছিলেন তা নিজ কানেই শুনেছিলাম আমি ।”

আবিরের কপালের ভাজ মিলে। গলা দৃঢ় করে বলে উঠে,

“ আমার মুখ থেকে? ”

“ ঠিক তা নয়, তবে আপনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন আবির ভাই। ”

“ নিশ্চয় আমার বন্ধুদের মুখ থেকে শুনেছিলি?

ছুটি শুধায়,

” সত্যিই তো ছিল। ”

আবির দাঁতে দাঁত চাপে। অত্যন্ত বিরক্ত দেখাল যেন তাকে। বলল,

“ সত্য মিথ্যা আমার উপর ছেড়ে দে বরং?”

.

সুহা তখন বিছানায় বসা। স্বচ্ছর কান্ডকারখানায় আর যাওয়া হয়ে উঠেনি ছুটিদের বাসায়। অথচ ছুটির সাখে কথা বলার সুহার প্রবল ইচ্ছা! এই যে এতকিছু হয় গেল, লুকিয়ে গেল তা জানার আগ্রহ। সুহা ছোটশ্বাস টানে। পাশে থাকা চায়ের কাপটা নিয়ে চুমুক বসাতেই ছুটে এল সিয়া। শুধাল,

“ ভাবি,ভাবি আগামী সপ্তাহে তোমার আর ভাইয়ার বিয়ের অনুষ্ঠান আব্বু বলল। তুমি খুশি? ”

সুহা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। কি বলবে বুঝে উঠে না। একবার বিয়ের অনুভূতি ছিল প্রখর। খুশি ছিল সে ভালোবাসার সঙ্গীকে পাবে বলে। কিন্তু শেষমেষ সব আনন্দ মাচি করে দিয়ে সে চলে গেল নিজের মতোই করে৷ সুহা ছোটশ্বাস ফেলে। যদিও এবারের অনুভূতিটাও রঙ্গিন স্বপ্নের ন্যায়। এবারের অনুভুতিটাও উচ্ছল!শুধায়,

“ তোমার ভাইয়া জানে? ”

সিয়া মুহুর্তেই উত্তর করে,

“ ভাইয়াই তো আব্বুকে বলল আয়োজন করতে। ”

সুহা কেঁশে উঠে। কেউ নিজের বিয়ের কথা নিজে বলে? তাও বাবাকে? সুহা অজান্তেই লজ্জ্বা পায়। বলে,

“ বাসায় দেখলাম না তো তাই। ”

সিয়া মুহুর্তেই শুধায়,

“ তুমি কি লজ্জ্বা পাচ্ছো? ”

সুহা মুহুর্তে উত্তর করে,

” একদম নয়। বিয়ে তো স্বাভাবিক বিষয়ই। ”

সিয়া উচ্ছাস নিয়ে বলে,

“ আমি অনেক খুশি ভাবি। বহুদিন পরে গিয়ে আনন্দ করব খুব। ”

.

সিয়ার থেকে কথাটা শোনার পরপরই সুহার দাদাজান এই বাসায় এলেন। বহুটা সময় স্বচ্ছর বাবার সাথে আলোচনা করে অবশেষে সুহাকে বললেন ব্যাগ গোঁছাতে।কারণ বিয়েটা ওখান থেকেই হবে৷ সুহাও বাধ্য মেয়ের মতো ব্যাগ গোঁছাতে গেল। রুমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ব্যাগ গোছাতে নিতেই কোথা থেকে ছুটে এল স্বচ্ছ৷ সুহাকে জামাকাপড় ব্যাগে নিতে দেখে মুহুর্তেই হাত টেনে ধরে সে। বলে,

“ এসব কি সুহাসিনী? নিষ্ঠুর বউদের মতো কেবল নিজের কথাই ভাবছো? স্বার্থপরতা হয়ে যাচ্ছে না?”

“ হ্ হু?”

স্বচ্ছ চোয়াল শক্ত করে। শুধায়,

“ ব্যাগপত্র গুঁছিয়ে নিচ্ছো কেন শুনি? ”

সরল উত্তর,

“ দাদাজান বলল। ”

স্বচ্ছ দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে,

“ তোমার দাদাজান তো দ্বান্ধাবাজ লোক।যেই দেখল বিয়েতে কোন বাঁধা দিতে পারছে না ওমনিই আমাকে বউ থেকে দূরে সরানো প্ল্যান কষেছে। ”

সুহার হাসি পায় এবারে। বলে,

“ ইচ্ছে হলে আপনিও যেতে পারেন স্বচ্ছ। যাবেন?”

স্বচ্ছ রাজি হলো না। বরং বলে উঠে,

“ তোমার যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ”

“ পাগলামো করছেন।”

স্বচ্ছ কেমন নজরে তাকায়। শুধ্য়,

“ অভ্যেস হয়ে গিয়েছে তোমার সঙ্গে থাকা। ”

” বাচ্চা নন আপনি। ”

স্বচ্ছ বাঁকা হাসে। সুহার ধরে রাখা হাতটা টেনে নিয়ে একদম কাছে আনল সুহাকে। বলে,

“ প্রেমিক তো! ”

কথাটা বলেই ফু দিয়ে উড়াল সুহার কপালের উপর চুলগুলো। ঝুঁকে গিয়ে বলে উঠল,

“ এসব পাগলামো খুব কম ঠেকছে সুহাসিনী৷ আরেকটু বেশি পাগলামি দেখার জন্য নিজেকে তৈরি করুন। কেমন? ”

বাঁকা হেসে কথাটা বলেই স্বচ্ছ ফের রুম ছেড়ে বেরিয়ে এসে বসে সুহার দাদাজানের মুখোমুখি। শার্টের হাতা ভাজ করতে করতে গম্ভীর গলায় বলে,

“ আমার বউ,আমি বিয়ে করব। আপনি আচমকা বউ নিয়ে যেতে এসেছেন কেন দাদাজান? বলেছি আমি? ”

দাদাজান তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকিয়ে বলে,

“ অনুষ্ঠান ও বাড়িতেই হবে। এই কারণেই। ”

স্বচ্ছ দ্বিগুণ তীক্ষ্ণ স্বরে উত্তর দিল,

“কিন্তু আমি আমার বউকে দিব না। ”

মুহুর্তেই দাদাজান বলে,

“বেহায়াপনা করছো। ”

স্বচ্ছ হেসে বলে,

“ আপনার বউকেও কেড়ে নিয়ে আসি?তারপর দেখি বেহায়াপনা আপনিও করেন কিনা! ”

দাদাজান রেগে তাকায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“ বেয়াদব ছোঁকরা।”

#চলবে…