অপরাজিতা পর্ব-০১

0
241

#অপরাজিতা
#শারমিন_প্রিয়া
#পর্ব_এক

বিয়ের তিন মাস পর আমার স্বামী নিশান আমাকে রেখে ইতালি চলে গিয়েছিল। দীর্ঘ আট মাস পরে আজ দেশে ফিরছে সে। বছরের পর বছর দেশে আসা ওর কাছে স্বাভাবিক বিষয়। তবে এবার সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছে—আমি, আর আমাদের অনাগত সন্তান, একসাথে তিনজন পাড়ি দেব ইতালিতে।

বাচ্চা এখনো হয়নি, মাতৃ*গ*র্ভে আছে। আমি আট মাসের প্রেগ*ন্যা*ন্ট । সামনের মাসেই ডেলিভারির তারিখ। ডাক্তার সম্পূর্ণ বেড রেস্ট দিয়েছেন বলে এখন বাপের বাড়িতে আছি। তাছাড়া নতুন বিয়ে, স্বামী বিদেশে, নতুন অবস্থায় তাকে ছাড়া শ্বশুরবাড়িতে থাকাটা খালি খালি লাগে। তাই বাবার বাড়িতে থাকাটাই স্বস্তিদায়ক মনে হয়েছে।

তার আসার খবর শুনে গতকালই শ্বশুরবাড়ি যেতে চেয়েছিলাম। সে বাধা দিলো। বলল, “রিস্ক নেওয়ার কি দরকার? শুধু এক রাত বাড়িতে কাটাবো, তারপরেই তোমার কাছে চলে আসব। ওখানেই বেশি সময় থাকব।”

সে যতই বলুক, আমার এই ছটফটানিটা সে টের পাচ্ছে না। শুধু আমি জানি, আমার ভেতরে কি চলছে। আমি এক রাতও অপেক্ষা করতে পারছি না। তাকে কাছে পেতে চাই, জড়িয়ে ধরতে চাই। সে আমার শহরেই আছে অথচ আমার পাশে নেই—এই ভাবনায় মনটা আরও ধুকপুক করতে লাগলো।

চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। না, চোখ বন্ধ করলেও চোখের সামনে ভেসে উঠছে ওর সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো। প্রথম কাছে আসা, শরীর কাঁপা, স্পর্শ করা, হাত ধরা—আর কত কী! আপনাআপনি লজ্জায় মুখে এক চিলতে হাসি ফুটল। মিটিমিটি হাসতে লাগলাম।

ভিডিও কল করলাম তাকে। বললাম, “আর সহ্য হচ্ছে না আমার, পাখি হয়ে উড়ে এসো জান।’”

সে হেসে বলল, ‘”পা*গ*লী আমার! একটু অপেক্ষা করো, সকালটা হোক। দেখবে আমি তোমার কাছে চলে আসছি। খুব টায়ার্ড আমি। এখন একটু ঘুমুতে দাও, প্লিজ।”

ছাড়তে মন চাচ্ছিল না তাকে, তবু কল কাটলাম। সত্যিই তো, বেচারা অনেক ক্লান্ত। একটু ঘুমিয়ে নিক।

তখনি পেটের মধ্যে পুঁচকেটা মোচড় দিয়ে উঠলো। ওকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে বিড়বিড় করে বললাম, “জানো সোনা, তোমার আব্বু আসছে। কাল প্রথমবার তোমাকে ছুঁয়ে দেখবে! তুমি টের পাবে তো? চিনতে পারবে তো বাবার স্পর্শ? জানো? তোমার আগমনের খবর পেয়ে সবচেয়ে খুশি হয়েছিল তোমার পাপা….!রাজপুত্রের সঙ্গে মনে মনে কথা বলতে বলতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম, টেরই পাইনি।

সকালে বড় ভাবির ডাকে ঘুম ভাঙলো। ঘড়ির কাঁটায় তাকিয়ে দেখি সকাল সাতটা বাজে। ভাবি বললেন, “ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নাও সুমাইয়া।”
তারপর মিটিমিটি হেসে বললেন,
“আজ একটু পরিপাটি হয়ে থেকো, কেমন? কতদিন পর দুজনার দেখা হবে!”

ভাবির কথায় লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম।

ভাবি চলে গেলেন। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হলাম। রুমে ফিরে হাতে ভর দিয়ে চেয়ারে বসলাম। শরীর এত ভারি হয়েছে যে হাঁটাচলা, বসা-উঠা—সবই কষ্টকর হয়ে দাড়িয়েছে।

মা বিভিন্ন রকম ফল নিয়ে এসে আমার পাশে বসলেন। খেতে খেতে অনেক গল্প করলাম।

ঘরে সুস্বাদু খাবারের রান্না চলছে। ঘ্রাণে বাড়িটা মইমই করছে। বড় ভাই বাজার থেকে বড় রুই মাছ, গলদা চিংড়ি, গরুর মাংস—আরও কত কি এনেছেন! বাড়ির জামাই আসছে বলে কথা! কোনো দিক দিয়েই কোনো ত্রুটি নেই।

আমার তো কোনো কাজ নেই। বসে বসে ফোন টিপছি আর ওর কথা ভাবছি। সকাল থেকে বহুবার ফোন চেক করেছি, অথচ ওর কোনো কল পেলাম না। মন খারাপ করিনি। অনেকদিন পর বাড়ি এসেছে, কত লোক দেখতে আসছে— হয়তো আলাপে ব্যস্ত। এই ভেবে আমিও আর কল করিনি।

১১টার দিকে ভাবি হালকা গরম পানি দিয়ে দিলেন। গোসল করে কমফোর্টেবল একটা প্রে*গন্যা*ন্সি ফ্রক পরলাম। মুখে হালকা ফেস পাউডার, চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে লিপস্টিক দিলাম। আয়নায় নিজেকে দেখলাম, মাশাআল্লাহ লাগছে আমাকে।

দুপুর ১২টা বাজে। নিশানের এখানে এসে লাঞ্চ করার কথা। আমার বাড়ি থেকে তার বাড়ির দূরত্ব ৩ ঘন্টা। এখন নিশ্চয়ই সে গাড়িতে। কল করলাম, কয়েকবার রিং হওয়ার পরেও রিসিভ হলো না। শাশুড়ী মায়ের কাছে কল করে জানলাম, সে এগারোটায় বাড়ি থেকে বের হয়েছে আমাদের বাড়ি আসার জন্য। তার অপেক্ষা করতে লাগলাম আমিসহ ঘরের সবাই। অপেক্ষা করতে করতে ২টা পার হয়ে গেল, নিশান এখনও আসেনি। কল করছে একাধারে সবাই, কিন্তু সুইচ অফ। আমার মুখ নিভে গেল। দুনিয়ায় যত রকমের বিপদ আপদ আছে, সব একে একে মনে পড়তে লাগল। আমার বেহাল অবস্থা দেখে মা আমাকে ধরে বসালেন। বুঝালেন, রাস্তাঘাটে কত ঝামেলা হয়, জ্যাম থাকে, সময়ও যায় মাঝেমধ্যে। টেনশনের কিছু নাই। তোর শাশুড়ী তো বলেছে, চলে আসবে, দেখিস।

না, মায়ের কথা ঠিক হয়নি। সন্ধ্যা পেরিয়ে এশার সময় হতে গেল, তার খোঁজ নেই এখনও। শশুড়বাড়ি আর আমার বাড়ির সবাই যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে, কিন্তু কেউ পারছে না। অবশেষে আমার দুই ভাই থানায় গেলেন। আমার দেবর, শশুড়সহ ওখানের অনেক লোক সবাই এক হয়ে সবাই মিলে থানায় জিডি করলেন। আমার আপন চাচা সেনাবাহিনীর উচ্চপদে আছেন, তিনি তার পরিচিত পু*লি*শ অফিসারদের দিয়ে শহরের বিভিন্ন জায়গায় চেকপোস্ট বসিয়েছেন।

আমি নামাজ পড়লাম, জায়নামাজে বসে কাঁদতেই আছি। কেঁদে কেঁদে দোয়া করছি, “আল্লাহ, আমার স্বামীকে সকল ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা করো। সে যেখানেই থাক, তাকে সুস্থভাবে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও।” এমনিতে প্রে*গ*ন্যা*ন্ট, তার ওপর মনের মধ্যে যে কী যাচ্ছে, তা বলার মতো নয়। সবাই ঘিরে বসে, পজিটিভ বুঝাচ্ছে আমাকে। টেনশন না করতে বলছে, কারণ বেশি টেনশন করলে বাচ্চার ক্ষতি হবে। আমি চাচ্ছি কান্না যেন থামে, তবুও চোখের পানি অনবরত পড়তেই আছে। কাঁদতে কাঁদতে একদম নেতিয়ে পড়েছি। প্রেশার হাই হয়ে গেছে। ডাক্তারকে কল করে নিয়ে আসছিল ভাবি। ডাক্তার ঔষধ দিয়েছে, ঘুমাতে বলেছে। কিন্তু আমি সন্ধ্যা থেকে না ঘুমিয়ে আছি। ঘুম না আসলে জোর করে তো ঘুমাতে পারব না। আমার স্বামী হুট করে উধাও, এতকিছুর মাঝে ঘুম পালিয়ে যাওয়ারই কথা।

অপেক্ষা করতে করতে সময় যেতে থাকে। ভাইয়েরা এখনও কেউ বাড়ি ফেরেনি। এদিকে ভোর চারটা বাজে। মা সজাগ ছিলেন এতক্ষণ, একটু আগে উনার চোখ লেগে গেছে।। ছোট বোনও পাশে ঘুমাচ্ছে। শুধু ভাবি সজাগ। চুপচাপ শুয়ে আছেন। ভাবিকে বললাম,

“আরেকবার কল দাও, ভাবি। দেখো ভাইয়া কী বলেন। কোন খবর পাওয়া গেলো নাকি!”

ভাবি কল করলেন, ভাইয়া কী বলছে জানিনা, ভাবি উঠে বাহিরে গেলেন। ভাবির চলে যাওয়া দেখে আমার মনে কু ডাকছে। সন্দেহ লাগছে। আমি ধীরে ধীরে খাট থেকে নামলাম। দরজার পাশে পর্দার আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভাবি কথা বলছেন আস্তে আস্তে। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। তখনই প্রস্রাবের বেগ পেল প্রচুর। ওয়াশরুমে ঢুকলাম।

তখনি মা ডাকলেন, “সুমাইয়া, তুই কই?”

জবাব দিলাম, “মা, আমি ওয়াশরুমে আছি।”

মিনিট দুয়েক পর বের হয়ে দেখি মা রুমে নেই। বারান্দায় বের হলাম। দেখি, ভাবি আর মা অন্যরুমে ফিসফিস করে কথা বলছেন। তাদের এইসব লুকোচুরি দেখেই আমার ভয় বাড়ছে। কী এমন কথা তারা এরকম আমাকে এড়িয়ে গিয়ে বলছে? শুনতেই হবে আমার। আমি চুপ পায়ে হেঁটে পর্দার আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালাম। স্পষ্ট শুনতে পেলাম, ভাবি বলছে, “সুমাইয়ার এই অবস্থা, যদি সে শুনে, নিশান তাকে ঠকিয়ে অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেছে, তার অবস্থা কী হবে মা, বুজতে পারছেন?”

কথাটা শুনে আমার শরীর ভূমিকম্পের মতো এক ঝাঁকুনিতে কেঁপে উঠল। আমি টের পেলাম, পুরো বাড়ি যেন আমার চারপাশে ঘুরছে। সবকিছু অন্ধকার লাগছে। নিজেকে আর স্থির রাখতে পারিনি। আল্লাহ গো! বলে মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম সেই জায়গায়।

চলবে।