অপরাজিতা পর্ব-০৭

0
1

#অপরাজিতা
#শারমিন_প্রিয়া
#পর্ব_সাত

রাত গভীর হলো। নদীর বয়ে যাওয়া ঢেউয়ের উপচে পড়া শব্দ কানে বাজতে লাগল, নির্জন বাতাস হুহু করে ঢুকে যখন আমাকে ছুঁইয়ে দিলো। আমার মন তখন অস্থিরতায় ডুবে গেল। নতুন জায়গা, নতুন সবকিছু, আমার আশেপাশে আমার আপন কেউ নাই। গহীন জঙ্গলের মধ্যে মনে হলো আমি একাকী আছি। সব থেকেও আমার কেউ নাই। আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। হু হু করে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলাম। মনে হচ্ছিল, যত কাঁদতে পারবো, ততই আমার শান্তি।

আমার কান্না বোধহয় মাদাম শুনেছেন। তিনি এসে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হলো? তুমি কাঁদছো কেন এত রাতে?”
কোনো উত্তর দিতে পারিনি আমি, কান্নার গতি আরও বাড়লো। মাদাম এবার আমার কাছে বসে শান্তনা দিতে লাগলেন, “সোনা বাচ্চা কাঁদে না। বলো, কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে? মা-বাবাকে মিস করছো?”
মাথা নাড়ালাম, না।
“তাহলে বলো কি হয়েছে,” বলে তিনি আমার চোখের জল মুছে দিতে লাগলেন। আমি উনাকে আচমকা জড়িয়ে ধরলাম। দু’হাত দিয়ে মাদামও আমায় আগলে নিলেন। পিঠ চাপড়ে বললেন, “কেঁদো না আর। কান্নার কারণ আমাকে বলতে পারো।”

আমি চোখ মুছে নড়ে চড়ে উঠলাম। মাদামকে নিয়ে দরজা খুলে বাইরে বসলাম। নদীর তীর থেকে ঠান্ডা বাতাস হু হু শব্দে আসছিল। স্কার্ফ দিয়ে দু’জনে ভালো করে মাথা ঢেকে নিলাম। মাদামকে বড় আপন আপন লাগছে। কেমন যেন ভরসা খুঁজে পাচ্ছি উনার মধ্যে। আমি নির্দ্বিধায় উনাকে সব বললাম। আমার সাথে ঘটে যাওয়া সব। সব শুনে উনি গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। ভয় লাগতে লাগলো আমার। সব সত্যি জানার পর উনি হয়তো বের করে দেবেন আমায়। কিন্তু এমনটা হয়নি। উনি আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার হাত ধরে বললেন, “যা হবার হয়েছে, সব ভুলে যাও। মুছে দাও মন থেকে। নতুন করে সব শুরু করার ইচ্ছে যখন করেছো, তাহলে তুমি পারবে। যে ইচ্ছে করে সামনে আগায়, সেই পারে। তুমি আমার বাসায় যতদিন ইচ্ছে থাকতে পারো। আরেকটা কথা, তোমার যদি খুব একা লাগে, তুমি আমাকে মা বলে ডাকতে পারো। মায়ের চোখে দেখতে পারো।”

আবেগে আপ্লুত হয়ে গেছি আমি মাদামের কথায়। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল। আমি খুশিতে উনার হাত আঁকড়ে ধরে চুমু খেলাম। এই অসম্ভব সুন্দর পরিবেশ ছেড়ে ঘরে আর যেতে ইচ্ছে করলো না আমার। বাকি রাত আমরা নানারকম গল্প করে সেই জায়গায় কাটিয়ে দিলাম।

সকালে উঠে জবের খোঁজে বের হলাম। কফিশপ, বুকশপ_ এইসব জব আমার কাছে কমফোর্টেবল মনে হয়। তাই এরকম কয়েকটায় সিভি জমা দিলাম। দুইদিন অপেক্ষা করার পর একটা কফিশপে চাকরি হয়ে গেলো। মাদামও খুশি। সকালে উঠে নাস্তা বানানোর আগে দেখি মাদাম আমার জন্য নাস্তা নিয়ে হাজির। সবসময় তিনি ওমন করেন। “এমন করো কেন,” বললে তিনি অভিমানী মুখ নিয়ে বলেন, “আমাকে মা মানিস তো? মায়েরা তো এমনি হয়।”
আমিও মাঝেমাঝে রাতের বেলা বাঙালি খাবার রান্না করি। মাদাম টুকটাক খান, বলেন, ভালো লাগছে।

শপ থেকে বিকেলে ফেরার সময় দেখি রোন নদীর পাশে অনেক পর্যটক। গোধূলি, নীরব হাওয়া, শান্ত পরিবেশ — এসব কিছু একবার চক্ষুগোচর করে আমিও আর লোভ সামলাতে পারিনি। ঘাসের উপর রাখা একটা কাঠের বেঞ্চে গিয়ে বসে পড়ি। পর্যটক অনেক। তারা গল্প করছে, কথা বলছে, আড্ডা দিচ্ছে, ছবি তুলছে। আমার পরিচিত কেউ নেই এখানে। আমি চুপচাপ নদীর পানে চেয়ে রইলাম। আমার পুরনো সবকিছু একে একে মনে পড়তে লাগলো। যত বলি ভুলে যাব, তবুও মনে পড়ে। সবার কথা মনে পড়ে। তখন কলিজা কাঁদে।
এই মুহূর্তে সবার আগে আমার ছেলের কথা মনে পড়ছে। চোখ বন্ধ করলেই ছেলের কবরের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। কতদিন দাড়াইনি গিয়ে তার কবরপাড়ে।

মা, বাবা, ভাই, ভাবি — সবাইকে মিস করি আমি। তারা কি জানে, তাদের ছাড়া একেকটা দিন আমার নরক যন্ত্রণার সমান?
আর রোশান, যাকে ভালোবাসতাম, তার কথা আমি মাথা থেকে সরাতেই পারি না। বারবার মনে হয়, একবার তার সাথে কথা কই। মনে প্রশ্ন জাগে অনেক , সে কি আমায় মিস করে? নাকি বউয়ের তাবিজ করাতে আমাকে তার মনেই নেই!

তারা সবাই কি এটা ফিল করছে, একটা জলজ্যন্ত মানুষ সবার থেকে হারিয়ে গেলো?
খোঁজ করছে আমার? আমার জন্য একটুখানি কষ্ট হয় তাদের? হয়তো হয়, নয়তো হয় না। গভীর এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক থেকে।

*********

আজকের রাতটা অপূর্ব। চাঁদনী রাত। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। মনকাড়া ঠান্ডা বাতাস বইছে অবিরাম। আমি রুমের লাইট অফ করে জানালার গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলাম। চুলের বেণি খুলে দিলাম। খোলা চুলে বাতাসের ঝাপটায় চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, বিষয়টা বেশ ভালো লাগছে আমার। নদীর জলে চাঁদের আলো ঝিকিমিকি করছে, যেন সোনা ছড়িয়ে পড়েছে জলের বুকে। এই শান্ত সৌন্দর্য মন ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার। অনুভব করলাম, প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে সবসময় কারও সঙ্গে থাকা লাগে না। একাকীত্বও অনেক সময় ভয়ংকর সুন্দর জিনিস উপহার দেয়। কোনো প্যারা থাকে না, সমস্ত মনোযোগ থাকে প্রকৃতির সৌন্দর্যে।

বেখেয়ালি আমি হঠাৎ কিছুর একটা আওয়াজ পেলাম। স্থির হয়ে কান পাতলাম, আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে তা বোঝার চেষ্টা করলাম। গতকাল মাদামের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে এসেছে এই বাড়িতে। হয়তো সে ঘরে কিছু করছে। মন স্থির রাখতে পারলাম না। কিছু একটা অস্বাভাবিক মনে হলো। রুম থেকে বের হয়ে করিডোর পেরিয়ে মাদামের ছেলের রুমের কাছে গেলাম। দরজা খোলা অথচ ভেতরে কেউ নেই। ভেতরে ঢুকে বেলকনিতে গিয়ে দেখলাম, সেখানেও নেই।

করিডোর থেকে কারও পায়ের আওয়াজ পেয়ে চমকালাম। ভয়-ভয় মনে দ্রুত পায়ে বের হয়ে এলাম। লাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলাম মাদামের ছেলে আদ্রিয়ানকে। সে সোজা উপরে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। বিষয়টা ভালো লক্ষণ মনে হলো না। দ্রুত মাদামের দরজায় গিয়ে বারকয়েক ডাকলাম। কিন্তু মাদাম সম্ভবত গভীর ঘুমে, তাই শুনলেন না।

আমি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। কোথাও ছেলেটা নেই। চোখ গেল ছাদের দরজার দিকে। দরজা খোলা! আজব লাগলো, এত রাতে ছেলেটা ছাদে কি করছে? পরে মনে হলো, অনেকে রাতে ছাদে পায়চারি করতে ভালোবাসে। সেটাই হয়তো। তবুও কৌতূহল থামাতে পারলাম না। ধীর পায়ে ছাদে উঠলাম। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া গায়ে এসে লাগতেই মনে হলো, ওভারকোট ছাড়া এখানে আসা উচিত হয়নি। চোখ ফেরালাম চারপাশে। এক কোণায় আদ্রিয়ানকে দেখে আঁতকে উঠলাম।

সে ছাদের কার্নিশের একদম কাছে দাঁড়িয়ে। বুক কাঁপতে লাগলো আমার। মনে হলো, ছেলেটা কি আত্মহত্যা করতে চাইছে? ব্যস্ত পায়ে ছুটে গেলাম। ছেলেটা এক পা ছাদের বাইরে ফেলতেই ঝট করে ধরে ফেললাম তার হাত। ভার সামলাতে না পেরে দুজন একসঙ্গে ছাদের উপর পড়ে গেলাম। শ্বাস উঠানামা করতে লাগলো আমার। তবু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। যাক, মানুষটাকে অন্তত আত্মহত্যা করতে দেইনি।

আদ্রিয়ান অবাক চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তারপর প্রশ্ন করল ইংরেজিতে , “কে তুমি ? আমাকে মরতে দিলে না কেন?”

“পাগল হয়েছেন আপনি? মরে যাবেন কেন?”
তার কৈফিয়ত জানতে চাইতেই সে বলল, “তোমাকে কৈফিয়ত দেবো কেন? তুমি কে? আর এত রাতে এখানে কেন?”

আমি শান্ত গলায় বললাম, “আমি আপনাদের বাসায় থাকি। দিনে কফিশপে কাজ করি, তাই আপনার সাথে দেখা হয়নি। মাদামের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক আছে।”

সে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “ওহ। এবার যান নিজের ঘরে।”

“আপনাকে না নিয়ে যাব না।” বললাম আমি।

“আজব মেয়ে তো! যান বলছি,” ধমক দিল সে।

ধমক গায়ে মাখলাম না আমি। মনে মনে ভাবলাম, মানুষ যখন নিজের সাথে পেরে ওঠে না তখনই আত্মহত্যা করতে চায়। নিশ্চয়ই আদ্রিয়ানও এমন কোনো ভয়াবহ যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এখন যদি চলে যাই, অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে সে। শরীরের সব জোর দিয়ে শক্ত করে পেছন থেকে আদ্রিয়ানকে ধরে ফেললাম। একরকম জোর করেই তাকে নিচে নামিয়ে আনলাম। সে বিড়বিড় করে বলছিল, “পাগল পাগল।”

মাদামের দরজার সামনে এসে থামলাম। অবশেষে আমার ডাক মাদামের কর্ণগোচর হলো। তিনি দরজা খুললেন। আমি আদ্রিয়ানকে মাদামের সামনে ঠেলে দিলাম আর পুরো ঘটনা খুলে বললাম। সব শুনে মাদাম কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আদ্রিয়ান মাদামকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো। আমি চুপচাপ রুমে চলে এলাম। হিটার অন করে শুয়ে পড়তে যাচ্ছি, এমন সময় দরজায় টোকা পড়লো।

“কে?” জিজ্ঞেস করলাম।

বাইর থেকে উত্তর এলো, “আমি, আদ্রিয়ান। দরজা খুলবে?”

আমি উঠে দরজা খুললাম।
আদ্রিয়ান বলল, “তুমি আমার বন্ধু হবে?”

আচমকা এমন প্রস্তাবে আমি চমকালাম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, “হবো।”

“আমার সাথে বেলকনিতে গিয়ে বসবে একটু? কিছু শেয়ার করতে চাই তোমার সাথে।”

“ওকে।” বললাম। গায়ে ওভারকোট জড়িয়ে বের হলাম। পাশাপাশি দুটি চেয়ারে বসে পড়লাম আমরা।

আদ্রিয়ান সব খুলে বললো। প্রেমজনিত কষ্ট। প্রেমিকা ছেড়ে অন্য সম্পর্কে চলে গেছে। তাই সে আর বাঁচতে চায় না। আমার মনে হলো আমার সাথে ঘটে যাওয়া সব বলি তাকে।

আমি আমার জীবনের কষ্টের কথা বললাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, “আমার কষ্টের তুলনায় কি আপনার কষ্ট বেশি হয়ে গেল? আমি তো একবারও মরার কথা চিন্তা করিনি। বরং শান্তিতে বাঁচার জন্য কত লড়াই করছি।”

আমার কথায় সে ভরসা পেলো। বলল, “মন খারাপ হলেই তোমার সাথে কথা বলবো কেমন? অনেক হালকা লাগছে তোমার সাথে কথা বলে। তুমি অনেক জোস মেয়ে। এবার রুমে চলে যেতে পারো। আমিও ঘুমুব।”

চলমান……!