#অপরাজিতা
#শারমিন_প্রিয়া
#পর্ব_আট
#শেষ_পর্ব
মাদাম আর আদ্রিয়ানের সাথে আমার একটা ভালো সম্পর্ক হয়ে গেলো। খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এখন আমার সময় দিব্যি চলে যায়। অত একা আর লাগে না। তবু বাড়ির কথা খুব করে মনে পড়ে।
বলতে মনে নাই, গত সপ্তাহে পত্রিকায় হুট করে দেখি আমার ছবি! পত্রিকাটা মাত্র একজন শপে দিয়ে গিয়েছিল। রোজ পত্রিকায় চোখ বোলানো আমার অভ্যাস। তাতে একটু চোখ বুলিয়ে
‘সন্ধান চাই’ এমন একটা কলামে আমার নাম আর ছবি দেখে চমকে উঠি আমি। দ্রুত সেটা লুকিয়ে ফেলি।
এমনিতে আমি তেমন একটা বাইরে যাই না। শপ আর বাসা আর নদীর ঘাট — এই হলো আমার সীমানা। তার ওপর মুখে মাস্ক থাকে, তাই কেউ চিনতে পারেনি। আর পারবেও না।
তবুও সেই ‘সন্ধান চাই’ কলামটা দেখার পর থেকে অস্থিরতা লাগছিল প্রচণ্ডভাবে। কে আমার খোঁজ করলো? আপা নাকি রোশান?
সেখানে যে নাম্বার দেওয়া ছিল, সেটা আননোন নাম্বার। চিনতে পারিনি। কয়েকদিন আমার ঘুম হারাম হয়ে গেল। বাড়ির কথা এত বেশি মনে পড়তে লাগলো যে বলার মতো না। বারবার মা আর বাবার মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো। নিজের ভেতর খুব খারাপ লাগতে লাগলো। মনে হতে লাগলো, মা তো কম কষ্ট করে বড় করেননি আমাকে। হয়তো দু’একটা কথা বলেছেন রাগের মাথায়। তাই বলে মায়ের ওপর এত রাগ করা ঠিক হয়নি। হয়তো আমার কথাও মায়ের খুব মনে পড়ে।
তাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য আমার ভেতরে এমন এক অস্থিরতা শুরু হলো যে নিজের ব্যালেন্স ঠিক রাখতে পারলাম না।
ঠিক করলাম, যোগাযোগ করবো। না করলে মন শান্তি পাবে না।
এদিকে ভেঙে পড়া আদ্রিয়ানকে বন্ধু হয়ে পাশে থেকে সামলে দেওয়ার পর, সে আমার প্রতি মুগ্ধ হয়ে পড়ল। আদ্রিয়ান অবাক করা চোখে তাকিয়ে থাকতো আমার দিকে। রোজ ফুল এনে দিতো। মুখে কিছু বলত না, আবার কখনও অসম্মানও করেনি। তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি সব বুঝতে পারতাম। সব পড়ে ফেলতাম।
এসব দেখে আমি তার সাথে কথা বলা কমিয়ে দিলাম। দূরত্ব বাড়ালাম।
সে আবার প্যারিসে ফিরে গেল।
এক ছুটির দিনের বিকেলে মাদাম আর আমি রোন নদীর পাশে বেঞ্চে বসে ছিলাম। মাদাম তখন আমাকে ডেকে ইতস্তত করতে লাগলেন।
আড়চোখে পরখ করলাম সেটা।
পরে উনার হাত ধরে হেসে বললাম,
“নিশ্চয়ই কিছু বলতে চান আমাকে, এমন না করে বলে ফেলুন নির্দ্বিধায়।”
মাদাম একটু ইতস্তত করে বললেন,
“আদ্রিয়ান তোমাকে বউ বানাতে চায়।”
“কি-হ?” বলে কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। বিয়ের কথা মনে পড়তেই আগের বিয়েগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো অটোমেটিকভাবে।
মাদামকে বিনয়ের সুরে বললাম,
“আপনি তো জানেন আমার সবকিছু। জীবন আমাকে কতভাবে পরীক্ষা করেছে, কতবার মানুষ আমাকে ঠকিয়েছে। আমি আর বিয়ের সাথে জড়াতে চাই না। প্লিজ।”
মাদাম আমাকে অনেক কিছু বুঝালেন, বললেন,
“তোমার মনের অবস্থা সব বুঝতে পারছি।
কিন্তু জীবনে একা থাকা যায় না। যারা বলে যায়, তারা আবেগের বশে বলে। আজ তুমি ইয়াং মেয়ে, কাল তোমার বয়স বাড়বে। তখন তোমার শক্তি থাকবে না। তখন তোমার আশ্রয় কী হবে? কার ভরসায় তুমি থাকবে বলো? শোন মেয়ে, তোমার থেকে আমার অনেক অভিজ্ঞতা আছে জীবন নিয়ে। জীবনকে শেষ একবার সুযোগ দিয়ে দেখো।
আদ্রিয়ানকে আমি জন্ম দিয়েছি, আমি জানি আমার ছেলে কেমন। তুমি তার জীবনে নতুন আলো এনেছো। হয়তো আমি বেঁচে থাকবো না, কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি — তার সাথে তুমি ভালো থাকবে, সুখে থাকবে। হয়তো তোমার জীবনে এতকিছু হয়েছে, যাতে তুমি আদ্রিয়ানের কাছে আসতে পারো, একজন সঠিক মানুষের কাছে।
মায়েরা মিথ্যে বলেনা কখনও। আমার কথা তুমি রাখো।”
আমি কিছু বলার মতো পাচ্ছিলাম না। মাদামের একটা কথাও ফেলে দেওয়ার মতো ছিল না। আবার আমার ভেতর থেকে আমি নতুন করে বিয়ে মেনে নিতে পারছিলাম না। অনেক কষ্টে জীবনকে একটু গুছিয়ে নিয়েছি। আবার যদি ঠকি, তাহলে হয়তো জীবন এখানেই ইতি টানতে হবে আমার। তাছাড়া ভেতর থেকে সব অনুভূতিগুলোও মরে গেছে অনেক আগেই।
মাদাম আমাকে সময় দিলেন ভেবে দেখার জন্য।
আমি সারারাত ভাবলাম। একবার মনে হলো মাদামের কথা শুনি, আবার মনে হলো না।
এইসব এলোমেলো চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে আবার কাজে মন দিলাম। মাদামও আর জোর করলেন না।
বছর খানেক কেটে গেল। এর মধ্যে আদ্রিয়ান অনেক বার এসেছে। শুধু ভালো মন্দ কথা ছাড়া আমাদের আর কথাই হয়নি। একদিন মাদাম ঘোরতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। এতটাই খারাপ অবস্থা হলো যে, উনার ছেলে-মেয়ে পরদিন সকালেই চলে এলো।
বয়স বাড়লে রোগ মানুষের পিছু ছাড়ে না। কোনোটা প্রকাশ্যে থাকে, কোনোটা গোপনে।
মাদামের গ্যাসের সমস্যা আগে থেকেই ছিল। কদিন ধরে সেটা গুরুতর হলে, ডাক্তারের পরামর্শে গ্যাসের ভালো ওষুধ খেতে শুরু করেছিলেন। তখনও বিস্তারিত পরীক্ষা করা হয়নি। সেদিন ব্যথা এত তীব্র হয়ে উঠলো যে, মেডিকেলেই নিতে হলো। সেখানে পরীক্ষা করে দেখা গেল — উনার ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে।
সেদিনই আমরা তিনজন মিলে উনাকে প্যারিসের নামকরা হাসপাতালে নিয়ে গেলাম।
অনেক ব্যাগ রক্ত জোগাড় করতে হলো।
কিন্তু যত রক্ত দেওয়া হলো, সব বের হয়ে যাচ্ছিল। শরীরে কিছুই থাকছিল না।
এভাবে সপ্তাহও যায়নি, উনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। মুমূর্ষু অবস্থায় কথা বলার শক্তি ছিল না উনার। আদ্রিয়ান আমি আর উনার মেয়ে পাশেই ছিলাম। মাদাম উনার কাঁপা কাঁপা হাতে আমার আর আদ্রিয়ানের হাত এক করে উনার মেয়ের দিকে তাকিয়ে কি যেন বললেন। উনার কোন কথা স্পষ্ট না।তবু আমাদের কারও বুজতে বাকি রইলো না, উনি কি বলতে চেয়েছেন।
মাদাম চলে যাওয়ার পর উনার ছেলে-মেয়েদের মতোই আমারও মন ভেঙে গিয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল, এই অপরিচিত শহরে আমার সবচেয়ে আপনজন আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন। যিনি মা হয়ে আগলে রেখেছিলেন, বুকের ভেতর আশ্রয় দিয়েছিলেন, মন খারাপি রাতে পাশে থেকেছিলেন। সেই মানুষটা আর নেই। প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছিল। আমি প্রচুর কেঁদেছিলাম।
তবুও নিজেকে শক্ত করে উনার সন্তানদের সাহস দিয়েছিলাম। এক সন্ধ্যায় উনার মেয়ে আমার পাশে বসে হাত ধরে বলল,
“মা নেই… এত বড় বাড়ি একা পড়ে থাকবে। তুমি ভাইয়াকে বিয়ে করো, মায়ের কথাটা রাখো। এই বাড়িতে আলো জ্বলুক, সুখ ফিরুক।”
আমি মুচকি হেসে মাথা নিচু করলাম। কারণ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম মাদামের মৃত্যুর দিনই — আমি উনার শেষ কথা রাখবো। আদ্রিয়ানকে বিয়ে করবো। যা হবার হবে।
অল্প কিছু আত্মীয়স্বজনের উপস্থিতিতে আমাদের বিয়ে হলো। মাদামের মৃত্যুর পর সেদিনই আমি আদ্রিয়ানের মুখে প্রথম বিশুদ্ধ হাসিটা দেখলাম। তার মুখে এত স্বচ্ছ আনন্দ, এত প্রাণ দেখে আমার নিজেরও নিজের অজান্তে হাসি ফোটে মুখে।
বয়স খুব বেশি হবে না — ২৮ কিংবা ২৯। প্রায় আমার সমানই। ছিমছাম গড়ন, কালো মণির মতো উজ্জ্বল চোখ, ধবধবে চেহারার এক ছেলের সুখের কারণ হতে পারবো, এটা কি কখনো ভাবতে পেরেছিলাম?
দিনগুলো ভালো চলতে লাগলো। একসাথে থাকা, গল্প করা, নদীর পাড়ে বসে রাতের হাওয়া খাওয়া, জোৎস্না দেখা, কত কথা, কত ছোট ছোট মুহূর্ত কাটতে লাগলো।
তবু মাঝে মাঝে থমকে যেতাম। মনে হতো, যদি এতো ভালোবাসার পরেও একদিন ঠকে যাই। তখন আমি কী করবো?কিন্তু আমার ভয় সত্যি হয়নি। ধীরে ধীরে বিয়ের দশ বছর হতে চলেছে।আমরা এখনও একসাথে আছি।এই দশ বছরে আদ্রিয়ান কখনো আমাকে ‘তুই’ সম্বোধন করেনি।সবসময় সম্মান দিয়ে কথা বলেছে। কেয়ার করেছে আগলে রেখেছে। যেমন মাদাম রাখতেন।
মন কাঁদে মাঝে মাঝে এই ভেবে — যদি অতীতের তিক্ততা আমাকে দমিয়ে রাখতো,
তাহলে কি এই সুখ খুঁজে পেতাম? আফসোস হতে লাগলো, কত ছেলে-মেয়ে আছে, যারা একবার আঘাত পাওয়ার পর আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না, আর খারাপ অতীতের জন্য জীবনের সত্যিকারের সুখ অজান্তেই হারিয়ে ফেলে তারা।
আমার একটা মেয়ে বাবু হয়েছে।তার নাম দিয়েছি আলিজা। অসাধারণ কিউট। বাবার মতো দেখতে হয়েছে একদম। সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখে সে।
বিয়ের দুই বছর পর আমি আলিজাসহ আদ্রিয়ানকে নিয়ে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম।
যাওয়ার আগে আপুদের সাথেও যোগাযোগ হয়েছিল। বাড়ি গিয়ে মাকে দেখে মনে হলো, তিনি কতোটা অপেক্ষায় ছিলেন আমার।
মা আমাকে বুকে জড়িয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। কত অভিমান ঝাড়লেন। সবাই কাঁদলো।
আমি ছেলের কবরের পাশে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম।
বাংলাদেশে মাস খানেক ছিলাম। মাকে কথা দিয়ে আসছি, নিয়মিত যোগাযোগ রাখবো।
কিন্তু রোশান আর নিশানের খোঁজ নেয়ার ইচ্ছে আমার একটুও হয়নি। বেইমানদের কোনো খোঁজ নেয়ার দরকারও নেই।
মায়ের সাথে রোজ যোগাযোগ হয় আমার। সবার সাথে এখন সম্পর্ক ভালো। সেদিন মা বললেন, নিশানের বউ নাকি একটা বাচ্চা রেখে পালিয়ে গেছে। আপুর থেকে শুনলাম, রোশান নাকি প্যারিসেই থাকে। পরিবার সহ। দুলাভাইয়ের সাথে হঠাৎ নাকি তার দেখা হয়েছিল। আমার কথা জিগাইলে দুলাভাই ইগনোর করে আসেন। তবে ভালো লাগলো, পরিবার সহ থাকে শুনে। জাকিয়া মেয়েটার মিষ্টি মুখ চোখে ভাসলো। মেয়েটা যেন সবকিছু থেকে এভাবে আগলে রাখে তার স্বামীকে। কোন মেয়ে যেন তাদের জীবনে আর না আসে। রোশান ও যেন তাকে ভালোবাসে।
আমিও এখন প্যারিসেই থাকি। আদ্রিয়ান এখানে চাকরি করে। রোন নদীর পাড়ের সেই বাড়িতে এখন ভাড়াটিয়া থাকে। নিচতলা আমাদের জন্য ফাঁকা রাখা। ছুটি পেলেই আমরা সেখানে যাই।মাঝরাতে নদীর পাড়ে বসি।আমি তার কাঁধে মাথা রাখি।সে মাথায় হাত বুলিয়ে গল্প করে। নানানরকম গল্প। আর আমি মনে মনে মাদামের কথা মনে করি।
উনার এত ইচ্ছে ছিল, অথচ দেখে যেতে পারলেন না আমাদের। বুকের ভেতর থেকে এক নির্মম হাহাকার চলে আসে নিজের অজান্তে।
চোখের কোণে জল জমা হয়। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলি —
“তুমি নিশ্চয়ই আমাদের দেখছো, মাদাম। নিশ্চয়ই তুমি দেখছো, আমরা কেমন সুখে আছি। তুমি দোয়া রেখো আমাদের বন্ধন যেন কখনও ছিড়ে না যায়। তোমার বলা কথাগুলো যেন সব সত্যি হয়।”
সমাপ্ত