ধোঁয়াশার শেষে পর্ব-০৬

0
343

#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ৬

উপমা দ্বিতীয়বারের মতো ইউভানের সঙ্গে দেখা করতে এলো। আগের দিন তাকে পায়নি, তাই আবারও এসেছে সে। অফিসের বাইরের চেয়ারে বসতেই মিনিট পাঁচেক পর ইউভানের এসিস্ট্যান্ট আমাদ এসে জানায়

“স্যার এখন কোনো কেইস লড়বেন না। আপনি অন্য কোথাও যান।”

উপমা আমাদের পানে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। একগুঁয়ে মেয়েটা আমাদকে উপেক্ষা করে । দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে রুমে।

ভেতর ঢুকতেই দেখা পায় সে ভারী কাঠের ডেস্কের ওপারে চেয়ারে বসে থাকা ব্যারিস্টারের। উপমা টেবিলে হালকা করে দু’টো থাপ্পড় দেয়। চেয়ার ঘুড়িয়ে বসে থাকা ব্যারিস্টার মুখোমুখি হয় উপমার। উপমা খেয়াল করে দেখে
গভীর দৃষ্টি, শার্প চেহারা, পরিপাটি একজন যুবক। পরনে কালো শার্ট। একটা অভিজাত অথচ অদ্ভুত শীতলতার ছাপ ছড়িয়ে আছে তার চারপাশে।

ইউভান বিরক্ত চোখে তাকাল উপমার দিকে। তার শক্ত চোয়ালে স্পষ্ট হলো অসন্তোষ, কপালের মাঝখানে ভ্রু জমাট বাঁধল।

“তোমার অনেক সাহস মনে হচ্ছে। অনুমতি ছাড়া কেউ আমার রুমে ঢোকে না,”

ঠান্ডা স্বরে বলল সে, গলায় এক ধরনের শাসানি মিশে থাকলেও উপমা অবিচল রইল।সে এক মুহূর্তের জন্যও পিছু হটল না। বরং ধীর কন্ঠে বলল

“আমি অনুমতি নিতে আসিনি, কথা বলতে এসেছি।”

ইউভানের কুঞ্চিত ভ্রুতে আরো খানিকটা ভাঁজ পড়লো। সে ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে রইল উপমার পানে। কয়েক সেকেন্ড নীরব থাকার পর, হাতের ঘড়ির দিকে এক ঝলক তাকিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠল। গলায় এক ধরণের উদাসীনতা টেনে বলল

“আমি সময় নষ্ট করতে পছন্দ করি না। আমার জরুরি মিটিং আছে,”

ইউভানের এমন উদাসীনতায় উপমা হতাশ হয়ে গেল। বলে ফেলল রেগে

” আপনি এতোটা খারাপ কেন? আপনার মতো এতো উদাস আইনজীবী দ্বিতীয়টা দেখিনি আমি।

” এই মেয়ে শোনো, আমি তোমার বোনকে বিয়ে করিনি যে তোমার কথা শুনতে বাধ্য হবো।”

উপমার মাথা গরম হলো। বিরবির করে ইউভানকে কিছু বলল। তবে ইউভান পাত্তা দিল না। পকেট থেকে সানগ্লাস বের করে চোখে দিল, কালো শার্টের হাতা গুটিয়ে নিতে নিতে দরজার দিকে এগোল। তার চলার ভঙ্গি ছিল নিখুঁত আত্মবিশ্বাসী, যেন পুরো পৃথিবী তার নিয়ন্ত্রণে।

আমাদ কিছুক্ষণ পরখ করলো উপমাকে। উপমা হাশফাশ করছে। মেয়েটার দুশ্চিন্তাভরা মুখ দেখে আমাদ এর মায়া হলো। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। ইউভান কখনো তার কথায় কেইস হাতে নেবে না।

চলতি দশায় ইউভান হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। একটা অস্পষ্ট দৃশ্য মাথায় ঘোরে। তীক্ষ্ণ ব্যাথা হয় তার। যেন কেউ মাথায় সুচ ফোটাচ্ছে। মনে পড়ে তার মায়ের কথা। ভয় হয় তৎক্ষনাৎ। মিসিং হওয়া থেকে মার্ডার! ইউভান পেছন ঘোরে। তার এবার মনে হয় সে কেইসটা হাতে নেবে। দ্বিতীয় কোনো নারীর প্রাণ সংশয় না হোক তার মায়ের মতো। পৃথিবী থেকে আরো একটা নারী হারিয়ে না যাক। এমনটা মনে করেই সে আমাদ কে ইশারায় বলে মেয়েটার থেকে সবকিছু বিস্তারিত শুনতে। সে মিটিং শেষ করে ফিরছে। আমাদ প্রথম বারের মতো ইউভানের ওপর খুশি হয়। মনে হয় তার ,ইউভান ততটাও খারাপ না।

.
জারার মাথাটা এখনো ভারী লাগছে। রাতের পর সকালে ঘুম ভাঙার পরও পুরোপুরি জেগে উঠতে পারেনি। গা হাত পা ব্যাথায় জর্জরিত। জারা আজ একটু সুস্থতা অনুভব করে। সবসময় তার পাশে থেকেছে নার্স। তবে এখন তাকে দেখা যাচ্ছে না। কে তাকে এখানে এনেছে তারও হদিস পায়নি জারা। একটু ভালো অনুভব করতেই বিছানা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলো সে। চারপাশটা অচেনা, অদ্ভুতভাবে নিখুঁত—আলিশান এপার্টমেন্ট, দামি আসবাব, নরম কার্পেট, সুগন্ধি বাতাস।

জারা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। মাথা একটু ঘুরে উঠল, কিন্তু কিছুক্ষণ পরই ধাতস্থ হলো। শীতল মেঝেতে খালি পায়ে পা ছুঁইয়ে ধীর পায়ে এগোতে লাগল। বাড়িটা বিশাল, কিন্তু নিঃশব্দ। দরজা খুলে বারান্দায় এল, সামনের কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। চারদিকে শুধু গার্ড।
তারা নড়ছে না, কথা বলছে না—শুধু দাঁড়িয়ে আছে, যেন প্রশিক্ষিত রোবট। জারার গলা শুকিয়ে এলো। কি অদ্ভুত পরিবেশ। ঘরের প্রতিটি আসবাবপত্র কালো। এমনকি জানালার উড়ন্ত পর্দার সবগুলোই কালো। কোথাও রঙিন কিছু যেন নেই।

পরখ পর্যায়ে হঠাৎ করেই জারার চোখ আটকাল ওপরের দিকে।একটা মেয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছিল। ওয়েস্টার্ন পোশাক পরা, আত্মবিশ্বাসী হাঁটা। মেয়েটির চলার মধ্যে কোনো ভয় নেই, যেন সে জানে এখানে থাকার অধিকার তার আছে। জারা দ্রুত জানালার কাছে গিয়ে কাচের এপাশ থেকে ডাকল,

“শুনতে পাচ্ছেন?”

মেয়েটি প্রথমে শুনতে পায়নি। জারা এবার জানালায় হাত ঠুকল,

“এই! শুনতে পাচ্ছেন?”

মেয়েটি থমকে দাঁড়ায়, ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল নিচের দিকে। চোখে বিস্ময়ের ছাপ।

জারা নিঃশ্বাস নিল, কণ্ঠে একটা উৎকণ্ঠা ঝেঁকে বসল,

” আপনার সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে? ”

মেয়েটা যেন জারার প্রশ্নের উত্তর দিতে চায় না। সে তার গন্তব্য নতুন করে হাঁটতে চাইলে জারা জিজ্ঞেস করে

” আচ্ছা ব্যারিস্টার ইউভান আপনার কে হন? ওনাকে আপনি চেনেন?”

মেয়েটি নিরুত্তর। সে চলে গেলো সিড়ি বেয়ে ওপরের দিকে। জারা ঠোঁট উল্টে ফেলল। মেয়েটা সুন্দর কিন্তু বেশ অহংকারী হবে হয়তো। জারা আবার ঘরে ফিরল। ততক্ষণে নার্সটাও চলে এসেছে। জারা নার্সকে অনুরোধ করে বলে তার ফোনটা কিছু সময়ের জন্য জারা নিতে চায়। নার্স দ্বিমত করে না। জারা ফোন হাতে পেতেই উপমার নাম্বার তোলে। চিন্তিত মুখে দু’বার ফোন করতেই তৃতীয় বারের বেলায় উপমা রিসিভ করে ফোন। জারা খুশি হয়। তার কন্ঠ কেঁপে ওঠে। ওপাশে উপমা বোনের কন্ঠ শুনে কিছুটা স্বস্তি পায়। তার মনের এলোমেলো চিন্তা দূর হয়। তবে পরক্ষণেই আবার ভরকে যায় সে জারার মুখে সব শুনে। বড্ড রাগ হয় তার। ইচ্ছে হয় আলভিকে সাত আটবার করে মেরে ফেলার। জারা একটু আড়ালে যায়। উপমাকে বলে ফৌজদারি অপরাধ দাড় করিয়ে দ্রুত মামলা করতে। সে এখন নিরাপদে আছে। কালকের মাঝেই এখন থেকে বের হয়ে সে বাসায় ফিরবে। আলভি আর মাহার চূড়ান্ত শাস্তি চায় সে। উপমা জারাকে এবিষয়ে দুশ্চিন্তা করতে মানা করে। সে জানায় খুব বড় একজন ব্যারিস্টারের সঙ্গে উপমা কথা বলেছে। উনি ইতিমধ্যে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর লাগিয়ে দিয়েছেন আলভি ও মাহার পেছনে।

.
অলস বিকেলে বিশাল জানালার পাশে দাড়িয়ে জারা দেখছিল বাহিরটা। এ বাসার বিস্তার বিশাল। চারিপাশে বাগান। কোথাও ফল, কোথাও ফুল আবার কোথাও বিদেশি গাছের সমাহার। জানালার নিচে আছে গোলাপ ফুলের বাগান। হাওয়ায় হালকা করে মাথা দোলাচ্ছে তারা। জারারও ইচ্ছে হলো গায়ে হাওয়া লাগানোর। কিন্তু অন্যের ঘর, জানালা, জিনিসপত্র ভেবে সে ইচ্ছে দমিয়ে ফেলল। মাথার ভেতরে আলভি নামটা দাপাদাপি করছে। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে অনাগত সন্তানের কথা ভেবে। জারার মন খারাপ হলো বড্ড। আকাশের পানে তাকিয়ে সে আনমনেই বলল

” তুমি তো পারতে আমাকে একটা সুন্দর জীবন দিতে। যে জীবনে আমি এক নারীতে আসক্ত থাকতো কেউ। আমাদের সুন্দর একটা সংসার হতে পারতো।”

কথার মাঝেই দরজায় নক করে কেউ। জারা ফিরে চায়। এগিয়ে যায় দরকার নিকট। আওয়াজ দেয় জারা

” দরজা খোলা আছে ভেতরে আসুন। ”

শব্দহীনতায় দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে এক অগোছালো যুবক। কালো শার্টের বোতাম দু’টো খোলা। এক হাতা গোটানো তো অন্য হাতা কব্জিতে অবলীলায়।
হাতে একটা ট্রে—তাতে ধোঁয়া ওঠা কফি আর কিছু স্ন্যাকস।

“কেমন লাগছে এখন?”

জারা একটু ভাবলো। অতঃপর বুঝতে সক্ষম হল এটাই হয়তো ব্যারিস্টার ইউভান। কিছুটা অবাক হলো জারা। কল্পনার সঙ্গে সদৃশতা নেই। জারা ভেবেছিল হয়তোবা হবে একজন বয়স্ক লোক। ভারি চশমা থাকবে চোখে। ব্যারিস্টারের কাজের চাপে চোখ তুলে সে তাকাতে পারবে না কারো দিকে। কিন্তু এনাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি মাত্র কিচেন থেকে ফিরলেন। শার্টে লেগে আছে চিনির দানা। চুলগুলো কপালে এসে ঝুলছে। নাকের ডগায় চিকচিক করছে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

“ভালো… অনেকটাই ভালো।” জারা হাসার চেষ্টা করে জবাব দেয়।

ইউভান ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। ট্রেটা টেবিলে রাখে। তার চোখ জারার মুখের উপর স্থির হয়ে থাকে।যেন প্রতিটি পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করছে।জারা অনুভব করে, ইউভানের দৃষ্টি অদ্ভুত এক মোহ তৈরি করছে যা তাকে ক্রমশ অস্বস্তিতে ফেলছে।

“আপনার এভাবে যত্ন নেওয়ার দরকার ছিল না, মিস্টার ইউভান। আমি ঠিক আছি। আমি এমনিতেই আপনার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ।”

চলবে….