ধোঁয়াশার শেষে পর্ব-০৮

0
22

#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ৮

সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা ছেলের মুখে ভালোবাসার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় জারা। ভুলেও কখনো ইউভানের সাথে জারার দেখা হয়েছিল কিনা সেটাও সন্দেহের। আর ইউভান কিনা তার আচরণ আর কথায় প্রমাণ করছে সে জারাকে ভালোবাসে? যে ভালোবাসার প্রখরতা আর আর গভীরতা এতোটাই যে জারা চলে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করতেই তাকে বন্দী করা হলো রুমে। ঘরময় পায়চারি করছে জারা। সে এসবের কিছুই বুঝতে পারছে না। তার কাছে সব নিছকই বোকামি বলে মনে হচ্ছে। আর ইউভানের বলা ভালোবাসা কথাটা মরিচীকার মতো অদ্ভুত বস্তু। কিছুটা ভয়, চিন্তা আর অস্বস্তি জারাকে ঘিরে রইলো। সে দমে যাওয়ার পাত্রী নয়। যে কেউ এসে বলে ফেলবে ভালোবাসি আর জারা চোখ ভরা মায়া নিয়ে ভাববে সে কি সত্যিই ভালোবাসে? আমি কি নতুন জীবন পেলাম? এমনটা হবে না কখনো। ঠকে যাওয়ার পর মানুষ হয় অসম্ভব কঠিন। যা তার কল্পনাতেও থাকে না। জারা আজকের রাত পার করলো না ঘুমিয়ে। হাসফাস করে। দরজা ভেতর থেকে ভালো করে লক করে। তবে কাজ হলো না। একটু পরই দরজা খুলে ভেতরে আসে একটা শক্ত চোখ মুখের মেয়ে। ঠিক মেয়ে তো নয়। যেন রোবট সুফিয়ার মামাতো বোন। জারা বুঝে ফেলে ইনি তার গার্ড। ইউভানও ভেতরে প্রবেশ করে। চোখে সেই একই দৃষ্টি। কেমন নেশালো।অদ্ভুত ঠান্ডা আর মোলায়েম। সে এসে জারার মুখোমুখি দাড়িয়ে বলে

“পলানোর চেষ্টা কোরো না। তুমি গেলে আমি আবার হারিয়ে যাব, জান…”

জারা জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল। আচমকা জান শব্দ শুনে সে আঁতকে ইউভানের পানে চায়। সে বেশ শক্ত কন্ঠে বলে

” আমার নাম জারা। জান নয়।”

ইউভান হাসে। জারা সে হাসির পানে দৃষ্টি স্থির রাখে না। সে আবারও চায় জানালা দিয়ে অজানা দিকে।

পেছন থেকে ইউভানের মৃদু কণ্ঠ ভেসে আসে

” সবার জন্য জারা হলেও আমার জন্য জান। যাই হোক, তুমি কি সত্যি ই চলে যেতে চাও?”

জারা ঘুরে দাঁড়াল। ছেলেটার চোখ অসম্ভব শান্ত, কিন্তু তার গভীরতায় একটা অদ্ভুত শূন্যতা লুকিয়ে আছে। যেন সে খুব কিছু হারিয়েছে, আর সেটা আরেকবার হারানোর ভয় তাকে তিলে তিলে কুরে কুরে খাচ্ছে।

“হ্যাঁ, আমি যেতে চাই,”

দৃঢ় কণ্ঠে বলল জারা।

ইউভান ধীরে ধীরে জারার বিছানার নিকট গেলো। তারপর বসে পড়ল। তার ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক হাসি। যেন এই উত্তরটা সে আগেই জানত।

“তুমি আমাকে চেনো না, তাই না?”

জারা কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা নাড়ল,

“আমি তো চাই-ই না চেনার প্রয়োজন হোক। আপনি আমাকে সাহায্য করেছ, আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু এখন আমার যাওয়া দরকার।”

ইউভান গভীরভাবে তার দিকে তাকাল।

“তুমি আমাকে না চিনলেও, আমি তোমাকে চিনি, জারা। পাঁচ বছর ধরে চিনি।”

জারার গা শিরশির করে উঠল। সে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল ।

“কিভাবে? ”

ইউভান মৃদু হাসল।কিন্তু তার চোখে একচিলতে বেদনা খেলে গেল।

“তুমি যাওয়ার কথা বললেই আমার মনে হয়, আবার হারিয়ে ফেলব তোমাকে। পাঁচ বছর আগে আমি তোমাকে হারিয়েছি, আর একবার পারব না।”

জারা ধৈর্য ধরে বলল,

“আপনি ভুল ভাবছেন, ইউভান। আমি আপনাকে চিনি না। আমি আপনার কোনো কিছুই নই।”

ইউভান ধীরগতিতে উঠে দাঁড়াল, একপা এগিয়ে এল।

“তুমি জানো না, আমি কীভাবে তোমাকে খুঁজেছি। কতবার মনে হয়েছে তুমি হারিয়ে গেছ চিরতরে। কিন্তু সেদিন, যখন আমি তোমাকে রাস্তায় পেলাম, রক্তে ভেজা, নিস্তেজ, জানো তখন কী মনে হয়েছিল?”

জারা কিছু বলল না, কিন্তু তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল।

ইউভান হাত বাড়িয়ে তার একগুচ্ছ চুল আঙুলে পেঁচিয়ে নিলো, খুব আস্তে, যত্ন নিয়ে।

“মনে হয়েছিল, তোমাকে ফিরে পেয়েছি। কিন্তু তুমি যদি এখন চলে যাও… তবে হয়তো আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারব না।”

জারার গলা শুকিয়ে এল।

“আপনি আমাকে আটকে রাখতে পারবে না, ইউভান।”

ইউভান তার চুলের গোছাটা ছেড়ে দিয়ে হাসল। হঠাৎ তার অভিমত বদলে দিয়ে সে বলল

” তুমি পালাতে চাও? পালাও। কিন্তু মাথায় রেখো, আমার ছায়া তোমার চেয়েও দ্রুত চলে। তুমি যত দূরেই যাও, আমি তার চেয়েও কাছে থাকবো। ”

এমন কথা বলেই ইউভান ঘর ছাড়ে। জারা অবাক হয়ে তাকিয়ে কিছুসময় ইউভানের যাওয়ার পানে। রাতটা কাটে নির্ঘুম। উপায় খুঁজে কিভাবে সে এখান থেকে বের হবে। শক্ত চোখ মুখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে গার্ডের দিকে। গার্ড মেয়েটা এক মুহূর্তের জন্য ঘুমালো না। উপরন্তু পালানোর পথ খুঁজতে গিয়ে জারাই ঘুমিয়ে গেছে। এরপর সকাল হতেই জারা মত বদলে ফেলে। নিজের বেশভূষা পাল্টে ফেলে ইউভানের দেওয়া পোষাক দিয়ে। একটা সবুজ রাঙা চুরিদার পড়ে নেয়। অতঃপর সুন্দর একটা ওড়না মাথায় পেঁচিয়ে বসে থাকে কিছুসময় বিছানায়। ভাবটা করে এমন যেন সে খুবই সুখে আছে। সুফিরার মামাতো বোনকে হঠাৎ কাছে ডাকে জারা। মেয়েটা রোবটের ন্যায় এগিয়ে আসে। জারা জিজ্ঞেস করে

” কি নাম তোমার? ”

” রিয়া”

জারা মাথা দোলায়। আরো কিছু প্রশ্ন মনে জমা করতে না করতেই কারো হেঁটে আসার শব্দ তার কানে পৌঁছায় জারা বুঝতে বাকি থাকে না কে আসছে এদিকে। আচমকা শুয়ে পড়ে সে বিছানায়। যেন ঘুমে কপোকাত সে এমন করে বন্ধ করে চোখ । রিয়া মেয়েটা বুঝে উঠতে পারে না জারার এমন ব্যবহারের কারণ। তবে যখন তার চোখ পড়ে ইউভানের ওপর তখন যেন সে থমকে যায়।

সকালের মৃদু আলো জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকছে। ঘড়ির কাঁটা তখন নয়টা ছুঁই ছুঁই। কালো ব্যারিস্টার কোট, সাদা শার্ট, নিখুঁত টাই আর চকচকে জুতোর সাথে ইউভান যেন একেবারে কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের রাজা। তার চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টির ঝিলিক, ঠোঁটে সামান্য হাসি।

দরজার সামনে এসে সে এক মুহূর্ত দাঁড়ায়। নিঃশব্দে দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে উঁকি দেয়। বিছানায় জারা বন্ধ চোখে শুয়ে আছে। মাথায় পেঁচানো ওড়না। এক হাত বুকের কাছে আর অন্য হাত মাথার নিচে। ইউভান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, চোখ সরাতে পারে না। যেন এক আশ্চর্য প্রশান্তি ছুঁয়ে যায় তাকে। কিন্তু সে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না এখানে। তাকে দ্রুত যেতে হবে কোর্টে।

ইউভান চলে যেতেই জারা উঠে বসে। রিয়া মেয়েটা তখনও হা হয়ে তাকিয়ে আছে ইউভানের যাওয়ার পানে। জারা লক্ষ করে এই নজর। ডেকে ওঠে

” শোন, সোফিয়ার মামাতো বোন।”

রিয়ার চোখের পলক পড়ে। ছোট ছোট চোখ করে সে চায় জারার দিকে। জারা উঠে এসে কিছুটা ঝুকে যায় রিয়ার ওপর। নিচু স্বরে অর্পণ করে দারুণ এক সুযোগ

” ব্যারিস্টার ইউভান অনেক হ্যান্ডসাম তাই না?”

রিয়ার চোখ জোরা গেল গোল হয়ে আসে। জারা দ্বিতীয় বার বলে

” তুমি চাইলে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি৷ তবে একটা শর্ত। যদি তুমি আমাকে এখান থেকে বের হতে সাহায্য করো তাহলে আমি ইউভানকে পটাতে বুদ্ধি দেবো তোমাকে।”

রিয়া দু পা পিছিয়ে যায়। যেন মহা পাপী জারা। কঠোর সুরে বলে

” ঠিক ভাবে কথা বলুন ম্যাম। আমরা ওনার গার্ড। মালিকের ওপর নজর দেওয়ার অভ্যাস আমাদের কারো নেই।”

জারা বোঝাতে চাইলো কিছু। এক হাত রিয়ার কাঁধের ওপর রাখার জন্য এগিয়ে যেতেই রিয়া মেয়েটা দ্বিতীয় বার পিছিয়ে গেলো। অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে বলল

” আমি বিবাহিত। আমার বাচ্চা আছে।”

জারার হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। পালানোর পথ পাড়ি দেওয়া এবার ভীষণ কঠিন হয়ে গেলো। সে পায়চারি করলো। জানালার পাশে দাড়ালো। বাহিরে কড়া পাহাড়া। আর ভেতরে রিয়া। রাগে জারার মাথা ধরে এলো। ইউভান নামের ছেলেটাকে এখন এই মুহূর্তে তার ছাদ থেকে ধাক্কা দেওয়ার ইচ্ছে হলো। এতোসব ভাবনার মাঝেই জারার মনে হলো রিয়ার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তাকে না আটকালে সে এখান থেকে এক পাও নড়তে পারবে না। যেই ভাবা সেই কাজ। ফাঁকিতে ফেলে রিয়াকে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিয়ে জারা হুট করে বাহির থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলো দরজার। রিয়া যেন হতভম্ব। জারা সময় নিলো না। দ্রুত মেইন দরজা খুলে বেরিয়ে পরল এ বাসার ছাদ থেকে। এখন তাকে পার করতে হবে মেইন গেইট।

অফিস টাইম হওয়ায় তখন তিন তলা থেকে নামছিল প্রথম দিন দেখা সেই মেয়েটা। জারা বাহিরে দাড়িয়ে ভাবছিল কিভাবে সে গেইটের গার্ডদের অতিক্রম করবে। যখন সে দেখতে পেলো নাম না জানা হালকা চেনা সেই মেয়েটাকে তখন মাথায় কিছু একটা খেলে গেলো। পিছু নিলল মেয়েটার। বাগানের দিকেও ছিলো কিছু নিষ্ঠুর গার্ড। ওরা এগিয়ে এল। জারাকে প্রশ্ন বানে ফাঁসাতেই জারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দিলো সামনে হেঁটে যাওয়া মেয়েটাকে। বলল

” আমি ওনার কাছে এসেছি।”

মানুষ রূপের রোবট তিনটে বলাবলি করলো

” ইকরা ম্যামের কাছে? ওকে যান। তবে ইউভান স্যারের সীমানা এটা৷ এদিকে আসবেন না৷ আসলে কিন্তু খারাপ কিছু হবে আপনার সঙ্গে। ”

জারা ধীর গতিতে মাথা নাড়লো। ইকরা মেয়েটার থেকে পাঁচ হাত দূরত্ব রেখে সে হেঁটে চলল। গেইটের দু’টো শক্তপোক্ত মানুষ তাকে অনায়াসে বাহিরে বের হতে দিলো।

.
দু’দিন ঘর বন্দী থাকার পর বাহিরে বের হতেই জারা বড় করে একটা শ্বাস নিলো। সামনে তাকালো চকচকে চোখে। তবে মিনিট না গড়াতেই সেই দৃষ্টিতে আঁধার নামলো। চারিপাশে কেবল বাগান। জনমানবশূন্য পথ। উঁচু পর্বতের ন্যায় রাস্তার এক পাশে মাটির স্তুপ। তারওপর দিয়ে অবাধ্যভাবে জন্ম নিয়েছে কিছু গাছ। পাতা নেই তাদের। শুকিয়ে গেছে। জারার মুখটা শুকিয়ে গেলো। এ কেমন জায়গায় বাসা তাদের? আশেপাশেও কোনো বাসার অস্তিত্ব নেই। এখান থেকে কোর্ট কতদূরে? কোন দিকে? সব প্রশ্নের উত্তরেই কেবল ধোয়াসা।

.
কড়া রোদের ঝলকে গা জ্বলে উঠছে উপমার। কোর্টের বাহিরে দাড়িয়ে সে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে জারার উপস্থিতির জন্য। দশটা বাজতে আার আধ ঘন্টা বাকি। ছটফট করতে করতে সে দু’টো ফোন করলো নার্সের নাম্বারে। কিন্তু কোনো সাড়া এলো না। জারা আসতে পারবে তো? না এলে হয়তোবা আজ জয়ী হবে অপর পক্ষ। শাস্তি হবে না মাহা ও আলভির।

” শালিকা, খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে?”

পরিচিত কন্ঠে উপমা পেছন ফিরে চায়। রোদ থেকে নিজের চোখ আড়াল করতে তার কপালে রাখা ছিল বা হাত। আলভি হাসলো। নিজ হাতে উপমার হাতটা কপাল থেকে সরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো

” সামান্য রোদের তাপ সহ্য হচ্ছে না? এতো দূর্বল শরীর নিয়ে লড়াই করতে এসেছো? সাবধানে থেকো। তোমার না আবার বোনের মতো পরিস্থিতি হয়।”

কথাটা বলেই আলভি মাহার চোখে চোখ রেখে তৃপ্তির হাসি দেয়। মাহাও হাসে। সে হাসি চিন্তামুক্ত। আলভি হঠাৎ খেয়াল করে মাহার চোখ বুঁজে আসছে রোদে। সে হাত আপন হাতে ছায়া তৈরি করে। মাহাকে অতি যত্নে গাছের নিকট নিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। হঠাৎ, এমন সময়ই ভেসে আসে এক নারী কন্ঠ। তাচ্ছিল্য সুরে সে বলে

” সামান্য রোদের তাপেই পুড়ে যাচ্ছো? জারার আগুন তো এখনো জ্বলে ওঠেনি মাহা। জেলের আগুন, কোর্টের আগুন, রিমান্ডের আগুন থেকে আলভি তোমাকে বাঁচাতে পারবে তো?”

বুক কেঁপে ওঠে আলভির। বড্ড পরিচিত মনে হয় কন্ঠটা। সে পিছু ফেরে তৎক্ষনাৎ।

চলবে…..