#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ১৭
ক্ষণিকের মাঝেই উপস্থিত হয় ইকরা ও আরমান শাহও। জারা অদূরে দাড়িয়ে থাকে থম মেরে। ইউভানকে কোনোভাবেই যেন আঁটকানো যাচ্ছে না। অর্কভ এর শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। আরমান শাহ সজোরে ইউভানের নাম ডেকে উঠলে ইউভান থেমে যায়। তা-ও আমাদ এর টানা হেচড়ার কারণে। আরমান শাহ ধমকে উঠলেন
” কি হচ্ছে এসব ইউভান? অর্কভ তোমার ভাই।”
ইউভান ফুঁসে ওঠে। রাগে টগবগ করতে করতে বলে
” ভাই বলেই এখনো বেঁচে আছে। শুধুমাত্র বড় ফুফুর ছেলে বলে। নয়তো ওর অস্বস্তি মুছে ফেলতে আমার এক সেকেন্ড লাগবে না। ”
কথাটা বলেই সে চলে গেলো। সঙ্গে জারাকে টেনে নিয়ে গেলো। আরমান শাহ আমাদ এর থেকে জানতে পারলেন অর্কভ জারাকে নিয়ে একটা অশোভন উক্তি করেছে। আরমান শাহ বুঝে উঠতে পারেন না এখন তিনি কোন পথে হাঁটবেন। একটা বিবাহিত মেয়েকে নিয়ে ইউভানের এমন বাড়াবাড়ি তিনি মেনে নিতে পারছেন না। হোক না কিছুদিন পর ডিভোর্স। তবুও, তবুও কিভাবে ইউভান-জারার সম্পর্ক মানবেন তিনি? সমাজ বলতে কিছু একটা আছে নিশ্চয়ই।
.
দিন দুই পেরিয়ে গেলো। জারার অলস সময় কাটে। ইউভানও ইদানীং বাড়ির বাইরে যাচ্ছে না। উপায় হয় না একটু বাগানে হাঁটার। তবে এ দুদিনে পাক্কা এক রুটিন তৈরি হয়েছে। তিনবেলার খাবারই খেতে হয় জারাকে ইউভানের সঙ্গে। কখনো ক্ষুধায় কাতর হয়ে বেহুঁশ হয়ে গোগ্রাসে গিলতে হয় জারাকে। কত আর না খেয়ে থাকা যায়?
উপমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে জারা। কিন্তু ফলাফল শূন্য। গতরাতে ইউভানের বাবা এসেছিল জারার নিকট। শুঁকনো মুখে বলে গেলো জারা যেন ইউভানকে বুঝিয়ে বলে এ সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। এভাবে থাকাটাও পাপ। আরমান শাহর কথা শুনে এক মুহূর্তে জারার মনে হয়েছিল সে মা হয়ে সন্তানের মুখে মামার বাড়ির গল্প শুনছে। ইউভান জারাকে কথা বলতে দিলেই না সে বলবে। যতবার চলে যাওয়ার কথা বলে ততবারই তাকে বন্দী করা হয়। তবুও জারা ভাবলো আজ একটা শেষ চেষ্টা করবে সে। এরপর অপেক্ষা। সেই অপেক্ষার অবসান রাতে খাবার টেবিলে হলো। তবে বাঁধলো আরেক বিপত্তি। খোলা চুলে খাবার খেতে বসে চুল বারবার আসছিল প্লেটে। জারা ধরে রাখতে পারছিল না। ইউভান আপন খাওয়া রেখে জারার পাশে বসে। এক হাতে ধরে রাখে মুঠ পাকিয়ে জারার খোলা চুল। জারা উশখুশ করে ওঠে। তারপর আধখাওয়া প্লেট রেখেই চায় ইউভানের দিকে। ইউভান মুচকি হাসে। কি মোহনীয় হাসি তার। কি পরম যত্ন! এমন একটা মানুষ প্রতিটি নারীর কল্পনায় থাকে। আর সেই মানুষটা কিনা জারার মতো নগন্য কারো পিছে পড়ে আছে আঠার মতো।
” আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।”
ইউভানকে দেখে জারা ভয়ে ঠকঠক করেনি কখনো। ইউভানের নামে নেই কোনো আহামরি কিছুও। তবে ইউভানের হুটহাট রেগে যাওয়া আচরণ ঘাবড়ে দেয় জারাকে। তাই এবার সাবধানে কথা বলতে হবে
” আশা করি এমন কিছু বলতে যাচ্ছো তুমি যা আমার রাগের কারণ হবে না। ”
জারার বুক ধ্বক করে ওঠে। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করে
” দেখুন.. ”
ইউভান ভ্রু উঁচিয়ে তাকায়।
” এখনই দেখাতে চাও? ওয়েট হাত ধুয়ে আসছি। দেখার পরে আরো কিছু হবে আমি ড্যাম শিউর।”
জারা কটমট করে তাকায়। চেয়ার ছেড়ে উঠে বলে
” আপনি অনেক জেদি সেটা জানতাম কিন্তু এতোটা অসভ্য এটা জানতাম না। ”
একথা বলেই জারা নিজ ঘরে প্রবেশ করে। তার আর গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয় না ইউভানকে।
.
রাত কেটে ভোর হয়। দু’দিন অফিসে যাওয়া হয়নি ইউভানের। আজ সে যাচ্ছে। জারার কেইসে জয়ী হওয়ার পর মেয়ে ঘটিত আরো কেইস এসে জরো হচ্ছে। আমাদ সামাল দিতে পারছে না। সে বোঝাতে পারছে না ব্যারিস্টাররা সোলো কেইস লড়ে না। ক্লায়েন্ট এসে একটাই কথা বলে। তারা সরাসরি ইউভানের সঙ্গে কথা বলতে চায়। নয়তো অফিসের বাইরেই বসে থাকবে ঘাপটি মেরে। ইউভান তৈরি হচ্ছিল নিজ কক্ষে। রিয়া এক উড়ন্ত বার্তা শুনেছে। ইউভান নাকি গত দুদিনেও না আসতে পারে বাসায়। একটা জটিল কেইসের প্রমাণ খুঁজতে সে চলে যাবে কোথাও। জারা শুরুতে খুশি হলেও পরে ভেবে দেখে এটা তার জন্য বিপজ্জনক। তাকে আরো অগণিত দিন থাকতে হতে পারে এখানে। সে রিয়াকে আদেশ করে ইউভান বেরিয়েছে কিনা দেখে আসতে। রিয়া ছুটে যায়। খবর দেয় ইউভান রুমে নেই। জারাও চলে যায় দেখতে। কিছুসময় উঁকি ঝুঁকি দেওয়ার পর হুট করে ইউভান দৃশ্যমান হয় আলমারির পেছন থেকে। হাতে কিছু কাগজ। গায়ে জড়ালো সাদা শার্ট। জারা তড়িৎ গতিতে দরজা ছাড়ে। হুলস্থুল হয়ে সে লিভিং রুমের ডিভানে বসে পড়ে। রিয়া তার পাশে দাড়িয়ে থাকে। জারা একটা হেতু দেখানোর জন্য টি টেবিল থেকে খবরের কাগজ হাতে তুলে নেয়। রিয়া ইশারায় জারাকে কিছু বোঝাতে চায়। কিন্তু কে শেনে কার কথা। ইউভান তখন এগিয়ে আসে জারার দিকে। ডাকে মিহি সুরে।
” জারা, জারা..”
জারা রিয়াকে কনুইয়ের ধাক্কা দেয় হালকা করে। এতেই যেন রিয়ার মধ্যে জারার কথা ট্রান্সফার হয়ে যায়।
” ম্যাম, পড়ার সময় কথা বলে না। কথা বললে নাকি ওনার রাগ হয়। ধ্যান ভঙ্গ হয়।”
ইউভান ঠোঁটের আকৃতি গোল করে। তার মাথা ঝাঁকিয়ে হালকা হেঁসে বসে পড়ে জারার পায়ের নিকট। জারা ঈষৎ কেঁপে ওঠে। হতে যাচ্ছেটা কি? রিয়া ঝুঁকে পরে দেখার জন্য। অতঃপর যখন সে বোঝে বিষয়টা তখনই কপালে হাত রাখে। তবে কৌতুহল বিন্দুমাত্র না দমিয়ে সে অপলক দেখে। ইউভান আস্তে করে জারার পা থেকে নিজের শু খুলে নেয়। জারা পেপার কোলের ওপর রেখে হা হয়ে দেখে। তার এক পায়ে ইউভানের কালো শু আর অন্য পায়ে তার নিজের স্লিপার। মান-ইজ্জত ডুব দেয় পুকুরে। ইউভান উঠে দাড়িয়ে বলে
” পড়া শেষ? ”
জারা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। কান দিয়ে যেন ধোঁয়া ওঠে তার। ইউভান দ্বিতীয় বার বলে
” আরেকটা ওখানে আছে। পরে নিও। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। নয়তো তোমার পড়ায় ডিসটার্ব না করে আমিই পরিয়ে দিয়ে যেতাম। ”
ইউভান চলে যেতেই জারা রিয়ার দিকে তাকায়। রিয়া এই মিশ্র চাহনি উপেক্ষা করে বলে
” ম্যাম, আপনার পা কিন্তু বেশ লম্বা। স্যারের জুতো পারফেক্ট ভাবে লেগেছিল। বিয়ের পর আপনাদের সুবিধা হবে। এক জুতো দিয়ে দুইজন চলবেন।”
.
ইকরা সেই মুহূর্তে জরুরি ওয়ার্ডে ব্যস্ত ছিল। এমন সময় দরজা ধাক্কাধাক্কির শব্দ শুনে পিছনে তাকায়। দেখতে পায়, আদৃত একজন আহত রোগীকে কাঁধে তুলে নিয়ে এসেছে, আর নিজেও বেশ আহত—কপাল কাটা, হাতে রক্ত, শার্টেও লাল দাগ।
ইকরা প্রথমে কিছুটা অবাক হয়, কিন্তু পেশাদারিত্ব বজায় রেখে দ্রুত এগিয়ে আসে।
“স্ট্রেচার আনুন!”
ইকরা নার্সদের ডাক দেয়।
আদৃত কষ্ট করে বলে,
“আমি নিজেই নিয়ে আসতাম, কিন্তু ওর অবস্থা খারাপ। তুমি আগে ওকে দেখো।”
ইকরা ঠান্ডা গলায় বলে,
“তুমি নিজেও বেশ আহত, বসো এখানে, আমি দেখছি।”
“আমি ঠিক আছি। ওকে আগে দেখো, ইকরা। প্লিজ।”
আদৃতের কণ্ঠে এক ধরনের তাগিদ। ইকরা ক্ষণিকের জন্য চুপ করে থাকে। ওদের মাঝে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সেটা ভুলে গিয়ে সে রোগীর দিকে মনোযোগ দেয়। কিন্তু কাজের ফাঁকে ফাঁকে চোখ চলে যায় আদৃতের দিকে। রক্ত পড়ছে, কিন্তু সে নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেন ব্যথা তার কিছুই করতে পারবে না।
“তুমি বোকা নাকি? নিজের অবস্থাটা দেখেছ?”
ইকরা বিরক্ত হয়ে ফার্স্ট এইড বক্স হাতে নেয়।
আদৃত হালকা হাসে,
“তুমি এখনও আমাকে নিয়ে চিন্তা করো?”
ইকরা চোখ গরম করে বলে,
“আমি ডাক্তার, রোগীর যত্ন নেওয়াই আমার দায়িত্ব!”
“তাহলে দায়িত্ব পালন করো, আমাকে নিয়ে না ভেবে।” আদৃত শান্ত গলায় বলে, কিন্তু চোখের গভীরে একটা চাপা কষ্ট খেলা করে।
ইকরা কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে যায়। কি হবে এই মানুষটাকে বোঝিয়ে? সম্পর্ক ভেঙেছে, কিন্তু কিছু অনুভূতি হয়তো আজও বেঁচে আছে…
চলবে…
#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ১৮
মহাসাগরে ডুবি ভাসি রকমের চিন্তা নিয়ে জারার যেন সময়ই অতিবাহিত হতে চায় না। মন টিকছে না আর কোনোভাবেই এখানে। মাথায় ঘুরছিল বাড়ি, বাবা, মা আর বোন। অসম্ভব বিরক্তি আর তিক্ততা তার ইউভানের নামে। জারা এক পর্যায়ে অসহায় চোখে চাইলো জানালা দিয়ে বাহিরে। তখনই চোখে ধরা দিল অর্কভ। ব্যগ পত্র নিয়ে সে রওনা হয়েছে গেইটের দিকে। ক্ষণে ক্ষণে ফিরে চাইছে জারার কক্ষের দিকে। বিশাল জানালার পুরোটাই থাই গ্লাস। ঠিক জানালা নয় একটা দেয়াল সরূপ। নীল পর্দার ফাঁকা অংশে দাড়িয়ে ছিল জারা। অর্কভের ফিরে চাওয়ায় সে নিজেকে আড়াল করে নেয় পর্দা দিয়ে। অর্কভ বিরবির করছিল। ধুপধাপ পা ফেলে সে গেইটের নিকট যায়। জারা উঁকি দিয়ে দেখলো অর্কভ সজোরে দু’টো লাথি দিচ্ছে দেয়ালে। সম্ভবত যে পাশে লেখা আছে ‘ইউভান রেসিডেন্স’। জারা চোখ ফিরিয়ে নিল। মনে এক অদ্ভুত জড়তা ধীরে ধীরে নিলীন হলো। সম্ভবত জড়তাটা ছিল অর্কভ। এখন যেন শকুন মুক্ত নীড় এটা। শুধুই সমস্যা একটা বাঘ। হরিণী এই বন থেকে চলে গেলেই সে পুরোপুরি স্বাধীন।
ভাবনা সেখানেই থামিয়ে দিয়ে জারা তাকিয়ে রইল নির্জন রাস্তার পানে। তখনই দেখা মিলল একটা কালো গাড়ির। সন্দেহ নেই এটা ইউভানের। জারা নড়ে চড়ে দাঁড়ালো। অন্ত প্রহরের সূর্যের তেজ এসে পরেছিল গাড়ির কাঁচে। সেই রোদ রশ্মি গায়ে মেখে বেরিয়ে এলো আামদ। ইউভান নেই। মুহূর্তেই জারার মাথায় খেলে গেলো এক বুদ্ধি। ছুটলো হঠাৎ নিচে। সাজিয়ে ফেলল নিজের কথা যা সে বলতে চায় আমাদ কে।
.
গোলাপ গাছের সারি পার হলেই আমাদ এর ঘর। সে এগিয়ে যাচ্ছিল ধীর পায়ে। হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ায় জারা। থামিয়ে দেয় গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে বলে। আমাদ উপেক্ষা করতে পারে না। ইউভানের বুকের জিনিস বলে কথা। তবে জারা যখন তাকে শোনায়
” আপনাকে একটা কাজ করতে আমাদ ভাই। আপনিও জানেন, আমিও জানি ব্যারিস্টার যা করছেন তা মোটেও ঠিক নয়। এটা এক প্রকার পাপ। এভাবে একসাথে থাকা ইসলাম বিরুদ্ধ। আমাদের ধর্ম আছে, নীতি আছে সংস্কৃতি আছে। ইউভান কেন এসবের বিরুদ্ধে? তাকে বোঝান এভাবে আমাকে আটকে রাখা উচিত নয়। তাকে বোঝান এভাবে চলতে থাকলে… এমনকি যুগের পর যুগ গেলেও জারা ইউভানকে একসেপ্ট করবে না। ”
আরো কিছু কথা। নিজের অবস্থার বর্ণনা। এসব শুনেই আমাদের মুখটা শুকিয়ে উঠলো। এমন বিষয় ইউভানের কানে তোলার অর্থ সাপের লেজে পা দেওয়া। আমাদ বরং উল্টো বোঝাতে চেষ্টা করে জারাকে। বলে
” এমন মানুষ আপনি পাবেন না। স্যার কিন্তু আপনাকে অসম্ভব ভালোবাসে। এমন করে কেউ আপনাকে কখনো ভালোবাসবে না গ্যারেন্টি।”
জারা বিরবির করে বলে
” থ্যাঙ্ক গড ”
এমন ভালোবাসা সে চায় না। জারা হাল না ছেড়ে বোঝাতে চেষ্টা করে আমাদ কে। আমাদই একমাত্র মানুষ যার কথা কিনা ইউভান গ্রহণ করে। আর একারণেই আমাদ সাহস করেছিল জারাকে বেঁধে রাখা থেকে মুক্ত করতে। আমাদ বেশ বিপাকে পড়ে। আচ্ছা মনে মনে প্রেমিকা হয়ে যাওয়া মেয়েটার বোনকে কি মুখের ওপর কোনো কিছু না করা যায়? ভীষণ কঠিন এটা! ভীষণ! উপরন্তু জারা তাকে ডাকছে ‘ভাইয়া’।
” আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। বাট…”
মাথা চুলকায় আমাদ। জারার চোখ জোরা সরু হয়ে আসে। বাটের পর কি? তা জানতে সে অপলক তাকিয়ে থাকে। আমাদ নিশ্বাস আঁটকে বলে
” উপমার সঙ্গে যদি একবার দেখা করার ব্যবস্থা করে দেন আপনি। ”
জারা বিস্ফোরিত নয়নে চায়। আমাদ সেই দৃষ্টির কবলে পড়ে দ্রুত চশমা ঠিক করে। জারার মাথায় অন্যকিছু ভীর করার পূর্বেই সে বলে ওঠে
” উপমার সঙ্গে আসলে আপনার কেইস নিয়ে কিছু কথা বলার ছিল। মানে অনেক কিছু জানানোর ছিল ওনাকে।”
জারা মাথা নাড়ায়। সে আর ঘাঁটতে যায় না বিষয়টা। আমাদ আরো বলে উপমা ভীষণ রাগী। তাকে হুটহাট ফোন করলে কিনা কি বলবে বা ভাববে। জারা আমাদ এর কথা সত্যি ধরে নিয়ে স্বীকার হয় সে ব্যবস্থা করে দেবে।
.
রিয়ার খবরে ভুয়া ট্যাগ বসিয়ে দিয়ে ইউভান হাজির হয় রাত আটটায় নিজ বাসাতে। জারা ঘরে অপেক্ষা করে একটা সুখবরের। তবে তাতে বেশ জটলা পাকিয়ে আছে। ইউভান কি সত্যিই তাকে যেতে দেবে? আমাদ কি পারবে ইউভানকে ম্যানিপুলেট করতে? জারার মন বলে সম্ভাবনা টেন পার্সেন্ট। এমন হিসাব নিকাশ করতে গিয়ে জারা বিমর্ষ মনে শুয়ে পড়ে বিছানায়। চেতনায় আসে মাহার কথা। সে কি যোগ্য শাস্তি পেলো?
.
ভোর হলো যেন খুব দ্রুত। খুবই সরু এক আজানের ধ্বনি বরাবরের মতোই কানে এসে লাগতেই জারা চোখ খুলে বসে। ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় দেখা যায় রিয়া সোফা কাম বেডে শুয়ে আছে মুখে চিন্তার ছাপ নিয়ে। যেন মনে হচ্ছে সে স্বপ্নে দেখতে পাচ্ছে জারা আবারও তাকে ওয়াশরুমে বন্দী করে পালিয়ে যাচ্ছে। অথচ রাতের বেলায় বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে দেয় ইউভান।
আমাদ একটা বেশ ভালো অভ্যাস আছে। ছেলেটা প্রত্যহ নামাজ পড়তে যায় মসজিদে। যদিও মসজিদ এখান থেকে বেশ দূরে। আমাদ বাসায় ফিরে ইউভানের ছাদ বারান্দায় তাকায়। মনে হচ্ছে ঘরে আলো জ্বলছে। আজ অফিস নেই। নিশ্চয়ই ইউভান ঘুমাতে যাবে পাঁচটার পর। আমাদ চলে যায় ইউভানের কাছে। ইউভান ল্যাপটপে কিছু করছিল। আমাদ অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ইউভানকে সরাসরি জানায়
” আপনার উচিত জারা ম্যামকে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া। ”
ইউভানের ঢুলুঢুলু চোখ দপ করে জ্বলে ওঠে। চোয়াল শক্ত হয় তার। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাবে ঠিক তখনই আমাদ বলে
” আপনি যা করছেন তাতে কি মনে হয় জারা ম্যামের মা-বাবা আপনার হাতে তাকে তুলে দেবে? আপনি নিজেকে একটা আতঙ্ক হিসেবে উপস্থাপন করছেন। আপনার উচিত ওনাকে আপাতত ওনার ডিভোর্স হওয়ার আগ পর্যন্ত তার বাসায় রেখে দেওয়া। ”
” আমার বিষয় আমি বুঝে নেবো আমাদ। তুমি এখান থেকে যাও।”
আমাদ যায় না। সে গম্ভীর মুখে বলে
” এমন করে বিয়ের আগে একসাথে থাকলে ভালোবাসা কমে যায়। সংসার সুখের হয় না। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা হয়ে ওঠে না। আপনি আপনার ধর্মকে উপেক্ষা করে কিছু করতে পারেন না। আবার মেয়ের গার্জিয়ান ছাড়া কিন্তু বিয়ে হয় না। বিয়ে না হলে জারা ম্যামের থেকে ভালোবাসা পাওয়া অসম্ভব। আপনি নিশ্চয়ই চান জারা ম্যাম আপনাকে ভালোবাসুক? ”
ল্যাপটপে দ্রুত চলা হাত হঠাৎ থমকে যায়। ইউভানের ভ্রু কুটি হয়। বোধ হচ্ছে এবার কাজ হতে পারে। আমাদ ঠোঁট টিপে হাসে। ওষুধ বোধ হয় কাজ করছে।
.
দিন দশটা। তখনই রিয়া জারাকে জানায় তৈরি হতে। তাকে রেখে আসা হবে বাসায়। জারা যেন ভ্রমে আবদ্ধ হয়। সে কল্পনা আর বাস্তব মিলিয়ে গুলিয়ে বেসামাল হয়ে যায়। সত্যিই ইউভান তাকে ছেড়ে দিলো? সত্যি? জারা তৈরি হয় খুশি মনে। এখন শুধু এ বাসা থেকে একবার বের হতে পারলেই হল। পরের প্ল্যান পরে ভাবা যাবে।
ইউভান অপেক্ষায় ছিল। গাড়িতে বসে সে জারার জন্য অপেক্ষা করছে। মনটা বড্ড খারাপ তার। বিরস বদন। বাচ্চাদের মতো কাচুমাচু ভাব। যেন মনে হচ্ছে কোন ছোট বাচ্চার খুবই শখের জিনিস কেউ ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। জারা আসে গাড়ির নিকট। আমাদ তখন ড্রাইভিং সিটে। একবার চোখাচোখি হলো। জারা দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা ফুটিয়ে তুলতে ভুলল না। গাড়ির দরজা রিয়া খুলে দিয়ে দাড়িয়ে রইলো। বেশ খানিকটা মন খারাপ তার নিজেরও। সে অনেক জায়গায় গার্ড দিয়েছে। অনেক বড়লোক বাসায় মহিলা অ্যাসিসটেন্ট ছিল সে। কিন্তু কেউ তাকে জারার মতো সমাদর করেনি। মেয়েটা খুবই ভালো। যেমন সুন্দর তার হাসি, যেমন সুন্দর সে নিজে। ঠিক তেমনই সুন্দর তার মন। কিন্তু আফসোস! এমন সুন্দর মনের অধিকারী মেয়েরাই বুঝি ঠকে যায়? রিয়া দুঃখ শেষে দোয়া করলো যেন জারা ইউভানের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়।
.
গাড়ি ছুটছিল। বাতাস শা শা। ভেতরে এক শীতল সুবাস যেন এদিকে ওদিকে ধাক্কা খাচ্ছে। বের হওয়ার পথ নেই। ইউভান আর জারার বসার আসন খুবই কাছাকাছি। জারা গাড়ির জানালা ঘেঁষে বসে। ইউভান তা খেয়াল করে বলে ফেলে
” গাড়ির জানালা কি তোমার জন্য চৌম্বক হয়ে গেলো?”
জারা কিছু না বলে একটু ইতস্তত করে। খেয়াল করে দেখে তার আর জানালার মাঝে আধা ইঞ্চির তফাৎ। ইউভান তাকে হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নেয়। জারা জবুথবু হয়। ইউভান হাত ছাড়ে না। যেন সে এক মাসের স্পর্শ একদিনে জমিয়ে রাখতে চাইছে। বুকের মধ্যে একটা ছটফট ভাব। হুট করে সে জারাকে আরো একটু কাছে টেনে নয়ে। জারা ভয় পেয়ে ধাক্কা দেয় তৎক্ষনাৎ। মাথা চড়াও হয়। কিন্তু পরক্ষণেই সে নিজেকে শান্ত করে এই ভেবে তরী যেন তীরে না ডোবে। জারার নাকটা গিয়ে আটকে পরে ইউভানের গলার কাছে। শক্ত হাতের বন্ধনী ঠেলেঠুলে জারা নাক একটু সরিয়ে নেয়। এবার তার স্থান পায় ইউভানের কালো শার্টের কলারে। তীব্র এক সুবাস মাথা চক্কর দিয়ে তোলে। ইউভান তখন খুবই মনোযোগী হয়ে বসে আছে। যেন সে মনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। জারার বাড়ির ঠিক সামনে এসে গাড়ি থামায় আমাদ। জারা তৎক্ষনাৎ ইউভান থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। আমাদ এসে দরজা খুলে দিলে জারা প্রায় লাফিয়ে নামে গাড়ি থেকে। তার পিছু নেমে আসে ইউভান। একেবারে জারার ঠিক পেছনে এসে দাঁড়ায়। আমাদ যখন বলে
” আপনার বাসায় এসে গেছি।”
জারা নড়েচড়ে দাড়াতে গিয়ে ধাক্কা খায় পেছনে ইউভানের বুকের সঙ্গে। অপ্রস্তুত হয়ে সামনে এগোতে গেলে ইউভান সঙ্গে আসে। হুট করে কেউ কিছু বলে ওঠার পূর্বেই সে আচমকা চুমু খায় জারার ওড়না দিয়ে ঘোমটা দেওয়া মাথায়। হা হয়ে যায় জারা। বিষয়টা খুব দ্রুত ঘটলো। যেন জারা রেগে যাওয়ার ফাঁকটুকুও পেল না। ইউভান জারার উদ্দেশ্যে বলে
” কোন ছেলের সঙ্গে কথা নয়। কোন ছেলের দিকে তাকানো নয়। বাড়ির বাইরে যাওয়া নিষেধ। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা, ঘুমানোর আগে ফোন করবো। এক সেকেন্ডের মধ্যে ফোন ধরতে হবে। ”
চলবে……