ধোঁয়াশার শেষে পর্ব-১৯+২০

0
204

#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ১৯

ইউভানের কথা কানে বাজতেই জারার ভ্রু জোরা যুগল হয়ে উঁচুতে উঠলো যেন। কি অসামান্য অধিকারবোধ। যেন মনে হয় এই মাত্র জারা ও তার শুভকাজ সম্পন্ন হয়েছে। জারার দু-হাত ইউভানের হাতের দু মুঠোয় বন্দি ছিল। শিরশির করছিল জারার গা। অবশ লাগছিল শরীর। সে মুচড়ে মুচড়ে হাত ছাড়িয়ে নেয়। অতঃপর ইউভান ও আমাদ এর চোখের আড়ালে হাত মোছে ওড়নার ধারে। দ্বিতীয় কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে জারা সম্মুখে হাঁটা দেয়। ইউভান সঙ্গে যেতে চায় তবে আমাদ হাত ধরে ফেলে। কানে ফিসফিস করে বলে

” আপনি গেলে বিষয়টা খারাপ দেখাবে। ওনাকে কথা শুনতে হবে মানুষের কাছে।”

ইউভানের রাগ হয়। সে হাত ছাড়িয়ে নেয় গা ঝারা দিয়ে বলে

” এই মানুষ গুলো আমার প্রেমের বাঁধা। ইচ্ছে করে এদের পৃথিবী থেকে বের করে দেই।”

অসম্ভব আফসোস তার মনে। সেই সঙ্গে দৃষ্টি নিবদ্ধ জারার চলে যাওয়ার দিকে। জারা ক্ষণে ক্ষণে পিছু ফিরে চায়। ইউভান আসছে না বলে তার মন স্বস্তি পায়। সে এলে বাসায় এক কেলেঙ্কারি বেঁধে যেত। তবে একটু আশ্চর্যের বিষয়! নিয়ম না মানা যার অভ্যাস সে আজ নিয়মের বস! ব্যাপারটা ভালো। হয়তোবা কেবল শুধু, শুধুমাত্রই জারার কথা ভেবে। ইউভান তার শখের নারীর জন্য নিয়ম ভাঙতেও রাজি, আবার যেন মানতেও রাজি।

.
জারার বাসা ছিল সড়কের সঙ্গে। বাজার ছেড়ে একটু এগিয়ে অনেকগুলো নির্মিত বাসার মাঝে একটা ছিল। ইউভান গাড়িতে ঠেস দিয়ে ঠোঁট কামড়ে অপলক দেখে গেলো জারাকে। যতক্ষণ না জারা দৃষ্টির আড়াল হলো। এরপর সে চলে গেলো নিজ গন্তব্যে।

বাসার দরজা খোলা ছিল। একবার ধাক্কা দিতেই তা একটু ফাঁক হলে জারা আবার দ্রুত লাগিয়ে দিল দরজা। বুকের মাঝে ঢিপঢিপ করছে। শঙ্কা আর লজ্জায় বারংবার সংকুচিত হয়ে আসছে হাত। মনে হচ্ছে এই মুখ মা-বাবা কে দেখানো বাস্তবিকই কঠিন। এম মুহূর্তে মনে হলো এর চাইতে ঢের সহজ ছিল ইউভানের বন্ধ ঘরে হাশফাশ করে থাকা। চোখে পানি টলমল করে আত্মায় গেঁথে থাকা মানুষগুলোর চেহারা দর্শন করার আগেই। খুব ভয়ে জারা কলিং বেল চাপে। যদিও দরজা খোলাই ছিল। উপমা এসে দরজা খোলে। জারাকে দেখেই সে জড়িয়ে ধরে। দরজা থেকে একটু দূরেই দাড়িয়ে ছিলেন জাহানারা। হঠাৎ বড় মেয়ের চেহারা তার চোখকে আটকে দেয়। মায়া স্থান পায় দুই মিনিটের জন্য। অতঃপর রাগ! ধুপধাপ পা ফেলে চলে যান এখান থেকে। জারার মনে ছিল না আজ শুক্রবার। মা বাসাতেই আছে। জাবেদ ইসলাম বাসাতেই ছিলেন। অবশ্য আর্মি থেকে রিটায়ার্ড হওয়ার পর তিনি বাসায়ই থাকেন। উপমা জারাকে ঘরে নিয়ে আসে। জাবেদ সাহেব ভীষণ রেগে ছিলেন। বড় মেয়েকে দেখেও না দেখার ভান করে টি টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে চলে গেলেন ঘরে। সম্ভবত তিনি পানি খাওয়ার কথাটাও ভুলে গেলেন। জারার চোখ টলমল করে উঠলো। এতোটা উপেক্ষা সে সহ্য করতে না পেরে উপমার পানে তাকিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিল। উপমা তখন ছুটে গেল বাবার কাছে। ছোট খাটো বোঝাপড়া সেরে এসে সে জারাকে নিজ ঘরে ঠাঁই দিল। ভাত সমেত মাংস এনে সামনে রাখলো। জারার চোখের পানি হাতে মুছে দিয়ে সান্ত্বনা দিল। মা বাবার মনে দুঃখ দেওয়ার পর আজ জারা অনুভব করছে তার ভুল। নিজ বাড়িতেই কেমন অতিথি মনে হচ্ছে নিজেকে। ক্ষমা চাওয়ার সাহস টুকুও জোগাতে পারছে না সে।

.
এভাবে উপেক্ষা আর অপেক্ষার খেলা চলল সন্ধ্যা পর্যন্ত। জারা ধীর পায়ে এগিয়ে যায় মায়ের কাছে। ছোট খুকির মতো করেই টলমল আঁখি নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ ডেকে ওঠে মা বলে। জাহানারা সাড়া দেন না। তিনি নিজের কঠিন সত্তা সরিয়ে ফেলতে নারাজ। রান্নাঘরের টুকটাক কাজ যেন তার কাছে এই মুহূর্তে খুবই দামী। জারা অপেক্ষায় না থেকে আচমকা মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। ডুকরে কাঁদে। তার অশ্রু মায়ের শরীর স্পর্শ করতেই কঠিন করে রাখা গলে যায়। জাহানারা স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে থাকেন। উপমা কান্নার শব্দে এসে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ায়। জাহানারা জড়িয়ে ধরে মেয়েকে। জারা ক্ষমা চায় ফোপাঁতে ফোপাঁতে। তার মনের সব দুঃখ কান্না হয়ে বেরিয়ে আসছে। জাহানারা বুঝে উঠতে পারেন না এতো কান্নার কারণ। বলেন

” কি হয়েছে মা? ঠিক আছে ঠিক আছে। আমি রাগ ভেঙে দিলাম। কিন্তু এত কান্না কেন?”

উপমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জারা মাথা তুলে মায়ের দিকে তাকায়। সে যেন প্রস্তুতি নেয় মা’কে সব বলার জন্য।

.
আছরের ওয়াক্তের পরের আকাশটা যেন এক অদ্ভুত বিষণ্নতায় ডুবে থাকে। সূর্য তখনও অস্ত যায়নি, কিন্তু আলোয় মিশে থাকে একরকম ম্লানতা। যেন প্রকৃতিরও মন খারাপ। আজকের বিকেলটা আরও বেশি ভারী, কারণ আকাশের বুক জুড়ে ঘন মেঘ জমেছে।

হালকা বাতাস বইছে, সঙ্গে একটা স্নিগ্ধ ঠান্ডা আমেজ। গাছের পাতাগুলো কাঁপছে ক্ষীণ কম্পনে, মনে হচ্ছে বৃষ্টির অপেক্ষায় আছে। হঠাৎ দূরে কোথাও বিদ্যুৎ চমকালো, কিন্তু শব্দ নেই—শুধু এক ধরনের চাপা প্রতীক্ষা। বাতাসে ভিজে মাটির গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে, অথচ এখনো এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়েনি।

ইউভান জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, এক হাতে তার কফির মগ। চোখ জোরা স্থির আকাশের বুকে।
আজ যেন চারপাশের এই বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব তার ভেতরের ঝড়টাকেও আরও প্রকট করে তুলেছে। সে জানে, বৃষ্টি নামবে। কিন্তু এই মন খারাপ কি ধুয়ে যাবে? নাকি আরও গভীর হবে? জারাকে ছাড়া তার এই কয়েকঘন্টা দম বন্ধ হয়ে আসছে। মানুষ মানুষের সঙ্গে এতেটাও মিশে যায়? ইউভান এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে নিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে। আমাদ কে ফোন করে। জানায় আদেশের সুরে

” জারার পরিবারের ডিটেইলস আমার লাগবে। আজকের মধ্যে। ”

এরপর ফোন কেটে সে চায় কালো হয়ে আসা আকাশের দিকে। বলে উদাস চিত্তে

” তুমি আমার গল্পের সেই অধ্যায় যা বন্ধ করলেও শব্দগুলো বাজতেই থাকে।”

.
দিনের পর রজনী কেটে গেলেও কাটলো না জারার বাবার রাগ। মায়েরা কঠিন ভাব দেখান কিন্তু বাস্তবেই তারা ততটা কঠিন হতে পারেন না। কিন্তু বাবা? এনারা তো সর্বদা শান্ত। আর শান্ত জিনিস ঠিক পর্যায় সারণীর গ্রুপ আঠারোর মতোই। এদের ভাঙা এতোটা সহজ নয়। না ভাঙতে চায় আর না গড়তে চায় কিছু। জাহানারা নিজেও বোঝানোর সাহস করলেন না। একটু সময় দেওয়া উচিত তাকে। তার কষ্টটা হয়তোবা অধিক।

রাতে মেয়েদের নিয়ে ঘুমালেন। জারাকে বোঝালেন জীবন সব জায়গাতেই সুন্দর হতে পারে। কিন্তু লাগবে শুধু আত্মবিশ্বাস। জারা মাথা নাড়িয়েছে। জাহানারার দ্বিতীয় মেয়ে বেশ চালু হলেও জারা খুবই শান্তিপ্রিয়। মেয়েটা জীবনে ঝামেলায় জড়াতে চায়নি। অথচ দেখো, সেই কিনা জীবনের অন্যতম এক কঠিন অধ্যায়ের অংশ হয়ে গেছে।

মেয়ের মন একটু হালকা করতে মা সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে দুই মেয়েকে নিয়ে গেলেন নিজ স্কুলে। সেখানকার হেড টিচার তিনি। ছোট বাচ্চাদের স্কুল। সরকারি প্রাইমারি স্কুলের। জারা ও উপমা সেই ছোট বেলার মতো মায়ের দু’পাশে হেঁটে হেঁটে চলে গেলো স্কুলে। অতঃপর মা অফিস রুমে বসে কাজ করলেন আর জারা উপমার সঙ্গে হাটাহাটি করছিল চারপাশে। স্কুল মাঠটা ছিল বিশাল। উপমা আর জারা খোলা মাঠে ঘাসের ওপর বসে একে অন্যকে মজা করছিল।

” তুমি আমাকে এই মাঠে নিয়ে এসে খেলতে তাই না? ওই যে, একবার কোল থেকে ফেলে দিয়েছিলে আর মা তেমাকে এই মাঠে একশো মিটারের দৌড়ানি দিয়েছিল। হাহাহা”

জারা রেগে তাকায়। কিন্তু উপমার হাসি থামে না। জাহানারা জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলেন মেয়েদের দিকে। চোখ হঠাৎ ঘোলা হয়ে আসে তার। শুধু একটা কথাই বুকে ব্যাথার ও আনন্দ দুইয়েরই অনুভূতি জাগায়। কথাটা খুবই ছোট কিন্তু একজন মায়ের চোখে জল আনার জন্য যথেষ্ট

” আমার মেয়েরা বড় হয়ে গেছে। ”

চলবে….

#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ২০

কিছু মানুষ এমনই খারাপ, যে ডালে বসে সে ডালই কাটে। জারা নিজ বাসায় এসেছে দু’দিন হয়নি। ইতিমধ্যে তাদের ভাড়াটে আন্টিরা তাকে আড্ডার কেন্দ্র বিন্দু বানিয়ে ফেলেছে। বিয়ের দিন পালিয়ে যাওয়া, স্বামীর সঙ্গে দুই মাসের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যাওয়া সবই তাদের জানা। পাশের বাসার আন্টি বলে কথা! জাহানারা উচিত জবাব দিয়েও মুখ বন্ধ করতে পারেন না। বাইরে বের হওয়া মুশকিল হয়। কর্মক্ষেত্রেও টেকা দায়। একই অবস্থা জাবেদ সাহেবেরও। জারা এখন বোঝে পৃথিবী কতটা কঠিন। বেঁচে থাকতে হলে কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। তবুও এভাবেই তার কাটে সাতটা দিন। বাবার সঙ্গে কথা হয় এখন। কিন্তু প্রতিবেশীদের এই জ্বালায় কারো মন ভালো থাকে না।

এতোকিছুর মাঝেও জারা ভুলে যায়নি আমাদ এর কথা। উপমাকে বলে একবার আমাদ এর সঙ্গে যেন সে দেখা করে। উপমা ফোন করে। আমাদ জানায় গুলশান ১ এর আর্ট ক্যাফেতে দেখা করার কথা। উপমার মাথা কাত হয়ে যায়। এতোটা দামী ক্যাফে দেখা করার কারণ?

.
আমাদ এর কাজ ছিল অনেক। ইউভান জীবনে দুটো জিনিস ভালোবাসে। এক তার জারা। আর দুই পেশা। তার ছন্দ হীন জীবনের সবকিছু এই দুটোতেই ছন্দ খুঁজে পায়। কিন্তু কেইসের তথ্য আর তদন্ত করতে হয় আমাদকেও। নতুন একটা কেইস এসেছে। চাচাতো ভাই তার চাচাতো বোনকে ধর্ষণ করেছে। মেয়েটা এই শোকে নিজ প্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করে এখন কোমায় আছে। তবে চিরকুটে লিখে গেছে তার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। কিন্তু বাবা মা দাবি করছে দোষী মেয়েটার চাচাতো ভাই। আমাদ শার্টের শেষ বোতাম লাগিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পৃথিবীটা অনেক নিষ্ঠুর! অনেক। পারফিউমের বোতল হাতে নিতে গিয়ে তার হাত কাপে। দৃষ্টি যায় ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা নীল ছোট বাক্সে। মনে পড়ে মায়ের কথা। তার মায়েরও মৃ*ত্যু হয়েছে এমনই এক কারণে। আমাদ ভাবনা ছেড়ে দ্রুত তৈরি হয়। শেষ ধাপে চশমাটা চোখে দিয়ে আর একবার পরখ করে নিজেকে। নিষ্পাপ একটা মুখ। মাথায় গোছানো এক ঝাঁক লাতানো চুল। ধবধবে তার গায়ের রং। হালকা আকাশি রঙের শার্ট। সে দেখতে ইউভানের চাইতেও যেন কয়েকধাপ বেশি সুন্দর। কিন্তু তা ঢাকা পড়ে থাকে তার নম্রতা, আর লাজুক ভাবে।

দুপুরে সময়। ইউভান গাড়িতে বসে অপেক্ষা করেছিল। তার বাবার পক্ষ থেকে ফোন আসছে ক্রমাগত কিন্তু সে রিসিভ করছে না। সে জানে বাবা তাকে কি বলতে চায়। জারাকে নিয়ে কথা বাড়ানোর ইচ্ছে তার নেই। আমাদ আসে। ইউভান ভ্রু কুঁচকে চায়। বলেই ফেলে

” কোথাও যাবে?”

আমাদ ড্রাইভিং সিটে বসে তার পাতলা ওষ্ঠ আর অধর প্রসারিত করে বলে

” হুম ”

আমাদকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করে না ইউভান৷ সে লুফে নিয়েছে আমাদ এর পেটের খবর। সাবধান বার্তা দেয়

” আগুনের সামনে যাচ্ছো, পানি হয়ে থেকো।”

আমাদে এর কাশি ওঠে। শুকনো কাশি। ইউভান দৃষ্টির হেরফের করে না।

.
জাহানারা স্কুল থেকে এসে জানালেন তার ট্রান্সফার হয়ে গেছে। তিনি এর জন্য দরখাস্ত করেননি কিন্তু হুট করে হয়ে গেছে। পারিবারিক আলোচনা বসে। সকলে এক প্রকার খুশি। বিশেষ করে জারার কারণে। তাকে আর এই বাসায় থেকে কটুক্তি শুনতে হবে না। আর জাহানারার কেবল বদলিই হয়নি। তার পদোন্নতিও হয়েছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার হয়ে গেছেন তিনি। এমন খুশির সংবাদ আর সুযোগে সকলে মেতে উঠলো। তবে পোস্টিং হয়েছে এখান থেকে বেশ দূরে। আমিনবাজার থেকে তাকে গুলশানের দিকে যেতে হবে। ঠিক গুলশান নয়। গুলশানের কাছাকাছি। কাজেই বাসা ভাড়া নিতে হবে। এটা আরেক ঝামেলা। জাবেদ সাহেব পরদিনই বের হলেন বাসার খোঁজে। নতু মাস আসতে আর পাঁচ দিন বাকি। বেশি খুঁজতে হলো না তাকে। এক নির্জন বাসা পেলেন। মেইন সরক থেকে একটু দূরে। তবে এখান থেকে অফিস কাছে হবে। আবার কিনা মেয়েদের থাকার জন্য উপযুক্ত হবে। চোর ছ্যাচড়ার ভয় নেই উপরন্তু বড় মেয়ে। তার বড় মেয়ের ধারে কাছে কেউ এসে সমালোচনা করতে পারবে না।

বাসায় এডভান্স করে দিয়ে তিনি চলে এলেন নিজ বাড়িতে। জারা ও উপমা রান্না করছিল। আজ বাড়িতে এলাহি আয়োজন। কেন? মায়ের পদোন্নতির কারণে। এক হাসিখুশি পরিবার মুহূর্তেই মেতে উঠলো।

.

বাসা পরিবর্তনের দিন জারা ও তার পরিবার সব জিনিসপত্র নিয়ে নতুন ঠিকানায় হাজির হয়। কিন্তু নতুন বাসা দেখে জারার চোখ কপালে ওঠে! হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে যায় তার। ইচ্ছে হয় দৌড়ে পালিয়ে যায় এখান থেকে।
সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে খাট, পালঙ্ক, বাক্স-প্যাটরা আর কাপড়ের স্তূপের সামনে।
সামনে বিশাল সাইনবোর্ড— “ইউভান রেসিডেন্স”।

আবারও! আবারও কিনা এই বাসা?!

মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না জারা, শুধু নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কোনোভাবে বাবার কানে কানে ফিসফিস করে জানতে চায়,

“টাকা দিয়েছো? মানে ভাড়া?”

বাবা নির্বিকার কণ্ঠে উত্তর দেন,

“হ্যাঁ, ত্রিশ দেওয়া হয়েছে।”

জারার মাথায় যেন বজ্রপাত হয়। ত্রিশ?! তার মানে এখান থেকে পালানোরও উপায় নেই? উপমাকে ধাক্কা দেয় জারা। উপমা হা হয়ে দেখতে ব্যস্ত নিজেদের থাকার জায়গা। তিন তলার একটা বিশাল আলিশান ভবনের পাশে আছে একটা ছোট ডুপ্লেক্স বাসা। এটাই নাকি তাদের ভাড়া বাসা। উপমার মুখ বন্ধ হচ্ছে না। সে এটাও বুঝতে পারছে না ভাড়ার টাকা কম হয়েছে নাকি বেশি।

গেইট খুলে দেওয়া হয়। জারা ভাবলো সে এই তল্পিতল্পা কোনো রকমে বাসায় ঢুকিয়ে দিয়ে দৌড় দেবে উল্টো পথে। সে বরং আমিনবাজারই থাকবে।

.
সব জিনিস গুছিয়ে নেওয়ার সময় আমাদ আসে। সাহায্য করে নিজ থেকেই। উপমার সঙ্গে কথা হয় তার। ক্যাফে দেখা করতে গিয়ে তেমন কথা বলা হয়নি। উপমা পাঁচ মিনিটের মাথাতেই বেরিয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত তখন তার বাসা থেকে ফোন এসেছিল। আমাদ যখন ফার্নিচার নিয়ে আসা লোকদের জায়গা নির্দিষ্ট করে দিচ্ছিল, জারার বাবাকে বলছিল বাসা সম্পর্কে। তখনই তার জারার সঙ্গে একটা নীরব যুদ্ধ হয় চোখে চোখে। জারা যেন পারলে তখনই আমাদ কে বাঘের খাঁচায় দিয়ে আসে। সন্ধ্যা নামে। আলো সূর্য ডুবে চাঁদ হেঁসে ওঠে। জারার আর বাসায় পৌঁছানো হয় না। উপমা নিজ ঘর গোছানো নিয়ে ব্যস্ত। সে যে এখন ইউভানের বাসায় আছে তার বড় বোনের যে এখন উর্ধশ্বাস উঠে গেছে সে বিষয় জেনেও সে নির্বিকার। সবকিছু স্থির হলে জারা উপমার ঘরে যায়। উপমা ফুলদানি সাজাচ্ছিল। জারা পাশে বসতেই সে ময়লা হাতে অগোছালো চুল গুছিয়ে নিয়ে বলে

” দেখ, কিছু করার নেই। আমরা যতোই ঘ্যান ঘ্যান করি মার কাছে যে এখানে থাকব না, ততই অযৌক্তিক হবে এটা। থেকে যা এখানেই। ব্যারিস্টার ভালো আছে আপু। তোর ইজ্জত নিয়ে কিন্তু টানাটানি করে না। সাইকো হলেও ভদ্রলোক।”

একমাত্র দুঃখের সঙ্গী থেকে এমন সান্ত্বনা শুনে জারা গাল ফুলিয়ে কিছুসময় তাকিয়ে থাকে। উপমা দ্বিতীয় কিছু বলে না। ইউভান বড্ড চালাক। তার মন বলছে হুটহাট বদলির পেছনে এই ইউভানই আছে। সুপার গ্লুর মতো লেগে আছে সে জারার পেছনে। পৃথিবী কেন, মঙ্গল গ্রহেও যদি জারাকে রেখে আসা হয় ইউভান ঠিকই হাজির হবে। অতঃপর জারার হাতটা ধরে বলবে

” আমি এসে গেছি জারা।”

.
ঘরে ফিরে গুমোট মুখে জারা বিছানা তৈরি করে। রাত বেশ হয়েছে। চোখে ঘুম নেই তবুও বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সে। হালকা শীতল বাতাস বাহিরে। ছাদ বারান্দার থাই গ্লাস খোলা ছিল। জারা যখন বিছানায় শুয়ে পরে ঘরের লাইট অফ করে, বন্ধ করে চোখ তখনই তার মনে হয় দ্বিতীয় কেউ উপস্থিত এখানে। যার নিশ্বাস আছড়ে পড়ছে জারার চোখেমুখে। তীব্র এক ঘ্রাণ নাকে ধাক্কা খাচ্ছে। জারা দ্রুত চোখ মেলে। আধো আলো, আধো অন্ধকারে চোখের সামনে বসে থাকতে দেখা যায় এক অবয়বকে। জারা দ্রুত বেড সাইডের দেয়াল হাতড়িয়ে লাইটের সুইচ অন করে। তখনই অক্ষিপটে স্থির হয় ইউভান। সে ঝুঁকে আছে কিছুটা। সিল্ক চুলের এলোমেলো গোছা তার কপালে। চোখে তার মোহ। ঠোঁটে হাসি। জারা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। ইউভানের চোখের পলক পড়ে না। যেন মনে হয় পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর দৃশ্য সে দেখছে।

চলবে…..