#চারুলতা_তোমার_জন্য
#৫ম_পর্ব
সকাল থেকে অঝরধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। থাইগ্লাস ঝাপসা হয়ে গেছে বারির ঝাপটায়। ঢাকা শহরে রাজপথে জলকেলী করছে ছোট ছোট কিছু শিশু। খালি গায়ে তারা নেমে গেছে রাজপথে। ঠাণ্ডা, জ্বরের চিন্তা নেই তাদের। জমে থাকা পানিতে তারা মনখুলে লাফাচ্ছে, পানি ছোড়াছুড়ি করছে, কেউ স্লাইড খাচ্ছে। দৃশ্যটি নিষ্পাপ। খালি গায়ে জীর্ণ শরীরের চার-পাঁচটি ছেলে জগতের সকল মূর্ছনাকে ভুলে মনের আনন্দে খেলছে। পৃথিবী তাদের কেবল দুঃখ দিয়েছে অথচ তারা পৃথিবীর সেই দুঃখের মাঝেও নিজেদের জন্য সুখ খুঁজে নিচ্ছে। সাততলা অট্টালিকা থেকে এই দৃশ্যটি দেখছে চারু। বাচ্চাগুলোকে তার পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো সে। এমন নিশ্চিত সেও হতে চায়। কিন্তু বিগত তিন দিন যাবৎ তার মনের শান্তি হাপিস হয়ে গেছে। ঘুম হচ্ছে না। এই দুশ্চিন্তার কারণ অবশ্যই শ্রাবণ তালুকদার। লোকটি বদলা নিবে, সুদে আসলে নিবে। কিন্তু সেই বদলার দিনক্ষণ ঠিক হয় নি। শ্রাবণ তালুকদার জিলাপি প্রজাতির মানুষ। চারু তাকে বুঝতে পারে না। তাই তার মস্তিষ্কে কি চলছে তা সে অনুমান করতে পারে না। তবে তার ধারণা লোকটি তার অস্থিমজ্জা জ্বালিয়েই শান্ত হবে। তাই চারুও অত্যন্ত সতর্ক হয়ে গেছে। সে কোনোপ্রকার ভুলভ্রান্তি করছে না। সে জল্লাদকে সুযোগ দিতে চায় না। সেদিনে ফাইলের গন্ডোগোলের পর থেকে লোকটি অত্যন্ত ক্ষেপে আছে। বলা যায় না কখন যে ক্ষুধার্ত বাঘের মত হামলা করে বসে। চিন্তার সুতো কাঁটলো যখন ফোনে এলার্ম বাজলো। জল্লাদের খাওয়ার সময় এখন। মাঝে মাঝে মনে হয় সে জল্লাদের সেক্রেটারি নয়, তার কাজের লোক। সময় করে তাকে খাওয়াতে হবে, ঔষধের সময়ের খেয়াল করিয়ে দিতে হবে। খাওয়ার সময় তার নকটামি আছে সেগুলোও সহ্য করে নিতে হবে। যন্ত্রণা কত প্রকার হয় হাড়ে হাড়ে টের পায় সে।
একটি প্লেটে খাবার সাজিয়ে চারু শ্রাবণের রুমে প্রবেশ করলো। শ্রাবণ তখন ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে ছিলো। কপালে প্রগাঢ় ভাঁজ। কিছু নিয়ে সে চিন্তা করছে। চারু মৃদু স্বরে বললো,
“স্যার, আপনার লাঞ্চ এবং মেডিসিনের সময় হয়ে গেছে”
“হু”
শ্রাবণ শুনেছে কি না সন্দেহ। চারু রুমের এক কোনায় টি-টেবিলের উপর খাবারগুলো রেখে বললো,
“স্যার, দেরি করবেন না। খাবার ঠান্ডা হলে তখন আপনার আবার খেতে ইচ্ছে করবে না”
বলে চলে যেতে ধরলে শ্রাবণ ভারী স্বরে ডাকলো,
“মিস মেহেনাজ?”
“জি স্যার?”
“আগামী সপ্তাহে আমাদের কোম্পানির বর্ষপূর্তি জানেন তো?”
“জি”
“আপনার জন্য একটি কাজ আছে। এই বর্ষপূর্তি উপলক্ষে একটি পার্টি অরগানাইজ করতে হবে। এই পুরো পার্টির দায়িত্ব আমি আপনাকে দিচ্ছি। হোটেল বুকিং, ইনভাইটেশন, মেন্যু প্রতিটি দায়িত্ব আপনার। আমাদের যত লয়াল ক্লাইন্ট, আমাদের ডিলারস সবাইকে ইনভাইট করবেন। ডোন্ট ফরগেট এবাউট রাইভেলস”
“মাত্র এক সপ্তাহ? এতো কম সময়ে?”
বিভ্রান্ত স্বরে শুধালো শুধালো চারু। শ্রাবণ ভ্রু কুচকে কঠিন স্বরে বললো,
“এনি প্রবলেম মিস মেহেনাজ?”
“নাহ, কি প্রবলেম হবে! কিন্তু স্যার…”
“আবার কি কিন্তু?”
“রাইভেলদের ইনভাইট করার কি দরকার বলুন? তারা তো আমাদের ভালো চায় না। অহেতুক একটা গ্যাঞ্জাম হবে। গতমাসে টেন্ডার নিয়ে অলরেডি একটা ঝামেলা হয়েছিল। তাই বলছিলাম যে, তাদের না ইনভাইট করে আমাদের কোম্পানীর সাথে যাদের রিলেশন ভালো তাদেরকেই বলি?”
“তাহলে তো বাজ হবে না”
“মানে?”
শ্রাবণ ধারালো স্বরে বললো,
“যারা আমাদের ওয়েলউইশার তারা তো প্রশংসা করছেই, সেই সাথে আমি চাই আমাদের রাইভেলদের গায়েও মরিচ ডলে দিতে। আমাদের কোম্পানিটি খুব পুরোনো নয়। এর মধ্যেই এই ইন্ডাস্ট্রিতে আমাদের একটা নাম হয়েছে। এটা অবশ্যই তাদের জানানো উচিত। আর মেক শিউর, পার্টিটা যেন গ্রান্ড হয়”
“জি স্যার”
দুপাশে মাথা হেলিয়ে উত্তর দিলো চারু। সে চলে যেতে নিলে শ্রাবণ ডেকে উঠলো,
“মিস মেহেনাজ?”
“জি”
চারুর কণ্ঠ মিয়ে গেলো। শ্রাবণ চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে এলো। দাঁড়ালো ঠিক চারুর মুখোমুখি। সামান্য ঝুঁকে উপহাসের স্বরে বললো,
“পার্টিতে কোনো ঝামেলা হলে সেটার রেসপন্সিবিলিটি কিন্তু আপনার। আর এবার আমি কিন্তু ছেড়ে দিব না”
চারুর গলা শুকিয়ে এলো। ভীত স্বরে বললো,
“কোনো ঝামেলা হবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন”
“সেটা সময় আসলেই বোঝা যাবে”
“আপনি আমার যোগ্যতায় আঙ্গুল তুলছেন?”
“আঙ্গুল না হাত, আমি আপনার যোগ্যতায় হাত উঠিয়ে নিচ্ছি। আসলে আপনি খুব আনপ্রেডিক্টেবল কি না। যাক গে, আমি আপনার আকাশতূল্য যোগ্যতা দেখার অপেক্ষা করবো। আই হোপ আপনি আমাকে হতাশ করবেন না”
চারুর গা জ্বলে গেলো। রীতিমত তাকে তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে। ফলে কিড়মিড়িয়ে বললো,
“স্যার, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি আপনাকে হতাশ করব না”
“হোপ সো”
শ্রাবণের কণ্ঠে এখনো উপহাস। চারুর রাগ হচ্ছে। লোকটি কি মনে করে? সে অযোগ্য কেউ? অযোগ্যই যদি হবে তবে চাকরি দিয়েছে কেন? নেহায়াত তার বেতনটা অনেক বেশি। বেতন বেশি না হলে কখনোই সে এই লোকের সাথে কাজ করতো না। চারু কঠিন স্বরে বললো,
“আপনি একটা পুরোদস্তর অসহ্য”
শ্রাবণ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। কৌতুক স্বরে বললো,
“শুনতে পারছি না। এতো নিচ থেকে কথা শোনা যায় না। নিজের টাওয়ার লাগান তারপর না হয় গাল্লান”
চারুর রাগে শরীর জ্বলছে। লোকটির খাবারে জামালগোটা মিলিয়ে দেওয়া যেত? শান্তি লাগতো।
****
বর্ষপূর্তির প্রস্তুতিতে চারুর অবস্থা নাজেহাল হয়ে গেলো। ডিলারস, ক্লাইন্ট সবাইকে বিশেষভাবে নিমন্ত্রণ করা, একটি জাকজমকপূর্ণ হোটেলের বুকিং, ডেকোরেশন, খাবার। এই সবকিছুর সাথে সাথে পুরো অনুষ্ঠানের খরচের হিসেব রাখা। চুলপরিমাণ ভুল করা যাবে না। মান সম্মানের ব্যাপার। এইচ.আরের সাথে স্টাফদের বোনাস নিয়ে কথা হয়েছে। বর্ষপূর্তি উপলক্ষে প্রতিবছর তাদের বেতনের ১০% বোনাস দেওয়া হয়। যদিও ব্যাপারটি সামান্য কিন্তু এই বোনাস সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে একাউন্ট অফিসার এবং এইচ.আরের সাথে তার দুবার মিটিং এ বসতে হয়েছে। ফলে কাজের যাতাকলে তার অবস্থা দূর্বিষহ।
“আপনি এখনো বাড়ি যান নি মিস মেহেনাজ?”
চমকে উঠলো চারু। ইনভাইটেশন কার্ডের শেষ ড্রাফট ফাইনাল করছিলো সে। ভুত দেখার মতো ঘাবড়ে বললো,
“জি?”
শ্রাবণের চোখ ছোট ছোট হয়ে গেল। চারু ইতস্তত স্বরে বললো,
“স্যার অল্প কিছু কাজ বাকি আছে”
“এখন দশটা বাজে। আপনার বাসায় যাওয়া উচিত”
চারু ঘড়ির দিকে চাইলো সত্যি দশটা বাজে। কিন্তু কাজগুলো না শেষ করতে পারলে তার-ই ঝামেলা হবে। সামনের দিনের কাজের স্তুপের সাথে জড়ো হয়ে বিশাল আকার ধারণ করবে। যন্ত্রণা হবে আলাদা। চারু ধীর স্বরে বললো,
“স্যার আর আধা ঘন্টা লাগবে। তারপর আমি চলে যাচ্ছি”
শ্রাবণ তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইলো। তার দৃষ্টির তীক্ষ্ণতায় চারুর গলা শুকিয়ে এলো। ভাবলো কটুক্তি এলো বুঝি। কিন্তু এমন কিছুই হলো না। শ্রাবণ একটি চেয়ার টেনে বসলো। বিরক্তি মাখানো স্বরে বললো,
“আধা ঘন্টার যেন এক মিনিট দেরি না হয়”
“স্যার, আপনি যেতে পারেন। খামোখা আমার জন্য কেন অপেক্ষা করবেন?”
“সেটা আপনার বলতে হবে না। নিজের কাজ করুন। কচ্ছপও আপনার থেকে দ্রুত কাজ করে”
কঠিন স্বরে উত্তর দিলো শ্রাবণ। শেষ বাক্যটির অপেক্ষাই করছিলো চারু। করলার থেকে তেঁতোভাব ছাড়া কিছু আশা করাও অন্যায়। চারুর মনে হয় শ্রাবণের শিরা উপশিরায় রক্ত না করলার জুস প্রবাহিত হয়। তাই তো এতোটা তেঁতো সে। কাজ শেষ করতে করতে এগারোটা বেজে গেলো। ল্যাপটপ বন্ধ করতে করতে চারুর নজর গেলো শ্রাবণের দিকে। বুকে হাত বেঁধে চোখ বুজে রয়েছে সে। ঘুমোচ্ছে? হয়তো। লোকটি কম পরিশ্রম তো করে না। এতো সময়ে তার বাড়িতে থাকার কথা ছিলো। কিন্তু সে চারুর জন্য অপেক্ষা করেছে। চারু কিছুসময় চেয়ে রইলো শ্রাবণের শান্ত মুখশ্রীর দিকে। লোকটিকে বালক বালক লাগছে। সেদিন যখন সে জ্ঞান হারিয়েছিলো তখনও তাকে এমন শান্ত লেগেছিলো। শ্যাম সৌম্য মুখশ্রী, খাড়া নাক, দীর্ঘ নেত্রপল্লব, ধারালো চোয়াল। লোকটি সুদর্শন বটে। ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে যতটা মানুষের মত লাগছে সজাগ অবস্থায় ততটাই জল্লাদের মত লাগে। সারাদিন লোকটির প্রতি তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করলেও এখন কেনো যেন চোখ সরাতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে গ্রীক দেবতা তার সামনে বসে রয়েছে। হাতে তানপুরা থাকলে হয়তো রাগ বাজতো। কিসের রাগ হত সেটা? নিশ্চয় রাতের রাগ। চারুর ইচ্ছে হলো কিছু সময় লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকতে। মায়া লাগছে তার। ডাকতে ইচ্ছে করছে না। খেয়াল করলো শ্রাবণের নাকের উপর একটি চোখের পাঁপড়ি এঁটে আছে। নিঁখুত সৌন্দর্যে দাগের মত লাগছে। তাই হাত আপনাআপনি সৌন্দর্য্যকে নিপুন করতে এগিয়ে গেলো। তখনই খপ করে হাতখানা ধরে ফেললো শ্রাবণ। আচমকা চোখ খোলাতে চারু বিভ্রান্ত হলো। শ্রাবণের চোখের দৃষ্টি হিংস্র। চারুর বুক ধক করে উঠলো। শক্ত বেষ্টনিতে তার হাত আবদ্ধ। হাতের জোরে মনে হলো চারুর হাতটা ভেঙ্গে যাবে। চারু ম্রিয়মান স্বরে বললো,
“স্যার আমি”
কঠিন দৃষ্টি নরম হলো। হাত ছেড়ে দিলো সে। স্বাভাবিক স্বরে বললো,
“চলুন”
***
চারুর মা বারান্দায় পায়চারি করছেন। মেয়ে এখনো ঘরে ফিরে নি বিধায় তার চিন্তায় ভেতরটা মিয়ে গেছে। দিনকাল ভালো না। ঘড়িতে সময় সাড়ে বারোটা। এখন পুরুষেরাও এতো রাতে বের হতে চায় না। সেখানে চারু একজন যুবতী মেয়ে। অঘটন ঘটতে সময় লাগে না। খবরের কাগজ খুলতেই একটা না একটা দুঃসংবাদ। দুঃসংবাদের ভিড়ে এখন খবর পড়াই হয় না। চারুর মা বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। চারুর বাবার ক্ষীন স্বর কানে আসছে,
“মেয়েকে আরোও লায় দেও। চাকরি করাতে হবে কেন শুনি? আমার মতে মেয়ের এখন বিয়ে হওয়া দরকার। ভালো পাত্র এখন পাচ্ছি। ভবিষ্যতে নাও পেতে পারি”
কথা তো ঠিক-ই। কম বয়সী মেয়েদের যতটা মূল্য বয়স বেড়ে গেলে সেই মূল্য থাকবে না। ভাবনার সুতোয় টান লাগলো বাড়ির গেটের বড় কালো স্করপিও গাড়িটি দেখে। চারু গাড়ি থেকে নামলো। সেদিনও এমন একটি বড় গাড়িতে সে এসেছিলো। নিশ্চয়ই তার বসের গাড়ি এটা। মধ্যবিত্ত মানুষ চারুরা। একে মেয়ে দেরি করে বাড়ি ফিরে বিধায় নানাবিধ কথা শুনতে হয়। উপর থেকে এমন বসের গাড়ির ব্যাপারটি নিয়েও কম কানাঘুষা হয় না। মেয়েটাকে দু-তিনবার বলা হয়েছে। কিন্তু সে উদাসীন স্বরে বলে,
“মা এটাই আমার কাজ। কি করবো”
চারুর মা সিদ্ধান্ত নিলেন এবার চারুর একটা ভালো বিয়ে দিতে হবে। বিয়ে দিলে অন্তত রোজরোজ কেচ্চা রটবে না।
***
বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে কোনো কমতি রাখে নি চারু। খুব নামকরা হোটেলে পার্টি রেখেছে সে। কোম্পানির প্রিমিয়াম ক্লাইন্ট, ডিলারস থেকে শুরুর করে উচ্চবর্গীয় মানুষের আনাগোনা সেখানে। চারুর এমন দারুন ব্যবস্থাপনায় প্রশংসাও কামিয়েছে সে। শ্রাবণের প্রশংসা যদিও তার নসিবে জুটে নি। কিন্তু অফিস কলিগ, স্টাফ সবাই তার বাহবা করেছে। আজ চারু সুন্দর করে সাজগোজ করেছে। মার একটি লাল শাড়ি পড়েছে সে। যদিও শাড়িটি খুব দামি নয়। কিন্তু মা যত্ন করে রেখেছেন বিধায় উজ্জ্বলতা হারায় নি। চোখে কাজল দিয়েছে। ঠোঁটে হালকা লিপ্সটিক। যতই হোক উচ্চবর্গীয় মানুষদের আনাগোনা এখানে। তার বেশভূষাও মানানসই হতে হবে। অতিথিদের একটু পর পর খাতিরদারি করছে সে। তন্মধ্যে একজন বলে উঠলো,
“শ্রাবণ লাকি যে আপনার মত পটু সেক্রেটারি পেয়েছে। আচ্ছা, আমি যদি আপনাকে বেশি স্যালারি অফার করি তবে কি আপনি আমাদের কোম্পানি জয়েন করবেন?”
চারুর প্রস্তাবটি পছন্দ হলো না। কারণ প্রস্তাবটি তাদের কোম্পানির শত্রু কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর সজীব ইসলাম দিয়েছে। সজীব মোটেই তার যোগ্যতার জন্য তাকে প্রস্তাব দিচ্ছে না। এই প্রস্তাবটির পেছনের কারণ শত্রুর তথ্য যোগাড়। সেক্রেটারির কাছে বসের সকল ধরণের তথ্য থাকে। গোপনীয় তথ্য থেকে শুরু করে কোম্পানির দূর্বলতা সব কিছুই থাকে তাদের নখদর্পনে। সুতরাং চারুর মাধ্যমে এই তথ্যগুলো পাওয়া যাবে। ফলে টেন্ডারের যুদ্ধে শ্রাবণকে হারানো যাবে। চারু মিষ্টি গলায় বললো,
“আপনি আমাকে শুধু শুধু তালগাছে তুলছেন। একজন দুমাসের সেক্রেটারি কি বা কাজ পারে বলুন। বরং আমাকে চাকরিতে নিলে আপনার লস হবে। সে মানুষ একটি কোম্পানিতে দুমাস কাজ করতে পারে না, সে মানুষকে অধিক অর্থের লোভ দেওয়া নির্বুদ্ধিতার কাজ। আমি জানি আপনি অনেক বুদ্ধিমান মানুষ”
“বিউটি উইথ ব্রেনও আছে দেখছি। আই মাস্ট সে শ্রাবণ লাকি। তবে আমার অফার কিন্তু এখনো ওপেন”
“সরি স্যার, আমি এতোটা কনফিডেন্ট নই। প্লিজ কোনো অসুবিধা হলে বলবেন”
মিষ্টি গলায় তাকে সজীবের প্রস্তাবকে না বললো। লোকটিকে তার পছন্দ নয় চারুর। কেমন একটা ছোঁকছোঁক ভাব আছে। শুধু সুযোগ পেলে ছোঁয়ার মতলব করে। শ্রাবণকে অসভ্য ভাবলেও এই দুমাসে কখনো সে তার সাথে বেয়াদবি করে নি। ফলে লোকটির সাথে কাজ করতে এখন অস্বস্তিবোধ হয় না। কিন্তু এই সজীব নামক ব্যক্তির চাহনীই খুব নোংরা। না চাইতেও গলায় বিঁধে। মনে হয় চোখ দিয়ে তাকে নোংরা স্পর্শ করছে। চারু চলে যেতে নিলেই সজীব তার হাত ধরলো। মুখে নোংরা হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“অতিথিদের মনোরঞ্জনের কোনো ব্যবস্থা আছে নাকি শুধু ডেকোরেশন?”
চারু হাতটা কোনমতে ছাড়িয়ে বললো,
“মন্ত্রীসাহেব হয়তো এসে গেছেন। আমি একটু আসছি”
তখনের জন্য কোনো মতে পিছু ছাড়ালো চারু। অনুষ্ঠানের মেইন গেস্ট হিসেবে একজন মন্ত্রীর নিমন্ত্রণ ছিলো। তিনি আসতেই অনুষ্ঠান শুরু হলো। শ্রাবণ সকলের উদ্দেশ্যে কিছু বললো, বিশেষ করে নিজের স্টাফদের ধন্যবাদ জানালো। যতই হোক, তার কোম্পানির মূল যোদ্ধারা তো তার স্টাফ। কয়েকটা স্লাইডশো হলো। এরপর খাওয়া দাওয়ার কার্যক্রম শুরু হলো। শ্রাবণ ব্যস্ত হয়ে গেলো অতিথিদের সাথে। এসব পার্টিতেই অনেক ডিল পাওয়া যায়।
অনুষ্ঠানের মধ্যে সবাই যখন মগ্ন, চারু একটু হাওয়া খেতে ব্যালকনির দিকে এলো। পা ব্যথা করছে। উচু স্যান্ডেল পড়া উচিত হয় নি। এতোবার সিড়ি বাইতে হয়েছে সে এখন আফসোস হচ্ছে। জুতোজোড়া খুলে একপাশে রাখলো সে। কালো আকাশে পূর্ণচন্দ্রিমা। জ্যোৎস্না দুধ-সাদা আলো তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। তন্মধ্যেই মনে হলো কেউ তার কোমড়ে হাত রেখেছে। সাথে সাথে গায়ে কাঁটা দিলো। চমকে উঠলো চারু। নাকে তীব্র মদের কটু গন্ধ আসছে। পেছনে ঘুরতেই দেখলো সজীব দাঁড়িয়ে। চারু হাত ঝাড়া দিলো তার। সজীব নিরুদ্বেগ স্বরে বলল,
“ভয় পেয়েছিলে?”
“স্যার, আমার এমন গা ঘেষাঘেষি পছন্দ নয়”
“ডোন্ট টেল মি, শ্রাবণ তোমার সাথে এমন করে না”
“সরি?”
“সেক্রেটারিদের সাথে বসের কেমন সম্পর্ক থাকে সেটা সবার জানা। সারাদিন একসাথে নিশ্চয়ই কিতকিত খেলো না”
চারুর ইচ্ছে হলো লোকটাকে চড় মেরে তার মুখ ভেঙ্গে ফেলতে। যেন এমন নোংরা কথা আর না বলতে পারে। কিন্ত একটি অনুষ্ঠান চলছে, লোকটি তাদের অতিথি। কিছু বললেই ঝামেলা হবে। উপরন্তু লোকটি নেশা করেছে। মাতালদের সাথে বেশি কথা বলা ঠিক নয়। চারু এড়িয়ে যেতে চাইলে সজীব তার হাত টেনে ধরে বললো,
“তোমাকে প্রথম দেখাতেই আমার ভালো লেগেছে। এমন পুতুলের মতো সেক্রেটারি হলে আমিও সাধু পুরুষ হতাম না। শ্রাবণ যে সাধু পুরুষ নয় আমি জানি। তাই তোমাকে বলছি, কত দেয় তোমাকে?”
“স্যার হাত ছাড়ুন”
“যদি না ছাড়ি”
“থাপড়ে আপনার দাঁত ফেলে দিব। এতক্ষন চুপ করে আছি বলে মনে করবেন না আমি দূর্বল”
“তাই নাকি?”
বলেই চারুর সাথে অসভ্যতা শুরু করলো সে। তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাবার চেষ্টা করলো সজীব। চারু তাকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চাইলে প্রথমে পারলো না। কারণ পুরষ মানুষের শক্তির কাছে ক্ষুদ্র মেয়ে মানুষের কি শক্তি? সজীব তাকে নোংরাভাবে স্পর্শ করার চেষ্টা করলে সে পায়ে সজোরে লাথি বসিয়ে দিলো। মাতাল সজীব একটু বেসামাল হলো। সে সুযোগে ঠাটিয়ে চড় বসালো চারু। আকস্মিক চড়ে সজীবের সৎবিৎ ফিরলো। সে কঠিন নয়নে তার দিকে তাকালো। চারু রোষমিশ্রিত স্বরে বললো,
“আর একবার আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করলে তোর মুখ ভেঙ্গে দিব হারামজাদা”
মাতাল হবার দরুন সজীব পালটা উত্তর দেবার সুযোগ পেলো না। সে নিজেকে সামলাতে সামলাতেই চারু সেখান থেকে চলে গেলো। ফলে আহত হিংস্র জানোয়ারের মত গজরাতে গজরাতে বললো,
“শালী তোকে দেখে নিব”
চারুর আর পার্টিতে থাকতে ইচ্ছে হলো না। সে তখনই বাসায় চলে গেলো। সারা গা কাঁটা দিচ্ছে। গা গোলাচ্ছে। মনে হচ্ছে বিষপোঁকা তাকে কামড়েছে। এতো জঘন্য অনুভূতি এই প্রথম হয়েছে তার। যদি সত্যি কোনো অঘটন ঘটতো? কি হতো তখন। নিজের সভ্রমহানির থেকে ভয়ংকর আর কি হতে পারে? সেদিন রাতে দীর্ঘসময় ধরে সে গোসল করলো। সারা গা ধুলো সাবান ঘষে ঘষে। তার মনে হলো তার গায়ে এখনো ময়লা লেগে আছে। রাত কাটলো একেবারে নির্ঘুম। সকালে শ্রাবণকে ফোনে জানালো,
“স্যার আমি অসুস্থ। আজ আসবো না। আপনাকে এপ্লিকেশন পাঠিয়েছি”
শ্রাবণ “হু” বলে ফোন রেখে দিল। চারু মন ভালো করতে মোবাইল হাতে নিলো। ফেসবুকের ফিড খুলতেই দেখলো একটি খবর। দূর্ঘটনার খবর। মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালানোর জন্য রাজপথে একটি গাড়ি এবং ট্রাকের সংঘর্ষ। সংঘর্ষে শিল্পপতী নুরুল ইসলামের পুত্র সজীব ইসলামের মৃত্যু……………
চলবে