চারুলতা তোমার জন্য পর্ব-১০

0
20

#চারুলতা_তোমার_জন্য
#১০ম_পর্ব

চারুর পা চলতে চাইছে না। তার স্থির দৃষ্টি দেখছে রুশানকে। রুশানের বুকে মাথা রেখে একটি মেয়ে বসে রয়েছে। বুকের উপর আঙ্গুল বুলাচ্ছে। অথচ রুশানের সেদিকে কোনো হুশ নেই। নেশার প্রবল ঘোর তাকে এতোটাই আঁকড়ে ধরেছে যে চোখ অবধি খুলতে পারছে না। চারুর মন মস্তিষ্ক নিশ্চল হয়ে গেছে। চিন্তাশক্তি কাজ করছে না। ভোঁতা যন্ত্রণায় ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। তাদের বিয়ের আর মাত্র একটি দিন বাকি। অথচ এমন বীভৎস, তিক্ত দৃশ্যের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। রুশান তাকে ব্যবহার শুধু করে নি, সে তাকে রীতিমত ঠকিয়েছে। নিজেকে এতটা তুচ্ছ কখনো মনে হয় নি চারুর। বিভ্রান্ত মনটা এতোকাল মরীচিকার পেছনে ছুটেছে। চারু ভেবেছিলো, নিয়তি তাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিচ্ছে। যে ভালোবাসা তাকে সুখ দিত সেই ভালোবাসা এখন গলায় ছুরির মতো বিঁধছে। বিষাক্ত অনুভূতিতে চোখ জ্বলছে। কিন্তু কাঁদলো না চারু। তার উত্তর চাই। এতো বছর পর কেন তার বিশ্বাসকে ভাঙ্গতে হলো রুশানের? কিসের লোভ? টাকা?

চারু এগিয়ে গেলো। দাঁড়ালো ঠিক রুশানের মুখোমুখি। সে সোফায় ঘাড় এলিয়ে আছে। তার বুকের উপর মুখ গুজে থাকা মেয়েটির সাথে চোখাচোখি হতেই মেয়েটি বিদ্যুৎপৃষ্টের মত চমকে উঠলো। উঠে গেলো রুশানের বুক থেকে। রুশান তখন প্রায় হুশহীন। চারু সামনের কাচের টেবিলের উপর রাখা তরলভর্তি গ্লাসটা হাতে দিলো। সকলকে অবাক করে সেই তরল ছুড়ে মারলো ঠিক রুশানের মুখ বরাবর। হঠাৎ এমন তরলের আক্রমণে চমকে উঠলো রুশান। চোখ মেলে চাইলো চারুর দিকে। চোখ কচলালো। ঠাহর করার চেষ্টা করলো পরিস্থিতি। চারু পাথর স্বরে বললো,
“হুশ এসেছে নাকি আরো ডোজ লাগবে?”

তার চোখ রাগে জ্বলজ্বল করছে। মুখখানা কঠিন। রুশান ভ্যাবলার মতো চেয়ে রইলো চারুর দিকে। তার সামনে আদোপি চারু কি না বুঝতে পারছে না। চোখ কচলে তাকালো। ততসময়ে তীব্র সাউন্ডের গান বন্ধ হয়ে গেছে। উপস্থিত সকলের নেশাতুর চোখ সোফার দিকে। বিনা পয়সায় নাটক দেখতে বাঙ্গালীর বড্ড আগ্রহ। রুশানের সৎবিৎ ফিরলো আরোও পাঁচ-ছ মিনিট পর। চারুর গা গুলাচ্ছে। এই মানুষটাকে সে কি করে ভালোবেসেছে? ছিঃ এতো নোংরা!

রুশান আমতা আমতা করে বলল,
“চারু তু…তুমি?”
“তুমি কি ভেবেছিলে, চাকরি হারিয়ে আমি এখন বাসায় মামলার ভয়ে কান্নাকাটি করছি? ছিঃ রুশান। তুমি এতোটা জঘন্য! সামান্য কিছু টাকা আর প্লেসমেন্টের জন্য তুমি আমার সাথে এতোটা বড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছো? আর এই তোমার ব্যস্ততা? ছিঃ না, না। তোমার দোষ নেই, ভুলটা আমার। আমার বুঝা উচিত ছিলো কয়লা ধুলে ময়লা যায় না। আজকের পর থেকে আমাকে তোমার মুখ দেখাবে না”

বলেই ক্লাব থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য পা বাড়ালো চারু। রুশান তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো। এলোমেলো পায়ে পিছু নিলো চারুর। ধরলো তার বাহু। অপরাধী স্বরে বললো,
“চারু আমার কথাটা শোনো”

সাথে সাথেই লম্বা দেহী রুশানের শ্যাম গালে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে চারু রাগী স্বরে বলল,
“ছোঁবে না আমার, স্কাউন্ড্রেল”

আকস্মিক থাপ্পড়ে রুশানের নেশা যেন পুরোপুরি কেটে গেলো। সকলে বাঁকা নজরের মধ্যমনি রুশানের অহমিকায় তীব্র আঘাত পড়লো যেন। শরীরের রক্ত টগবগিয়ে ফুটতে লাগলো যেন। মাথার শিরাগুলো দপদপ করছে। সাথে সাথেই ভালো মানুষী রুশানের মুখোশটা খসে পড়লো। চারুর খোলা চুলগুলো নিজের বিশাল হাতে মুষ্টিগত করে ফেললো সে। এতো জোরেই টানলো যে ব্যাথায় নীল হয়ে গেলো চারুর মুখ। রুশানের ক্রুদ্ধ স্বর আলোড়িত হলো নিস্তব্ধ ক্লাবে,
“এই মা***, তোর এতো বড় সাহস আমাকে মারিস”

চারু বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে রইলো রুশানের বিকৃত মুখের দিকে। স্তব্ধ হলো সে। নিজেকে ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করছে। সে সত্যি মানুষ চিনে না। রুশানের হাতের বাঁধন থেকে নিজের চুল ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। রুশানের হাতের শক্ত মুঠোর সাথে নিজের ছোট শরীর শক্তি পেরে উঠলো না। চোখ থেকে নোনাপানির রেখা গড়ালো। রুশান আরোও কুৎসিত ভাষার প্রয়োগ করছে। চারুর শিরা উপশিরা অবধি কেঁপে উঠছে। ঠিক তখনই কোথা থেকে একজন এসে রুশানের মাথা ধরে ক্লাবের পিলার প্রচন্ড জোরে বাড়ি মারলো। অপ্রত্যাশিত আঘাতে মাথা থেকে গলগল করে রক্ত পড়তে লাগলো তার। রুশান সাথে সাথেই অচেতন হয়ে পড়ে গেলো মাটিতে। আতঙ্কে রক্তশূন্য হয়ে গেলো চারুর মুখখানা। স্তব্ধ, আতংকিত চোখে সে রুশানের অচেতন দেহের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর পাশে তাকাতেই চেনা শান্ত মুখখানা দেখতে পেলো চারু। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,
“স্যা…র”

শ্রাবণ নির্বিকার। তার মুখখানায় ক্লেশের কোনো রেশ নেই। এতোটা স্বাভাবিক যেন কিছুই হয় নি। একজন কালো কোটপরিহিত পুরুষকে শীতল স্বরে বললো,
“বেঁচে থাকলে হসপিটালে এডমিট কর”

লোকটি মাথা নাড়িয়ে মানুষ যোগাড় করলো। তারপর তারা রুশানের হাত পা ধরে তাকে নিয়ে গেলো। চারু এখনো নির্বাক চেয়ে রয়েছে। শ্রাবণ তখন ধীর স্বরে চারুকে বললো,
“চলুন মিস মেহেনাজ”

***

নিকষ কালো আঁধার। শ্রাবণ গাড়িটা থামালো ঠিক এলিভেটর এক্সপ্রেসের একটি জায়গায়। চারপাশ নীরব, নিস্তব্ধ। শো শো করে মিনিট বিশেক পর এক দুটো গাড়ির দেখা পাওয়া যাচ্ছে। গাড়ির দরজা খুলে শ্রাবণ স্বাভাবিক স্বরে বললো,
“বের হন”

চারু একপলক শ্রাবণ শান্ত মুখখানার দিকে চাইলো। তারপর এলোমেলো পায়ে গাড়ি থেকে বের হলো। এখানে আনার কারণ সে জানে না। জানতে ইচ্ছেও করছে না। শুধু জানে মনটা বিষাক্ত। মস্তিষ্ককোষগুলো ক্লান্ত। বুকের ভেতর হু হু করছে কিছু চাপা কষ্ট। শ্রাবণ গাড়ির দরজা আটকে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। অপেক্ষা করলো চারুর মৌনতা ভাঙ্গার। কিন্তু চারু নীরব। তার নিশ্চল আঁখি তাকিয়ে রয়েছে কালো আঁধারের দিকে। শ্রাবণ অনেকক্ষণ পর ধীর স্বরে বললো,
“এমনটা হয়, এতো ভেঙ্গে পরার কিছু নেই”

কথাটায় কিছু একটা ছিলো যেন। নীরব চারু হঠাৎ করে ফুঁপিয়ে উঠলো। আকাশ পানে চেয়ে সেই কান্নার দমক বাড়লো। একটা সময় সব ভুলে উচ্চশব্দে কেঁদে উঠলো সে। শ্রাবণ তাকে থামালো না। শুধু হাতটা বাড়িয়ে তাকে টেনে ধরলো বুকের কাছে। বুকের মধ্যিখানে তাকে আগলে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। শ্রাবণ উষ্ণ আলিঙ্গনে চারুর কান্নারা বাঁধ ভাঙ্গলো। চারু কাঁদছে। তার বুকের ভেতর জমাট বাঁধা কষ্ট গুলো অশ্রু রুপে ভিজিয়ে দিচ্ছে শ্রাবণের বলিষ্ট বুক। শ্রাবণ নড়লো না। একটা মুহূর্তের জন্য ছাড়লো না চারুকে। শুধু বিড়বিড় করে বলল,
“এই শেষবার চারুলতা, অন্য পুরুষের জন্য এই শেষবার কাঁদার অনুমতি দিলাম”

*****

গাড়িতে পাশাপাশি বসে রয়েছে দুজন। দুজনের মুখে কোনো কথা নেই। চারুর চোখ এখনো ভেজা। তার খুব লজ্জা লাগছে। শ্রাবণকে জড়িয়ে কান্নার দৃশ্যটা মনে পড়তেই লজ্জায় মিয়ে যাচ্ছে সে। রাত তখন এগারোটা। শ্রাবণের গাড়ি থামলো ঠিক চারুর বাসার সামনে। চারু বুঝতে পারছে না বাসায় কি বলবে? রুশানের সত্যটা কি এখনই জানাবে? শ্রাবণ গাড়ির দরজা খুলে বললো,
“আমি আছি চারুলতা, তোমার ভয় নেই”

চারু ফ্যালফ্যালিয়ে তাকালো শ্রাবণের দিকে। পুরুষটি তাকে প্রথমবারের মতো আপনি এবং মিস মেহেনাজ ছাড়া কথা বলেছে অথচ তার মস্তিষ্ক ব্যাপারটিকে আমলে আনে নি। কারণ সে চিন্তাগ্রস্থ। এলোমেলো পায়ে বের হলো গাড়ি থেকে। একরাশ দ্বিধা নিয়ে পা বাড়াতে যেয়েও পারলো না। পেছনে ফিরে শ্রাবণের দিকে তাকাতেই সে বললো,
“আজকে কিছু বলার দরকার নেই, কালকে ধীরে সুস্থে বলবেন”
“আপনি একটু আমার সাথে যাবেন”
“ভয় পাচ্ছেন কেন?”
“জানি না”
“ঠিক আছে”

শ্রাবণ চারুর সাথেই তার ঘর অবধি গেলো। চারু বেল বাজাতেই চারুর মা দরজা খুললেন। তার মুখখানা হাসিহীন, বেজার। চারু এবং শ্রাবণকে তীক্ষ্ণ চোখে একদফা দেখে গম্ভীর স্বরে শুধালেন,
“কোথায় ছিলে?”

চারু শুকনো গলায় বললো,
“একটা জরুরি কাজ ছিলো”

চারুর কথাটা শেষ হবার সাথে সাথেই চারুর মা তার গালে সজোরে চড় বসিয়ে বললেন,
“বেহায়া মেয়ের মা হবার থেকে মরে যাওয়া ভালো ছিলো”…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি