বড়োজা পর্ব-২৮

0
720

#বড়োজা
#Nadia_Afrin

২৮
আপার পছন্দ মতো বাড়ি তৈরি করেছি আমি।
জমির মধ্যে একটা বকুল ফুল গাছ ছিল।
সেই গাছ ঘেসে একটা ঘর করেছি আপার জন্য।বড়ো একটা জানালা ঘরের।ছিমছাম ঘরটিতে একটা ছোট্ট বিছানা ও টেবিল।
সবই আপার ইচ্ছা অনুযায়ী।
ঘরে ওঠার আগের রাতেই ঘটে আপার মৃত্যু!

আগের রাতে ভালোভাবে খেয়েদেয়ে শুয়েছে আপা।
উনার নার্সটি সেদিন কিছুকাজে সন্ধ‍্যায় বাড়ি চলে গেছে।রাতে আপা একাই থাকতে চায় বলে আমরা কেউ জোর করিনি।
সকালে বেলা হয়,তবুও আপা ওঠে না।উনি সাধারণত খুব ভোরে উঠতেন।সেদিন উঠলোনা দেখে আমি ডাকতে গেলাম।
দরজা খোলাই ছিল।আপার নিথর দেহ বিছানাতে ছিল।আমি বুঝিনি।ডাকলাম দুবার।শুনলোনা সে।শোনার কথাও নয়।
গায়ে হাত দিয়ে ডাকলাম।শরীরটা কেমন ঠান্ডা ও শক্ত হয়ে আছে।ভাবলাম ফ‍্যানের বাতাসে শীত লাগছে।
ফ‍্যান অফ করে ডাকলাম।তবুও তার সারা নেই।তখনও কিছু বুঝিনি আমি।
বিরক্ত হয়ে এলোমেলো ঘরের কাপড় ভাঝ করে রাখছিলাম আর বকা দিচ্ছিলাম তাকে।
আমার কথা শুনে এক শিক্ষক এলো।
আপার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুপল।
এরপর ‘আপা’ বলে চিৎকার করে দৌড়ে গেল।
তাকে ধরে কাঁদতে লাগলো অঝোরে।
চিৎকার শুনে সবাই দৌড়ে আসে।
আমি তখনও ঠায় দাড়িয়ে আছি।
কান্নার গতি বাড়ে।আহাজারিতে এতিমখানা ভারি হয়।
এক মেয়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগে হুস ফেরে আমার।এতোক্ষণ যেন কোন ঘোরের মাঝে ছিলাম।
ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ওদের মাঝে বসে বললাম,”কী হয়েছে আপার?মানুষটা ঘুমাচ্ছে।আপনারা এভাবে বিরক্ত করছেন কেন তাকে?”

এক শিক্ষক আমার বাহু ধরে কেঁদে কেঁদে ঝাকিয়ে বলেন,”আপা আর নেই তন্নি।উনি মারা গেছেন।”

কর্ণধারে কথাটি পৌঁছাতেই মস্তিষ্ক ফাঁকা লাগে আমার।
কেমন যেন হয়ে গেলাম আমি।শুধু বুঝলাম আমি হারিয়ে যাচ্ছি।চোখ বুজে আসছে।

দীর্ঘ তিন ঘন্টা পর জ্ঞান ফেরে আমার।
ধরফরিয়ে উঠেই আপাকে খুঁজতে লাগি।
সবাই আমাকে ঘিরেই বসে বসে কাঁদছিল।
আমায় উঠতে দেখে এক মেয়ে বলেন,”আপাকে শেষ গোসল করানো হচ্ছে।”

আমি মানতে চাইনা।
সেই জায়গায় যেতে চাই বারবার।ওরা আটকে রাখে আমায়।
গগনবিদারী চিৎকার করে কাঁদি আমি।বুকের এক পাজর যেন ভেঙে গেছে।
বাচ্চাদের মতো হাত-পা ছুড়ি।নিজের শরীরে আঘাত করি।আমি জানিনা আমি কী করছি।
কিছুক্ষণ পর আপাকে আনা হয়।
উনার ওপর একপ্রকার হামলে পড়ি আমি।
কী মায়া ভরা মুখটা!
হাসি যেন লেগে আছে ঠোঁটের কোণে।

কাঁদতে কাঁদতে আপাকে ডাকি প্রচুর।প্রথম দিনের কথা মনে হয়।
আজ আমাদের ঘরে ওঠার কথা ছিল।দুজনে কতো কিছু প্ল‍্যান করেছিলাম।সারারাত আজ গল্প করার কথা ছিল দুজনের!

কিছুসময় পর আপাকে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়।আমি তাকে আকড়ে ধরি।
সবাই মিলে টেনে-হিচড়ে সরিয়ে আনে আমায়।
আপাকে নিয়ে যাওয়া হলে আবারো জ্ঞান হারাই।
কমিটির লোকেরা সহ সবাই আপার মৃত্যুতে শোকাহত ছিল।তিনি বহু পুরোনো কর্মী ছিলেন।
সঙ্গে বিশ্বস্ত।

আমার অবস্থা অনেকটাই খারাপ হয়ে যায়।স‍্যালাইন দিয়ে রাখা হয়।
সন্ধ‍্যা পর্যন্ত চিৎকার করে করে কেঁদেছি আমি।হাত নড়াচড়ার ফলে র*ক্ত এসেছে বহুবার।
অন‍্যসব শিক্ষকরা মিলে কোনোমতে সামলেছে আমায়।এতিমখানার পরিবেশ তখন চুপচাপ একদম।যেন আপার মৃত্যুতে এতিমখানাই কাঁদছে।প্রতি ঘরে কান্নার রোল।এমন কোনো মানুষ নেই যে সেদিন কাঁদেনি।
আমাদের ধর্মীয় রীতিনীতি চলছিল তখনও।দোয়া করছিল সকলে।

রাত হয়।আমি শান্ত হই কিছুটা।ঘরে সেসময় আমি একাই ছিলাম।
ধীরে ধীরে আপার ঘরের উদ্দেশ্যে যাই।
দরজা খোলাই ছিল।ভেতরে অনেকে ছিল।
আমায় দেখে একটি মেয়ে আচলে মুখ গুজে কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে আসে।
আমার হাতে একটা চিঠি দিয়ে বলেন,”এটা আপনার জন্য রেখে গেছেন তিনি।”

চিঠির ওপরে আপার হাতের লেখা।ভীষণ ভালো লাগে আমার।মুখে হাসি ফোটে।মনে হলো এইতো আপা!
চিঠি নিয়ে দৌড়ে বারান্দায় আসি।
তাড়াতাড়ি খুলে পড়া শুরু করি।

‘প্রিয় তন্নি।

আশা করি ভালোই আছো।অবশ‍্য ভালো তোমায় থাকতেই হবে।
হয়ত ভাবছো আপা হঠাৎ আমার জন্য চিঠি লিখছে কেন?
আসলে আজ খুব ইচ্ছে হলো তোমায় নিয়ে দুটো কথা লিখতে।
মনের মধ্যে আজ কেমনই যেন লাগছে।মনে হচ্ছে আমি হারিয়ে যাচ্ছি কোথাও।
তুমি আমায় খুঁজে নিও।

জানো তন্নি,আমি পারভীন মানে তোমার আপা তোমায় ভীষণ ভালোবাসি।
তোমায় দেখলে বড্ড আপন মনে হয়।
তুমি হাসলে ভীষণ সুন্দর লাগে।তোমার চোখ দুটো ঠিক আমার মায়ের মতো।

প্রায় প্রায় তুমি বলো তুমি নাকি এতিম।কেউ নেই তোমার।আসলে প্রকৃত এতিম তো আমি।তোমার দুটো সন্তান আছে।তাদের পরিচয়ে তোমার পরিচয়।
আমার সেটাও নেই।
এক নিঃসন্তান,বিতারিত নারী আমি।
স্বামীর সংসার হতে ‘অপয়া’ বলে তাড়ানো হয়েছিল একসময়।
আমার সত্যিই কেউ নেই জানো!

এই ছোট্ট মনে কতো দুঃখ চেপে রেখেছি এতোকাল।পাহাড় হয়ে গেছে এতোদিনে।পাহাড়ের এই বোঝা বইতে আমার খুব কষ্ট হয় তন্নি।
দম বন্ধ হয়ে আসে।
মনে হয় সব ফেলে হালকা হয়ে ভেসে যাই মেঘের আড়ালে।কিন্তু পারিনা।আমার কাধে যে বহু দায়িত্ব।
আমি বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছি বোন।
এবার একটু শান্তি চাই।

‘মুক্ত আকাশে ডানা মেলে উড়ে যেতে চাই।
মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়তে চাই।
এক বৃষ্টির দিনে শিতল আবহাওয়া হয়ে তোমায় ছুয়ে দেব অবশ্যই।
তুমি খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে ‘আপা’ বলে চিৎকার করে ডাকবে আমায়।
মেঘের আড়াল থেকে তোমায় দেখে মুচকি হাসবো আমি।’

চিঠিটা পড়ে বসে পড়ি আমি।
আরেকটি চিঠি আছে ভেতরে।
কাঁপা হাতে খুলি সেটিও।

তাতে লেখা,

আমার এই চিঠি যখন পড়বে তখন আমি থাকবো কিনা জানিনা।থাকলে এই চিঠি তোমার হাতে পড়বেনা।লুকিয়ে রাখবো।তুমি মেয়ে বড্ড আবেগী কিনা!
কেঁদে বুক ভাসাবে আবার।

তোমার একটা কাজ আছে।
আমার অনুপস্থিতিতে আমার জমানো টাকা দিয়ে এতিমখানার কজন মেয়েকে বিয়ে দিও তুমি।দায়িত্ব নিয়ে এই ভালো কাজে আমার সারাজীবনের সঞ্চয় গুলো ব‍্যায় করিও।
একটা ছোট্ট বাড়ি আছে আমার।বাড়িটা তোমার নামে লিখে দিচ্ছি।পারলে ওটাকে একটা বৃদ্ধাশ্রমের রুপ দিও।
আমার মতো বিতাড়িত নারীরা যেন ঠায় পায় সেখানেও।আমার গহনা গুলো তোমার মেয়ের বিয়েতে পড়িয়ে লাল টুকটুকে বউ সাজাবে।তুমিতো আর বউ সাজলেনা।মেয়েটাকে সাজিও।ভাববে আমি ওর সঙ্গে আছি।ও আমার সন্তানের মতো।তাই ওকে দিয়েই না’হয় নিজের অপূর্ণ ইচ্ছাটা পূরণ করলাম।

তুমি তন্নি আমার সব দায়িত্ব নিজে নিও।তোমায় ভরসা পাই আমি।এই এতিমখানা আমার বড্ড প্রিয়।এটাকে তুমি বহুদূর নিয়ে যেও।পাছে লোকের কথায় কান না দিয়ে নিজ ছন্দে এগিয়ে যেও।
তুমি পারবে তন্নি।তোমার মাঝে সেই সাহস আছে।
শক্তি আছে।
জীবনে অনেক দূর যেতে হবে তোমায়।
এখনো অনেক কিছু বাকি তোমার।
তোমার ওপর হওয়া অন‍্যায়ের প্রতিবাদ করতে যোগ্য রুপে তাদের সামনে দাড়াতে হবে তোমায়।

জানি আমি চলে গেলে এতিমখানার প্রতিটি মানুষ ভেঙে পড়বে।তোমার সবাইকে সামলাতে হবে।প্রথমে নিজেকে সামলাও।শক্ত করো।আমার তন্নি দূর্বল নয়।
সে সাহসি,শক্তিশালী।
বরাবরই আমি চেয়েছি আমার এতিমখানার মানুষ সবসময় হাসি-খুশি থাকুক।তারা না কষ্ট পাক।ওদের চোখের পানি আমায় ভীষণ দুঃখ দেবে তন্নি।আমি থাকি বা না থাকি,ওদের হাসতে হবে।
উঠে দাড়াও তন্নি।সবাইকে বলো আমি আছি।
কান্না থামাও।এগিয়ে যাও নতুন ছন্দে।
শুভকামনা রইলো তোমায়।
আপা ভীষণ ভালোবাসে তন্নিকে।

ইতি,
তোমার পারভীন আপা।

দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে আমার।
চোখের পানি মুছে উঠে দাড়াই।আপার চিঠিতে কয়েকটি চুমু খাই।বুকে জড়িয়ে ধরে দাড়িয়ে থাকি কিছুক্ষণ।
আকাশের দিকে তাকিয়ে বলি,”আমি পারবো আপা।আপনার জন‍্য হলেও পারতে হবে আমায়।”

দৌড়ে আপার ঘরে আসি আমি।মুখে হাসির ছটা।
সবাই কাঁদছিল তখন।সকলের সম্মুখে দাড়িয়ে বলি,”কাঁদছেন কেন আপনারা?আপা আছে আমাদের মাঝেই।স্বশরীরে না থাকুক,মনে তো আছে।আমরা কাঁদলে আপা কষ্ট পাবে।
আপা আমাদের হাসি দেখতে চেয়েছেন বরাবর।
আমরা আজো হাসবো।হাসিমুখে বিদায় দেব তাকে।
উনি আমাদের অনেক দায়িত্ব দিয়ে গেছেন।সব পালন করতে হবে আমাদের।
আর নয় কান্না।”

এক শিক্ষক এগিয়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বলেন,”আমাদের তো শান্ত হতে বলছো।তুমি নিজে পারবে শান্ত হতে?”

আবারো কান্নায় ভেঙে পড়ি আমি।
সত‍্যিই নিজেকে সামলে নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার।

পরদিন থেকে সব কিছু স্বাভাবিক নিয়মে চালাতে চাই।রেশ থেকে যায় তবুও।
মন মরা হয়ে থাকে সকলে।
বহুদিন লাগে আপার শোক কাটিয়ে উঠতে।
উনার ইচ্ছে গুলো একে একে সবার সহায়তায় পূরণ করি।
এতিমখানার বেশ কিছু মেয়েকে বিয়ে দেই আপার টাকায়।
উনার বাড়িটা একটা ছোট্ট বৃদ্ধাশ্রম ও অসহায় নারীর আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে তুলি।এতিমখানার ফান্ড থেকেই এই দুটির খরচ চলে যেত।
আমি আজও আপাকে ভুলতে পারিনা।
আমার জীবনে তার অবদান অপরিসিম।তাকে কখনো ভুলতে চাইনা আমি।
সম্পূর্ণ গল্পটি আমার পেইজে দেওয়া আছে।নাদিয়া আফরিন ইংরেজিতে লিখে সার্চ দিলেই পেয়ে যাবেন আমার পেইজ।
ফলো দিয়ে সম্পূর্ণ গল্পটি পড়ুন।
ফলো না করলে হারিয়ে ফেলতে পারেন।

বাড়িতে উঠেছি আমি।বাড়িতেই থাকি বর্তমানে।যদিও বেশিরভাগ সময় কাটে এতিমখানাতেই।রাতটা বাড়ি এসে থাকি কাজকর্মের জন্য।
আপার জন‍্য বরাদ্দ সেই ঘরে কাউকে থাকতে দেইনা।আমিই সময় কাঁটাই সেখানে।নামাজ,কোরআন পড়ি।দোয়া দরুধ পাঠ করি।
ঐ ঘরে থাকলে মনে হয় আপা আমার সঙ্গেই আছে।

পার হয়েছে বেশ কিছু বছর।এতিমখানার আরো উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।ভালো কাজে প্রত‍্যেকেই ভীষণ সাহায্য করেছেন আমাদের।পাশে থেকেছেন।
বর্তমানে আমি এতিমখানার প্রধান।ও কমেটির প্রধানের সহকারি পদে আছে।খুব শিগ্রই হয়ত কমিটির প্রধান হবো আমি।
মেয়েটা বড়ো হয়েছে।ছেলেও বড়ো হয়েছে।ভালো স্কুলে ভর্তি হয়েছে।ওকে বাইরে পাঠানোর ইচ্ছা আমার।ও নিজেও যেতে চায়।
ছেলে নিয়ে নিজ বাড়িতেই থাকি।এতিমখানার ও অন‍্যান‍্য দায়িত্ব পালন করি সঙ্গে।
মেয়েটা কাছে থাকেনা কিছুতেই।এতিমখানাতেই থাকে সবার সঙ্গে।মাঝে মধ্যে আসে।ঘন্টাখানিক থেকে আবার চলে যায়।কাছাকাছি তো।তাই সুবিধা হয়েছে যাওয়া-আসার।

সময় যেমন বদলেছে তেমন বদলেছি আমিও।
চোখে এখন মোটা ফ্রেমের চশমা আমার।
আপার চিঠিটা আজও কাছে রেখেছি আমি।যখনই কোনো বিপদে পড়ি আপার চিঠিটা পড়ি।অলৌকিক ভাবে সাহস পাই।

এক শুক্রবারের পড়ন্ত বিকেলে নিজের বারান্দায় বসে বই পড়ছিলাম আমি।
এমন সময় ছেলে এলো আমার নিকট।
পায়ের কাছে বসে বলল,”একটা কথা ছিল আম্মু।”

চোখ জ্বোড়া বই এ রেখেই বললাম,”বলো।”

ছেলে আর একটু কাছে বসে বলল,”আমি অতীতের সেই মরিচীকায় যেতে চাই আম্মু।বস্তির মানুষগুলোকে দেখতে চাই।
আমার পিতা নামক পাষণ্ড মানুষটির সামনে দাঁড়াতে চাই।পরিবার নামক মিথ‍্যার সামনে দাঁড়াতে চাই।”

থমকে গেলাম আমি।
ছেলের কথা শুনে স্থির হয়ে গেলাম।
চশমা খুলে সরু দৃষ্টিতে তার পানে তাকালাম।
ও মাথা নিচু করে বসে আছে।
সামনে তাকাই আমি।চোখ বুজে কিছু হিসেব মেলানোর বৃথা চেষ্টা করি।

এরপর ধীর স্বরে বলি,”তুমি কী তোমার বাবার কাছে ফিরতে চাইছো?
বাবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করছো?”
পুরো গল্পটি নাদিয়া আফরিন পেইজে দেওয়া আছে।ফলো দিয়ে পড়েনিন।
নাহলে হারিয়ে ফেলতে পারেন।
এছাড়াও আমার লেখা সব গল্প পাবেন আমার পেইজে।
অন‍্য কোনো গ্রুপে বা পেইজে আর গল্পটি পাবেন না।সুতরাং সম্পূর্ণ গল্প পড়তে এবং আপডেট পেতে মূল লেখিকাকে ফলো দিয়ে রাখুন।

ছেলে হাসলো।খুব সহজ সরল হাসি।তবে এ হাসিতে আছে চরম উপহাস।
আমার দিকে গোটা গোটা চোখ করে তাকিয়ে বলে,”সবই কী এতোই সহজ আম্মু?
আমরা কী এতোই স্বস্তা?
‘বাবা’ নামক লোকটাকে জবাব দিতে চাই আম্মু।একটা সময় ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল আমাদের।যখন তাকে প্রয়োজন ছিল পাইনি।
এই একটা মানুষের জন্য লোকে আমাদের অ*বৈধ সন্তান অব্দি বলেছে।আমার মায়ের চরিত্রে কাঁদা ছিটিয়েছে।সব ভুলি কী করে আম্মু?
ঐ মানুষটার জন্য দিনে রাতে না খেয়ে থেকেছি।লোকের কটু কথা শুনেছি।
বস্তিতে অব্দি ঠায় নিয়েছি আমরা।
কী ভাবছো সব ভুলে গেছি?
তখন আমি ছোট থাকলেও সেদিনের স্মৃতি আমার মনে গেঁথে আছে।ঐ দিনকে একটা অভিশাপ বলে মনে করেছিলাম আমি।তাই হয়ত আজও মনে আছে।
আমাদের বস্তি থেকে বাহির করে দেওয়া হয়েছিল।গায়ে পাথর,কাঁদা ছুড়ে মারা হয়েছিল।সেদিন আমরা নিরাপরাধ ছিলাম।কিন্তু কেউ আমাদের বিশ্বাস করেনি।
আমি সেই বস্তিতে যেতে চাই আম্মু।
চিৎকার করে বলতে চাই,আমার আম্মুর কোনো দোষ ছিল না সেদিন।
প্লিজ আম্মু।নিয়ে চলো আমায়।”

ছেলের কথা ফেলতে পারিনি আমি।
পরদিনই যাই বস্তির উদ্দেশ্যে।বহুদিন পর চিরচেনা পথে পা রাখি।
শরীর জুড়ে শিতলতা বয়ে যায়।
আমরা তিন মা-ছেলে-মেয়েই এসেছি শুধু।
জানিনা বস্তিটা এখনো আছে কিনা!

গাড়ি থামাই অনেক আগেই।এ টুকু আমি হেঁটে যেতে চাই ঠিক আগেরই মতো।
আজ আমি তন্নিই কিন্তু এসেছি।তবে সেদিন আর আজকের মধ্যে বহু তফাৎ।
আজ এসেছি ত্রাণকর্তা হিসেবে।গরীব-দুঃখী মানুষদের ত্রাণ দিতে এসেছি।

খালার বাড়ির সামনে এসে থামি।একবার তাকাই।পুরোনো সেই ঘর-বাড়ি আজও আছে।
ছেলের দিকে তাকাই।ছেলে মুচকি হেসে বলে,”সবই মনে আছে আমার আম্মু।”

মেয়ে বার বার প্রশ্ন করছে,এটা কোথায়?কেন এলাম?কে থাকে এখানে?
ওর কিছুই মনে নেই।না থাকাই স্বাভাবিক।

খালাকে দেখলাম না।
বাড়িতে নতুন মানুষজন।হয়ত ছেলে-ছেলের বউ।
সামনে হাঁটি আরো।
বস্তির বাইরে একটা লোককে দেখলাম।পরিচিত মনে হলো।এটা সেই রাশেদ স‍্যার।
উনি বস্তির একটা ঘর থেকে বের হচ্ছেন।
আমায় দেখেই থমকে দাড়ায় তিনি।
সঙ্গে আমিও প্রগাড় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছি।
লোকটার পরণে সাধারণ লুঙ্গি।ছেড়া গেঞ্জি।কাধে গামছা।
আমার নিকট এগিয়ে এলো সে।
কিছু বলতে যাবো এমন সময় পেছন থেকে ডাক এলো।ত্রাণ ভর্তি গাড়ির ড্রাইভার গাড়ি কোথায় রাখবে জিজ্ঞেস করছে।
সেদিকেই এগিয়ে গেলাম আমি।
গাড়ি থেকে আমার চারজন সহকারি নেমে এলো।এনারা আজ আমায় সাহায্য করবে।
বস্তির মাঝে গেলাম।সব আর আগের মতো নেই।কতো পরিবর্তন হয়েছে।
লতা আপার ঘরের সামনে দাড়াতেই ‘খচ’ করে ওঠে আমার বুক।
এরই মাঝে বস্তির সকলে জড়ো হয়েছে ত্রাণ নিতে।আমায় ঘিরে ধরেছে।প্রচন্ড কোলাহল।
সহকারিরা আমায় ও বাচ্চাদের মাঝে রেখে ভির সামলাতে চেষ্টা করছে।
সবাইকে লাইন ধরে দাড়াতে বলা হয়।
যে যার মতো দাড়ায় ও।
জিনিস পত্র সব গুছিয়ে নিয়ে একে একে আমি আর ছেলে দেওয়া শুরু করি হাতে হাতে।মেয়ে এগিয়ে দিচ্ছে।
আমার তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো দুজন মানুষকে খুঁজতে ব‍্যস্ত তখনও।
সবাইকে দেওয়া হলো।বাদ থাকলো একটা লোক।তিনি এগিয়ে এলো।এটা রাশেদ স‍্যার।সঙ্গে একটা মহিলা ও কোলে বাচ্চা।
সম্ভবত রাশেদ স‍্যারের স্ত্রী-বাচ্চা এটা।
এদের দেখে ভীষণই অবাক হয়েছি আমি।তবুও চুপ আছি।
মহিলাটিকে দিলাম ত্রাণ।লোকটা এগিয়ে এসে হাত পেতে দাড়ালো।
উনি নিজেই বলল,”আপনাকে চেনা চেনা লাগছে।
মনে হচ্ছে কোথাও যেন দেখেছি।”

বললাম,”আমায় তাড়িয়ে নিজেই বস্তিতে উঠেছেন?বাহ বেশ ভালো!”

লোকটা ভ্রু কুচকে বলে,”মানে?”

“মানে চিনতে পারেন নি আমায়?
আমি তন্নি।যাকে বহুবছর আগে মিথ‍্যা অপবাদ দিয়ে বস্তি ছাড়া করেছিলেন আপনি।”

লোকটা দু-পা পিছিয়ে গেল।
চোখ দুটো যেন বেড়িয়ে আসবে এবার।
হয়ত ভেবেছিল আমি মরে গেছি।আমি যে এভাবে ফিরবো তা তিনি ভাবেন নি।
একসময়কার বস আমার থেকে ত্রাণ নিচ্ছে।জানিনা এর অবস্থা এমন কী করে হলো।
হয়ত পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছিল।

সকলেই তখন আমার দিকে ফ‍্যালফ‍্যাল করে তাকিয়ে আছে।
গোল হয়ে দাড়িয়ে থেকে আমায় দেখছে।
আলিফ দাড়ায় সামনে।চিৎকার করে বলে,”চিনতে পারছেন আমাদের?অনেকেই আছেন সেসময়ের।
নাম বললে চিনবেন।
আমি আলিফ।তন্নি আমার মা।
যাদের একদিন আপনারা তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
বস্তির বাহিরের অনেকেই আছেন দেখছি।আপনাদের মাঝে অনেকেই সেদিন আমাকে,আমার মা-বোনকে গায়ে পাথর ছুড়ে মেরেছিলেন।কাঁদা ছুড়েছেন আমার মাকে।
আমি সেই মায়ের সন্তান।
আমার মা ফিরেছে ঠিকই।যোগ‍্য সম্মান নিয়ে ফিরেছে।আজ আমার মাকে সবাই চেনে।আপনারা আজ আমার মায়ের থেকে নিতে এসেছেন।
একটা এতিমখানার প্রধান আমার মা।এতিমখানার কমেটির ও প্রধান হবে।দেশে-বিদেশে নাম কুড়িয়েছে আমার মা।
তাকে নিয়ে পেপারে পর্যন্ত খবর উঠেছে।লোকে এক নামে চেনে তাকে।
প্রভাব-প্রতিপত্তি দিয়ে সৃষ্টিকর্তা আমাদের অনেক ভালো রেখেছেন।
অনেক ভালো কাজে আমার মায়ের অবদান আছে।

আমার মা সেদিনও সৎ ছিল।কিছু মানুষ আমাদের পাশে ছিল।সাহস দিয়েছিল।তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।
আর যারা কিছু না জেনে-বুঝে আমাদের প্রতি নির্দয় হয়েছিলেন তাদের মুখের জবাব দিতেই আমরা এসেছি।তবে ত্রাণ গুলো ভালোবেসেই দিয়েছি।
অনুরোধ থাকবে ওমন পরিস্থিতিতে কখনো কেউ পড়লে তাকে তাড়িয়ে না দিয়ে পাশে থাকবেন।
আমার মা সৎ ছিল সেটা আপনারাও জানতেন।
তবুও অন‍্যের কথায় আমার মাকে দোষ দিয়েছিলেন।
তার প্রমাণ আজ আমি আপনাদের দিতে চাই।”

আলিফ কাকে যেন ফোন করলো।
দুজন লোক এলো সঙ্গে সঙ্গেই।
সাথে একটা বয়স্ক মতো মহিলা ও পুরুষ।
চিনতে অসুবিধা হলোনা আমার।ইনি চম্পা।
লোকটাকেও দেখেছি।রাশেদ স‍্যারের অফিসে কাজ করতো।
বুঝলাম না ছেলে এদের পেলো কোথায়।বা এদের দিয়ে দরকারই বা কী!

ওদের সামনে এনে বলল,”বলুন সেদিন কী হয়েছিল?কার কথায় আপনারা আমার মাকে দোষ দিয়েছিলেন?”

উনারা নিচু স্বরে বলে,”রাশেদ স‍্যারের কথায় সবটা করেছিলাম আমরা।তিনিই টাকা দিয়ে আমাদের দাড় করিয়ে রেখেছিল সেখানে।
পড়ে আমরা ঝামেলা করেছি।আসলে উনি চেয়েছিল তন্নির অপবাদ করতে।যাতে বাধ‍্য হয়ে তন্নি তার নিকট আসে।”

তার কথা শেষ হতেই আমার ছেলে রাশেদ স‍্যারকে টেনে এনে সামনে দাড় করায়।
চিৎকার করে বলে,”এই সেই পাপি রাশেদ।যার জন্য আমার মায়ের করুণ পরিণতি হয়েছিল।
আমার ঘটনা মনে থাকলেও এতোকিছু মনে ছিল না।তাই এই বস্তিতে এসে খোঁজ নিয়ে সবটা জানতে পারি।
এরপর তদন্ত করে বের করি সবটা।
আমার মা সৎ ছিল তাই সে সফল।
উনি অসৎ তাই তার ধ্বংস হয়েছে।প্রতারণার দায়ে চাকরিচ্যুত হয়ে পথে বসেছে।
লোকটার নামে বহুত মামলা আছে এখনো।জালিয়াতি করে বেড়াতো ইনি।তাই আর কোথাও কাজ না পেয়ে বাড়ি ঘর বিক্রি করে পালিয়েছে।এখানে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
এর পরিণতির জন্য দায় ইনি নিজেই।”

ছেলের কাজে চোখে পানি জমে আমার।
ও যে এতোটা করবে আমার ভাবনার বাইরে ছিল।
হাত জোর করে অনেকে ক্ষমা চায় আমার থেকে।যেই মহিলারা আমায় যা তা বলেছিল রাস্তায়,তারাও ক্ষমা চায়।
রাশেদকে মারতে এলে আমি নিষেধ করি।তবুও দু-তিনজন ঢিল ছুড়ে মারে।গায়ে কালি ছেটায়।

আমার ওপর হওয়া অন‍্যায়ের প্রতিবাদ আমার সন্তান বহু বছর পর হলেও করেছে।
আজ আমি নির্দোষ।আমার কাধে আর মিথ‍্যার দায় নেই।

হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন আমার কাধে হাত দেয়।পেছনে তাকাতেই দেখি লতা আপা দাড়িয়ে আছে।
আমায় জড়িয়ে ধরে তিনি।হুহু করে কেঁদে উঠে বলে,”ফিরতে বড্ড দেরী করলে তন্নি।”

আমারও চোখ দিয়ে অশ্রু গড়ছে।কান্নাভেঝা কন্ঠে বলি,”ফিরেছি কিন্তু আপা।আপনার কথা রাখতে হলেও ফিরেছি।সম্মান নিয়ে মাথা উচু করে ফিরেছি।লোকে আমায় ফুল দিয়েই বরণ করে নিয়েছে।
আপনি কেমন আছেন আপা?চাচি কোথায়?”

আপা আমার হাত দুটো ধরে বলেন,”উনি মারা গেছেন দু-বছর আগেই।অসুস্থ হয়ে মা*রা গেছেন।নাতনি টাও মা*রা গেছে তিনবছর আগে।
আমি আর এখানে থাকিনা বোন।
ঘর ভাড়া নিয়ে থাকি।
চলো আমার বাড়ি।অনেক কথা আছে তোমার অতীতের মানুষ গুলোর বিষয়ে।শুনলে আকাশ থেকে পড়বে।”

আপা আমায় নিয়ে যেতে লাগে।বস্তি থেকে বিদায় নেই আমি।
বস্তির সিমানা পেড়িয়ে মেইন রাস্তায় উঠেছি এমন সময় রাশেদ স‍্যার ডেকে ওঠেন আমায়।
পেছন ফিরি আমি।
লোকটা বলেন,”তোমায় পাওয়ার জন্য কতোকিছু করলাম তন্নি।তবুও তোমায় পেলাম না।”

সামান্য হেসে আমি বলি,”তন্নি একাই থাকবে আজীবন।ওর কাউকে চাইনা।ওর জন্য ও নিজেই যথেষ্ট।সব গল্পের শেষে যে মিলন ঘটবে এমনটা নয়।
আমার গল্পে আমি একাই সেরা হয়ে থাকতে চাই।
কিছু না পাওয়া,কিছু স্মৃতি,কিছু আক্ষেপ নিয়েই না’হয় চলুক আমার জীবন ছন্দ।”

চলবে।