#ভালোবাসা_হাত_বাড়ালো
#লেখনীতে_মেহেরীন
#সূচনা_পর্ব
— বিয়ের এক মাসের মাথায় বিধবা হয়ে গেছিলাম আমি। সেটা নিশ্চয়ই আপনার অজানা। নাহলে আপনি বাড়ি বয়ে আমায় দেখতে আসতেন না…
আরোহীর কথা শুনে ওর মুখোমুখি চেয়ারে বসে থাকা সুদর্শন পুরুষটি হাত দিয়ে চোখের চশমা ঠিক করে স্মিত হাসলো। এতো সিরিয়াস একটা কথা শোনার পর হাসি কিভাবে আসছে লোকটার ভেবে পাচ্ছে না আরোহী
— আমি মোটেও মজা করছি না যার জন্যে আপনি হাসছেন, এটা আমার জীবনে ঘটে যাওয়া এক তিক্ত সত্যি
— আপনার কি মনে হয় মিস আরোহী। এতো গুরুতর একটা বিষয় ধামাচাপা দেয়া এতোই সহজ? কোনোকিছুই আমার অজানা নয়
লোকটার কথা শুনে চমকে উঠলো আরোহী। বিয়ের একমাসের মাথায় হাসবেন্ড মারা গেছে এটা শুনেই এখন অব্দি চারটা ছেলে সাফ জানিয়ে গেছে বিয়ে করবে না ওর মতো মেয়েকে সেখানে কিনা এই লোকটা সব জেনেই বিয়ে করতে চাইছে? ছাদের সাইডে সাজিয়ে রাখা ফুলের টব গুলো দেখে লোকটা প্রশ্ন করে বসলো
— আপনার ছোট্ট বাগানে সুন্দর সুন্দর ফ্লাওয়ার প্লান্ট আছে দেখছি, গার্ডেনিং এর শখ আছে মনে হয়?
— আপনি সব জানেন? সব জানার পরও আমার মতো একজনকে কেনো বিয়ে করতে চাইছেন? আপনি তো মাশাআল্লাহ দেখতেও বেশ! মেয়ের অভাব তো পড়বে না আপনার
— ওহ রিয়েলী? আমি দেখতে বেশ? তারমানে আপনি আমাকে নোটিস করেছেন? থ্যাংক ইউ! প্রশংসা শুনে ভালো লাগলো
আরোহী কিছুটা ভরকে গেলো, তা দেখে মুচকি হাসলো সে। টি টেবিলের ওপর থেকে চায়ের কাপ উঠিয়ে মনের আনন্দে চা পান করতে শুরু করলো, যেনো কোনকিছুতেই ওনার কিছু যায় আসে না। আরোহী জানেনা লোকটার মাথায় কি চলছে, কি করতে চাইছে সে? শুকনো ঠোঁট জোড়া হাল্কা ভিজিয়ে আরোহী বলে উঠলো
— দেখুন, আমি আপনার ভালোর জন্যই বলছি! আপনি প্লিজ নিচে গিয়ে আমার মাকে বলে দিন বিয়েটা আপনি করবেন না, বাকিটা আমি সামলে নেবো
— আপনাকে কষ্ট করে কিছু সামলাতে হবেনা কারণ এরকম কিছুই আমি করবো না
— পাগলেও তো নিজের ভালো বোঝে আর আপনি বোঝেন না?
— অত কিছু বুঝতে চাইনা, আমি তো আপনাকে বিয়ে করতে চাই, তাইতো সব কাজকর্ম ছেড়ে আজ আপনার বাড়িতে এসেছি, সেখানে না করার প্রশ্নই আসে না। আপনি কি জানেন এতো সময় তো মনে হয় নিজেকেই দেইনা?
— আমি বুঝতে পারছি না আপনি এই জেদ কেনো করছেন? সব জানার পরেও কেনো আপনি আমাকেই বিয়ে করতে চান?
— কেনো বিয়ে করতে চাই সেটা আমার ব্যাপার, আমার ইচ্ছা। আপনার না জানলেও চলবে। কিন্তু আমাকে বিয়ে না করতে চাওয়ার পেছনে আপনার কারণটা কি? যেখানে আমার সমস্যা নেই, আপনি কেনো পিছিয়ে যাচ্ছেন?
— কারণটা আপনিও জানেন, আমার বৈধব্য জীবনের ছায়া কারো জীবনে পড়ুক সেটা আমি চাইনা
— এটা কোনো বিশেষ কারণ নয়, নিছক একটা ঘটনা মাত্র আর তাও অনেক দিন আগেই ঘটে গেছে
— সামান্য ঘটনা নয় এটা, এর প্রভার এখনো আছে আর সারাজীবন রয়ে যাবে। আমি চাইনা আমার জন্যে আপনার জীবনেও তার প্রভাব পড়ুক
— ভবিষ্যতে কি হবে সেটা ভাবছেন আপনি কিন্তু বর্তমানটা যে আপনি এইভাবে শেষ করে দিচ্ছেন সেটা ভাবছেন না?
— আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না
— কেনো করবেন না? কি দোষ আপনার? এই বয়সে বৈধব্য জীবন তো আপনি ইচ্ছে করে বরণ করেননি, এতে আপনার দোষ নেই! তাহলে নিজেকে কেনো দোষী ভাবছেন?
লোকটার কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেললো আরোহী। আফসোস হচ্ছে ওর ভেবে যে একটা অচেনা মানুষ যদি ঐভাবে ভাবতে পারে তাহলে ওর চেনা মানুষগুলো কেনো ভাবতে পারলো না? কেনো তারা শুধু ওর দোষ দিয়ে গেলো এতদিন ধরে? চোখের সামনে দু বছর আগের সেই তিক্ত দিনগুলো ভেসে উঠলো আরোহীর, কত্তো অপবাদ পেতে হয়েছিলো ওকে তখন। এখনও মাঝে মাঝে অপবাদ শুনতে হয় ওকে, পার্থক্য শুধু এইটুকুই যে সময়ের সাথে অপবাদের মাত্রা কমে এসেছে
— আমি নিজেকে দোষী ভাবিনি, আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। আত্মীয় স্বজন, এই সমাজ আমায় বিনা দোষেই দোষী সাব্যস্ত করেছিলো, দু বছর আগে! সবাই তো আর আপনার মতো ভাবে না
ফেলে আসা দুর্দশাময় অতীতের কথা ভেবে কেমন এক তাচ্ছিল্যের হাসি চলে এলো আরোহীর। এদিকে লোকটা শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর দিকে, কিন্তু সেদিকে খেয়াল করেনি আরোহী। ও আবার বলতে শুরু করলো
— তখন একবার ভেঙেছিলাম আমি, অনেক কষ্টে একটু একটু করে নিজেকে সামলেছি। দ্বিতীয়বার ভাঙলে যে নিজেকে সামলানো দায় হয়ে যাবে আমার
— কি বোঝাতে চাইছেন আপনি এই কথার দ্বারা?
— আমি আর কিছুই বলতে চাইনা, আমার শেষ কথা এটাই আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু ম্যারি ইউ!
— আপনি পিছিয়ে গেলেও আমি তো পেছাবো না মিস আরোহী, যেকোনো কাজে আমার এগোনোর অভ্যাস। পিছিয়ে যেতে পছন্দ করিনা
লোকটার দিকে দৃষ্টিপাত করলো আরোহী, ওর সম্পর্কে জানার এতো আগ্রহ কেনো লোকটার মধ্যে বুঝতে পারছে না মেয়েটা! তবুও ও চাইছে লোকটা যেনো বিয়ের জন্যে না করে দেয় ওকে!
— লুক মিস আরোহী, একটা কথা আপনাকে আগেই জানাই যে আমি আমার বাবা মায়ের একমাত্র ছোটো ছেলে, আই মিন আমার বড় আপু আছে, সে অবশ্য ম্যারেড তো আমি এখন একা! আমি মানুষটা নেহাৎ গায়ে গতরে বড়, শক্ত সামর্থ্য হয়েছি। কিন্তু স্বভাব কিন্তু এখনও টেন পড়ুয়া বাচ্চাদের মতো, আমার মায়ের আমার ঘর গোছাতে বড্ড বেগ পেতে হয়! সেসব কিন্তু এরপর আপনাকেই করতে হবে
যেখানে বিয়েটাই অনিশ্চিত ধরে নিয়েছিলো মেয়েটা সেখানে লোকটার মুখে ঘর গোছানোর কথা শুনে চোখদুটো বড় বড় হয়ে এসেছে আরোহীর
— আপনি এখনি এতো দূর ভেবে ফেলেছেন?
— আমি এমনই, অতীত ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করি, বর্তমান নিয়েও কম ভাবি তবে সুদূর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার অভ্যাস বেশি..আপনি না তো আমার অতীত না বর্তমান, আমার ভবিষ্যত জীবনের সঙ্গিনী হতে যাচ্ছেন আপনি। একটু দূরের কথা তো ভাবতেই হয় তাইনা?
— আপনি এতোটা নিশ্চিত কিভাবে হচ্ছেন যে আপনি বললেই বিয়েটা হয়ে যাবে? বিয়েটা কিন্তু আপনি একা একাই করতে পারবেন না মিস্টার..!”
— আই নো, সেই ব্যবস্থাও করে ফেলবো, বলেছি যখন আপনাকে রাজী করিয়েই ছাড়বো!”
ভ্রু কুঁচকে ফেললো আরোহী, লোকটার মধ্যে এতো কনফিডেন্স আসছে কোত্থেকে বুঝতে পারছে না ও
— জোর করে বিয়ে করবেন? আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে?
— জোর করে আমাকে কোনোদিন কিছু পেতে হয়নি, যা চেয়েছি এমনিতেই পেয়ে গেছি আপনাকেও সেভাবেই পাবো। জোর করে ছিনিয়ে নেওয়ায় নয় বরং অর্জনে বিশ্বাসী আমি! বাকিটা সময়ের ওপর ছেড়ে দিন
লোকটার কথাবার্তা যেনো মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে আরোহীর, কি বোঝাতে চাইছে? জোর করে বিয়ে করবে না। একাই পেয়ে যাবে? এটা কিভাবে হতে পারে? লম্বা এক আলোচনা শেষে দুজনেই উঠে দাড়ালো। কি একটা ভেবে লোকটা আরোহীর চায়ের কাপে হাত দিলো। ওটা শুরু থেকে ওইভাবেই আছে, চা ঠান্ডা হয়ে গেছে একদম!
— আমার সাথে বেইমানি করে ফেললেন যে আপনি মিস আরোহী, এটা না করলেও পারতেন
কয়েক মুহূর্তের জন্য ভয় পেয়ে গেলো আরোহী, এ আবার নতুন করে কোন বেইমানির কথা বলছে?
— ম..মানে? কিসের বেইমানি?
— এইযে, আপনি চা খাননি। এখানে থেকে থেকে ঠান্ডা হয়ে গেলো! আমায় দিতে পারতেন, খেয়ে নিতাম। চায়ের প্রতি নেশাটা আমার একটু বেশিই কিনা!
হেসে দিলো লোকটা, আরোহী বোকার মতো তাকিয়ে রইলো তার দিকে। কি না কি ভেবে নিয়েছিলো ও আর লোকটা কিনা এতো সিরিয়াস ভাব নিয়ে চায়ের কথা বলছিলো? ভারী অদ্ভুত উনি! কিছুটা বিরক্তি নিয়ে আরোহী বলে উঠলো
— আমি খাচ্ছিলাম না সেটা তো দেখেছেন, তাহলে নিজেই নিয়ে নিতেন..আমি কিভাবে জানবো যে আপনার চায়ের নেশা?
— আপনাকে জানানোর জন্যেই কথাটা বললাম। আপনি বরং কয়েক রকমের চা বানানো শেখার প্র্যাকটিস শুরু করে দিতে পারেন। আমার জন্যে ভালো হবে
কথাটা বলার সময়ও লোকটার মুখে এক অমায়িক হাসির রেখা লক্ষ্য করলো আরোহী যেটা কথা শুরু করার সময় থেকেই দেখে আসছে.. বুঝলো মানুষটা বেশ প্রানবন্ত স্বভাবের! এমন একজন ওকে বিয়ে করতে চাইছেন ভেবেই মন খারাপ হয়ে আসছে আরোহীর!
— আপনি বোধহয় আমার নাম জানেন না তাইনা?
না সূচক মাথা নাড়লো আরোহী…
— মনে হয় জানার প্রয়োজন মনে করেননি? আমি এতবার আপনার নাম নিলাম কিন্তু কথার মাঝে একবারও আপনার মুখে নিজের নাম না শুনে বড্ড ব্যথিত হলাম! কষ্ট পেয়েছি বুঝলেন তো?
কি মারাত্মকভাবে কথাবার্তা বলছে লোকটা! আরোহী দু কদম পিছিয়ে আসে, লোকটাকে ঠিক সুবিধার লাগছে না ওর!
— পিছিয়ে গেলেন যে? আমার কথাবার্তা পছন্দ হয়নি নাকি আপনার? আমি তো শুনেছিলাম মেয়েরা এরকম টকিং স্টাইল পছন্দ করে
উত্তর দিলো না আরোহী, এ লোক যে কিভাবে ওর মনের কথাও বুঝে ফেলেছে মাথায় আসছে না। জাদু শিখে এসেছি নাকি লোকটা? আরোহীর একটু কাছে এগিয়ে শীতল কণ্ঠে লোকটা বলে উঠলো
— হসপিটালের জন্যে আমি ডাক্তার ইশতিয়াক মীর নীল। কিন্তু আপনার জন্যে আমি ওনলি “নীল” সো এরপর থেকে আপনার সাথে যখনই কথা বলবো তখনই অন্তত পাঁচবার আপনার মুখে “নীল” নামটা শুনতে চাই”
চোখ নিচু করে তাকিয়ে ছিলো আরোহী, নীলও আর প্রতিউত্তরের অপেক্ষা করলো না। ছাদ থেকে নেমে যেতেই যাচ্ছিলো তখন আরোহী বলে উঠলো
— আপনার বাড়ির সবাই কি সব জানে আমার ব্যাপারে?
দাড়িয়ে গেলো নীল, তবে পেছনে ফিরলো না
— সেসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না, আমার ওপর ছেড়ে দিন ওসব। আমি ভালো থাকলেই আমার বাবা মা খুশি
— ওনারা মানবেন না আমায়! আরেকবার ভেবে দেখুন
— সেসব আমার ওপর ছেড়ে দিন, আর আমি কোনো সিদ্ধান্ত নেবার আগে এমনভাবে ভেবে নেই যাতে দ্বিতীয় বার ভাবতে না হয়! সব জানার পরও আপনাকে বিয়ে করতে চাই আমি আর হ্যা ভাববেন না আমার ওপর কারো কোনো প্রেসার আছে। এ সিদ্ধান্ত সম্পূর্ন আমার একার
চলবে….
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন..!!]