চৈত্রের শেষে বৃষ্টি পর্ব-০১

0
30

#চৈত্রের_শেষে_বৃষ্টি (০১)
#ছনিয়া_তাবাচ্ছুম

” এক ছেলে’র বাপ’রে আমি বিয়ে করতে পারবো না মা। এটা তোমরা ভাবলে কি করে আমি একটা অবিবাহিত মেয়ে হয়ে একটা বিবাহিত ছেলে কে বিয়ে করবো? সামনে আমার পুরো জীবন পড়ে আছে মা। বিয়ে কোনো ছেলে খেলা নয়। বিয়ে একটা পবিত্র সম্পর্ক। আমার পক্ষে এই বিয়ে টা করা সম্ভব নয় মা! ”

এক নিশ্বাসে পুরো কথাটা বলে দম নেয় শশী। শশী’র কথা’য় চুপসে যান তাহমিনা আক্তার। তিনি মেয়ে’র দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। তিনি এবার শান্ত চাহুনি তে তাকিয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে নরম সুরে বললেন,

” শশী মা, আমার পুরো কথাটা তো তুই শোন। শোনা’র পর তোর যেটা ভালো মনে হয় তুই সেটাই করিস। আমরা তোকে কেউ কিচ্ছু বলব না।

শশী মা’য়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” মা তুমি কিভাবে এমন একটা প্রপোজাল দিতে পারলে? তুমি আমাকে চিনো না?তুমি জানো না তোমার মেয়ে কেমন? বাবা না হয় বুঝলো না। কিন্তু তুমি,তুমি তো বুঝবে আমায়। নাকি বড়ো আপাই চলে যাওয়ার পর থেকে আমিও তোমাদের কাছে পর হয়ে গেছি?

তাহমিনা আক্তার ছলছল চোখে মেয়ে’র পানে তাকান। তিনি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললেন,

” মা’রে এভাবে বলিস না। আমরা তোর ভালো চাই। বাবা-মা কখনো সন্তানের খারাপ চাই না৷

শশী তাচ্ছিল্যের হেসে সুধালো,

” তাহলে একটা বিয়াত্তা ছেলের সাথে আমাকে বিয়ে দিতে চাইছো কেন? দেশে কি মেয়ের অভাব পড়ছে যে তাকে আমাকেই বিয়ে করতে হবে। সবসময় আমিই কেন বলি’র পাঠা হবো মা! লাস্টের কথা টা আস্তে বলায় তাহমিনা আক্তার শুনতে পেলেন না। তিনি ফের বললেন,

” তোর জন্য যদি একটা বাচ্চা ছেলে তার মায়ের অভাব পূরণ করতে পারে। তাহলে দোষ কথা’য় শশী৷

শশী মা’য়ের দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়,

” মা তোমরা যতটা সহজ ভাবছো বিষয় টা ঠিক ততটাই কঠিন। আমি বাইরে বের হলে লোকে আমায় দেখে বলবে ঐ দ্যাখ শশী এক ছেলের বাপরে বিয়ে করছে। তখন বিষয় টা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তুমি ভাবতে পারছো৷ আমি কিভাবে সমাজে চলাফেরা করব বলো তো?

তাহমিনা আক্তার আবার বললেন,

” তুই তো কারোর কথা গা’য়ে মাখিস না শশী। যে যা বলে মুখের উপর জবাব দিয়ে আসিস। কারোর কথা পরোয়া করিস না। তাহলে ছোট্ট উৎসবের জন্য তুই একটু করতে পারবি না।

শশী আশ্চর্য হয়ে বলে ওঠে,

” উৎসব, এখানে উৎসব আসছে কোথা থেকে মা। উৎসব আমার জান। ওর তুলনা কারোর সাথে করবে না মা। আমি নিজের থেকেও উৎসব কে ভালোবাসি।

তাহমিনা আক্তার মৃদু হেসে বললেন,

” উৎসব! উৎসব ই তো আসবে। তুই উৎসব কে যতটা ভালোবাসিস। এমনটা আর কেউ ভালোবাসতে পারবে না রে মা।

শশী এবার সিরিয়াস হয়ে বসল। তারপর মা’য়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

“মা তুমি একটু ক্লিয়ার করে বলবে আসল কাহিনী টা কি?

তাহমিনা আক্তার নড়েচড়ে বসে মেয়ে কে বললেন,

” আমি সেই প্রথম থেকেই তোকে বিষয়টা খুলে বলতে চেয়েছি। তুই ই আমার কথা বুঝতে চাসনি। জেদ ধরে বসে আছিস।

” এত ঘুরিয়ে পেচিয়ে না বলে সোজাসাপটা বলো তো?

তাহমিনা আক্তার শশী ‘র দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা তোর সাথে সৌহার্দ্যের বিয়ে দিতে চাই।

কথাটা যেন বিস্ফোরণের ন্যায় ফেটে পড়ল। শশী চেচিয়ে বলে ওঠে,

” হোয়াটটটট..? এসব তুমি কি বলছো মা? তোমাদের মাথা ঠিক আছে? কি বলছো ভেবে বলছো? নাকি মেয়ে’র শোকে মাথা টাও গেছে।

তাহমিনা মেয়ে’র কথায় অবাক হন না। তিনি জানতেন এমনটাই হবে। শশী কখনো রাজি হতে চাইবে না। শুধু শশী কেন কোনো মেয়েই চাইবে না একটা বিবাহিত ছেলে সাথে একটা দুই বছরের বাচ্চা। কোনো মেয়ের পক্ষে ‘ই এটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তবুও তিনি কিছু টা আশা নিয়ে এসেছিলেন। তিনি ফের সাহস জুগিয়ে শশী’র কাছে এগিয়ে আসেন। অতঃপর অনুরোধের সুরে বলেন-

“- মা’রে একটু বোঝার চেষ্টা কর। উৎসব তোর খুব নেউটা। তোকে ছাড়া কিছু বোঝে না। আমরা যদি সৌহার্দ্য কে অন্য কোনো মেয়ে’র সাথে বিয়ে দেই। আর সে যদি ভালো না হয়, মানে বলতে চাইছি আমাদের সমাজে এমন অহরহ ঘটনা ঘটছে। বউ মারা যাবার পর ছেলে বিয়ে করে নতুন বউ ঘরে আনছে। অথচ দ্যাখ সৌহার্দ্য জেদ ধরে বসে আছে সে কাউকে বিয়ে করবে না। সৌহার্দ্য চাই না তার ছেলেটা সৎ মায়ের কাছে থেকে বড় হোক। ও চাই না বাচ্চা ছেলেটা মার ধোর খা’ক।

“- তোমরা যে সৌহার্দ্য ভাইয়ের সাথে আমাকে বিয়ে দিতে চাচ্ছো সেটা কি সৌহার্দ্য ভাই জানে। আকস্মিক নিজের কথার মাঝে মেয়ের কথা শুনে থেমে যান তাহমিনা। পরক্ষণে শশী’র প্রশ্নে চুপ হয়ে যান।

শশী মা’ কে চুপ যেতে দেখে ফের বলল,

“- কি হলো মা চুপ করে গেলে কেন? আমার কথার উত্তর দাও। এভাবে চুপ করে থাকলে কোনো কিছুরই সলিউশন হবে না।

“- হ্যাঁ, সৌহার্দ্য জানে।

“- কিহহ! সৌহার্দ্য ভাই এই বিয়ে করতে রাজি আছে।

তাহমিনা মেয়ে’র মেজাজ বুঝতে পারেন। তাই তো তিনি বললেন-

“- শশী মা। তুই যা ভাবছিস তেমনটা না। সৌহার্দ্য এই বিয়ে টা করতে চাই না। ও চাই না তোর জীবনটা নষ্ট হোক। ছেলেটা খুব ভালো রে মা। তাই তো,,

“- আমি একা থাকতে চাই মা। প্লিজ লিভ মি এলোন।

তাহমিনা আর কথা বাড়ান না চুপচাপ দরজা ভিড়িয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যান।

তাহমিনা যেতেই শশী দরজার ছিটকিনি দিয়ে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে পরে। চলন্ত সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে-

“- এ কেমন পরিস্থিতিতে ফেললে আল্লাহ! আমি এখন কি করব? একদিকে ওই ছোট্ট বাচ্চা টা আরেক দিকে আমি। কিভাবে কি করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না আল্লাহ। প্লিজ এই পরিস্থিতিতে থেকে আমায় রক্ষা করো। আমি কখনোই চাই না উৎসব কষ্ট পাক। তুমি কি সব আগে থেকেই ভেবে রাখছিলে। হ্যাঁ তুমি তো উত্তম পরিকল্পনাকারী। যা করো সবকিছু আগে থেকেই ঠিক করে রাখো। আমি জানি এরপর যা হবে সেটা হয়ত আমার জন্য খুব কষ্ট দায়ক হবে তবে আমি এটা জানি আমার একটা ডিসিশনে হয়ত উৎসবের জীবন টা বদলে যেতে পারে। শশী ঘনঘন কয়েকটা নিঃশ্বাস নেয়।

_________

আমি নওরীন শশী। বাবা মায়ের ছোটো সন্তান। আমাকে যার সাথে বিয়ে দিতে চাইছে তিনি আমার বড় আপু’র হ্যাজবেন্ড সৌহার্দ্য আহসান। সৌহার্দ্য ভাইয়ের আরেকটা পরিচয় আছে তিনি সম্পর্কে আমার ফুপাতো ভাই। আমার একমাত্র ফুপির আদরের ছেলে। আপু আর ভাইয়া দু’জন দু’জন কে ভালোবেসে বিয়ে করছিল। পরিবারের সবাই খুব খুশি হয়েছিল আপুদের বিয়েতে। বিয়ের ছ’মাস যেতেই পরিবারের সবাই আরো বেশি খুশি হয় তখন যখন আপুর কন্সিভ করে। আপুর প্রেগন্যান্সির খবর শুনে ফুপা পুরো এলাকায় মিষ্টি খাইয়েছিল। আমাদের বাসা থেকে ফুপি দের বাসায় যেতে দশমিনিট লাগে। তারপর দেখতে দেখতে কেমন যেন সময় কেটে যায়। আপুর ডেলিভারির সময় চলে আসে। আপুকে যখন ডেলিভারি করার জন্য ওটিতে নেওয়া হয় । ঠিক ঠাক ভাবেই আপুর ডেলিভারি হয় কিন্তু তখন ডক্টর এসে বলে-

” এখানে পেসেন্টের বাসার লোক কে?

তখন ভাইয়া দৌড়ে গিয়ে বলে –

“- আমি, কি হয়েছে ডক্টর। সব ঠিক আছে তো? কিছুটা আতঙ্ক নিয়ে বলে।

ডক্টর গম্ভীর হয়ে বলল-

” – মিস্টার আহসান আপনার স্ত্রী র কন্ডিশন ভালো নয়। আপনারা কি জানতেন না বাচ্চা নিলে আপনার স্ত্রী ‘র প্রাণ সংশয় হবে।

সৌহার্দ্য চমকে বলল-

” আপনি কি বলছেন ডক্টর সব তো ঠিক ছিল। আমার স্ত্রী তো সুস্থ ছিল। ওর কোনো খারাপ কন্ডিশনের কথা ডক্টর বলেনি।

“- মিস্টার আহসান আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। আপনার স্ত্রী সব জানতেন। বিষয়টা আমিও জানতাম। বাট আপনি যে জানেন না সেটা আমি জানি না।

সৌহার্দ্য অনেক ভেঙে পড়ে কান্না জড়ানো কন্ঠে ডক্টর কে বলল-

” আমার স্ত্রী’র কি হয়েছে ডক্টর। আমি এ ব্যাপারে কিছু জানি না। প্লিজ আমাকে একটু খুলে বলবেন।

” সত্যি বলতে আমি বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। তিনি ক্যান্সারের পেসেন্ট ছিলেন। তিনি জানতেন এই অবস্থায় বেবি নিলে তিনি আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বেন তারপরও তিনি বেবি নিছেন। আমি যদি জানতাম আপনি এই ব্যাপরে কিছু জানেন না তাহলে অনেক আগেই আমি আপনাকে সব বলে দিতাম।

***

হসপিটাল থেকে চার দিন পর আপুকে রিলিজ দেওয়া হয় । আপুকে আমাদের বাসায় আনা হয়। যেখানে সবাই উৎসব কে নিয়ে মেতে থাকবে সেখানে সবাই মনমরা হয়ে বসে থাকে। উৎসবের যখন তিনমাস বয়স হলো ঠিক তখনই আপু আমাদের সবাইকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যায়।

শশী নিজের ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পরে। সেটা অতি সন্তর্পণে মুছে নেয়।

অতঃপর ফোন হাতে নিয়ে একটা নাম্বারে ডায়াল করে। কিছুক্ষণ পর ফোন টা রিসিভ হয়। শশী ফোন কানে নিয়ে বলল-

“- আমার সাথে দেখা করতে পারবা খুব আর্জেন্ট ।

#চলবে