যে থাকে আঁখি পল্লবে পর্ব-০২

0
27

#যে_থাকে_আঁখি_পল্লবে
#পর্ব-২

দোতলা দালানটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রুজাইফ। তিনশো ষাট ডিগ্রী এঙ্গেলে ঘুরে পুরো বাড়িটায় একবার চোখ বুলালো। উত্তর দক্ষিণ আর পূর্ব তিন দিকে তিনটে পাকা দালান দাঁড়িয়ে। উত্তর আর দক্ষিণের দু’টো দোতলা দালান মাঝের দালানটা একতলা। মাঝখানে বড় উঠোন বরাবর প্রবেশ পথ। পুরো বাড়ির চারপাশে ইটের গাঁথুনি দিকে প্রাচীর দেওয়া। তমিজউদদীন নামের মানুষটা বেশ রুচিশীল ছিলো বোঝা যাচ্ছে। রুজাইফ ফজিলাতুন্নেছার দিকে তাকিয়ে চোখ নাচাল-“তোমার জামাইটার রুচি তো ভালো মনেহচ্ছে। তো এই রুচিশীল মানুষটা কুরুচিপূর্ণ কাজটা করলো কিভাবে?”
ফজিলাতুন্নেছা অসন্তোষ প্রকাশ করলো-“বাদ দে রুজাইফ। মৃত মানুষকে নিয়ে খারাপ বলতে নেই।”
দিদার দিকে তাকিয়ে কাঁধ নাচালো রুজাইফ-“তুমিও আজব মানুষ মাইরি। বিশ বছর আগের স্বামীর সমালোচনা সইতে পারো না। এতো প্রেম নিয়ে দূরে থাকলে কি করে?”
অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঘরে প্রবেশ করলো ফজিলাতুন্নেছা। রুজাইফও এলো পিছু পিছু-“আচ্ছা সরি, আর বলবো না এসব কথা।”
ফজিলাতুন্নেছা জবাব দিলো না। আলো জ্বালিয়ে ঘরগুলো দেখতে লাগলো। একটা রান্নাঘর একটা স্টোররুম সহ আরও দু’টো কামরা আছে নিচতলায়।
মাঝের ঘরখানা খাবার ঘর মনেহয়। বারো চেয়ারের বড়সড় একটা টেবিল পাতা আছে। একপাশে শোকেস আর বসার ডিভান। সাথেই একটা বড় বেডরুমে। প্রাচীন কালের মতো আট বাই আট ফিটের ভারী নকশার বড় খাট। পাশে স্টিলের আলমারি একটা আলনা কাপড় রাখার র্যাক। এই কামরাটা সম্ভবত তমিজউদদীনের। তার একটা বড় ছবি ঝুলছে দেয়ালে। ঠিক পাশেই আরেকটা পারিবারিক ছবি যেখানে তমিজউদদীন তার পুরো পরিবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা সময় নিয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকলো ফজিলাতুন্নেছা। শামসুন্নাহার আর তিনছেলে বউবাদে কাউকে চিনতে পারলোনা ফজিলাতুন্নেছা। ছবির দিকে তাকিয়ে হাসলো সে। একটা সুখী পরিবারের ছবি। এই ফ্রেমে তারও তো থাকার কথা ছিলো। ওপস, ভুল বললো। তারই থাকার কথা ছিলো সন্তানদের নিয়ে। কিন্তু সত্যি কথা হলো ওই ফ্রেমে তার জায়গা হয়নি। গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ঘুরতেই রুজাইফ এর সাথে চোখাচোখি হলো। অসস্তি নিয়ে রুজাইফকে দেখলো। ছেলেটা তার দিকে তাকিয়ে আছে অপলক।
“কি দেখছিস?”
রুজাইফ জবাব না দিয়ে দেয়ালের ছবিটা একটানে খুলে ফেললো। ফজিলাতুন্নেছা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো-“কি করছিস?”
রুজাইফ বড় বড় কদমে পা ফেলে বাইরে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে ছবিটা উঠোনে ছুড়ে দিলো। ফিরে এসে ফজিলাতুন্নেছার হাত ধরলো-“যে জিনিস কষ্ট দেয় তা ছুড়ে ফেলতে দেরি করতে নেই। শুধু যেচে পড়ে কষ্ট কেন পাবে?”
ফজিলাতুন্নেছার নয়ন আদ্র হলো। বলতে চাইলো, মনের মধ্যে যে বসে আছে তাকে কি করে ছুঁড়ে ফেলি? বিশ বছরেও তো পারলাম না ছুঁড়ে ফেলতে। উল্টো তার দেওয়া কষ্ট বুকের ভেতর পেলে পুষে বড় করছি। দিদার মনের অবস্থা টের পেয়েই তার হাত ধরে টানলো-“চলো উপরের ঘরগুলো দেখে আসি। তুমিও কিন্তু উপরেই থাকবে আমার পাশের ঘরে। আর ফুপু মা আর নাদিরা নাহিয়ানের জন্য ঘর পছন্দ করে নাও।”
ফজিলাতুন্নেছা হাত ছাড়িয়ে নিলো-“তুই দেখ। আমি এই ঘরেই থাকবো।”
“দিদা! এসব আবেগ কেন দেখাচ্ছ? বোঝা যাচ্ছে উনি এই ঘরে থাকতেন। ওনার ঘরে কেন থাকবে তুমি? জীবিত থাকতে তো তার জীবন থেকে সরিয়ে দিয়েছে।”
ফজিলাতুন্নেছা হাসলো-“আরো দুটো দালান থাকতে এই দালানটাই কেন আমার নামে দিলো বুঝতে পারছিস? মানুষটা চেয়েছে তার মৃত্যুর পরে আমি থাকি তার ঘরে।”
রুজাইফ রেগে গেলো-“ওই হিপোক্রেট লোকটা কি চেয়েছে তা জানতে চাই না আমি। বারবার তার উদাহরণ দিয় না আমাকে।”
ফজিলাতুন্নেছা বিছানায় বসলো। ক্লান্ত স্বরে বললো-“তুই যা। উপরে কোন ঘরে থাকবি দেখে পছন্দ কর। নিমাকে ফোন করে জানিয়ে দে আমরা পৌঁছেছি। নয়তো ওরা টেনশন করবে।”
“আচ্ছা। আর খাবারের চিন্তা করো না। আমার অফিস সহকারী চলে আসবে খাবার নিয়ে। আমি ফোন করে দিয়েছি।”
ফজিলাতুন্নেছা বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। তার বড্ড ক্লান্ত লাগছে। দীর্ঘ দিন পর স্বামীর ভিটেয় ফেরা কিন্তু মনে আনন্দের লেশমাত্র নেই। যে জায়গাটা তারই ছিলো সেটা ফিরে পেতে মুল্যটা কি একটু চুকাতে হলো না? পেছনের দিকে ফিরে তাকালে কেবলই মরুভুমির শুন্যতা টের পায়। ফজিলাতুন্নেছার ভাঙাচোরা বুকটা কি এই পাওয়ায় শান্তি পাবে?

★★★

দক্ষিণের দোতলার কাচারি ঘরে তখন মিটিং বসেছে। শামসুন্নাহারকে ঘিরে তার তিন ছেলে, তাদের ছেলেমেয়ে সকলেই এই মিটিং এ উপস্থিত আছে। মাজেদ নম্রস্বরে জানতে চাইলো-“মা, আব্বা এমন কিছু করবে তা কি একবারও বলছে আপনাকে?”
শামসুন্নাহার মাথা নাড়লো-“কইলে কি আর এতো বড় একটা আকাম করতে দেই? ঘুনাক্ষরেও টের পাই নাই মানুষটার মনে কি চলতেছে?”
মাজেদ নীরব রইলো। সাজেদের বউ লাকি টিপ্পনী কাটলো-“বোঝা যাইতেছে আব্বার ওই বউয়ের প্রতি খুব টান আছিল।”
শামসুন্নাহার অগ্নিশর্মা হয়ে মেঝ বউকে দেখলো। জাহাঙ্গীর অস্থির পায়চারি করতে করতে থামলো-“স্কুলটা আব্বা ওই পোলার নামে দিলো কেন? এতো কষ্ট কইরা ওই স্কুল আধা সরকারি করলাম এহন ওই দুইদিনের পোলা আইসা মাতব্বরি করবো। আমি মানমুনা ভাইজান।”
মাজেদ কি বলবে ভেবে পেলো না। এমন পরিস্থিতি তাদের জীবনে আসবে কখনো ভাবেনি। মাজেদের বড় ছেলে উপল যে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে সে জানতে চাইলো-“আব্বা, যদি কিছু মনে না করেন আমাদের একটু বিস্তারিত বলেন। আমরা ভাইবোনরা কেউই ওনাদের বিষয়ে কিছু জানি না।”
মাজেদের সাথে চোখাচোখি হলো শ্যামলীর। সে সবাইকে তাড়া দিলো-“তোরা তোদের ঘরে যা। তোদের সাথে এইসব নিয়ে আলোচনা করার সময় হয় নাই এখনো।”
সেঁজুতি ফোঁস করে উঠলো-“কিন্তু আমরা থাকবো কোথায়? আমাদের ঘর তো দখল হয়ে গেলো।”
“তুমি আপাতত নীলা আর কেয়ার সাথে রুম শেয়ার করো। ওপাশের ঘরের কাজ শুরু করবো কালই। উপল আর মেরাজ কাচারি ঘরে থাকুক আপাতত। তোর কোন আপত্তি আছে সাজেদ?”
“না ভাইজান, আপত্তি থাকবে কেন?”
“আমি আর শ্যামলি জাহাঙ্গীরের ঘরের ছোট রুমটাতে থাকবো আপাতত।”
“ভাইজান, আপনেরা কি ওই ছোট ঘরে থাকতে পারবেন? আমাদের ঘরে থাকেন না হয়?”
জাহাঙ্গীরের বউ খুকু বললো। মাজেদুর মাথা নাড়ে-“নাহ, কারো সমস্যা করা পছন্দ না আমার। দোতলায় ঘর করা পর্যন্ত একটু কষ্ট করবো আমরা।”
বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে আদেশ দিলো-“তোমরা এখন নিজেদের ঘরে যাও। বিকাল থিকা একের পর এক কাহিনি চলতেছে। আর শোন, ওদের সাথে কেউ আগ বাড়ায়া কথা কবা না। সব বিষয়ের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত কোন ঝামেলা চাই না আমি।”
সেঁজুতিরা মাথা দুলিয়ে সায় দিয়ে ঘর ছাড়লো। বাচ্চারা চলে যাওয়ার পর খুকু বললো-“ভাইজান, ওনাদের জন্য কি খাবারের আয়োজন করবো?”
মাজেদুর মায়ের দিকে তাকালো। শামসুন্নাহার গোমড়া মুখে বসে আছে নিশ্চুপ। তার ইচ্ছে ছিলো মানুষ দুটোর খাওয়ার দায়িত্ব নিতে৷ তাদের বাড়িতে অতিথির কদর করার সুনাম আছে। কিন্তু মায়ের মুখের ভাব দেখে আর কিছু বলার সাহস হলো না।
“থাক বাদ দাও। ওরা নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা করুক। বেশি আদিখ্যেতা করলে আবার ভাববে আমরা ভয় পায়া ওদের সাথে মিলমিশ করতে চাইতেছি।”
“আমরা তাইলে রাতের খাওয়ার আয়োজন করি।”
শ্যামলি বেরিয়ে গেলো। তার পিছু পিছু লাকি আর খুকু।
“ওই পোলা কি যেন নাম কইলো?”
“রুজাইফ।” মাজেদের কথার প্রতিউত্তর সাজেদ জবাব দিলো।
“ওর সম্পর্কে এট্টু খোঁজ নে। কি কাম করে জানার চেষ্টা কর।”
“আচ্ছা।”
মাজেদ আড়চোখে শামসুন্নাহারকে দেখলো। তখনও সেভাবেই বসে আছে। জাহাঙ্গীর মায়ের কাছে এগিয়ে গেলো। মাকে জড়িয়ে ধরতেই শামসুন্নাহার ঝরঝর করে কেঁদে দিলো-“তোর বাপ সারাজীবন ওই বেটির দিকে ঝুল দিছে। বড় বউ ছিলাম আমি তাও তার কাছে আমার মুল্য ছিলো দুই আনা। যে ঘরে পন্চান্ন বছর তার সাথে কাটাইলাম সেই ঘর সে দিয়ে গেলো আরেকজনকে। মরে যাইতে যাইতে বুড়া ওই মাতারীকে আমার চাইতে বেশি সন্মান দিয়ে গেলো।”

★★★

দোতলায় মাঝে একটা বসার ঘর বাদে চারদিকে মোট চারটা শোবার ঘর। ঘরগুলো বেশ গোছানো আর টিপটপ। ঘুরে ঘুরে দেখছিল রুজাইফ। চেহারায় সন্তুষ্টির চিন্হ। ফুপু মায়ের থাকার অসুবিধে হবে না। নাদিরা নাহিয়ান নিশ্চিত খুব খুশি হবে। ওদের কতদিনের ইচ্ছা গ্রাম দেখার। গ্রামে থাকবে শুনেই দুই ভাইবোন খুশিতে আটখানা হয়ে গেছিল। এখন শহুরে সুযোগ সুবিধায় গ্রামে থাকার ব্যবস্থা দেখে দু’জন খুশিতে লাফাবে নিশ্চিত। ভেবে নিজের মনে হাসলো রুজাইফ। এলোমেলো ভাবনা ভাবতে ভাবতে একদম কোনার দিকের কামরায় এসে থমকে গেলো সে। পুরো ঘরটা যেন একখন্ড তুষার ঘর। সব কিছু সাদা এই ঘরের। নিজের অজান্তে মুগ্ধ নয়নে সবকিছু দেখলো সে। বোঝা যাচ্ছে এ ঘরের বাসিন্দা একজন মেয়ে এবং সে খুব যত্ন নিয়ে ঘরটা সাজিয়েছে। দেয়ালে টানানো ছোট ছোট হ্যান্ডিক্রাফট দেখে মন জুড়ালো। হুট করে ভেসে আসা উইনচাইন্ডের টুংটাং আওয়াজটা কানে দারুণ লাগলো। রুজাইফ পায়ে পায়ে বারান্দায় এগুলো। মানিপ্লান্টের ঝাড় দেখে থমকালো। সুন্দর নকশা করে মানিপ্লান্টগুলো গ্রিলের সাথে জড়িয়ে আছে। নিচে মেঝেতে তিনটে গোলাপের চারা শোভা পাচ্ছে যাতে তিনরঙা তিনটে গোলাম ফুটে আছে। রুজাইফ ফুল খুব ভালোবাসে এমন না। তবে কেন যেন আজ ভালো লাগলো। বিক্ষিপ্ত মনটা শান্ত হয়ে যাচ্ছে অকারণে। সে ঘরে ফিরে এলো। শুভ্র সুন্দর বিছানাটা দেখে চোখে ঘুম জড়িয়ে এলো। বুঝলো কাল থেকে ছুটে চলা ক্লান্ত শরীর বিশ্রাম চাইছে। কিছু না ভেবেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো রুজাইফ। নরম গদিতে গা ডুবে গেলো সহসাই। ঘুমের অতলে হারিয়ে যেতে যেতে আচমকা উঠে বসলো রুজাইফ।

শরীর জুড়ে অসম্ভব চুলকানি শুরু হয়েছে। কেমন যেন লাগছে। রুজাইফ পাগলের মতো চুলকাতে শুরু করলো দুই হাত গলা ঘাড়। বুঝে পেলো না আচমকা কি হলো তার? এভাবে চুলকানোর মানে কি? মিনিটের মধ্যে গলা আর হাতের চামড়া উঠে জায়গায় জায়গায় জখম হলো। দ্রুত কাপড় ছেড়ে পাশের ওয়াশরুমে ঢুকলো। ঠান্ডা জলে স্নান করলো আধাঘন্টা ধরে তবুও জ্বালা কমলো না। অসহ্য বোধ হলো রুজাইফের। এর প্রতিকার কি? পাগলের মতো আধভেজা হয়ে বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে। কি মনে করে বিছানার চাদরটা তীক্ষ্ণ নজরে পরীক্ষা করলো দূর থেকে। তেমন কিছু চোখে পড়লোনা কিছু গুঁড়ো ময়লা ছাড়া। চুলকানি জারি তখনো। পাগলের মতো গায়ে পরার কিছু খুঁজতে লাগলো। খুঁজতে গিয়েই আয়নায় নজর গেলো তার। লাল লিপস্টিক দিয়ে লেখা বাক্যটা পড়লো বারকয়েক। বুঝলো এই বিছানাটাই যত নষ্টের গোড়া। নিশ্চিয়ই কিছু ছিটানো আছে বিছানায় যার দরুন এই ইচিং শুরু হয়েছে। আগের বাসিন্দা তার জায়গা ছাড়তে নারাজ ছিলো এটা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলো বার্তা দিয়ে। রাগতে যেয়েও শব্দ করে হেসে দিলো রুজাইফ। নেহাৎ বাচ্চামি আচরণ করা মানুষটাকে দেখতে মন চাইতে। মেয়েটা নিশ্চয়ই তমিজউদদীনের আদুরে নাতনি হবে। দাঁতে দাঁত চেপে হাসি থামালো রুজাইফ। ভাবছে, সামান্য রুমের মায়া যে ত্যাগ করতে পারে না সে কি জানে রুজাইফ চাইলে তাদের বাসস্থানই কেড়ে নিতে পারে?

চলবে—
©Farhana_Yesmin