#যে_থাকে_আঁখি_পল্লবে
#পর্ব-৯
“এই সেঁজুতি আপা, দেখো দেখো।”
কেয়া আঙুল উঁচিয়ে সামনের বারান্দায় নির্দেশ করলো। সেঁজুতি দেখলো তার রুমের বারান্দায় কেতাদুরস্ত পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। তার সিল্কি ঘন ঘাড় পর্যন্ত কাটা চুলগুলো হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। ফর্সা ত্বকে লাল রঙের ফ্রকটা এমন ভাবে ফুটে আছে যেন প্রস্ফুটিত গোলাপ। বয়স আনুমানিক চোদ্দ পনের। তারমানে কেয়ার বয়সী মেয়েটা। সেঁজুতি জুলজুলে চাহুনি দিয়ে দেখতে লাগলো মেয়েটাকে। মেয়েটা তার লাগানো গাছগুলোর দেখছে মুগ্ধতা নিয়ে। পানি দিচ্ছে সম্ভবত। কে মেয়েটা? ওই কুংফু পান্ডার বোন? এতো সুন্দরী? কেয়া পাশ থেকে ফিসফিস করলো-“কি সুন্দর দেখতে আবার পোশাকটাও কি সুন্দর। শহরে থাকে লাগে। তাই না আপা?”
সেঁজুতি জবাব দিলো না। উল্টো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো মেয়েটাকে। কেয়া আবারও ডাকলো-“এই আপা, ওই বাড়িতে আর কে কে থাকে?”
সেঁজুতি বিরক্ত হয়ে বললো-“কেন? তুই জাইনা কি করবি?”
“ওরা কি আমগোর কেউ না? কেউ না কেউ তো লাগেই। তাই কইতেছিলাম আর কি, জাইনা রাখা ভালো। এক বাড়িতেই তো থাকুম সেইজন্য।”
“আমারে জিগায়া লাভ কি? আমি কি ওগোরে চিনি আগে থিকা? তোর আব্বা অথবা চাচারে জিগা।”
“হেরা কিছু কইতো না।” কেয়া মুখ বাঁকায়।
“তাইলে চুপ থাক। আমার মাতা খাইস না।”
কেয়ার মুখ কালো হলো। সেঁজুতি আপা সবসময় এমন করে। কিছু বলতে চায় না উল্টা খালি ধমক দেয়। এদিকে সেঁজুতির পুরো মনোযোগ তার বারান্দায় নিবন্ধিত। দেখছে সে ওই মেয়েটাকে। কিছুক্ষণ পর রুজাইফ এসে দাঁড়িয়। মেয়েটা উচ্ছ্বসিত হয়ে কি যেন বলছে। রুজাইফ হাসি মুখে তার কথা শুনছে। সেঁজুতি অবাক হয়ে দেখলো, সর্বদা রাগান্বিত থাকা রুজাইফের চেহারায় বাচ্চাসুলভ হাসি ফুটে আছে। সেঁজুতি মনে মনে বিরবির করলো-“এই লোক হাসতেও পারে?”
হুট করে সেঁজুতির সাথে চোখাচোখি হলো রুজাইফের। সাথে সাথে মুখটা কঠিন হলো তার। মেয়েটার হাত টেনে ঘরে নিয়ে গেলো। শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিলো। সেঁজুতির তীব্র অপমানবোধ হলো। বিক্ষিপ্ত মনে ভ্রু কুঁচকে সে তাকিয়ে রইলো তার চিরচেনা বারান্দার দিকে।
★★★
সন্ধ্যায় দিদার ঘরে চা খাওয়ার নামে গল্পের আসর বসেছে। গল্পের মধ্যমনি রুজাইফ। ওকে ঘিরে বাকিরা বসে আছে। রুজাইফ নাদিরা আর নাহিয়ানের দিকে তাকালো-“তোরা আপাতত বাড়ির বাইরে যাবি না। কোথাও ঘুরতে মন চাইলে আমাকে বলবি আমি নিয়ে যাব। আর আমি স্কুল কলেজের খোঁজ করছি। সদরে ভর্তি করাবো তোদের। দু’জনকে একই জায়গায় দেব যাতে একসাথে আসা যাওয়া করতে পারিস। ঠিক আছে?”
নাহিয়ান মাথা দুলালো-“ঠিক আছে ব্রো। কিন্তু একটা কথা বলো তো, নতুন জায়গায় এসেছি একটু ঘুরে বেড়াব না? এভাবে বাড়িতে বসে থাকা যায়? সকালে ছাঁদে উঠে দেখেছি এ বাড়ির আশপাশটা বেশ সুন্দর।”
রুজাইফের চোয়াল শক্ত হলো-“এ বাড়ির আশেপাশে যত সুন্দর এ বাড়ির মানুষগুলো তত ভয়ংকর। তোদের নিয়ে কোন রিস্ক নিতে চাই না আমি। আর ফুপা, আপনিও যখন তখন ঘর থেকে কোথাও যাবেন না। বাইরে বের হলে অবশ্যই ফু মাকে বলে যাবেন৷ আর কারো সাথে আলাপে যাবেন না। ঠিক আছে?”
হাশেম বাধ্য ছেলের মতো মাথা দুলালো। ফজিলাতুন্নেছা বসে বসে সব দেখছে৷ হুট করে বলো বসলো-“এতো সাবধান থাকার কিছু নাই রুজাইফ। ওরা তোর পরিচয় পাইলে কিছু করার সাহস পাবে না। তাছাড়া এক বাড়ির মধ্যে থেকে এতো কিছু মাথায় রাখা যায় না আসলে। এই বাড়িতে এখন যারা আছে তাদের কেউই আমাদের সম্পর্কে জানে না ঠিকঠাক। তাদের থেকে খারাপ কিছুর আশঙ্কা করা ঠিক না।”
রুজাইফ বিরক্ত হলো-“দিদা, এসব কথা বলো না প্লিজ। ও বাড়ির কেউ যে আমাদের নিয়ে ভালো কথা বলবে না তা জানা আছে ভালোমতো। যারা নতুন তারা তো বড়দের কথাই বিশ্বাস করবে। আর ধরো যদি আমাদের নামে উল্টো পাল্টা নাও বলে তবুও বংশের ধারা বলেও একটা কথা আছে। ওরা কারণে অকারণে আমাদের হিংসে করবে, ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। সেজন্য আমাদের জানা বা চেনার কোন প্রয়োজন হবে না। আমি বলছি সবাই সাবধান থাকবে তো থাকবে। বেশি কথা বাড়িয়ে লাভ কি?”
নাদিরা রুজাইফ হাত ধরলো-“আচ্ছা ঠিক আছে দা ভাই আমরা কোথাও যাব না তোমাকে না জানিয়ে। ঠিক আছে? এতো প্যানিক হয়ো না রে বাবা।”
রুজাইফ হেসে দিলো। নিমা এতোক্ষণ চুপ করে ছিলো এখন সে মুখ খুললো-“এ বাড়িতে না থাকলে হয় না রুজাইফ? মা বলছিল শহরে বলে একটা বাড়ি আছে। তাহলে আমরা সবাই ওই বাড়িতে থাকলেই তো হয়।”
রুজাইফ মাথা নাড়ে-“সবকিছু এতো সহজ ভেবো না ফু মা। হুট করে উড়ে এসে সব দখল করে নিতে চাইলে ওরা কি সহজে ছাড়বে? ওখানে থাকলে ওরা সহজেই অনেক শয়তানী করতে পারবে। ওরা কেমন তাতো আর তোমাকে বলার দরকার নেই। আমাদের ক্ষতি করার কোন অপশন পেলে ছাড়বে না। তাই রিস্ক নেবো না আমি। একটা কথা মনে রেখো, শত্রুর যত কাছে থাকবে তত নিরাপদ থাকবে।”
রুম জুড়ে নীরবতা নেমে এলো। রুজাইফ গলা নামালো-“খুব সহজে কাউকে বিশ্বাস করবে না। কারো কাছে কোন গোপন কথা বলবে না। অন্তত কিছুদিন তোমরা আমার কথা মেনে চলো৷ সম্পদের বিলি বন্টন হোক। আমাদের ভাগের জিনিস বুঝে নেই তারপর আর এখানে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। তবে সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার আগ পর্যন্ত ঘুনাক্ষরেও কারো কিছু বোঝা চলবে না। ঠিক আছে?”
সবাই মাথা দুলিয়ে সায় জানালো। হাশেম হাসি হাসি মুখ করে বললো-“আমি তাইলে কি করুম রুজাইফ?”
রুজাইফ হতচকিত হলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো হাশেমের দিকে। সত্যি বলতে হাশেমকে নিয়ে তার বড় ভয় হয়৷ লোকটার কাজের কোন আগামাথা নেই, পরিস্থিতি বোঝার জ্ঞান নেই। ভেবে নিয়ে মুচকি হাসে রুজাইফ-“আপনি গোয়েন্দা হবেন ফুপা? নজর রাখবেন সবদিকে। কে কি বললো তা শুনে পেটে জমা করবেন। আমি অফিস থেকে ফিরে এলে আমায় সব জানাবেন। ঠিক আছে?”
হাশেম ভীষণ খুশি হয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসলো-“ঠিক আছে। এই কাজ আমি খুব ভালো কইরা করুম দেইখো।”
হাশেমের উত্তর শুনে রুজাইফ খুশিই হলো। মানুষটা এই কাজে ব্যস্ত থাকলেই ভালো। অন্তত অন্য কোন ঝামেলায় জড়াবে না তাহলে।
★★★
মায়ের অনুমতি নিয়ে গেটের পাশের ফাঁকা জায়গায় বাড়ি বানানোর কাজ শুরু করেছে মাজেদ। সন্ধ্যায় স্কুল থেকে ফিরে চেয়ারে বসে থেকে মিস্ত্রিদের কাজই দেখছিল। তখনই সেঁজুতি পায়ে পায়ে বাবার কাছে এসে দাঁড়ায়। মাজেদ একবার মেয়েকে দেখে আবার কাজ দেখায় মন দিলো। সেঁজুতি উসখুস করছে। মাজেদ আবারও মেয়ের দিকে তাকালো-“কিছু বলবা আম্মা?”
সেঁজুতি মাথা দুলায়-“বাড়ি হইতে কতদিন লাগবে আব্বা?”
“বছরের কাছাকাছি লাগবে আম্মা।”
সেঁজুতি চোখ কপালে তুললো-“এক বছর? এতোদিন ওগো সাথে থাকা লাগবে আমাগো?”
সেঁজুতির মুখে আঁধার নামে। মাজেদ নরম চোখে মেয়েকে দেখলো। মেয়েটা ছোট বলে একটু আদূরে। তারউপর ভালো ছাত্রী বলে মাজেদ ভীষণ দূর্বল মেয়ের ব্যাপারে। সে কোমল গলায় বললো-“তাড়াতাড়ি করার চেষ্টা করবো আম্মা। তয় বাড়ির কামে তাড়াহুড়ো করা যায় না। গাতনি ভালো ন হইলে তো বাড়ি মাইঙা মরুম সবাই।”
সেঁজুতি ভয়ে ভয়ে মৃদুস্বরে বললো-“আমার ওই ঘরের জিনিসগুলা আনবানা আব্বা?”
মাজেদ না বুঝে মেয়ের মুখপানে তাকালো-“কি কইলা বুঝি নাই।”
সেঁজুতির বুক টিবটিব করে। বাবা আবার রেগে যাবে নাতো? সে নম্র কন্ঠে শুধায়-“কইতেছিলাম ওই ঘরে যেসব জিনিস আছে ওইগুলা আনলে হয় না? অনেক পছন্দ কইরা আনছিলাম।”
মাজেদ ক্ষনকাল চুপ থাকে। তারপর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো-“যা কিছু অন্যের হয় তাতে নিজের দাবি রাখতে নাই আম্মা। আমি তোমাকে নতুন জিনিস গড়াই দিব। ওর চাইতে সুন্দর জিনিস দিব। তুমি মোবাইলে সার্চ কইরা দেখো। যেইটা ভালো লাগে সেইটা দিয়া তোমার ঘর সাজায় দিব।”
সেঁজুতি কথা হারায়। তার হৃদয়ে চিনচিনে ব্যাথা অনুভুত হয়। নতুন কিছু দেখার ইচ্ছে তার হচ্ছে না। এতো কষ্ট করে সবকিছু খুঁজে খুঁজে এনে সাজিয়েছিল। এখন আবার ওইসব করার ধৈর্য্য হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, নতুন ঘরটা যে দখল হবে না তার কি গ্যারান্টি। সেঁজুতি মুখ গোজ করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। মাজেদ মেয়ের মনের ভাব বুঝেও বুঝলো না। ওই ছেলেটা ঘরের সব জিনিস নিয়ে যেতে বললেও মাজেদ চায় না আর। ছেলেটা তাকে দয়া দেখতে চাইছে। মাজেদের এখনো এতো খারাপ দিন আসে নাই যে ওই ছেলের দয়া নিতে হবে।
★★★
রবিবার সকাল থেকে রুজাইফের মেজাজ খুব ফুরফুরে। সময়ের একটু আগেই তৈরি হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো। অফিস তখন কেবল সব ঝাড়ামোছা হচ্ছে৷ রুজাইফ নিজের কেবিনে বসে কেসের কাগজপত্র গুছিয়ে নিলো। টেবিলে ফাইলের পাহাড় জমছে যেন। কয়েকদিন ধরে যেসব কেসের কাগুজে কাজ করেছে সেসব গুছিয়ে রাখলো। ডায়েরির নোটগুলোতে নজর বুলিয়ে নিলো, কিছু কিছু জায়গা কারেকশন করলো। সব কাজ শেষ করে সন্তুষ্ট হয়ে ঘড়ির দিকে তাকালো। অফিস টাইম হয়ে গেছে আগেই। বেল বাজিয়ে সহকারীকে ডাকার আগেই তাকে দরজায় উঁকি দিতে দেখা গেলো-“স্যার, সব তৈরি। কাজ শুরু করবেন?”
রুজাইফ মাথা দুলায়-“ওই মেয়েটা এসেছে? দুই বিয়ের কেসটা?”
“মেয়েটা আর তার প্রথম জামাই আসছে স্যার। তবে বিবাদী আসে নাই এখনো।”
“আর মেয়েটার গার্জিয়ান? তাদের সমন পাঠানো হইছিল না? আজকে উপস্থিত থাকার কথা বলা হইছে?”
মতিন মাথা নাড়ে-“পাঠানো হইছে স্যার তবে এখনো ওরা কেউ আসে নাই। ওর সিরিয়াল পরে দেই স্যার। জমি সংক্রান্ত একটা কেস আছে ওইটা দেখেন৷ অনেকদিন ধইরা ঘুরতেছে এরা। ততক্ষণে ওদের সবাই আসুক।”
খানিকটা বিরক্ত হলো রুজাইফ। ভেবেছিল সকালের কেসটাই আগে দেখবে। সে অসন্তুষ্ট হয়ে মাথা দুলিয়ে উঠে দাঁড়ালো। রুম থেকে বেরিয়ে নির্ধারিত আসনে বসলো। কেসের বাদী বিবাদী উকিলদের কথা শুনতে শুনতেই দরজার নজর পড়লো তার। দেখলো মাজেদ ব্যস্ত হয়ে হলরুমে ঢুকছে। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে খুঁজছে মনেহয়। তাকে বেশ বিচলিত দেখাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর নাদেরকে ঢুকতে দেখা গেলো। সে সরাসরি মাজেদের দিকে এগুলো। দু’জনে কথা বলছে বেশ উত্তেজিত হয়ে। দূর থেকে এমন দৃশ্য দেখে রুজাইফের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। তার মেয়ের কেসটার বিচারক রুজাইফ এটা জেনে মাজেদের কেমন লাগবে? তাকে দেখে মাজেদের মুখের এক্সপ্রেশন কেমন হবে দেখার খুব ইচ্ছে রুজাইফের। মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে তার। আজকের দিনটা বেশ আনন্দময় হতে চলেছে এটা বুঝে তার খুশিতে শিষ বাজাতে মনচায়।
চলবে—
©Farhana_Yesmin