#যে_থাকে_আঁখি_পল্লবে
#পর্ব-১৫
রাতে খেতে বসে মাজেদ খুব উসখুস করছে। জরুরি কথা বলবার আছে কিন্তু কিভাবে বলবে বুঝে পাচ্ছে না। শামসুন্নাহার ছেলেকে দেখলো-“কিছু কবি বাজান? এমুন করতাছোস কেন?”
“আম্মা, খুব হাত টান যাইতেছে। কি করুম বুঝতেছি না।”
সাজেদ খাবার খাওয়া থামিয়ে বললো-“কেন ভাইজান? হাত টান কেন?”
মাজেদ গম্ভীর হলো-“বিয়ার অনুষ্ঠান গেলো, তারপর বাড়ির কাজ চলতেছে। এদিকে ওই পোলাকে দেওয়া লাগছে কিছু টাকা।”
জাহাঙ্গীর ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো-“কোন পোলা?”
“রুজাইফরে। প্রথমে দুই লাখ চাইছিলো। পরে ওইদিন হিসাবপত্র দেইখা আরও তিনলাখ চাইলো। ওরে টাকা দিয়া আমার হাতে আর কোনই টাকা নাই। এইদিকে স্কুলে মাস্টার গো বেতন দেওয়া লাগবে। কি করি কও তো?”
সাজেদ সাবধানে চেচিয়ে উঠলো-“এইসব কি কন ভাইজান? ওই পোলা চাইলো আর আপনে টাকা দিয়ে দিবেন? আমাগোরে জানাইছেন একবারও? না জানায়া এতোবড় কামডা করলেন কেমনে?”
মাজেদ মিনমিন করলো-“জানানোর টাইম দিছে নাকি? কইলো না দিলে সরকারি অফিসে কমপ্লেন কইরা নিবন্ধন বাতিল কইরা দিবে।”
জাহাঙ্গীর রেগে গেলো-“আর আপনে ভয় পাইয়া টাকা দিয়া দিলেন? এমনে দিলে আমরা চলুম কি দিয়া?”
মাজেদ অসহায় চাহুনি দিলো-“তাইলে কি করতাম? ওর লগে যুদ্ধ করুম?”
“লাগলে তাই করুম। আমাগো এতোদিনের সাজানো গুছানে জিনিস ওরে এমনে খাইতে দিতাম?”
মাজেদ বিরক্ত হয়ে বললো-“তোরা যা পারোস কর। আমি এইসব ঝামেলায় যাইতে পারুম না। এমনেই কম ঝামেলায় নাই। আম্মা, এখন কি করুম কন? টাকা জোগাড় না হইলে স্কুলের স্যারগো বেতন আর আমার বাড়ির কাম দুইটাই বন্ধ হইয়া যাবে।”
শামসুন্নাহার চুপচাপ খাওয়া শেষ করলো। মাজেদ অধৈর্য্য হয়ে বলেই ফেললো-“আম্মা কিছু কন? কি করুম এহন?”
শামসুননাহার বিরক্ত হলেন-“আমি কি করুম? এইসব কিছু বুঝি আমি? তোরা তিনভাই মিলা ঠিক কর কি করবি?”
সাজেদ বলে উঠলো-“ইটের ভাটার বেচাবিক্রি একদমই কম। নাই বললেই চলে। দেওয়ার মতো টাকা নাই।”
“এইবার ফসলের দাম কম। গুদামের আলু বেইচা যা হইছিল তার অর্ধেক তো দিলাম বিয়াতে। যা আছে তা আবার ফসলের জিনিস কেনায় দরকার লাগবে।”
জাহাঙ্গীর তাড়াহুড়ো করে জবাব দিলো। মাজেদ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে-“আম্মা, উত্তরে রাস্তার পাশের জমিটা বেচতে চাই। ওই টাকা দিয়া আপাতত স্কুলের খরচ আর আমার বাড়ীর কাজটা সামাল দেই।”
জাহাঙ্গীর ফট করে বলে ফেললো-“অতো ভালো জমি বেচবেন মানে? ওই জমি তো একা আপনের না। আপনে এই সিদ্ধান্ত নিলেন কেমনে?”
অপমানে আর বেদনায় নীল হলো মাজেদ। দুঃখী গলায় বললো-“তাইলে কি চাস তোরা? আমি উদ্বাস্তু হইয়া থাকি? সাজেদের এই দোতলা, তোর নামের একতলা আমি নিজে দাঁড়ায় থাইকা কাম করাইছি। তোগো জিনিস বইলা আলাদা নজরে দেখি নাই। আর আব্বা নিজের দালানডা আমারে দিতে চাইছে বইলা আমি আর নতুন কইরা কিছু বানাইনাই। এহন ওই দালান আব্বা তার আরেক পক্ষরে দিলে এই দায় কি খালি আমার? কষ্ট একা আমার আর আমার পোলাপানের করা লাগতেছে কেন?”
রুম জুড়ে নীরবতা নেমে এলো। মাজেদের হৃদয় চুর্ন করে একটা শ্বাস ছাড়লো-“সবার সব গুছানো হিয়া গেছে বইলা এখন আমি কিছু করলেই তোগো চোখে লাগবে এইটা মানুম না আমি। আমার মাথা গুজুনের ঠাই লাগবে তাই ওই জমি বিক্রি করাই লাগবে। আরেকটা কথা, ওই পোলা যদি আব্বার দেওয়া সবকিছু বুইঝা নিতে শুরু করে তাইলে আমরা সবাই বিপদে পড়ুম। তার চাইতে ভালো ও যা চায় তা ওরে দেই। তাতে যদি ওয় শান্ত থাকে থাক।”
“কিন্তু শেষ পর্যন্ত তো ও নিজের সব বুইঝা নিবই। তাইলে ওর চাওয়া পূরণ কইরা লাভ কি?”
না পারতে বলে ফেললো লাকি।
“তাইলে তুমি কি কও? ওরে এখনই সব বুঝায় দিব?”
সাজেদ গর্জে উঠলো-“ভাইজান পাগল হইছেন? আমাগো তো তাইলে ভিক্ষার থালা নিয়া বসা লাগবে।”
মাজেদ মাথা নাড়ে-“আমিও তাই কই। যত দিন দেরি করা যায় কর। এরমধ্যে ওরে ঠেকানোর অন্য কোন উপায় বাইর কর তোরা। নাইলে যা হইবো সবারই তা ভোগ করা লাগবে।”
শামসুন্নাহার এবার ফিসফিস করলো-“এইবার এমন কিছু কর যাতে পুরা পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়া যায়। বারবার এই ঝামেলা পোহাইতে ভালা লাগে না।”
মাজেদ চমকে গেলো-“আম্মা, আপনে যা বলতেছেন বুঝে বলতেছেন?”
শামসুননাহারের নয়ন দ্বয় ক্ষনিকের জন্য জ্বলে উঠলো যেন-“না বুইজা কউনের কি আছে? বিশ বছর আগে যদি জানতাম এমুন কিছু হইবো তাইলে তখনই ব্যবস্থা নিতাম। এমনে ছাইড়া দিতাম না ওগোরে।”
★★★
দু’দিন পর ফেরার কথা থাকলেও রুজাইফ ফিরলো পাঁচ দিন পরে। বিকেলে সেই সময় দোতলায় আসর বসেছে। পাখির কিচিরমিচিরের শব্দের মত কলকাকলীতে মুখর কোনার ঘরে উঁকি দিতেই সব চুপচাপ। রুজাইফ অবাক হয়ে দেখলো সেঁজুতি, নাহিয়ান আর নাদিরা ফ্যাকাশে মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নাদিরা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো-“দা ভাই, তুমি! আজকে আসার কথা ছিলো? কই মাতো কিছু বললো না?”
রুজাইফ ঘরের ভেতর এসে দাঁড়ায়। তিনটে নার্ভাস মুখকে জড়িপ করলো-“আসার কথা তো তিনদিন আগেই। দেরি হলো বলে আজ এলাম৷ কিন্তু মনেহচ্ছে হঠাৎ এসে তোদের খুব প্রবলেম করে দিলাম?”
নাদিরা কষ্ট করে ঠোঁট টেনে হাসলো-“আরে তা কেন? আমরা তো তোমাকে মিস করছিলাম।”
রুজাইফ দু’হাত আড়াআড়ি ভাবে রেখে দাঁড়ালো। মাথা নেড়ে বললো-“হ্যা, দেখতেই পাচ্ছি কতটা মিস করছিস।”
নাহিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে বললো-“ব্রো, আমরা পড়ালেখা নিয়ে আলাপ করছিলাম। জানো সেঁজুতি আর আমি ক্লাস মেট? আরও মজার ব্যাপার হলো আমরা দুজনাই সায়েন্স। ভালোই হলো না বলো? এখানে একই বাড়িতে পড়ালেখা করার একজন পার্টনার পাওয়া গেলো।”
রুজাইফের দৃষ্টি সেঁজুতিতে আঁটকে আছে। মেয়েটা তখন থেকে মাথা নিচু করে পা খুঁটিয়ে যাচ্ছে। রুজাইফ ওকে দেখতে দেখতেই বললো-“হুমমম, খুব ভালো। তা কি পড়বি দু’জন মিলে ঠিক করেছিস?”
সেঁজুতি উঠে দাঁড়ায়-“আমি আসি নাদিরা।”
নাদিরা মাথা নাড়তেই সেঁজুতি দৌড়ে বেরুতে যেয়ে সোজা রুজাইফের সাথে ধাক্কা খেলো। মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে পিছিয়ে গেলো মেয়েটা। নাদিরা ছুটে এলো-“সেঁজুতিপু, ব্যাথা পেয়েছ?”
সেঁজুতি মাথা নাড়ে-“নাহ ঠিক আছি আমি। আচ্ছা যাই হ্যা।”
বলেই প্রায় পালিয়ে গেলো বলা যায়। নাদিরা বারবার ঢোক গিলছে আর রুজাইফকে দেখছে ভয়ে ভয়ে-“দা ভাই, বকো না প্লিজ। সেঁজুতিপু ভালো মেয়ে। তুমি জানো, ওর সাথে ওরা কথা বলে না। ওই যে ওই লোকটার সাথে বিয়েতে রাজি হয়নি বলে ওরা আপুকে দেখতে পারে না। আপুর থাকার জন্য ঘরও নেই। এই রুমটায় নাকি আপু থাকতো। এখন তো আমি থাকছি। সব শুনে দিদা বললো, সে যেন আমার এখানে এসে থাকে। আপু রাজি হয়নি কিন্তু আমিই জোর করেছি। তুমি প্লিজ ভুল বুঝো না।”
“ব্রো, সি ইজ রিয়েলি সুইট। একটু বোকাসোকাও আছে। বাট পড়ালেখায় খুব ভালো বুঝলে। দেখলাম অনেক কিছু আমার থেকে ভালো বোঝে।”
নাহিয়ান কাঁধ ঝাঁকাল। রুজাইফ ঠোঁট চেপে কথা শুনছিল। এবার মুখ খুললো-“তুইও ভালো বুঝতি যদি গেম খেলা থেকে ফুরসত পেয়ে বইয়ে চোখ বুলাতি।”
নাহিয়ান মাথা চুলকালো। কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে ফেরত গেলো সে। ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে ফজিলাতুন্নেছার কাছে বসলো। রাতের খাবার খেতে খেতে গত দিনগুলোর খোঁজ খবর নিলো। সন্তুষ্ট হয়ে ঘুমাতে গেলো।
এদিকে সেঁজুতির কেন যেন সে রাতে ঘুম হলো না। সারারাত এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দিলো। বারবার সন্ধ্যার ঘটনা মনে পড়ছে। হুট করে রুজাইফকে দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিল সে। তারউপর রুজাইফের ওরকম অন্তরভেদি দৃষ্টির সামনে কেমন কুঁকড়ে যায় সে। লোকটা খুব ত্যাড়া, নিজের কথার নড়চড় করে না। মায়াদয়াও কম মনেহয়। ও যে এতো জোরে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলো লোকটা তবুও একচুল নড়লো না। শুধু ছোটো করে একটা কথা বলেছিল যা তার কানে বেজে চলেছে এখনো-“হাঁটতেও পারে না ঠিকঠাক। এ নাকি আবার আমাকে ঠেকাবে।”
অন্য সময় হলে একদম সাথে সাথে উচিত জবাব দিয়ে দিত সেঁজুতি কিন্তু ওইসময় কেন যেন কথা আসেনি মুখে। উল্টো অপমান বোধে কান গরম হয়ে উঠেছিল। লোকটাকে কি করে জব্দ করবে ভেবে পাচ্ছে না কিছুতেই।
★★★
প্রায় প্রতিদিন স্কুল থেকে বেরুলেই নাদেরকে দেখতে পাচ্ছে নীলা। ওকে দেখলেই নাদের তেলতেলা একটা হাসি দিচ্ছে যা দেখে গা জ্বালা করছে৷ এই লোককে কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না নীলার। কেমন গদগদ হয়ে কথা বলে। বিয়ের পরদিন ফিরানিতে এসে বাবা মাকে বলে দিয়েছে আর যাচ্ছে না নাদেরের কাছে। অন্তত স্কুল শেষ হওয়া অবধি তো নয়ই। বাবা মা কিছু বলেনি। কিন্তু এই নাদেরের ঢং শুরু হয়েছে। প্রায় প্রতিটা দিন স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে থাকে। নীলা বেরুলে ওর সাথে সাথে হেঁটে বাড়ি পর্যন্ত আসে। নীলা বাড়িতে ঢুকলে সে চলে যায়। পথে টুকটাক কথা বলে নাদের। কোন কোন দিন আইসক্রিম চকলেট কিনে দেয়। নীলা নিতে না চাইলে জোর করে বলে নিঃশব্দে নিয়ে নেয়। পরে বাড়িতে এসে চুপটি করে ফেলে দেয়। নাদেরকে আজ অব্দি বাড়িতে ডাকেনি নীলা।
আজ নাদের চকলেট বা আইসক্রিম কোনটাই কেনেনি। চুপচাপ নীলার পাশে পাশে হাঁটছে। নীলা মাঝে মাঝে নাদেরকে দেখছে আড়চোখে। হুট করে নাদের বললো-“আজকে চকলেট আইসক্রিম কিনি নাই। দিয়ে কি লাভ তুমি তো খাও না। বাড়িতে ঢুকে ফালাই দাও।”
নীলা দাঁড়িয়ে গেলো। লজ্জাও পেলো খুব। লোকটা দেখলো কিভাবে এতোসব? নাদের হাসলো সামান্য-“তুমি ঘরে ঢুকুনের আগ পর্যন্ত খাঁড়ায় থাকি তাই দেখছি।”
শরমে গাল দুটো লাল হলো নীলার। নাদের অবশ্য দাঁড়ায় না হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে বললো-“তুমি আমারে ঘিন্না করো?”
নীলা চুপ করে রইলো। নাদের তার জবাব পাওয়ার আশা না করে বললো-“ঘিন্না করার মতো কিছু কি করছি আমি? বিয়া হইছে তোমার লগে আমার। মানলাম বিয়াডা তোমার ইচ্ছায় হয় নাই। যেমনেই হোক হইছে তো? তাইলে এখন মাইনা নিলে কি হয়? আমি তো কোনকিছুতে জোর করতাছি না। তুমি তুমার মতো থাকো পড়ালেখা করো। আমি মাঝে মাঝে দেখতে আসি তোমারে। বউ লাগো দেখতে মন চায়। তুমি পছন্দ না করলে তাও আসমু না। তবুও আল্লাহর দোহাই লাগে উল্টাপাল্টা কিছু কইরো না। তোমার লগে জীবনডা কাটাইতে চাই নীলা। আমি মানুষটা এতোটাও খারাপ না। একটু ভালো কইরা ভাইবা দেখো টের পাইবা।”
নীলার বুকটা ধুকপুক করছে। বাকী পথ নাদের চুপচাপ রইলো। নীলা ঘরে ঢুকতেই সে ফিরতি পথ ধরলো। আজ নীলা পিছু ফিরে নাদেরের চলে যাওয়া দেখলো। কেন যেন তার মনটা উদাসী হলো বিনা কারণে।
★★★
নাদিরা আর নাহিয়ানকে সাথে নিয়ে আজ তাড়াতাড়ি ফিরে আসছে রুজাইফ। একসাথে গাড়িতে ফিরলে ঝামেলা কমে যায় বলে আজ অফিস থেকে একটু আগেই বেরিয়ে এসেছে। পথে দু’জনার পড়ালেখার আপডেট শুনছিল। হঠাৎ করে দু’জনই চেচিয়ে উঠলো। রুজাইফ চমকে পিছু ফিরে জানতে চাইলো-“কি হয়েছে?”
নাদিরা জানালো-“সেঁজুতিপুকে দেখলাম। পথে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে ”
“কি বলিস? ও এখানে কেন আসবে? এটা তো ওর বাড়ি আর স্কুলের উল্টো পিঠে।”
নাহিয়ান বললো-“আমিও দেখেছি ব্রো। একা মেয়ে এই মাঝপথে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের ওকে হেল্প করা উচিত ব্রো।”
“দা ভাই, প্লিজ একটু পেছাও গাড়িটা। আপু একা একা দাঁড়িয়ে আছে যদি কোন বিপদ হয়?” নাদিরা নাকি সুরে আবদার করলো৷ রুজাইফ বিরক্ত হলো-“কি জ্বালা! ওর এলাকা, সবাই চেনে ওদের। ওর কেন বিপদ হবে?”
“তবুও দা ভাই। বলা তো যায় না। দেখছো না রাস্তা ঘাট কেমন শুনশান হয়ে আছে? চলো না প্লিজ। নানু শুনলে কিন্তু খুব বকবে তোমাকে।”
অগত্যা বাধ্য হয়ে রুজাইফকে গাড়ি ঘোরাতে হলো। সেঁজুতি আসলে ভয়ে ভয়েই দাঁড়িয়ে ছিলো। সকালের সাথে দেখা করতে এসেছিল কলেজ ফাঁকি দিয়ে। সোহান এতদূর এগিয়ে দিয়ে নিজের কাজে গেছে। এখন নির্জন রাস্তায় বড্ড ভয় করছিল। পরিচিত গাড়িটাকে দেখে মনে খানিকটা সাহস পেলেও রুজাইফের কথা ভেবে কুঁকড়ে গেলো। কিন্তু পরক্ষণেই নাদিরা আর নাহিয়ানের উচ্ছ্বসিত ডাকে সে রুজাইফকে ভুলে গেলো। গাড়িতে উঠে তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে গল্প শুরু করলো। কেন এসেছে, কিভাবে রাস্তায় দাঁড়ালো সব বিস্তারিত বলে তবেই দম নিলো সেঁজুতি। পানি খেতে গিয়ে সামনের আয়নায় নজর পড়তে পানি উগলে দিলো নিজের গায়ে। এই বেডা এমনে তাকায় আছে কেন? যেন চাহুনি দিয়ে গিলে খাবে এমন করে তাকিয়ে আছে দেখে সেঁজুতি ঢোক গিললো।
রুজাইফ একনজরে মিররে তাকিয়ে দেখছিল সেঁজুতিকে। লম্বা বিনুনিটা বুকের উপর পড়ে আছে অবহেলায়। কানের ঝুমকো এমনভাবে দুলছে যেন বিদ্রোহ করছে কানে থাকবে না। তার আশেপাশে কিছু ছোট ছোট চুল উড়ছে বাতাসে। চোখে কাজল লেপ্টে আছে। মাঝারি ঠোঁট জোড়ায় লিপস্টিকও আধা খাওয়া। তবুও সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে রইলো রুজাইফ। তারপর মেয়েটা মুখ থেকে পানি উগলে দিলো। দেখার মতো হয়েছিল মুখটা। রুজাইফের হাসি পেলেও হাসলো না। মুখ টিপে গম্ভীর হয়ে বসে রইলো। ভাবছে, সোহান ছেলেটাকে দায়িত্ববান ভেবেছিল। সেই ছেলে কিনা তার একমাত্র সুন্দরী শ্যালিকাকে এভাবে একা ফেলে চলে গেছে? দেখা হলে খুব করে বকো দেবে তাকে।
চলবে—
©Farhana_Yesmin
#যে_থাকে_আঁখি_পল্লবে
#পর্ব-১৬
সেঁজুতি তার পুরনো নিজ হাতে সাজানো রুমটাতে মোটামুটি পাকাপোক্ত আসন গেড়ে নিয়েছে। কলেজের ক্লাস শেষ করে ঘরে ফিরে গোসল খাওয়া ঘুম শেষ করে বইখাতা নিয়ে চলে আসে নাদিরার ঘরে মানে তার পুরনো ঘরে। নাদিরা ততক্ষণে স্কুল থেকে ফিরে খেয়ে দেয়ে তৈরি। সেঁজুতি আসলে কিছুক্ষণ গল্প করে দু’জনই পড়তে বসে। খানিক বাদে নাহিয়ান ওদের সাথে যোগ দেয়। সেঁজুতি আর নাহিয়ান একই ক্লাসের বলে দু’জনার ভাব হয়েছে দ্রুত। ক্লাসে কি হলো না হলো সেসব নিয়ে হাসাহাসি আর আড্ডা চলে রুজাইফ আসার আগ অবধি। রুজাইফ এলে সাথে সাথে নাহিয়ান নিজের কামড়ায় ফিরে যায়। সেঁজুতিও নিজের বাসায় ফিরে যায়। তবে প্রায় দিনই রুজাইফের নজরে পড়ে যায় সে। অবশ্য ইদানীং রুজাইফ কিছু বলছে না তাকে। দেখলে কেবল ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া।
আজ রুজাইফ ওদের সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। খেয়ে দেয়ে একটুু শুয়েছিল। হুট করে ঘুম ভেঙে গেলো হইচই এর শব্দে। বিরক্ত হয়ে উঠে এলো বাইরে। নাদিরার ঘরে উঁকি দিতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। সেঁজুতিসহ তিনজন মজা করে আড্ডা দিচ্ছে। হাসাহাসি করতে করতে একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ছে। রুজাইফ ঘরি দেখলো। এইসময় এভাবে সময় নষ্ট করার মানে কি? এটা পড়ালেখার সময় এভাবে আড্ডা দেওয়ার সময় নাকি? সে রাগান্বিত হয়ে রুমে ঢুকলো। ওরা তিনজনই ভয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। মুখ কাচুমাচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। রুজাইফ কিছু বলবে তার আগেই নুমা ওর হাত ধরে টানলো-“নিচে আয় রুজাইফ। মা ডাকছে তোকে।”
রুজাইফ হতবাক হলেও প্রশ্ন না করে মেনে নিলো। মাথা দুলিয়ে ওদের দিকে চাইলো-“নাহিয়ান, তোর টিচার আসার কথা আজ। মনে আছে?”
নাহিয়ান একবার ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার নামিয়ে ফেলে। মাথা নেড়ে বললো-“মনে আছে ব্রো।”
“মনে থাকলেই ভালো।”
বলেই বেরিয়ে এলো সে। তার পিছু পিছু নুমা। রুজাইফ নিচে নামতে নামতে ফুপুর দিকে তাকালো-“কি হয়েছে? ওভাবে টেনে নিয়ে এলে কেন? ওরা পড়ালেখা না করে গল্প করে নাকি প্রতিদিন?”
নুমা হাসলো-“ওরা গল্প করে এটা সত্যি। তবে এইটুকু সময় গল্প করলে ওদের মন ভালো থাকে। পড়ালেখা করে মন দিয়ে। তুই বকা দিলে ওদের মন খারাপ হতো। তাই টেনে এনেছি।”
রুজাইফ দাঁড়িয়ে গেলো-“একটু বেশি আসকারা দিচ্ছ না? ও বাড়ির কাউকে কিন্তু ভরসা করো না। ওরা কেমন তা নিশ্চয়ই তোমাকে ভেঙে বলার প্রয়োজন নেই।”
“জানি। কিন্তু মেয়েটা ভালো। একটু বেশি চঞ্চল তবে ওর মধ্যে প্যচ নেই।”
“আচ্ছা ধরলাম প্যাচ নেই। তা বলে প্রতিদিন এখানে আসে কেন? আর ও বাড়ির লোকেরাই বা আসতে দেয় কেন? সন্দেহজনক কিনা বলো? হাজার হোক আমরা তো ওদের শত্রুই।”
“আহা, ও শত্রু নাকি? ও কি জানে অতীত? ছোট মানুষ, নিজেদের বাড়ি ছিলো, নিজের ঘর ছিলো এটা। এখানে থাকলে হয়তো ভালো লাগে। তাই আসে। থাক কিছু বলিস না।”
রুজাইফ হতাশ হয়ে মাথা নাড়ে-“তোমরা এতো সহজে গলে যাও ফুমা। এতো তাড়াতাড়ি মানুষকে বিশ্বাস করতে নেই না হলে ঠকতে হবে। কে জানে ওকে ইচ্ছে করে পাঠায় কিনা? আমাদের খবর জানতে পাঠাতেও পারে।”
নুমা হতাশ হয়ে বললো-“তুই বড্ড বেশি ভাবিস সবকিছু নিয়ে।”
“ভাবতে হয়। এটা অতীত থেকে শিক্ষা পেয়েছি ফুমা।”
কথা বলতে বলতে দু’জনে এসে বসার ঘরে বসলো। এই ঘরটা নতুন করে ডেকোরেট করা হয়েছে। বড় একটা টিভি লাগানো হয়েছে, সোফাসেট দিয়ে আরামদায়ক বসার ব্যবস্থ করেছে। সেই সোফায় বসে ফজিলাতুন্নেছা টিভি দেখছে। দুজনকে দেখে জানতে চাইলো-“কি হয়েছে? কি নিয়ে কথা বলছিস দু’জন?
রুজাইফ দিদার কাছে বসলো-“তেমন কিছু না। তোমার কোমড় ব্যাথার কি হাল?”
ফজিলাতুন্নেছা টিভির দিকে নজর ফিরিয়ে ঠোঁট বাঁকায়-“আছে একরকম। বুড়ো বয়সে আর কত ভালো থাকবে। এই নুমা, হাশেম কোথায়? বেশ অনেকক্ষণ হলো ওকে দেখছিনা।”
নুমা রান্নাঘর থেকে জবাব দিলো-“বাইরে গেছে মা।”
ফজিলাতুন্নেছা সতর্ক করলো-“ও আজকাল একটু বেশি বাইরে থাকছে। বোকাসোকা মানুষ, কখন কি হয়ে যাবে। মানা করিস এতো বাইরে থাকতে।”
নুমা চা আর পাকোড়া নিয়ে ফিরে এলো। রুজাইফের হাতে চা দিয়ে বললো-“এখানে চায়ের দোকানে কয়েকজনার সাথে আলাপ হয়েছে নাকি। গল্প করতে যায় বলে কিছু বলি না। সারাদিন ঘরে বসে থেকে কি করবে?”
রুজাইফ ভাবলো কথা ঠিকই। হাশেম করবেটা কি? বোকাসোকা মানুষটা যে কোন কাজে গেলে ঝামেলা বাঁধিয়ে দেয়। এই মানুষকে কেউ কি কাজ দেবে?
★★★
মাজেদের উপর দুই ভাই ভীষণ রুষ্ট হয়ে আছে। এতো ভালো জমি কম দামে সেল দিয়েছে দেখে দু’জনই মনে মনে রাগ। মুখে না বললেও আচরনে বুঝিয়ে দিচ্ছে। দু’জনের বউ শ্যামলীর সাথে কথা বলছে না কোন। খাওয়ার সময় হলেও ওরা আগে আগে খেয়ে উঠে যাচ্ছে মাজেদকে ডাকছে না। জমিজমা কিংবা অন্য ব্যবসার টাকা পয়সার হিসেবও দিচ্ছে না। মাজেদ সব বুঝেও চুপচাপ থাকছে। অনেকটা নিরুপায় সে। সে জানে এতোদিনে যখন নিজের জন্য আওয়াজ তুলেছে সবার কাছে খারাপ হবে এটাই স্বাভাবিক। আজকে শামসুন্নাহার তিন ছেলেকে একসাথে ডেকে নিলো খাওয়ার জন্য। বউয়েরাও আছে। বাচ্চাদের আগেই খাইয়ে দেওয়া হয়েছে। শামসুন্নাহার খাবার শুরুর আগে বললো-“তোরা তিন ভাই আমার শক্তি। তোগে ভবিষ্যত ঠিক রাখুনের লাইগা আমি ন্যায় অন্যায় কিছু দেখি নাই। অথচ আইজ বাইরের মানুষের লাইগা তোরা নিজেরা ঝগড়াঝাটিতে লিপ্ত। মা হইয়া আমি কেমনে দেখি এইসব?”
তিন ভাই চুপ করে রইলো। শামসুন্নাহার তিনছেলের মুখ পানে তাকায়-“নিজেরা অশান্তিতে থাকলে বাইরের লোক সুযোগ পাইবো। এমন করিস না বাজানরা।”
সাজেদ ফট করে বলে বসলো-“ভাইজান তো নিজের সুবিধা ছাড়া কিছু ভাবতেছে না আম্মা। নিজের বাড়ি তুলুনের লাইগা জমি বেচলো। ওই পোলার সাথে খাতির জমানোর লাইগা ওরে ঠিকই তলে তলে টাকা দিতেছে। শুধু তাই না ওই বাড়ির মানুষের সাথে ভাব জমাইতে নিজের মাইয়ারে ওই বাড়িতে পাঠায় দেয়। দেখোনা সেঁজুতি সারাদিন ওই বাড়িতে থাকে?”
শ্যামলী প্রতিবাদ করলো-“এইসব কি কও সাজেদ? মাইয়ারে আমরা কেন পাঠামু ওই বাড়ি?”
জাহাঙ্গীর বললো-“তা আপনে না পাঠাইলো কে পাঠায়? মাইয়া প্রতিদিন নিয়ন কইরা ওই বাড়িতে যায় কিনা কন? কি করে ওইখানে?”
মাজেদ গম্ভীর হয়ে বললো-“আমি ওই পোলার লগে খাতির করি? এমুন কথা কইলি কেমনে তোরা?”
জাহাঙ্গীর বললো-“সাধে তো কই নাই ভাইজান। পোলা সকালরে ঠিক সমাধান দিলো আর এই দিকে নীলার ভবিষ্যত নষ্ট করলো। এইসবে কি বুঝা যায় কন দেখি?”
“কি বুঝা যায়? আমি ওরে হাত কইরা কোর্টের সিদ্ধান্ত পাল্টাইছি? এতদিনে এই চিনলি তোরা আমারে? আম্মা, আমার দোষটা কি কন দেহি? নিজের জন্য ঘর করা অপরাধ হইছে আমার?” -মাজেদ চিবিয়ে চিবিয়ে বললো।
শ্যামলী কিছু বলতে যাবে শামসুন্নাহার থামালো-“তুমি এরমধ্যে কথা কইয়ো না। ভাইয়ে ভাইয়ে কথা হইতেছে।”
মাজেদ ভাতের থালা থেকে হাত গুটিয়ে নিলো। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। শামসুন্নাহার বললো-“সেঁজুতি সারাক্ষণ ওই বাসায় থাকে এইটা ভালো বিষয় না। শত্রুর লগে এতো খাতির থাকবে কেন? তোরাও কিছু কস না ওরে।”
মাজেদ রেগে গেলো-“আম্মা, আপনে ঘুরেফিরে আমার আর আমার পোলা মাইরার দোষই দেখবেন। একদিকে সাজেদ জাহাঙ্গীর ওরা কোন ব্যবসার হিসাব দিতেছে না আইজ দুইমাস হইলো আপনে তাদের কিছুই কন না। কেন ওই ব্যবসায় আমার হক নাই নাকি?”
জাহাঙ্গীর তেতে উঠলো-“কেন হিসাব দিমু? আপনে দিছেন জমি বেচা টাকার হিসাব? রুজাইফরে টাকা দেওয়ার কথা জানাইছেন পরে। ওই পোলা এখন স্কুলে যায় প্রায়ই। নতুন কইরা মাস্টার নিয়োগ দিবেন বইলা বিজ্ঞাপন দিছেন। জানাইছেন এইসব?”
মাজেদ দাঁতে দাঁত চাপলো-“স্কুলে মাস্টার নিয়োগের সিদ্ধান্ত রুজাইফের। ও চায় নতুন ভালো মাস্টার আসুক স্কুল আর কলেজে। ইদানীং ওই পোলা কলেজে যায়, লুকায় ক্লাস নেওয়া দেখে। গাধা মাস্টারগুলা উল্টাপাল্টা পড়ায়। ওই পোলা সুযোগ মতো সেই পড়ানির ভিডিও কইরা রাখছে। আমরা যে ঘুষ খাইয়া মাস্টার নিযোগ দিছি তা সে ধইরা ফেলছে। এখন সে চায় নতুন কইরা মাস্টার নিয়োগ দিতে। না দিলে খবর কইরা ছাড়বো বইলা হুমকি দিছে। এইখানে তোগো জানানোর কি আছে এইবার ক। আমি ওর কথা না শুনলে ও কি করবো বুঝেস তো?”
নিরবতা নেমে এলো ঘরজুড়ে। অক্ষম আক্রোশে ফুঁসে উঠলো দুই ভাই। সাজেদ বললো-“বহুত বাড়তেছে এই পোলা। এরে কিছু করা লাগবে খুব তাড়াতাড়ি।”
মাজেদ সে কথার জবাব দিলো না। শ্যামলীর দিকে তাকিয়ে বললো-“সেঁজুতিরে ডাকো।”
সেঁজুতি এসে দাঁড়াতেই মাজেদ হুঙ্কার দিলো-“তুই প্রতিদিন ওই বাড়িতে যাস?”
সেঁজুতি কেঁপে উঠলো। ভয় পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। মাজেদ উঠে এসে মেয়ের গালে চড় কষিয়ে দিলো-“তোর জন্য নতুন কইরা ঘর তুলতেছি তাও ওই বাড়ি যাওয়া লাগে তোর? বেদ্দপ মাইয়া।”
উল্টো ঘুরে মেঝেতে পড়লো সেঁজুতি। শ্যামলী আঁতকে উঠে মেয়েকে ধরলো। সেঁজুতি মায়ের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। টকটকে লাল হয়ে যাওয়া গাল জ্বলছে রীতিমতো। চোখ জলে টইটম্বুর। চোখে অবিশ্বাস।
“আব্বা!” অবাক নয়নে আর্তনাদ করে উঠলো সেঁজুতি। ক্ষনিকের জন্য বাপের মুখপানে তাকিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। দোতলায় এসে বিছানায় আছড়ে পড়ে হুহু কান্নায় ভেঙে পড়লো।
পরদিন কলেজ গেলো না সেঁজুতি। বাবা চাচারা বেরিয়ে যেতেই সেঁজুতি নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস বইপত্র গুছিয়ে নিয়ে নিচে নেমে এলো। শ্যামলী জানতে চাইলো-“কই যাস জিনিস নিয়ে।”
সেঁজুতি জবাব দিলো না। সে সব নিয়ে সোজা ফজিলাতুন্নেছার কামরায় এলো-“দাদী, ওইদিন আমারে বলছিলেন আপনের উপকার করছি। কিছু চাইলে আমারে দিবেন। আজকে কিছু চাবো। দিবেন আমাকে?”
ফজিলাতুন্নেসা কিছু বলবে তার আগেই সেঁজুতি গাল বাড়িয়ে দিলো-“দেখেন আব্বা জীবনে প্রথমবার আমার গায়ে হাত তুলছে। আমি আর আব্বার কাছে থাকুম না। আমারে থাকতে দিবেন আপনের কাছে?”
ফজিলাতুন্নেছা থতমত খেলো। কি জবাব দেবে বুঝে পেলো না। সেঁজুতির চোখ দিয়ে টপটপ অশ্রুগড়িয়ে পড়ে-“যদি আপনে না করেন তাইলে এই বাড়ি ছেড়ে দূরে চলে যাব, অনেক দূরে যেন কেউ খুঁইজা না পায়।”
ফজিলাতুন্নেছা সেঁজুতির মাথায় হাত বুলালো-“আচ্ছা, থাকো। নাদিরার সাথে থাকো যে কয়দিন মন চায়।”
“আমি আর যাবই না ওই বাড়ি। এইখানেই থাকবো।”
বলেই ব্যাগপত্র তুলে নিয়ে দুপদাপ পা ফেলে দোতলায় উঠে গেলো। নুমা এগিয়ে এলো-“মা, রুজাইফ শুনলে রাগ হবে। হাজার হোক শত্রুর মেয়ে বলে কথা।”
ফজিলাতুন্নেছা চিন্তিত হলো-“রুজাইফকে আমি বুঝায় বলবোনে। এই মুহূর্তে মেয়েটাকে মানা করলে ও হয়তো উল্টা পাল্টা করবে। বাড়ি ছাইড়া পালাইতে পারে৷ ওর ক্ষতি হইলে তো আমাদের কোন লাভ নাই। থাক কয়দিন। পরে আবার চলে যাবে।”
নুমা মাথা দুলায়-“চলে গেলেই ভালো। এইসব নিয়ে কথা হইলে রুজাইফ কি করবে আল্লাহ জানে।”
★★★
আজ পুরো বাড়ি শান্ত দেখে রুজাইফ অবাক হলো। ওই মেয়েটা আসেনি নাকি? নাদিরার ঘরে উঁকি দিতে গিয়ে দিলো না। দরজা চাপানো দেখে ভাবলো শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাওয়ার জন্য নিচে নামার সময় ডেকে নেবে। সেই ভেবেই নিজের ঘরে ঢুকে গেলো রুজাইফ।
আধাঘন্টা পরে নাদিরার ঘরে উঁকি দিলো। নাদিরা নেই, সেঁজুতি ঘুমিয়ে আছে বিছানায়। লম্বা বেনী অবহেলায় বালিশে পরে আছে। মুখটা ভীষণ মলিন দেখাচ্ছে। মেয়েটা চাদর গায়ে গুটিসুটি মেরে এমনভাবে শুয়ে আছে যেন ভীষন শীত লাগছে। রুজাইফের ভ্রু কুঁচকে গেলো। এই মেয়ে এখন শুয়ে আছে কেন? এগিয়ে কাছাকাছি দাঁড়াতেই গালে পাঁচ আঙুলের দাগটা স্পষ্ট হলো। খারাপ লাগলো রুজাইফের। এভাবে কে মারলো মেয়েটাকে? রুজাইফ সেঁজুতির কাছাকাছি বসলো। তাকিয়ে রইলো ওর গালের দাগের দিকে। মসৃন গালে দাগটা চাঁদের গায়ে কলঙ্কের ন্যায় লাগছে। রুজাইফ মন দিয়ে দেখে সেঁজুতিকে। ছোট্ট কপালের উপর হাজারখানেক ছোট ছোট চুল এসে ভীড় করেছে। নাকটা ঈষৎ লালচে হয়ে আছে। হঠাৎ নড়েচড়ে ঘুমের মধ্যে গুঙিয়ে উঠলো মেয়েটা। ঠোঁট দু’টো কাঁপছে থেকে থেকে। চোখের কোল বেয়ে আবছা জলের ধারা বালিশে আছড়ে পড়ছে। মেয়েটা আরও গুটিয়ে গেলো নিজের মধ্যে। রুজাইফ হাত বাড়াতে গিয়েও সংকোচে গুটিয়ে নিলো। কিন্তু সেঁজুতির ব্যাথা জড়ানো আর্তনাদ দেখে একসময় না পেরে হাত রাখলো কপালে। আঁতকে উঠে হাত তুলে নিলো। পরক্ষনেই আবারও হাত দিলো কপালে। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে মেয়েটার। হাতের স্পর্শে আরাম পেলো হয়তো। আবার শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেলো।
কি মনে হতে গালের দাগের জায়গাটা আলতো স্পর্শ করলো রুজাইফ। অস্ফুটে কুঁকিয়ে উঠে সেঁজুতি আচমকা রুজাইফের হাত জড়িয়ে নিলো বুকের সাথে। কাত হয়ে শুয়ে রুজাইফের শক্ত পোক্ত হাতটাকে কোল বালিশের মতো আঁকড়ে ধরলো। চমকে উঠলো রুজাইফ। মুখচোখের রং বদলে গেলো। হাতে নরম অংশের স্পর্শ টের পেতেই মাথা দপ করে উত্তপ্ত হয়ে উঠলো। দ্রুত হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটা হচ্ছে যেন। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তার তিরিশ বছর জীবনে এমন হয়নি কখনো। একদম নতুন ধরনের এক অনুভব জাগ্রত হচ্ছে। এ কেমন অনুভূতি হচ্ছে তার? ছিহ! নিজেকে ধিক্কার দিলো। ছুটে বেরোলো রুম থেকে। নিজের ঘরে এসে মুখে পানি দিয়ে ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করলো। খানিকক্ষণ বাদে নিচে নেমে এলো। খাওয়ার টেবিলে সবাই বসে আছে। ওকে দেখে ফজিলাতুন্নেছা ডাকলো-“আয় বোস, খেয়ে নেই একসাথে। নাদিরা তুই সেঁজুতিকে ডেকে আন।”
নাদিরা উঠে চলে গেলো। রুজাইফ ভীষণ অসস্তি নিয়ে বসলো। সেঁজুতিকে ডাকার কথা শুনেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলোনা। দু’মিনিট পরেই নাদিরা ছুটে এলো-“নানু, সেঁজুতিপুর অনেক জ্বর এসেছে। আবোলতাবোল বকছে।”
ফজিলাতুন্নেছা উতলা হলো-“নুমা দেখতো কি হলো? এই মেয়ের এ বাড়িতে এসেই জ্বর হতে হলো? কি ঝামেলায় পড়লাম?”
নুমা চলে গেলো। রুজাইফ দিদার দিকে তাকালো-“এ বাড়িতে এসে জ্বর হলো মানে কি দিদা? এই মেয়ে এতো রাত অব্দি এখানে আছে কেন?”
“ওর বাবা মেরেছে ওকে তাই রাগ করে এসেছে এখানে। বলছিল, থাকতে না দিলে নাকি বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাবে। ছোট মানুষ উল্টো পাল্টা না করে ফেলে এই ভেবে ওকে রেখে দিলাম। রাগ পড়লে চলে যাবে আবার। ভুল করেছি?”
রুজাইফ বরাবরের মতো প্রতিবাদ করলো না। বলা ভালো করতে পারলো না। কেন যেন তার গলা শুকিয়ে এলো অকারণে। অসহায় বোধ হলো ভীষণ। মেয়েটা তাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করছে নাতো?
নুৃহা নেমে এসে প্লেটে খানিকটা ভাত ডাল নিলো। মাকে বললো-“বাবা মেরেছে বলে মনে কষ্ট পেয়েছে খুব। সেই থেকে জ্বর এসেছে। একটু ভাত খাইয়ে জ্বরের ওষুধ দিয়ে দেই। কি বলো মা?”
ফজিলাতুন্নেছা মাথা দুলায়-“দে। কাল সকালে ভালো না হলে ওর মাকে ডেকে আনতে বলিস রোমেলাকে।”
রুজাইফ পুরো সময় চুপচাপ খেয়ে গেলো। যদিও খাওয়ায় তার মন নেই। বারবার খানিকক্ষণ আগের ঘটনা চোখের সামনে রিটেক হচ্ছে। আর অজান্তেই নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাচ্ছে।
★★★
“সেঁজুতি কই?” মাজেদের প্রশ্নে শ্যামলী ভয় পেয়ে চুপ করে রইলো। জবাব না পেয়ে মাজেদ আবারও একই প্রশ্ন করলো। শ্যামলীর কিছু বলার প্রয়োজন হলো না অবশ্য। শামসুন্নাহার জবাব দিলো-“ওই বাড়িতে গেছে। নিজের সব জিনিস নিয়ে গেছে। ওইখানেই নাকি থাকবো।”
মাজেদের চেহারা ভয়ংকর হয়ে উঠলো মুহূর্তেই-“ওর এতোবড় সাহস? আইজ ওরে মাইয়াই ফালাব। যে মাইয়া বাপের কথা শুনে না এমন মাইয়ার দরকার নাই আমার।”
বলেই একটা মোটা লাঠি তুলে নিলো। শ্যামলী ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠলো মেয়ের আসন্ন ভবিষ্যতের আশঙ্কায়। অসহায় চোখে শাশুড়ীর দিকে তাকালো। শামসুন্নাহারের ঠোঁটের কোনে দূর্ভেদ্য হাসি। সে ছেলেকে ডাকলো-“মাজেদ, এইদিকে আয়। লাঠি ফালায় মায়ের কাছে বয়।”
“না আম্মা, ওরে আগে শায়েস্তা করে নেই। মাইয়ার সাহস দেখছেন আপনে?”
শামসুন্নাহার ধমক দিলো-“আরে আয় কইতেছি। কি কই আগে শুইনা লল।”
মাজেদ অনিচ্ছায় মায়ের কাছে বসলো। শামসুন্নাহার বললো-“সেঁজুতি গেছে যাক। ওইখানেই থাকুক। শত্রুর ঘরে নিজেগো লোক থাকুন দরকার। একদিকে ভালোই হইছে। না চাইতেই সেঁজুতি আমাগো মেলা কাম আসান কইরা দিছে। ও থাকুক, ওগো উপর নজর রাখুক। যখন সময় হইবো তখন ওরে ডাইকা আনুম। বুঝছোস আমার কথা?”
মাজেদ বিস্মিত হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকালো। তাকে বেশ শান্ত দেখাচ্ছে। মাজেদ দ্বিধান্বিত হলো। তার মা আসলে ভাবছেটা কি? শ্যামলীর শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে আছে। বোঝার চেষ্টা করছে, কি চলছে এই কুটনা মহিলার মনে। মনে মনে ভয় পাচ্ছে ভীষণ। কেন যেন মনেহচ্ছে,তার শাশুড়ী ভয়ংকর কোন পরিকল্পনা আঁটছে যার খুঁটি হবে তার মেয়ে। শ্যামলী নিস্পলক তাকিয়ে আছে। শামসুননাহারের মুখের রেখায় দূর্ভ্যেধ্য কোন পরিকল্পনার আভাস। অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠলো তার।
চলবে—
©Farhana_Yesmin