যে থাকে আঁখি পল্লবে পর্ব-২৪

0
27

#যে_থাকে_আঁখি_পল্লবে
#পর্ব-২৪

ফজিলাতুন্নেছা হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফেরার দিন দুয়েক পর সেঁজুতি নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলো। নাদিরা ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইলো-“আপু, কোথায় যাচ্ছ?”
“বাসায় যাই নাদিরা। অনেকদিন থাকলাম তোমাদের সাথে।”
নাদিরা অবাক হলো-“আপু, তুমি বলেছিলে নতুন ঘর তৈরি না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সাথে থাকবে।”
সেঁজুতি বই গুছিয়ে নিতে নিতে বললো-“এখন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলাম।”
নাদিরা এসে হাত ধরলো-“কি হয়েছে তোমার? রাগ করেছ? আমি কিছু করেছি?”
সেঁজুতি নাদিরার হাত ধরলো-“পাগল হইছো? তুমি কি বলবা? কোন কিছু হয় নাই এমনেই চলে যাই। রমজান মাস আসতেছে, তারপর ঈদ। বাড়ির বাইরে থাকা ঠিক হবে না।”
“তাতে কি আপু। বাড়ি তো এই দু কদমে। প্লিজ যেয় না। তুমি চলে গেলো আমার ভালো লাগবে না। একা হয়ে যাব।”
সেঁজুতি নাদিরার হাত ধরে কাছে বসলো-“একা হবা কেন? তুমি যাবা আমার কাছে।”
নাদিরা কাঁদো কাঁদো হলো-“তুমি জানো ভাইয়া আমাকে যেতে দেবে না। তাহলে আমি কার সাথে গল্প করবো? প্লিজ যেয় না।”
সেঁজুতির মন খারাপ হলো-“এমন কইরা বইলো না গো। মন খারাপ হয়।”
নাদিরা হুট করে সেঁজুতির হাত ছেড়ে দিয়ে ছুটে নিচে নামলো। নানির ঘরে এসে কেঁদে দিলো-“নানু, সেঁজুতি আপুকে বলোনা থেকে যেতে। সে গেলে আমি কার সাথে গল্প করবো?”
ফজিলাতুন্নেছা নাদিরার কান্নার কারণ বুঝলো না। হতভম্ব হয়ে জানতে চাইলো-“কি হইছে বনু? কান্দো কেন? সেঁজুতির কি হইছে?”
নাদিরা চোখ মুছলো। ভেজা কন্ঠে বললো-“সেঁজুতি আপু আমাদের সাথে থাকবে না বলতেছে। সব গুছায়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে।”
ফজিলাতুন্নেছার ভ্রু কুঁচকে গেলো। মেয়েটা নিজ থেকে থাকতে এসেছিল। এখন আবার চলে যাবে কেন হঠাৎ? সে নাদিরাকে বললো-“চলে যাববে? কেন? ডাকো দেখি কি হইছে শুনি।”
নাদিরা উপরে ছুটে গেলো। সেঁজুতিকে টানতে টানতে নিয়ে এলো-“নানু, বলো আপুকে সে যেন না যায়।”
ফজিলাতুন্নেছা সেঁজুতির দিকে তাকালো-“তুমি চইলা যাইতেছ শুনলাম। কি হইছে?”
সেঁজুতি মাথা নাড়ে-“কিছু না দাদী। এমনেই চইলা যাব। মেলাদিন তো থাকলাম আপনাদের সাথে।”
সেঁজুতির নত মাথা দেখে মনে হলো মেয়েটা সত্যি বলতেছে না। ফজিলাতুন্নেছা সেঁজুতিকে কাছে ডাকলো। চিবুক ধরে তুলে বললো-“কেউ কিছু বলছে তোমাকে? মিছা কইয়ো না কিন্তু।”
সেঁজুতি বরাবরের মতো মানা করলো। ফজিলাতুন্নেছা গম্ভীর হয়ে বললো-“নিজের ইচ্ছায় আইছিলা কিন্তু যাইতে আমার অনুমতি লাগবে। এমনে তোমারে যাইতে দেই কেমনে? রুজাইফ আসুক তারপর ভাইবা দেখবো তোমারে যাইতে দিব কিনা।”
সেঁজুতি অসস্তিতে হাত মোচড়ায়-“দাদী, এমন কইরেন না। যাইতে দেন আমাকে।”
“আমি অনুমতি দিব না। এখন আমার অনুমতি ছাড়া তুমি যাইতে চাইলে যাও।”
সেঁজুতি ভারী বিপদে পড়লো। সে তো রুজাইফকে কথা দিয়েছে যে দাদী এলে সে চলে যাবে। এখন এখানে কিভাবে থাকে? এদিকে নাদিরা ভীষণ খুশি। সেঁজুতিকে জড়িয়ে ধরলো-“আমি জানি দাদীর অনুমতি ছাড়া তুমি যাবা না। চলো ঘরে চলো।”
প্রায় জোর করে সেঁজুতিকে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে গেলো নাদিরা। ফজিলাতুন্নেছার ঘর থেকে বের হতেই রুজাইফকে দেখা গেলো। সে অফিস থেকে ফিরেছে মাত্র। দিদা আর সেঁজুতির কিছু কথা তার কানে এসেছে। তখন থেকেই ভাবছে কি বলে ঠেকাবে মেয়েটাকে। এখন চোখাচোখি হতেই দু’জনেই অসস্তি নিয়ে একে অপরকে দেখে নজর ফিরিয়ে নিলো।

রাতে পানি আনার জন্য নিচে যাচ্ছিল সেঁজুতি তখনই হুট করে কেউ তার হাত ধরে টান দিলো। ঘরে ঢুকিয়ে দরজার সাথে মিশিয়ে তার মুখ চেপে ধরে কানের কাছে ফিসফিস করলো-“ভয় পেয় না আমি রুজাইফ। কথা আছে তোমার সাথে তাই এভাবে ধরে এনেছি। খবরদার আওয়াজ করবে না।”
সেঁজুতি চেচাতে চাইছিল কিন্তু রুজাইফের কন্ঠ শুনে থমকে গেলো। অন্ধকারে চেহারা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিল না। ড্রিম লাইটের আলোয় ধীরে ধীরে দু’জনের চেহারা পরিস্কার হলো। রুজাইফের চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে সে আলোয়। সেঁজুতি তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। রুজাইফ হাত সরিয়ে নিয়ে সেঁজুতির চোখে চোখ রেখে দুই হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলো-“বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছ নাকি? কেন?”
সেঁজুতি রেগে গেলো। এই লোক সব অঘটন ঘটিয়ে ভাব নেয় কিছু বোঝে না। সে দাঁত কিড়মিড় করে জবাব দিলো-“এইটা কি আমার শশুরবাড়ি যে সারাজীবন থাকবো? মেহমান হয়ে আসছিলাম এখন চলে যাব। এতো কথা কিসের?”
সেঁজুতির কথা শুনতে শুনতে রুজাইফের ভ্রু কুঁচকে গেলো। পরক্ষনেই ঠোঁটের কোনে দুষ্ট হাসি জমা হলো। বাঁকা হেসে বললো-“চাইলেই শশুর বাড়ি বানানো যায়, বানাবে? তাহলে সারাজীবন অধিকার নিয়ে থেকে যেতে পারবে।”
রুজাইফের কথা না বুঝতে পেরে বিরক্ত হচ্ছিল সেঁজুতি। ধীরে ধীরে কথার মর্ম অনুধাবন করে থতমত খেলো বেচারি। রুজাইফকে মোক্ষম জবাব দেওয়ার জন্য মনটা আনচান করছিল। নিজেকে সামলাতে না পেরে বলেই ফেললো-“আপনার মতো কাঁঠালকে কে বিয়ে করবে?”
“কাঠাল! আমি?” রুজাইফ হতবাক। সেঁজুতি সুযোগ পেয়ে খেঁকিয়ে উঠলো-“আপনে ছাড়া আর কে? ধরলেই সারা গায়ে কাটা। খাইতে যাও তাও কত ঝামেলা। আগে হাতে তেল দাও তারপর শক্ত খোলস সরাও তারপর যেয়ে কোয়া বের হয়।”
রুজাইফ যেন মজা পেলো। সেঁজুতির অঙ্গভঙ্গি ভারি মজা লাগছে তার। মনেহচ্ছে মেয়েটা তাকে বাটে ফেলে চরম মজা পাচ্ছে। চেহারায় আলাদা একটা পরিতৃপ্তির ছাপ। কিছু কচি চুল কপাল ঘিরে রেখেছে। মোলায়েম গালদুটো চকচক করছে তার। পাতলা ঠোঁট জোড়া নড়ছে অনবরত। রুজাইফ ডুবে যাচ্ছে যেন। সে মোহাচ্ছন্ন হয়ে বললো-“আচ্ছা! তা কাঁঠালের ভেতরটা দেখেছ? কি মজাদার খেতে? এতো পেরা দেয় বলেই কাঁঠাল খেতে মজা।”
সেঁজুতি ঠোঁট ওল্টায়-“খুব দেখছি। এতো পেরা দেওয়া ফল আমি খাই না। কেমন বাজে গন্ধ ছিহহহ।”
রুজাইফ হাসলো-“রিয়েলি! নাকি কষ্ট হবে এই ভেবে খাও না। ভালো জিনিস আবার সবার পেটে সয় না।”
“নিজেরে এতো দামী ভাবার দরকার নাই। আপনির মতো কাঁঠাল মাইয়ারা পছন্দ করবে না।”
“তুমি জানো দৈনিক কতগুলো প্রেমের প্রস্তাব পাই? কতজন আমারে মেয়ে বা বোনের জামাই বানাতে চায়?”
“ওরা জানে না আপনি একটা কাঁঠাল তাই জামাই বানাতে চায়। জানতে দুরবিন দিয়ে খুঁজেও আপনার জন্য একজন পাত্রীও পাইতেন না।”
রুজাইফ হেসে দিলো-“তুমি দেখতে চাও মেয়েরা আমাকে পছন্দ করবে কিনা? খুশি হবে কেউ আমাকে পছন্দ করলে?”
সেঁজুতি ঠোঁট ওল্টায়-“জ্বি না দেখতে চাই না। আমার এতো শখ নাই। যাইতে দেন আমাকে।”
সেঁজুতি দরজার লক খুলতে চায়। রুজাইফ ওর হাত ধরলো-“শোন, বাড়ি ছেড়ে যেয় না। সেদিনের কথা ভুলে যাও।”
“কেন ভুলে যাব? যাতে আপনে আবার আমাকে চোর কইতে পারেন?”
“আর বলবো না। তুমি চলে গেলে নাদিরার কষ্ট হবে।”
“আর কারও কষ্ট হবে না?”
সেঁজুতির প্রশ্নে রুজাইফ ঢোক গিললো। মেয়েটাকে যতটা বোকা ভাবে ততটা বোকা না। রুজাইফ গম্ভীর হলো-“এতো কথা বলার দরকার নাই। তুমি যাবে না এটাই শেষ কথা। আমার কথার বিরুদ্ধে যাওয়ায় চেষ্টা করো না নয়তো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে ফেলবো।”
“কইলেই হইলো?”
“হ্যা, হলো। চেষ্টা করে দেখো তারপর বুঝবে। এখন ঘরে যাও।”
বলে নিজেই দরজা খুলে দিলো। সেঁজুতি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই রুজাইফ দরজা দিলো বিনা আওয়াজে। রুজাইফের দরজা বন্ধ হতেই সেঁজুতি পিছু ফিরে দেখে চোরা হাসি দিয়ে বিরবির করলো-“কাঁঠাল কোথাকার।”

★★★

রোজার মাসটা মোটামুটি ঝামেলা বিহীন কাটলো। সেঁজুতি নিজের বাবা মায়ের সাথেও ইফতার করেছে আবার রুজাইফদের সাথে করেছে কিছুদিন। উপল আর মেরাজ ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসার পর বাড়িতে ঈদের একটা আমেজ এলো। উপল এবার ঈদের সাতদিন আগেই চলে এসেছে বাড়িতে ঈদ করবে বলে। সেঁজুতি তাকে ধরে নিয়ে এলো ফজিলাতুন্নেছার সাথে দেখা করতে। ফজিলাতুন্নেছা বেশ খুশি হলো উপলকে দেখে-“খুব খুশি হইছি তোমাকে দেইখা। কবে আসছো?”
উপল মাথা চুলকে জবাব দিলো-“আজকেই দাদী। সেঁজুতি জোর করে ধরে নিয়ে এলো।”
ফজিলাতুন্নেছা কিন্চিৎ মন খারাপ করে বললো-“জোর কইরা ধরে আনতে হইলো? নিজের ইচ্ছায় আসো নাই?”
উপল তৎক্ষনাৎ বুঝলো ফজিলাতুন্নেছার মনোভাব। সে তাড়াহুড়ো করে সান্ত্বনা দিলো-“আমি নিজেই আসতাম পরে সময় করে কিন্তু এই পাগলি তো আমাকে সুযোগ দিলো না তার আগেই ধরে নিয়ে এলো।”
ফজিলাতুন্নেছা হাসলো-“হুমম জানি। আমি জানি তুমি সত্য বলছো। আমার কথায় কিছু মনে কইরো না।”
“কিছু মনে করি নাই দাদী।”
সেঁজুতি এই ফাঁকে গেছিল নাদিরা নাহিয়ানকে ডাকতে। কিছুক্ষণ পরেই ওদের তিনজনে ছুটে আসতে দেখা গেলো। নাহিয়ান এসে উপলের সাথে হাত মিলিয়ে বললো-‘হে ব্রো, হাউ আর ইউ? তুমি বাড়ি আসো না কেন?”
উপল হাসলো-“সময় পাই নাতো আসবো কিভাবে?”
নাহিয়ান উৎসাহ নিয়ে বললো-“ডাক্তারি পড়া অনেক কঠিন নাকি? আমি তো ভাবছিলাম ডাক্তারি পড়বো কিন্তু তোমাকে দেখে আগ্রহ চলে যাচ্ছে।”
“ডাক্তারি পড়তে ধৈর্য্য লাগে ব্রো। মানুষকে সেবা করার মনমানসিকতা, ডাক্তারির প্রতি তোমার ডেডিকেশন আর ভালোবাসা না থাকলে ডাক্তারি পড়ো না। অনেকেই হুজুগে ডাক্তারি পড়তে চলে আসে কিন্তু চাপ নিতে না পেরে পরে আর কন্টিনিউ করতে পারে না। কারণ তারা ভালোবেসে এই পেশায় আসে না।”
“তুমি বলছো যেহেতু ভেবে দেখবো ডাক্তারি পড়বো কিনা।”
নাদিরা চুপচাপ বসে ছিলো। মাঝে মাঝে উপলকে দেখছে চোরা চোখে। কয়েকবার চোখাচোখিও হলো। উপল হঠাৎ জানতে চাইলো-“তোমার কি খবর পিচ্চি? তুমিও কি ডাক্তার হতে চাও?”
নাদিরা চমকে গেলো। সত্যি সত্যি সে মনে মনে ডাক্তার হতে চায়। এবং এই ইচ্ছা তার মনে ইদানীং উদয় হয়েছে। সে লজ্জা পেলো ভীষণ। উপল কিভাবে তার মনের সুপ্ত ইচ্ছার কথা জেনে গেলো? উপলকে ভুল প্রমান করতেই যেন সে মাথা নেড়ে না করলো-“এরকম কিছু ভাবিনি এখনো।”
উপল অবাক হলো-“সেকি? কেন? ক্লাস নাইনে না তুমি? অলরেডি ছয়মাস পার করে ফেলেছ। ফোর্থ সাবজেক্ট কোনটা তোমার? এসব আগে থেকে ঠিক করতে হয়।”
নাদিরা হচকে গেলো। সে তো রুজাইফ ভাইয়ার পরামর্শ মতোই সব করে তাহলে ভুল হয় কি করে? ভাইয়া নিশ্চয়ই ওকে ভুলভাল কিছু করতে বলবে না? সে অসহায় নয়নে সেঁজুতিকে দেখলো। সেঁজুতি ভাইকে ধমকে উঠলো-“আহহ ভাইয়া, তুমি ওরে ডর দেখাইয় না। বেচারি এমনিতেই পড়ালেখা নিয়ে অনেক সিরিয়াস থাকে তোমার কথা শুনে আবার শকে না চইলা যায়।”
উপল হেসে দিলো-“আচ্ছা ঠিক আছে আর কিছু বলবো না আমি। তবে আমি কিন্তু তোমাকে ভয় দেখাতে চাইনি। এমনিতেই জানতে চাইলাম। তুমি ভয় পেয়েছ?”
নাদিরা আবারও লজ্জা পেলো। মাথা নিচু করে জোরেশোরে মাথা নাড়লো। উপল মিটিমিটি হাসছে ওকে দেখে। তার গহীন মনচায় একলা বসে মেয়েটার দিকে চেয়ে থাকবে অনেকটা সময়। কেন যেন ভালো লাগছে মেয়েটাকে? বাচ্চা মেয়েটার বাচ্চামো এতো ভালো লাগছে কেন? উপল মাথা চুলকে নজর সরায়। কিছুক্ষণ পরে আবারও তাকিয়ে দেখে বেহায়ার মতো।

চলবে—
©Farhana_Yesmin