যে থাকে আঁখি পল্লবে পর্ব-২৮

0
25

#যে_থাকে_আঁখি_পল্লবে
#পর্ব-২৮

একদিন থাকার কথা ছিলো সেখানে আজ তিনদিন হলো। নীলাকে যাওয়ার কথা বলতেই দিচ্ছে না নাদের। অবশ্য নীলা নিজেও বাড়ি ফিরতে চায় কিনা সন্দেহ। ঈদের দিন ভোরে গোসল করে নাদেরের ইচ্ছে অনুযায়ী শাড়ী পরেছিল নীলা। শাশুড়ীর সাথে হাতে হাতে কাজও করেছিল। নামাজ থেকে ফিরে নাদের ওকে নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল। নীলাকে সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে মন ভরে দেখতে দেখতে বলেছিল-“তোমাকে কি যে সুন্দর লাগতেছে নীলা।”
নীলা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে থাকে। আজকাল নাদেরের প্রসংশা ভালো লাগে তার। নাদের ওর হাত ধরে কাছে টানে-“একটু বুকে আসো বউ। কলিজা ঠান্ডা করো আমার।”
নীলা জবাব দিলো না। বরং চুপচাপ নাদেরের বুকে পড়ে রইলো। দু’জনই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। খানিক বাদে নাদের সুধায়-“ঈদ সালামি চাইলা না যে?”
নীলা মৃদুস্বরে জবাব দিলো-“আপনে দিলেন নাতো?”
“সালাম না করলে কেমনে দেই?”
নীলা ঝট করে মুখ তুলে নাদেরকে দেখলো। ছেলেটার চোখে দুষ্টামি মেখে আছে। নীলার রাগ হলো তা দেখে-“সালাম চান আপনে?”
নাদের মাথা দুলায়। নীলা মুখে সালাম দিলো। নাদের পা দেখালো। নীলা সরু চোখে চেয়ে থেকে বললো-“পা ছুঁয়ে সালাম করা ধর্মে মানা।”
নাদের এবার ফিসফিস করলো-“তাইলে একখান চুমা দাও। বউয়ের চুমার স্বাদ কেমন দেখি।”
নীলা বাকহারা, গাল দুটো হুট করে গরম হলো, রক্ত জমাট বাঁধলো। সে ছিটকে দূরে সরে গেলো-“এগলা কি কন?”
নাদের পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো-“ভুল কইছি? আর কিছু না দাও একটা চুমা তো দিতে পারো। বউ তুমি আমার হক আছে। আচ্ছা তুমি না দিলা আমি দেই দাও।”
নীলা পিছিয়ে যায়। লাজে তার মন ওষ্ঠাগত। পেছাতে পেছাতে টের পেলো দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে আর জায়গা নেই পেছানোর। নাদের দেয়ালে হাত রেখে ওর দিলে হেলে এলো। মুখের কাছে মুখ নামিয়ে বললো-“কি করবা এখন? কই পালাবা?”
নীলা লজ্জা পেয়ে দু’হাতে মুখ ঢাকলো। নাদের হুট করে চেঁচায়-“আল্লাহ! এইটা কি নীলা?”
নীলা চমকে হাত সরিয়ে দেখার চেষ্টা করতেই নাদের টুপ করে ওর গালে চুমু আঁকলো। নীলা থতমত খেলো। বুঝলো ভয় দেখানো নাদেরের চাল। সে গাল ফুলালো-“মিছা কথা কইলেন কেন?”
“বউরে ভালোবাসতে গেলে মিছা কতা জায়েজ আছে।”
“আপনে খুব খারাপ।”
“কিন্তু তোমাকে ভালা পাই।”
বলেই আরেক গালেও চুমু দিলো। তারপর মানিব্যাগ খুলে কড়কড়ে এক হাজারের দু’টো নোট এগিয়ে দিলো-“নাও সালামি।”
নীলা অভিমানে মাথা নাড়ে। নাদের হাসলো-“আরও লাগবে? কম হইছে?”
নীলা চুপ করে রইলো। নাদের ঠোঁট টিপে হাসলো-“ভাবছিলাম বিকালে তোমারে নিয়ে ঘুরতে যামু। কিন্তু তুমি রাগ করলে কেমনে যাই। থাক ঘোরাঘুরি বাদ, তোমারে বাসায় দিয়া আসমুনে।”
নীলা ফট করে বলে বসলো-“না বাসায় যামু না,ঘুরতে যামু। কই নিবেন?”
নাদের মুচকি হাসলো-“কই যাইতে চাও?”
নীলা এক্সাইটেড হয়ে বলেই ফেললো-“শহরে নতুন একটা পার্ক হইছে অনেক সুন্দর। ফেসবুকে দেখছি। নিবেন ওইখানে?”
“নিমু। কিন্তু শহরে তো বিকালে যাওয়া যাবে না। গেলে সকালে যাইতে হবে। কালইকা যামুনে তাইলে। তুমি তো আবার বাড়িতে যাইবা বিকালে।”
“বাড়িতে যামু না। কাইল শহর থেকে ঘুরে আইসা বাড়ি যামু।”
নাদের মনে মনে খুব খুশি হলো কিন্তু মুখে বুঝতে দিলো না। সে মাথা দোলায়-“আচ্ছা তোমার যেমন ইচ্ছা।”

পরদিন শহরে বেড়াত গেলো। বিশাল বড় রিসোর্টের সাথে সাজানো গোছানো জায়গা দেখে নীলার চোখ কপালে। অনেক কাপল বেড়াতে এসেছে, তারা নানাভাবে ছবি তুলছে। নীলা অবাক হয়ে তাদের দেখে আর নিজের সাথে তুলনা দেয়। মাঝে মাঝে গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকতে দেখা গেলো তাকে। কোত্থেকে যেন শুনলো, সেখানে রাতে থাকা যায়। নীলা আবদার জুড়ে দিলো সে রাতে থাকবে এখানে। নাদের খুশি মনে মেনে নিলো।

রাতে খেয়ে এসে নিজেদের রুমের বারান্দায় বসে ছিলো ওরা। সামনে খোলা প্রান্তরের ওপাশে ঘন জঙ্গল। ঠান্ডা বাতাস গা ছুয়ে দিচ্ছিল। নীলার খুব ভালো লাগছে। সে চোখ বুঁজে মৃদুস্বরে গুনগুন করছে। আর নাদের ওকে দেখছে মুগ্ধ হয়ে। একসময় সে নীলার খুব কাছে বসলো। ওর হাত ধরলো নিবিড় করে। নীলা চমকে চোখ মেলে। চোখাচোখি হয় দু’জনার। নাদের চোখ অন্যরকম লাগে। ঘোরলাগা দৃষ্টি দেখে নীলার নিজেকে এলোমেলো লাগে। নাদের বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বললো-“চলো রুমে যাই।”
নীলার বুক ধুকপুক করছে তবুও নাদেরের হাত ধরে উঠে এলো। বিছানায় শুয়ে রইলো গুটিসুটি মেরে। খানিক সময়ের মধ্যে টের পেলো সে নাদেরের বুকের নিচে। নাদের ফিসফিস করলো-“তোমারে সোহাগ করতে মন চায়। করমু?”
নীলা জবাব দিতে পারে না। ভীষণ হাসফাস লাগে তার। নাদেরকে ফেরাতে মন চাইছে না। মানুষটা খারাপ না, তার খেয়াল রাখে ভালো মন্দ ইচ্ছা অনিচ্ছার মুল্য দেয়। কিন্তু সকাল আপারে নেওয়ার জন্য পাগল হইছিল লোকটা। সেইটাও তো ভুলতে পারে না। তাইলে সকাল আপাকে ভালোবাতো? সে হুট করে প্রশ্ন করলো-“আপনি সকাল আপারে বিয়া করছিলেন কেন?”
দুপ করে নিভে গেলো নাদের। তার উৎসাহে ভাটা পড়লো। মনটা ভার হলো। নীলা কি তাকে সন্দেহ করে? এইজন্য এতো রাগ দেখায় তাকে? নাদের ওর দিকে তাকিয়ে রইলো-“যদি কই এইসব আমার ইচ্ছায় হয় নাই। তোমার বাপ মার বুদ্ধিতে হইছিল তাইলে মানবা?”
“আব্বা মা এমুন কেন করবো?”
নাদের উদাস হলো-“সত্য বলতেছি। আমি তো জানতাম না সকাল বিবাহিত। তোমার বাপ মা আইসা কইলো সকাল ভালো মাইয়া ওরে বিয়ে করতে। বিয়ের পর তো কত কাহিনি হইলো। কত মানুষ কত কথা শুনাইছে আমারে। বউ রাখতে পারি না, ক্ষমতা নাই আমার। রাগ হইবো না কও? আমার তো দোষ আছিলো না তো আমি ভুগমু কেন?”
নীলা ফিসফিস করলো-“আপনে আপারে ভালা পাইতেন?”
নাদের নীলার মুখপানে চাইলো। মেয়েটা কি বলতে চাইছে তা পরিস্কার বুঝতে পারছে। সে মাথা নাড়লো-“ও তো আমারে স্বামী মানতো না। ওরে কেমনে ভালা পাবো?”
নীলা দ্বিধা জড়ানো গলায় বললো-“সত্য বলতেছেন?”
নাদের গলা ধরলো-“একশোভাগ সত্য। ভালো কেবল তোমারে পাই। আমার সত্যিকারের বউ তো তুমি। আমি মন থিকা তোমারে ভালা পাই।”
নীলা কিছু না বলে কেবল নাদেরকে আঁকড়ে ধরলো দু’হাতে। বুকে মাথা রেখে আদুরে গলায় বললো-“আমারে বাদ দিয়া কোনদিন যেন আর কারো দিকে না তাকান। নাইলে আমার চাইতে খারাপ কেউ হইবো না।”
আকস্মাত পাওয়ায় নাদের দিশেহারা হলো। নীলা সত্যিই তাকে মেনে নিচ্ছে? অবিশ্বাস্য আনন্দে মনটা দিক হারালো। সে নীলার নরম অধর জোড়া আঁকড়ে ধরলো শক্ত করে। রাতটা তাদের স্বপ্নের মতো কাটলো। নাদের বড্ড যত্ন করে আদর করলো নীলাকে। যেন ভীষণ দামী জিনিসটাকে আগলে রাখছে। ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে রইলো নীলা। ব্যাথা বেদনা টেরই পেলো না। পরদিন দুপুর নাগাদ ফিরে এলো নাদেরের সাথে। নাদের ওকে বাসায় দিয়ে আসতে চাইলো কিন্তু নীলা গেলো না। সে জানালো স্কুলের বন্ধ পর্যন্ত সে নাদেরের সাথে থাকতে চায়। চরম খুশি নাদের। তার ধৈর্য্যের ফল সে এতো দ্রুত পাবে এটা ভাবেনি। নীলার প্রতি আরও খেয়ালি হলো সে। নিজেকে মনে মনে বললো, নীলার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবে আজীবন। কখনো কষ্ট দেবে না ওকে।

★★★

রুজাইফের অফিসে খুলেছে। উপল হাসপাতালে ফিরে গেছে। নাদিরা নাহিয়ান আর সেঁজুতির স্কুল খুলবে দুই একদিনে। নুমা রুজাইফকে বলেছে হাশেমের জন্য কাজের ব্যবস্থা করে দিতে। সারাদিন বাসায় বসে সময় কাটে না হাশেমের। সে বিরক্ত হচ্ছে। রুজাইফ বললো-“ফুপাকে দিয়ে ঘরের বাজার সদাই করাও না কেন? এটা ওটা কত কাজ আমাকে বলো সেসব ফুপাকে বললেই তো হয়।”
নুমা বললো-“সে এসব পারবে? কি না কি করবে।”
রুজাইফ বিরক্ত হলো-“খুব পারবে ফুপু। তুমি শুধু শুধু বেশি চিন্তা করো। এখন থেকে ফুপাকে টুকটাক কাজ দেবে। দেখবে তাতে তার মন ভালো হবে।”
এ কথার পর নুমা হাশেমকে দিয়ে বাজার করায়, ঘরের এটা সেটা সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য বলে। হাশেম ছোটাছুটি করে সব করে। তাকে ব্যস্ত থাকতে দেখে নুমা স্বস্তি পায়।

নুমা রান্নাঘরে কাজ করছিল তখন সেঁজুতি এলো। ওর চা খেতে খুব মন চাইছে কিন্তু নুমাকে ব্যস্ত হয়ে কাজ করতে দেখে আর কিছু বললো না। ও দাঁড়িয়ে থেকে নুমার কাজ দেখতে লাগলো। নুমা সেঁজুতিকে দেখে হাসলো-“কিছু লাগবে?”
সেঁজুতি বললো-“তুমি আজকে এতোকিছু কার জন্য বানাইতেছ? কারো জন্মদিন নাকি?”
“হুমমম, রুজাইফের জন্মদিন। তবে ও জন্মদিন পালন করে না। ও হয়তো ভুলেই গেছে ওর আজকে জন্মদিন।”
সেঁজুতি অবাক হলো-“কও কি ফুপু? ওই রসকষহীন মানুষের জন্মদিন! তার আবার জন্মদিন পালনে কি সমস্যা?”
নুমা সেঁজুতির দিকে তাকালো-“সমস্যা অনেক গুরুতর। কেউ তার জন্মদিন পালন করতে চাইলেও সে রাগ হয়। তাও আমার মন মানে না। কিছু ভালোমন্দ রান্না করি, ও খাইলে মন ভালো লাগে।”
সেঁজুতি হাসলো-“আর আমার জন্মদিন পালন করতে খুব ভালো লাগে। কত কি যে করি আমি।”
“তোমার জন্মদিন কবে?”
নুমা জানতে চাইলে সেঁজুতি মাথা নাড়ে-“কমু না।”
নুমা হেসে দিলো-“কেন বলবা না কেন?”
“এমনেই। আচ্ছা, সে আসবে কখন?”
নুমা কাজ করতে করতে সেঁজুতিকে দেখে। মাঝে মাঝে কেন যেন মনেহয়, সেঁজুতি রুজাইফকে পছন্দ করে। দু’জনার জোড়া হলে বেশ হতো। পরক্ষণেই মনে পড়ে, সেঁজুতি শত্রু পক্ষের। আর রুজাইফ ওকে কখনো মেনে নেবে না। নুম মন খারাপ করে বললো-“প্রতিদিন যখন আসে তখনই আসবে।”
সেঁজুতি চলে গেলো মাথা দুলিয়ে। নুমা সেদিকে একবার তাকিয়ে আবার কাজে মন দিলো।

নাদিরা বই পড়ছিল, সেঁজুতি এসে হামলে পড়লো-“এই নাদিরা, তোর খারুস ভাইয়ের জন্মদিন আজ?”
নাদিরা শুকনো গলায় বললো-“ভুলে যাও আপু। ভাইয়া একদম পছন্দ করে না জন্মদিন পালন।”
সেঁজুতি বসে পা নাঁচায়-“আরে তুই তো জানিস আমার ত্যারামি করতে ভালো লাগে। তোর ভাইয়ের জন্মদিন পালন করেই ছাড়বো এইবার।”
নাদিরা সেঁজুতির হাত ধরলো-“আপু প্লিজ, এমন করো না। ভাইয়া সত্যিই পছন্দ করে না।”
সেঁজুতি সে কথা শুনেও শুনলো না-“তুই আমাকে হেল্প করবি কিনা বল।”
নাদিরা হাল ছেড়ে দিলো। সেঁজুতির জন্য ভয় লাগছে তার। আজ মেয়েটার কপালে কি আছে কে জানে।

সন্ধ্যায় রুজাইফ এলো। তখন সবাই মিলে বসার ঘরে আসর জমিয়েছে। সেঁজুতির পরনে একটা নীল তাতের শাড়ী। রুজাইফ থমকে গেলো। মেয়েটাকে ভারী মিষ্টি লাগছে দেখতে। সেঁজুতি ওকে দেখে এগিয়ে এলো-“আমারে উইশ করেন। আজ আমার জন্মদিন।”
রুজাইফ ভ্রু কুঁচকে ফেলে। বাকী সকলের দিকে তাকালো সে। নুমা অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। সেঁজুতি বললো-“আরে ওইদিকে কি দেখেন? আচ্ছা এইদিকে আসেন। আপনের জন্য অপেক্ষা করতেছিলাম। এখন কেকটা কাটি।”
রুজাইফ তবুও দাঁড়িয়ে আছে। সেঁজুতি হাত ধরে টেনে নিয়ে কেকের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো। রুজাইফের হাতে ছুড়ি ধরিয়ে দিলো-“আসেন না কেক কাটি।”
নাদিরা আর নাহিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। ওদের চেহারায় ভয়ের ছাপ। রুজাইফ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেঁজুতি বললো-“তোমরা গান গাইতেছ না কেন? গাও গাও। হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ…”
রুজাইফ চেচিয়ে উঠলো-“স্টপ সেঁজুতি।”
ধমকে কেঁপে উঠলো সেঁজুতি। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো-“কি হইছে? চেঁচান কেন?”
সে সন্দিহান নজরে তাকিয়ে রইলো-“সত্যি তোমার জন্মদিন?”
“তা নয়তো কি? আচ্ছা যান আপনের কেক কাটা লাগবে না। আমিই কাটি।”
বলেই কেক কেটে এক টুকরো তুলে রুজাইফের মুখের সামনে ধরলো-“নেন খান।”
রুজাইফ সেঁজুতির হাত থেকে কেক ফেলে দিলো। সেঁজুতি চেচিয়ে উঠলো-“আরে আরে কি করলেন? এতো কষ্ট করে কেকটা বানাইলাম আপনে না খেয়ে ফেলে দিলেন?”
রুজাইফের কি হলো জানে না সে ঠাস করে চড় মেরে দিলো সেজুতিকে-“মেহমান মেহমানের মতো থাকো। ঘরের মানুষের উপর মাতব্বরি করার অনুমতি কে দিয়েছে?” সেঁজুতি গালে হাত দিয়ে হা করে তাকিয়ে আছে। অপমানে তার চেহারা ফ্যাকাশে। চোখে পানি টলমল করছে। সেঁজুতি ছুটে চলে গেলো দোতলায়। ওর পিছু পিছু নাদিরা। নুমা মন খারাপ করে বললো-“মেয়েটাকে শুধু শুধু মারলি রুজাইফ। ছোট মানুষ একটু আনন্দ করতে চেয়েছে তাতে কি দোষ করলো?”
রুজাইফ জবাব দিলো না। চুপচাপ নিজের কামরায় চলে গেল।

রাতে খাওয়ার জন্যও আর নিচে নামলো না রুজাইফ। এমনকি সেঁজুতিও খেলো না। সবারই মন খারাপ রইলো। গভীর রাতে পানি খাওয়ার উদ্দেশ্যে নিচে নেমেছিল রুজাইফ। সেঁজুতিকে দেখা গেলো টেবিলে বসে কেক খাচ্ছে। রুজাইফকে দেখেও দেখলো না। রুজাইফ ফ্রিজ থেকে বোতল নিয়ে সেঁজুতির কাছে এসে দাঁড়ালো-“একা একা কেক খাচ্ছ?”
সেঁজুতি উত্তর দিলো না। রুজাইফ ওর পাশে বসলো। মুখ বাড়িয়ে বললো-“দাও খাইয়ে দাও। দেখি কেমন কেক বানিয়েছ?”
সেঁজুতি তবুও কথা বললো না। রুজাইফ ওর গাল ধরে ঘুড়ায়। চড়ের দাগ বসে গেছে গালে। রুজাইফ হাত বুলিয়ে দিলো দাগে। ফিসফিস করলো-“সরি। অনেক ব্যাথা পেয়েছ তাই না?”
সেঁজুতি মুখ সরিয়ে নেয়-“চড় মাইরা আলগা আদর দেখানো লাগবে না।”
সেঁজুতি উঠে যেতে নেয়। রুজাইফ হাত ধরে আঁটকায়-“কেক খাইয়ে দিয়ে যাও।”
“নিজের হাত আছে নিয়া খান।”
রুজাইফ ওর হাত ধরে টেনে কাছে নিয়ে এলো-“না খাইয়ে দিলে ছাড়বো না।”
সেঁজুতি ফুঁসে উঠলো-“সব আপনের ইচ্ছা? খাওয়ামু না।”
সেঁজুতিকে টেনে কোলের উপর বসালো রুজাইফ। জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুঁজে থাকলো। সেঁজুতি ছটফটিয়ে উঠলেও ছাড়লো না। শক্ত করে ধরে থাকলো। মৃদুস্বরে বললো-“এতো নড়াচড়া করো না। চুপচাপ বসে থাকো। এতো জ্বালাও কেন তুমি? কি চাও বলো তো? নাদিরা বলেনি আমি জন্মদিন পালন করি না? তাও কেন তোমার আদিখ্যেতা? আমাকে জোর করতে ভালো লাগে?”
“আপনেও তো জোর করেন। এই যে জোর করে বসায় রাখছেন আমারে।”
“খাইয়ে দিলে জেতে দেব।”
সেঁজুতির চোখে অকারণে জল জমে। রুজাইফ ওকে সামনে ঘুরিয়ে আনে। সেঁজুতি মুখ নিচু করে রাখে। রুজাইফ ওর মুখ তুলে ধরে দেখলো-“খাইয়ে দাও প্লিজ না হলে খুব কষ্ট পাবো।”
সেঁজুতি ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আঁটকায়। অনিচ্ছায় রুজাইফের মুখে কেক তুলে দেয়। রুজাইফ সেঁজুতির কান্নাভেজা মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কেক খায়। সেঁজুতির কাঁদো কাঁদো মুখ দেখতেও কেন যেন ভালো লাগছে তার।

★★★

বাচ্চাদের স্কুল শুরু হলো। সারাদিন ঘর ফাঁকা থাকে। হাশেম দুপুরে খেয়ে চায়ের দোকানে যাচ্ছে রেগুলার। নুমা কয়েকবার মানা করার পরও শুনছে না-“মানা কইরো না বউ। পোলাপান বাড়িতে নাই, কি করমু সারাদিন? মানুষের লগে একটু কথাটথা কইলে মন ভালো লাগে। আমি চইলা আসমু ঘন্টাখানেক পর।”
নুমা আর কিছু বলতে পারে না। সে বিছানায় গড়িয়ে নেয় কিছু সময়।

বিকেলে সবাই ফিরে আসে। হাত মুখ ধুয়ে নিচে নেমে বাবাকে না দেখে নাদিরা মায়ের কাছে জানতে চাইলো-“বাবা কোথায় মা? দেখছি না যে?”
নুমা হুশ হলো-“তাইতো, তোর বাবা কই? সে দুপুরে চা খাইতে গেলো, বললো ঘন্টাখানেকের মধ্যে চলে আসবে। এখনো আসলো না।”
সেঁজুতি জানতে চাইলো-“কোন চায়ের দোকান?”
নুমা মাথা নাড়ে-“আমি তো চিনি না।”
সেঁজুতি রোমেলাকে ডাকে-“ও রোমেলা দাদি, তুমি একটু উল্টাদিকের চায়ের দোকানটাতে দেইখ আসো তো ফুপা সেইখানে আছে নাকি।”
রোমেলা দেরি না করে ছুটলো। নাহিয়ান আর নাদিরার খিদে লেগেছে কিন্তু সে খেতে বসতে পারলো না। তারা স্কুল কলেজ থেকে ফেরা মাত্রই বাবা তাদের আশেপাশে ঘুরঘুর করে। এটা সেটা জানতে চায়। কখনো এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। আজ নেই দেখে চিন্তা হচ্ছে। নুমা বললো-“তোদের ভাত দেই খেয়ে নে।”
নাদিরা মাথা নাড়ে-“বাবা আসুক আগে। আর দা ভাই কে বলো মা না হলে সে রাগ করবে।”
রুজাইফ তখনই বাড়িতে ঢুকলো-“কি হয়েছে? কি বলার কথা বলছিস তোরা?”
নাহিয়ান বললো-“ব্রো, বাবা নাকি দুপুরে চা খেতে বাইরে গেছে এখনো ফেরেনি।”
রুজাইফ চিন্তিত হলো-“কোন চায়ের দোকান?”
নুমা বললো-“এই তো বাড়ির কাছেই নাকি।”
রুজাইফ কিছু না বলেই আবার বেরিয়ে গেলো।

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামলো তবুও হাশেমের কোন খবর নেই। আশেপাশের এলাকা তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে সে নেই। চায়ের দোকানীর ভাস্য, দুপুরে হাশেম এসেছিল দোকানে। চা খেয়ে বেরিয়ে গেছে। সে আর দেখেনি। রুজাইফের মাথা নষ্ট হয়ে গেলো। সে রাতের বেলা সেজুতিদের বাড়ির উঠনে এসে চেচামেচি শুরু করলো। মাজেদ বেরিয়ে এলো-“কি হইছে?”
“আমার ফুপা কই? তাকে কই রাখছেন তাড়াতাড়ি বের করেন নাইলে কিন্তু খুব খারাপ হবে।”
মাজেদ অবাক হয়ে বললো-“তোমার ফুপা কই তা আমরা কেমনে জানবো? আমি এই কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি আসলাম।”
“আপনেরা ঠিকই জানেন। জিজ্ঞেস করেন আপনার ভাইদের। আমার ফুপার খবর দেন নাইলে সত্যিই খারাপ হবে।”
শামসুননাহার বেরিয়ে এলো-“এই পোলা, কতা বুইজা সুইনা কইবা। তোমার ফুপা কই তা আমরা কেমনে জানুম?”
রুজাইফ দাঁতে দাঁত চাপলো-“কোমড়ে পুলিশের দড়ি পড়লে ঠিকঠিক জানবেন। আমি এখনই পুলিশে খবর দিতেছি। তারপর যদি বাইর হয় যে আমার ফুপার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে আপনাদের হাত আছে তাইলে আপনাদের সাথে কি হবে তা চিন্তাও করতে পারবেন না। ভাইবেন না বিশ বছর আগে যা করতে পারছেন তাই আবার করবেন। আমি রুজাইফ তা কোনদিন হইতে দিব না।”
বলেই ফোন বের করলো রুজাইফ। পুলিশে ফোন দিয়ে অপেক্ষা করছে সে। এদিকে শামসুন্নাহার, মাজেদ শ্যামলী ওরা চোখাচোখি করছে। সাজেদ আর জাহাঙ্গীর বাড়ি ফিরে এলো তখনই। রুজাইফ সন্দিহান নজরে চেয়ে আছে ওদের দিকে। এরা নিশ্চয়ই কিছু করেছে তার ফুপার সাথে।

চলবে—
©Farhana_Yesmin