#যে_থাকে_আঁখি_পল্লবে
#পর্ব-৩২
দুই সপ্তাহ গত হওয়ার পর সেঁজুতি আবিষ্কার করলো রুজাইফের থেকে দূরে থাকতে অসহ্য লাগছে তার। ওই লোকের ধমক না খেয়ে কেমন যেন বিস্বাদ লাগছে জীবনটা। তার উপর রুজাইফ তাকে দেখলে না দেখার ভান করে। তখন খুব অপমান বোধ হয়। বুকে তীব্র জ্বলুনি টের পায়। রুজাইফকে মনে মনে হাজার গালাগাল দিয়েও মন শান্ত হচ্ছে না তার। নাদিরাটাও কেমন যেন স্বার্থপর হয়ে গেছে। একটা দিনও সেঁজুতিকে ডাকে না। নিশ্চয়ই মিস করে না আর। না হলে ঠিকই ডাকতো। সেঁজুতি ভাবলো, যথেষ্ট হয়েছে আর না। আজ রুজাইফের সাথে কথা বলতেই হবে।
কলেজ থেকে ফিরতে গিয়ে রুজাইফের সাথে দেখা হলো সেঁজুতির। কথা বলার জন্য মনস্থির করলেও কেন যেন পারলো না। উল্টো ঘুরে চলে আসতে গিয়ে অবাক হলো। রুজাইফ ডাকছে তাকে। সেঁজুতি বিস্মিত হয়ে রুজাইফকে দেখলো-“আপনে আমারে ডাকতেছেন?”
রুজাইফ বিরক্তিসূচক শব্দ করে বললো-“আশেপাশে তো আর কেউ নেই। তাহলে তোমাকেই ডাকছি।”
সেঁজুতি কিছুটা ভাব নিয়ে বললো-“কেন ডাকতেছেন? আমার লগে কি দরকার? আপনের দরকার থাকলেও আমার নাই। আপনের মতো স্বার্থপর মানুষের লগে কথা কইতে চাই না।”
রুজাইফের ভ্রু কুঁচকে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“ফালতু আলাপ ঝাড়লে চড় খাবে। একদম ভাব নেবে না। আমি জানি আমার সাথে কথা বলার জন্য জান চলে যাচ্ছিল তোমার।”
সেঁজুতির মুখ কালো হয়ে গেলো। এই লোকের সামনে ঠিক মতো অভিমানও করা যায় না। সবসময় এ্যাকশন হিরোর মুডে থাকে। সে গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো। রুজাইফ বললো-“এখনি বাসায় এসো। কাজ আছে তোমার সাথে।”
“আসুম না। সবসময় খালি বকা দেন।”
রুজাইফ দু’কদম এগিয়ে আসতেই সেঁজুতি ভয়ে পিছিয়ে গেলো। রুজাইফ কঠোর দৃষ্টি ফেলে-“বাবার কথা মনে আছে তো? কিছু বলছি না বলে সব ভুলে গেলে তো সমস্যা। আর একবার যেন বলতে না হয়। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসো। না হলে খারাপ হবে।”
সেঁজুতি ভেঙচি কেটে ঘরে ঢুকে গেলো। রুজাইফ সেদিকে তাকিয়ে রইলো কিছুসময় তারপর নিজের বাড়িতে ঢুকে গেলো।
ঘন্টাখানেক পরে সেঁজুতি এলো। তখন রুজাইফরা সকলে সন্ধ্যার নাস্তা করছে। ওকে দেখে নাদিরা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো-“সেঁজুতিপু, তুমি এতো নিষ্ঠুর? এতোদিনে একবারও দেখতে এলে না আমাদের।”
সেঁজুতি মন খারাপ করে উত্তর দিলো-“তোমরা মনেহয় আমারে অনেকবার দেখতে গেছো? তোমরাও স্বার্থপর।”
সেঁজুতির কথা বলার ধরনে নুমা আর হাশেম হেসে দিলো। নাদিরা ওর হাত ধরে টানলো-“এসো নাস্তা করি। মা মজাদার পেঁয়াজু বানিয়েছে।”
“খাবো না গো। আমি কেবলই খেয়ে এলাম।”
নাদিরা জোর করে-“খাও না। তুমি তো মায়ের হাতের রান্না পছন্দ করো।”
“সত্যি পেট ভরা না হলে খেতাম।”
সেঁজুতি কিছুতেই খেতে রাজি হলো না দেখে ওরা সকলে অবাক হলো। মেয়েটা কি সত্যি চেঞ্জ হয়ে গেলো ওর পরিবারের বাকি সবার মতো? রুজাইফ অবশ্য চুপচাপ দেখলো সব কোন মন্তব্য করলো না। চা শেষ করে সেঁজুতিকে উপরে যেতে বলে সে উঠে গেলো।
কিছুক্ষণ পর সেঁজুতি দরজায় নক করতেই রুজাইফ ডাকলো-“ভেতরে এসো।”
সেঁজুতি ভয়ে ভয়ে ভেতরে এলো-“আমারে ডাকছেন কেন?”
রুজাইফ সোজা হয়ে বসলো, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে জানতে চাইলো-“তোমার কি মনেহয় কেন ডাকছি?”
সেঁজুতি থতমত খেলো-“আমি কেমনে কমু?”
রুজাইফ উঠে সেঁজুতির কাছে এসে দাঁড়ায়। এতোটাই কাছে যে ওর নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে সেঁজুতির মুখের উপর। সেঁজুতি অসস্তিতে সেটে গেলো দরজার সাথে-“দূরে দাঁড়ান। এতো কাছে দাঁড়াইছেন কেন?”
রুজাইফ ফিসফিসিয়ে উঠলো-“যে কথা বলবো তা কানে কানে বলতে হয়।”
সেঁজুতি নার্ভাস হয়ে তোতলায়-“কককি কইবেন?”
রুজাইফ আরও একটু কাছঘেষে এসে সেঁজুতির কানের কাছে মুখ এগিয়ে এনে বললো-“আমি তোমাকে…”
সেঁজুতির বুকের ভেতর ড্রাম বাজছে যেন৷ হার্টবিট দ্রুত হচ্ছে। সেঁজুতি কাপড় খামচে ধরলো। গত কয়েকদিনে সে রুজাইফকে যেমন মিস করছে সেরকম রুজাইফও করছে? জানতে উদগ্রীব হলেও রুজাইফ বাক্য শেষ করে না। উল্টো ঘুরে টেবিলের কাছে গিয়ে কিছু কাগজ নিয়ে এলো। সেঁজুতির হাতে দিলো-“আমি তোমাকে একটা কাজ দিতে চাচ্ছি। পারবে করতে?”
সেঁজুতি বোকার মতো মুখ করে বললো-“হ্যাহহহ!”
“মন দিয়ে শোন। এই কাগজগুলো এখনই তোমার দাদীকে দেবে। শুধু দিলে হবে না তাকে পড়ে শোনাবে। ঠিক আছে?”
সেঁজুতি মনে মনে ভীষণ লজ্জা পেলো। সে ভেবেছিল রুজাইফ অন্য কিছু বলবে। এখন কাজের কথা শুনে মেজাজ খারাপ হলেও কিছু বললো না। কেবল মাথা দুলায়। সেঁজুতি চলে যাচ্ছিল রুজাইফ পিছু ডাকলো-“এখন থেকে আমার সামনে শুদ্ধ ভাষায় কথ বলবে। ঠিক আছে?”
“হুমমম।”
কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ চলে এলো সেঁজুতি। সোজা শামসুন্নাহারের ঘরে। এসে কাগজ গুলো তার হাতে দিলো-“তোমারে দিতে কইলো।”
শামসুন্নাহার খুব অবাক হয়ে বললো-“কেডা? কাগজ দিয়া কি করুম আমি?”
“ওই বাড়ির পোলা। কইলো তোমারে পইড়া শুনাইতে।”
শামসুন্নাহার বিরক্ত হলো-“তো আমার হাতে দিছোস কেন? পইড়া শুনা দেখু কিসের কাগজ।”
সেঁজুতি নিরাসক্ত ভঙ্গিতে প্রথম কাগজটা খুলে পড়তে শুরু করলো। কয়েক লাইন পড়ার পরই শামসুন্নাহার চেচিয়ে উঠলো-“ওই ছেড়ি, কি লেখছে এইগুলা? হ্যাহ, কি লেখছে? এইসব মিছা কতা কেন লেখছে?”
সেঁজুতি ততক্ষণে কাগজের মধ্যে থাকা ছবিগুলো তুলে নিলো। ওর চোখ দুটো কোটড় থেকে বেড়িয়ে আসার উপক্রম হয়েছে। আল্লাহ! এইসব কি? সেঁজুতি অস্ফুটে চেচিয়ে উঠলো-“দাদী, দেখো।”
শামসুন্নাহার চোখে চশমা ঠেলে ছবিগুলো হাতে নিলো। তার চোখ দুটো ক্রমান্নয়ে বড় হতে লাগলো মুখ হা। রাগে তার ব্রক্ষতালু জ্বলছে৷ এতো বড় ধোঁকা! শামসুন্নাহার সেঁজুতিকে বললো-“যা তোর চাচীগো ডাইকা আন। এখনি আইতে কবি।”
সেঁজুতি মাথা দুলিয়ে ছুটে বের হলো। শামসুন্নাহার ছবির দিকে তাকিয়ে বসে থেকে দুলছেন ক্রমাগত। তার গা হাত পা নিশপিশ করছে অজানা রাগে।
“আম্মা, ডাকছেন আমাগো?” লাকি আর খুকু এসে দাঁড়িয়েছে। শামসুন্নাহার ওদের মুখের উপর ছবিগুলো ছুঁড়ে দিলো-“এইগুলা কি? কি এইগুলা? এই বাড়ির বউ হইয়া নষ্টামি করতে বুক কাঁপে নাই? আর তুমি? পোলা কি করে খোঁজ রাখো কোন? আল্লাহ রে, কাগেরে নিয়া চিন্তা কইরা আমার ঘুম হারাম করি? কাগো লাইগা এতো কষ্ট করলাম?”
লাকি আর খুকু কিছু না বুঝে একে অপরের মুখের দিকে তাকালো। নিচে পড়ে থাকা ছবিগুলো হাতে তুলে নিয়ে দেখতেই দুজনার হাত পা কাঁপতে লাগলো। একি! এই সর্বনাশ কে করলো?
শামসুন্নাহার এগিয়ে এসে খুকুর চুলের মুঠি ধরলো-“হা*মজাদি, তুই আমার ঘরে খাইয়া পইরা আরেক নাগর ধরোস? কতদিন ধইরা চলতেছে এইগুলা?”
খুকু আর্তনাদ করলো-“আম্মা, ছাড়েন আমারে। কি করগেছেন? এইগুলা মিছা কতা সব।”
“মিছা কতা? এই ছবি মিছা? তুই আমার পোলা থুইয়া আরেক ব্যাডার লগে মুখ কালা করোস আবার মিছা কতা কস? শয়তান মাইয়া। তোগো পামে পইরা দুই পোলা এহন পালায়া বেড়াইতাছে।”
দুপদাপ কিল বসিয়ে দিলো খুকুর পিঠে। লাকি কিংকর্তব্যবিমুড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে মেরাজের ছবি যেটাতে মেরাজকে কয়েকজনের সাথে বসে গাঁজা সেবন করতে দেখা যাচ্ছে।
এদিকে চেচামেচি শুনে শ্যামলী আর মাজেদ ছুটে এসেছে। খুকুকে মায়ের হাত থেকে ছুটিয়ে নিয়ে মাজেদ মাকে ধমক দিলো-“কি করতেছ আম্মা? হইছে কি আপনাগো?”
শামসুন্নাহার সেঁজুতিকে ধমক দিলো-“তোর বাপরে দে কাগজগুলা। দেখা এই মাতারীর কাম।”
সেঁজুতি বাবার দিকে সব কাগজ এগিয়ে দিলো। পড়তে পড়তে মাজেদের চোখ কপালে। সেঁজুতি র দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো-“তোরে কে দিছে এইগুলা? রুজাইফ?”
সেঁজুতি মাথা দুলায়-“দাদীরে দিতে কইলো।”
মাজেদ নিজেকে সামলে নিলো দ্রুত। স্থির হয়ে মাকে ডাকলো-“মা, রুজাইফ চায় সাজেদ আর জাহাঙ্গীর থানায় আত্মসমর্পণ করুক। আর ওগো জমিজমা শান্তি মতো ওগো বুঝায়া দেই। নাইলে এইগুলা সব গ্রামে ছড়ায় দিব। মিরাজের পড়ালেখা বন্ধ করাইব।”
শামসুন্নাহার মাজেদের দিকে সন্দিহান নজরে চেয়ে থেকে বলে-“তুই কেমনে জানলি রুজাইফ কি চায়?”
মাজেদ কাগজ বাড়িয়ে দিলো-“রুজাইফ এইখানে সব লিখা দিছে। মিরাজ নাকি ড্রাগ বেচাকেনার ধান্দা করে ওর কথায় রাজি না হইলে ও মিরাজরে পুলিশে ধরায় দিব।”
শামসুন্নাহার শান্ত হয়ে গেলো। মাজেদ খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললো-“তাতেও যদি না মানের আম্মা, তাইলে পুরান ইতিহাস ধইরা টান দিব। আপনের বিরুদ্ধে মামলা করবো। সাক্ষী নাকি আছে।”
শামসুন্নাহার অবিশ্বাস্য নজরে মাজেদকে দেখলো। মাজেদ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো-“আমি বারবার আপনেগো কইতেছিলাম ওগো জমিজমা বুঝায় দেই। বারবার কইছি আগের দিন নাই। আপনেরা আমার কথা শুনেন নাই। এখন দেখছেন কি পরিস্থিতি হইছে? কি করবেন এখন? কেমনে ওর বিরুদ্ধে লড়বেন?”
শামসুন্নাহার অনেকটা সময় নিশ্চুপ বসে রইলো। মাথায় অংক কষেও কোন কূলকিনারা করতে পারছে না। কি করবে? কি করলে রুজাইফকে শায়েস্তা করা যাবে ভাবতে ভাবতে সেঁজুতির দিকে নজর পরলো তার। ঠিক তখনই শামসুন্নাহারের মুখে কুটিল হাসিটা দেখা গেলো। এবার সময় এসেছে শেষ চাল দেওয়ার।
চলবে—
©Farhana_Yesmin