#যে_থাকে_আঁখি_পল্লবে
#পর্ব-৩৩
শামসুন্নাহার ঘটনা জেনে ফেলার পর থেকে খুকুর মনে অশান্তি চলছে। কোনভাবে এই খবর জাহাঙ্গীরের কানে গেলে কি হবে সে ভেবে পাচ্ছে না। জাহাঙ্গীর বড্ড বদরাগী মানুষ। মাথা বিগড়ে গেলে সে খুন পর্যন্ত করে ফেলতে দ্বিধা করবে না। এলোমেলো ভাবনায় মাথা নষ্ট হওয়ার জোগাড় হয়েছে। অনেক ভেবেও নিজেকে বাঁচাতে কি করবে সেটা বুঝে পেলো না। শেষ মেষ ঠিক করলো, রুজাইফের কাছে গিয়ে সাহায্য চাইবে। ওই ছেলেই ওর ঝামেলার সুরাহা করতে পারবে। যেই ভাবা সেই কাজ। ছেলেমেয়েদের ঘুম পাড়িয়ে চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে খুকু এলো রুজাইফের দুয়ারে। রুজাইফ যেন জানতো এমন কিছু হবে তাই সে অবাক হলো না। গম্ভীর মুখে বললো-“কি চাই?”
খুকু ওর পায়ে পড়ে গেলো-“আমার এতো বড় ক্ষতি কইরেন না বাপজান। তিন পোলাপান আমার, তাগোর বাপ জানলে আমারে খুন করবো। পোলাপানগুলার কি হইবো কন দেহি।”
“সে তো আগে ভাবা উচিত ছিলো। যাইহোক, তাকে আত্মসমর্পণ করতে বলুন তাহলে কেউ কিছু জানবে না।”
রুজাইফের কথায় খুকু যেন কথা হারায়-“হ্যাহহ, কি কন?”
রুজাইফ বললো-“বললাম আপনার ওনাকে থানায় আত্মসমর্পণ করতে বলেন। তাহলে আমি আপনার ঘটনা ভুলে যাব।”
খুকু মাথা নাড়ে-“হে কিছুতেই মানতো না এই কথা।”
“তাকে মানানো আপনার দায়িত্ব। নিজের ভবিষ্যত নিরাপদ রাখতে চাইলে তাকে রাজি করান। না হলে পুরো গ্রাম এই ঘটনা জানবে। তার কানেও যাবে। সেটা কি ভালো হবে? উহু, আর কোন কথা শুববো না। যেটা বললাম সেটা করুন।”
খুকু অসহায় চোখে ফিরে যেতে যেতে বললো-“আপনে আমার ক্ষতি করলেও আমি আপনের একটা উপকার করতে চাই বাজান। একটা সত্য কইয়া যাই। মা কিন্তু আপনের বদনাম করার বুদ্ধি করতেছে। সাবধান থাহেন।”
রুজাইফ তেমন কিছু বললো না। এমনকি ওর চেহারায় কোন পরিবর্তন এলো না। সে শান্ত চোখে ও বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলো। আঁধারে তার ঠোঁটের কোনের হাসিটা বড্ড অশরীরী দেখালো।
★★★
সকালে অফিসে যাওয়ার সময় রুজাইফের সাথে দেখা হলো সেঁজুতির। সে গাল ফুলিয়ে বললো-“আপনেরে ভালো মানুষ ভাবছিলাম এহন দেহি আপনে মানুষটা খুব খারাপ।”
রুজাইফ কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো। সেঁজুতি সেই দৃষ্টি দেখে ভয় পেয়ে ঢোক গিললো। এই লোক রেগে আছে কেন? কি করলো সে? রুজাইফ নির্দেশ দিলো-“গাড়িতে ওঠো তোমাকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে আসি।”
সেঁজুতি ভীত চোখে মাথা নাড়ে-“নাহ আব্বা দেখলে রাগ হইবো। আমি হাইটা যাইতে পারুম।”
রুজাইফ চোয়াল শক্ত করে ধমক দিলো-“গাড়িতে উঠতে বলেছি।”
সেঁজুতি এবার সত্যি সত্যি অবাক হলো। এই লোক আবার আগের স্বভাবে ফিরে এসেছে? মনে মনে হাজারটা গালি দিলেও রুজাইফের কথার বাইরে যেতে পারলোনা। সে সুরসুর করে গাড়িতে উঠতেই রুজাইফ তার পাশে বসে গাড়ির দরজা লাগিয়ে সিটে হেলান দিয়ে ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলো-“যাও।”
সেঁজুতি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বসে আছে। রুজাইফ চোখ বুঁজে আছে বলে কিছু বলতেও পারছে না। খানিকক্ষণ বাদে সেঁজুতি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখলে গাড়ি কলেজ ছেড়ে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। সে চেচিয়ে উঠলো-“কলেজ তো পিছনে। গাড়ি থামতে কন আমি নাইমা যাই।”
রুজাইফ বিরক্ত হয়ে সোজা হয়ে বসলল-“চেচাচ্ছ কেন? গাড়ি তার নির্দিষ্ট গন্তব্যই যাচ্ছে। আজ আর কলেজে যেতে হবে না।”
“কেন কলেজে যামু না কেন? সামনে পরীক্ষা, ক্লাস করা জরুরি।”
“আমি বুঝিয়ে দেব। তোমার যে সাবজেক্টে সমস্যা সেসব নিয়ে আমার কাছে আসবে।”
সেঁজুতি এবার মিনমিন করলো-“কিন্তু আমরা যাইতেছি কই?”
রুজাইফ জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। গাড়ি থামলো বিশাল বড় পুকুরের সামনে। ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে গেলো। সেঁজুতি নামার প্রস্তুতি নিতেই রুজাইফ বললো-“তুমি নামছো কেন? আমি বলেছি নামতে?”
সেঁজুতি ঢোক গিললো। বোকার মতো মাথা নাড়লো। রুজাইফ পূর্বের ন্যায় গম্ভীর হয়ে বললো-“চুপচাপ বসো। কিছু জরুরি কথা আছে তোমার সাথে। যেমন বলছি তেমন করবে। এর অন্যথা হলে এবার তোমার বাবার নামে কেস করবো। কথা বুঝেছ?”
সেঁজুতি ভয় পেয়ে দ্রুত মাথা নাড়ে-“সবসময় ভয় না দেখালেও চলবে। আমি আপনের সব কথাই শুনি।”
রুজাইফ থমকালো। ভেবে দেখলো সেঁজুতির কথা মিথ্যে নয়। মেয়েটা ঘাড় তেড়ামো করলেও ওর সব কথা শোনে। ওকে ভয় পায় কি? রুজাইফ অসস্তি নিয়ে তাকালো সেঁজুতির দিকে। মেয়েটা ওকেই দেখছে। রুজাইফ তাকাতেই সেঁজুতি মুখ ঘুড়িয়ে নিলো। ওর নাকের ডগা আর চিবুক ঘামে ভিজে আছে। কপালের দু পাশের চুলগুলো ভেজা ভেজা। উজ্জ্বল শ্যামা সেঁজুতির পরনে আকাশি রঙা কলেজ ড্রেস। বড় সাদা ওড়নায় শরীর জড়ানো বলে হয়তো গরম লাগছে মেয়েটার। দেখতে দেখতে চোখে ধন্ধ লাগে রুজাইফের। সে অস্ফুটে উচ্চারণ করলো-“তুমি আমার সব কথা শোন কেন? ভয় পাও?”
সেঁজুতি মাথা নাড়ে-“তা পাই।”
রুজাইফের মন খারাপ হলো খানিকটা। সে কি খুব বেশি মেজাজ দেখায় সেঁজুতির সাথে? ওদের বংশের বাকী সবার রাগটা ওর উপর দেখায় কি? মনে মনে নিজেকে অপরাধী ভেবে ভাবুক হয়ে উঠলো রুজাইফ।
সেঁজুতি তাড়া দিলো-“কি বলতে চাইলেন?”
রুজাইফ ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো। সেঁজুতি প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে তাকিয়ে আছে। রুজাইফ অহেতুক ভাবনা সামলে নিলো। সেজুতির দিকে তাকিয়ে গড়গড়িয়ে নিজের পরিকল্পনা বলে গেলো। শুনতে শুনতে মুখ হা হয় সেঁজুতির। এই লোক মহা পাগল নির্ঘাত। এই ভয়ানক কাজের দায়িত্ব সেজুতির উপর দিচ্ছে। বাই চান্স ভুল হলে শুলেও তো সেঁজুতি কে চড়তে হবে। নিজের চুল ছিঁড়ত মন চাইলো তার। তাকেই কেন রুজাইফ সব কাজের দায়িত্ব দেয়? সেঁজুতি অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে রুজাইফের দিকে। রুজাইফ বিরক্ত হলো-“কি হয়েছে?”
“সব কাজ আমাকেই করতে হবে? আর কেউ নাই?”
সেঁজুতির বোকামিতে বিরক্ত হলো রুজাইফ-“তুমি করবে না তো কে করবে? ওরা কেউ কি আমার.. “রুজাইফ থেমে গেলো। কি ভেবে বললো-“আচ্ছা রোমেলা দাদীকে বলবো তোমাকে হেল্প করবে। এখন বাসায় ফিরে যাও। তোমার বাবা বকলে আমার কথা বলে দেবে।”
সেঁজুতি উসখুস করছে দেখে রুজাইফ বললো-“কিছু বলতে চাইলে বলে ফেলো।”
“এইগুলা করা কি জরুরি? কারো দোষ গোপন করা কিন্তু সোয়াবের কাজ। আর ঘর ভাঙা গুনাহ।”
রুজাইফের চেহারায় আবার গাম্ভীর্যের আড়াল-“ওদের বিরুদ্ধে কিছু না করলে ওরা তোমার মানসন্মান নিয়ে টানাটানি করবে, চলবে?”
“মানে!”
“মানে বুঝলে তুমি সেঁজুতি হতে না আর আমি রুজাইফ। আমার কাজে বেশি প্রশ্ন করো না কেবল যা বলছি তাই করো চুপচাপ।”
সেঁজুতি আর কথা বাড়ালো না। রুজাইফ ওকে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো।
★★★
সন্ধ্যার পরপর শামসুন্নাহার সেঁজুতির কাছে এলো-“ওই ছেমড়ি, ওই পোলা কখন আইবো?”
সেঁজুতি কিছুটা অবাক হলো-“কোন পোলা দাদী?”
“আরে ওই রুজাইফ। আমি ওর লগে কথা কইতে চাই। ওই পোলা আইলে এট্টু খবর দিবি।”
“আচ্ছা। আসুক খবর দিমু নে।”
শামসুন্নাহার ইতস্তত করে বললো-“তুই ওই বাড়ি যাওনের আগে আমারে জানাবি।”
“কেন?”
শামসুন্নাহার তেতে বললো-“আরে, ওর লগে কথা কমু আমি। আমারে না জানাইলে কেমনে হইবো?”
“আচ্ছা জানামু তোমারে। এতোক্ষণে তো চইলা আসে। আচ্ছা এট্টু পরে যামুনে।”
শামসুন্নাহার তবুও বসে ছিলো। সেঁজুতি বড্ড অবাক হলো দাদীর আচরণে। কেমন যেন করছে। এতো ভালো আচরণ ওর সাথে কখনোই করে না দাদী। সেঁজুতির ভাবনার মাঝেই লাকি এলো হন্তদন্ত হয়ে-“আম্মা, তাড়াতাড়ি আহেন সর্বনাশ হইছে।”
লাকি কাঁপছে রীতিমতো। শ্যামলী জানতে চাইলো-“কি হইছে লাকি? এমুন করতাছো কেন?”
লাকি ঘাবড়ে গেলো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো-“আমি কিছু জানি না আপনেরা আসেন আগে।”
শামসুন্নাহার সেঁজুতি শ্যামলী সকলেই একসাথে বেরিয়ে এলো। খুকুর বাড়িতে হইচই হচ্ছে। বাচ্চাগুলো উচ্চস্বরে কাঁদছে। শামসুন্নাহার হতবিহ্বল হয়ে জানতে চাইলো-“কি হইছে লাকি?”
“জাহাঙ্গীর আইছে বাড়িতে।”
“হ্যাহহহ! কখন আইলো? ওরা কান্দে কেন?”
লাকি কিছু বললো না। শামসুন্নাহের মনটা অজানা আশঙ্কায় দুলছে। সবাই ছুটলো ওই বাড়ির দিকে। সেঁজুতি একবার তাকিয়ে “আল্লাহ!” বলে পিছিয়ে এলো। ওর মুখচোখ ফ্যাকাশে। রাতের আঁধারে একটা নাটক মঞ্চস্থ করার কথা ছিলো তার কিন্তু কিছুই করতে হলো না তার আগেই সব হয়ে গেলো। এ কি আল্লাহর ইশারা? সেঁজুতি হাসফাস করতে করতে পিছিয়ে গিয়ে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে বমি করে দিলো।
শামসুন্নাহার ভীষন ঘাবড়ে গেলো। তার কেন যেন ভেতরে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। মনেহচ্ছে ভেতরে ভয়াবহ বিপদ ওত পেতে আছে। পা টানছে না। কিন্তু যেতে তো হবেই ভেবে হাক ছাড়ে-“আরে হইছে কি? এমন করতাছোস কেন?” বলে ভেতরে ঢুকতেই পা জমে গেলো শামসুননাহারের। চোখের সামনে একি দেখছে সে? তার চোখ দুটো কোটর থেকে বেড়িয়ে আসবে যেন। একবার চোখ দুটো দু’হাতে ঘষে নিলো। অবিশ্বাস্য লাগছে সব। পুরো ঘর যেন রক্তের স্তুপ। সেই স্তুপে গড়াগড়ি খাচ্ছে খুকু আর পাশের গ্রামের রুস্তম আলীর লাশ। হাতে ধারালো একটা ছুড়ি নিয়ে রক্তে জুবজুব হয়ে বসে আছে জাহাঙ্গীর। তার তিন ছেলেমেয়ে আরেকদিকে বসে তাতস্বরে চেচিয়ে যাচ্ছে। শামসুন্নাহার চোখে আঁধার দেখলো। জাহাঙ্গীর! জাহাঙ্গীর কখন এলো বাড়িতে? সে কেন টের পেলো না। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সকলেই স্তম্ভিত। জাহাঙ্গীর মাকে দেখে অপ্রকৃতস্থের মতো হাসলো-“আমি নাই এই সু্যোগে আমার ঘরে পর বেডা নিয়া শুইয়া আছিল। ও ঘরে ফুর্তি করতেছে আর আমি জায়গায় জায়গায় ফেরার হইয়া পলায়া বেড়াইতেছি। দিছি দুইজনরে শেষ কইরা। ভালো করছি না, আম্মা?”
পুরো ঘরে নজর বুলিয়ে নিলো আবার। ঘরটা দেখে মনেহচ্ছে মৃত্যুপুরী। শামসুন্নাহারের চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। এতো বড় আকস্মিক ঘটনা মেনে নিতে পারলো না। সে বুক খামচে ধরে মেঝেতে গড়িয়ে পড়লো।
চলবে—
© Farhana_Yesmin