অশ্রুজলে লেখা পর্ব-০১

0
13

#অশ্রুজলে লেখা
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী

—রানু, সামনের শুক্রবার ছেলেপক্ষ তোকে দেখতে আসবে। আল্লাহপাকের কসম লাগে এবার কোনো উল্টা পাল্টা করিস না। আমার আর তোর বাবার বয়স হয়েছে। কবরে যাওয়ার আগে তোকে অন্তত সংসারী দেখে যেতে পারলে শান্তিতে মরতে পারবো।
রানু কেবল ভাতের লোকমাটা মুখে তুলেছে। কিন্তু মা আয়েশা বেগমের কথাগুলো শুনে খাবারগুলো গিলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। উপায় নেই গিলতেই হবে। কেননা খাবার নষ্ট করতে রানু পছন্দ করে না। আড় চোখে বাবার দিকে তাকালো। রানুর পাশে বসে ইদ্রিস সাহেব রাতের খাবার খাচ্ছেন। একমনে মাথা নীচু করে খাবারগুলো গিলছেন। রানু জানে,বাবা এই প্রসঙ্গে অংশ নিবে না বলে খাবারটাকে গুরুত্ব দেওয়ার ভাব করে খাচ্ছেন। রানুর প্রচন্ড বিরক্ত অনুভব হলো। চোখে মুখে বিরক্তভাব ফুটে উঠলো। এই একই প্রসঙ্গ নিয়ে প্রায় প্রতিদিন মায়ের সাথে ওর কথা কাটাকাটি হয়। আর ভালো লাগে না। মাতো জানে ,কেন ও বিয়ে করতে চায় না। তারপরও কেন মা এই বিষয়টা নিয়ে খোঁচাখুঁচি করে। রানুর চেহারার বিরক্তভাব দেখে ওর মা রেগে গিয়ে বলে,
—-বিয়ের কথা বললেই মুখটা বিড়ালের পাছার মতো করে রাখিস ক্যান? বয়স কত হলো সেদিকে খেয়াল আছে? এরপর কপালে দোজবরে ছাড়া আর কিছু জুটবে বলে আমার মনে হয় না।
রানু বিরক্ত হয়ে বলে,
—-তোমার জন্য আমি মনে হয় এ বাড়িতে আর থাকতে পারবো না। শীঘ্রই মহিলা হোস্টেল দেখে আমাকে চলে যেতে হবে।
—-এখন তো এই কথাই বলবে। চাকরি করছো বলে ভাবটা এমন সবার মাথা কিনে নিয়েছো। কত কষ্ট করে মিডিয়ার মারফতে আমি সমন্ধগুলো নিয়ে আসি। আর তুমি নানা রকম বাহানা করে নিষেধ করে দাও। এবার যদি এরকম কিছু করার চেষ্টা করো না তাহলে থাপড়ে তোমার দাঁত ফেলে দিবো।
রানু অবাক হয়ে ওর মায়ের দিকে বেশকিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। তারপর না খেয়ে খাবারগুলো ফ্রিজে রেখে হাত ধুয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।
মেয়ের সাথে এরকম ব্যবহার করতে দেখে ইদ্রিস সাহেব রেগে গিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
—তুমি তো এই বিষয়টা রাতের খাবারের পরেও করতে পারতে। মেয়েটা খেটে খুঁটে সারাদিন পর রাতে আমাদের সাথে খেতে বসে। তুমি ওর মানসিকতাটুকু আজও বুঝে উঠতে পারলে না।
আয়েশা বেগম নিজের কপাল চাপড়ে বললেন,
—-সবার ভালো চাই বলে আমি তোমাদের কাছে ফেলনা হয়ে গিয়েছি তাই না?
একথা বলে উনি কাঁদতে লাগলেন। ইদ্রিস সাহেব রেগে গিয়ে বললেন,
—তোমার এই আলগা চোখের পানির স্রোত বন্ধ করো। মেয়েটার জীবনটার কথা আগে চিন্তা করো।
—-করি বলেই তো ওর বিয়ে নিয়ে এতো ভাবনা আমার!কোন ছোটোবেলায় কি ঘটেছে সেটা নিয়ে পড়ে থাকলে জীবনকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না। মানুষ যেখানে হোঁচট খেয়ে পড়ে সেখান থেকে আবার নতুন করে শুরু করতে হয়। যা কিছুই ঘটুক না কেন জীবনে একা থাকার সিদ্ধান্তটা মোটেই সমীচীন নয়। মা হিসাবে এটা ওকে প্রতি মুহুর্তে মনে করিয়ে দেওয়া আমার কর্তব্য।
ইদ্রিস সাহেব সেটা বুঝেন। কিন্তু মেয়ের বুকের ভিতরে যে কষ্টের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে তাকে নেভাবেন কি করে? ইদ্রিস সাহেব ভালোই বুঝতে পারেন মেয়ের অন্তরে এখন সে আগুন জ্বলছে। যদি অনেক বছর পার হয়ে গিয়েছে তারপরও একমুহুর্তের জন্য সেই রাতের কথা মেয়ে যে ভুলতে পারেনি এটা উনি ভালোই বুঝতে পারেন। রাতে তার মেয়ে ভালো করে ঘুমাতে পারে না,প্রায় রাতে বেলকনিতে বসে থাকে। উনি তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে গিয়ে মেয়ের ঘরে উঁকি মেরে দেখেন, ও বারান্দায় একা বসে গিটারে টুংটাং সুর তোলার চেষ্টা করছে।
ইদ্রিস সাহেব জানেন আজও তার মেয়ে সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিবে। আয়েশা বেগম টেবিলের খাবারগুলো সব ফ্রীজে ঢুকিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন। মুহুর্তেই ঘরের পরিবেশটা অন্যরকম হয়ে গেল।

রানু বারান্দায় এসে বসে। চারিদিক চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিতো। উর্দ্ধগগনে জোস্নার আলোয় সাদা মেঘেরা দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার মাঝে আকাশের বুকে বসেছে তারার মেলা। আশে পাশের ফ্লাটগুলোতে রাতে শোয়ার আয়োজন চলছে। হয়তো একটু পরেই সবাই সুখ নিদ্রায় ডুবে যাবে। শুধু রানুর মতো জীবন যাদের তারাই হয়তো জেগে জেগে পুরো নিশি কাটিয়ে দিবে। শ্রাবনের সিক্ত হিমেল হাওয়া এসে শরীরে শীতলতার পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। আশে পাশে হয়তো কোথাও বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিভেজা হাসনাহেনা ফুলের সুবাস এসে নাকে লাগছে।
ওর একাকীত্বের মুহুর্তগুলোতেই সেই দুঃসহ স্মৃতিগুলো বক্ষপটে বারবার ভেসে উঠে। ওর সেই পাপের চোরাবালিতে ডুবে যাওয়া অধ্যায়ের ঘটনা কাউকে আজ অবদি পুরোটা বলতে পারেনি। শুধু স্কটল্যান্ডের এডিনবরা ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করার সময় মুসাকে কিছুটা বলেছিলো। তাও পুরো সত্যি ঘটনা তুলে ধরতে পারেনি। সেটাকে কিছুটা রঙ লাগিয়ে নিজের মতো করে উপস্থাপন করেছিলো। তাতেই মুসা পল্টি মারলো। আসলে না বলে উপায় ছিলো না। মুসা ওকে বিয়ের জন্য প্রেসার দিচ্ছিলো। সে কারনে রানু ওকে বিবেকের তাড়নায় ওর নোংরা অতীতের ঘটনা তুলে ধরেছিলো। কিন্তু মুসা সেটা নিতে পারলো না। ও বাঙ্গালী ছিলো না। নাইজেরিয়ান মুসলিম ছিলো। আসলে এই পৃথিবীতে এখনও সে রকম পুরুষের জন্ম হয়নি। যে নিজের স্ত্রীকে বিয়ের আগে অন্য পুরুষের সাথে রাত কাটানোর কাহিনী শুনে তাকে আবার বিয়ে করতে চাইবে। রানু ভেবেছিলো মুসা হয়তো এসবদিক থেকে অনেক উদার। আসলে রানু তো স্বেচ্ছায় এই কাজটি করেনি। ট্রাপে পড়ে করতে হয়েছে। তাতেই মেনে নিতে পারেনি। আর যদি আসল সত্যিটা ও প্রকাশ করে তাহলে এই সমাজ সংসার ওকে একঘরে করে রাখবে। অথচ ইউনিভার্সিটি ক্লাস করার সময় রানু বুঝতো মুসা ওকে খুব পছন্দ করে। কিন্তু রানু এড়িয়ে চলতো। ভালবাসার সমুদ্রে ডুবতে গিয়ে ও যে একসময় পাপের সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিলো। তারপর জীবনের সেই ট্রমা থেকে আল্লাহপাকের রহমতে উঠে আসতে পেরেছে। জীবনটাকে আবার নতুন করে সাজাতে শুরু করেছে। সে কারণে ও আর ভালোবাসার শীতল স্রোতে নিজেকে আর ডুবাতে চায় না। এটুকু ও বুঝে নিয়েছে সবার জীবনে ভালোবাসা আসে না। কিন্তু মুসা ছিলো নাছোড়বান্দা। সে কারণে যেদিন ওদের দুজনের থিসিস পেপার জমা দেওয়া হয় এবং প্রফেসর সেটাকে এগ্রি করে সেদিন মুসা ওকে নিয়ে লং ড্রাইভে বেরিয়েছিলো। রানুও আর অমত করেনি। ভেবেছিলো এই সময় মুসাকে ওর জীবনের সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা শেয়ার করবে। ঐ লং ড্রাইভ ছিলো রানুর জীবনে এক মধুময় স্মৃতি। যদিও রানুর অন্তরে মুসার আচরণ দেখে ক্ষীণ আশা জেগেছিলো হয়তো মুসা ওকে মেনে নিতে পারে। কিন্তু বাস্তবে ওদের ভালেবাসার সম্পর্কটা গড়ে উঠার আগেই ভেঙ্গে গিয়েছে। তাই বলে এটা নিয়ে রানুর কোনো আফসোস নেই। কিন্তু সেই মুহুর্তগুলো ছিলো অনেক সুন্দর। আসলে স্কটল্যান্ড এমন একটা স্থান যেখানে গেলে মানুষের মন এমনিতেই অনেক ভালো হয়ে যায়। ওদের স্থাপত্য শৈলী দেখার মতো। যা নিয়ে যায় এক ভিন্ন জগতে। এডিনবার্গের বিস্ময়কর জাদুকরী পরিবেশে নিজেকে রুপকথার রাজ্যে হারাতে ইচ্ছে হয়। স্যার ওয়াল্টার স্কট ঐতিহাসিক উপন্যাসিক হিসাবে স্বীকৃত। আসলে পরিবশটা যেন ঐসব উপন্যাস লেখার উপযুক্ত স্থান।
সেদিন ছিলো ছুটির দিন। মুসা খুব ভালো ড্রাইভ করতে জানে। ওখানে আবার বামদিকে বসে গাড়ি চালাতে হয়। মুসা একটা বিএমডব্লিও গাড়ি ভাড়া করে নিলো। রানুরা লোচ লোমন্ড এ যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাে। সেখান থেকে Duck bay তে ঘুরে আবার ভার্সিটির ডরমেটরীতে ফিরে আসবে। এই ছিলো ওদের ট্যুর প্লান। যদিও মুসা বলেছিলে ডাকবেতে থাকার জন্য ভালো রিসোর্ট আছে। কিন্তু রানু রাজী হয়নি। গাড়ি চলতে শুরু করলো। মুসাকে বেশ উচ্ছল দেখাচ্ছে। ওর সেই উচ্ছলে উদ্ভাসিতো মুখের দিকে তাকিয়ে রানুর সেই নোংরা অতীতের পাতা উল্টাতে ইচ্ছে হলো না। ওকে কিভাবে বলবে ওর নিজের ভুলে একরাতের জন্য প্রস্টিটিউট হিসাবে চারজন ক্লায়েন্টের সাথে ও রাত কাটিয়েছে।

চলবে