তৃষ্ণা তব নাহি মেটে পর্ব-০১

0
1

#তৃষ্ণা_তব_নাহি_মেটে
#পর্ব১
#রাউফুন

(শুধুমাত্র প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত)

নামি-দামি রিসোর্টের দরজা খুলতেই নিজের প্রেমিকাকে দেখে জুহাইরের পা থমকে গেল, বুকের ভেতরটা হঠাৎ করে নিস্তব্ধ হয়ে গেল যেন। শিপাকে এখানে দেখে বিশ্বাস করতে পারছিল না সে। দরজা খুলে শিপা জুহাইরকে দেখে একটু ঘাবড়ে গেলেও তা বুঝতে দিলো না তাকে।

“আমাদের প্রটে**কশন এর পার্সেলটা এসেছে সোনা?”

বলতে বলতে শিশির বেড থেকে উঠে এলো। দরজার কাছে জুহাইরকে দেখে কুটিল হাসলো সে। কি অশ্লীল আর কদাকার লাগলো সেই হাসি৷ শিশির শিপার কাধ স্লাইড করতে করতে জুহাইরকে উদ্দেশ্য করে বললো,

“আমিই অর্ডার করেছিলাম সেই জিনিসটা। জিনিসটা দে, দিয়ে বিদেয় হো এখন। আর যদি নিতান্তই থাকতে চাস তো থেকে যা আমাদের রোম্যান্স দেখার জন্য ! আফটার অল আমার নিউলি ম্যারিড ওয়াইফের এক মাত্র প্রাক্তন বলে কথা।”

হোটেলের রুমে শিশির আর শিপা দুজনে? দুজনের এমন ঘনিষ্ঠ অবস্থান, তাদের মুখের হাসি—সবকিছুই যেন তার সামনে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা হয়ে ধরা দিলো। ওয়াইফের প্রাক্তন কথাটা যেনো জুহাইরের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো বাজতে লাগলো৷

মুহূর্তের জন্য জুহাইরের মস্তিষ্ক যেন কাজ করছিল না। কথা বলার চেষ্টা করেও গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। শিপা আর শিশিরকে একসঙ্গে দেখে তার ভেতরে যে তোলপাড় শুরু হয়েছে তা কেবল সেই জানে। যে মানুষটাকে সে নিজের পৃথিবী ভেবেছিল, সেই মানুষটা তার সঙ্গে বিট্রে করবে—এটা তার কল্পনারও বাইরে ছিল। তাকে রেখে এই নোংরা ছেলেটাকে বিয়ে করেছে? সে কি ভুল শুনলো? নাকি তার মস্তিষ্ক তাকে নিয়ে খেলছে? না না তার মস্তিষ্ক তাকে নিয়ে খেলছে না, তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন তাকে নিয়ে খেলেছে, তার ইমোশনের সঙ্গে খেলেছে। সে আনমনে অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,

“শিপা? তু-তুমি…!”

জুহাইরের কণ্ঠে বিষ্ময় আর কষ্ট একসঙ্গে ঝরে পড়লো। শিপা চোখ সরিয়ে বললো,“তো? এখানে থাকতে পারি না?”

তার গলায় কোনো অনুশোচনা নেই। বরং তার চোখেমুখে ছিল এক ধরনের কুলনেস। শিশির পাশে দাঁড়িয়ে এমনভাবে তাকালো, যেন পুরো পরিস্থিতিটা তার কন্ট্রোলের মধ্যে।

“শিপা, এভাবে কেন ঠকালে আমায়? শিশিরের সঙ্গে মিলে তুমি আমায় বিট্রে করলে? পারলে এমন একটা জঘন্য কাজ করতে?” কথাগুলো গলায় আঁটকে যাচ্ছিলো জুহাইরের। কোনো ভাবেই তার অপ্রত্যাশিত দেখা বিষয় টার ঘোর কাটছিলো না।

শিশির এবার হেসে উঠলো, “আরে, তুই বুঝিস নি এখনো? শিপা এখন আমার ওয়াইফ। ওকে আমি তোর থেকে কেড়ে নিয়েছি। তুই ওকে স্যাটিসফাই করতে পারিসনি দ্যাটস হোয়াই ও এখন আমার কাছে।”

জুহাইরের মনে হলো বুকের পাজর ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে এক দমকা হাওয়া যেনো এসে তাকে আঘাত করলো। এতদিন সে যে মানুষটাকে নিজের ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছিল, সেই মানুষটা আজ তাকে ঠকিয়ে এমন অবস্থায় নিয়ে এসেছে। যখন মনে হলো শিপা তাকে ঠকিয়েছে তার কষ্ট তখন রাগে রূপ নিলো, কিন্তু অত্যন্ত সরল আর সাদাসিধা হওয়াই সে কোনো প্রতিবাদ করতে পারলো না। এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা ছিল তার সামনে নির্দয়ভাবে দাঁড়িয়ে। শুধু অস্ফুটে বললো, “তুমি আমাকে এভাবে ঠকালে শিপা? এভাবে?”

শিপা দুই হাত বুকের নিচে আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে শ্রাগ নিয়ে বললো, “জুহাইর, তুমি তো কিছুই দিতে পারোনি আমাকে। তোমাকে যা দেখছি, তোমার পক্ষে আর ফাইনান্সিয়াল স্টেবল হওয়া সম্ভব নয়। তুমি যতই ভালোবাসো, তুমি আমার লাইফস্টাইল মানিয়ে নিতে পারতে না। ওসব ছোটলোকি ভালোবাসার দাম আমার কাছে এক আনাও নেই। তাই আমি শিশিরের সঙ্গে ঘর বেঁধেছি।”

জুহাইর কেমন ক্লেশ ভরা দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে রইলো, কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারলো না আর। তার ভেতরের বিশ্বাস, আত্মবিশ্বাস সবকিছু যেন মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে পড়লো। ভালোবাসা শুধু অনুভূতির উপর নির্ভরশীল নয়, এটা আজ নতুন করে বুঝলো সে। সে হাতে পার্সেল টা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো তখন চট করে শিশির তার থেকে সেটা ছিনিয়ে নিয়ে ধপাশ করে দরজা লাগালো। দরজা লাগানোর শব্দে জুহাইরের ঘোর কাটলো। শিশির শিপার কোমল উদরে লেলিহান দৃষ্টি ফেলে বললো,“তোমার মতো জংলি, বন্য, ম্যানার্সলেস মেয়েদেরকেই তো আমার ভালো লাগে। ঐ গর্ধ্ববটা কি তোমার মতো সুদর্শণাকে পাওয়ার যোগ্যতা রাখে? তুমি কি দেখে ওর প্রেমে পড়লে?”

“ওর প্রেমে আমি কোনো কালেই পড়িনি৷ জাষ্ট ইউস করেছি ওকে। ভালো স্টুডেন্ট কিনা! তুমি জানো, ঐ ষ্টুপিড টা তিন বছর রিলেশনশিপ এ একটা চু’মু অব্দি দেয়নি? মাঝে মধ্যে তো মনে হতো ওর পুরুষত্বই নেই। নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা আছে। না হলে আমার মতো সুন্দরীকে দেখেও ওর পুরুষত্ব কখনোই জাগলো না কেন?”

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে ভেতর থেকে ওঁদের দুজনের এসব কথা শুনে জুহাইরের সর্বাঙ্গ কাঁপছিলো। এক সঙ্গে এতো ধাক্কা নিতে পারলো না নাজুক ছেলেটা। পরক্ষণেই ওদের খুনসুটির আওয়াজ পেয়ে, সে কানে হাত চেপে ধরলো৷ সে চাইলো এই মূহুর্তে যেনো তার কান স্তব্ধ হয়ে যায়, বধির হয়ে যাক সে। আর এক মূহুর্তেও দাঁড়িয়ে থাকার মতো শক্তি সে পেলো না।

বর্ষাকাল, বাইরে তখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জুহাইর বুঝতে পারলো তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ঝড় দ্বিতীয় বারের মতো আবারও বয়ে গেছে। শিপার বিদ্রুপ, তাকে সুযোগ পেয়ে ইউস করেছে শিপা এটা যেনো মানতে পারছে না। রাস্তায় নেমে জুহাইর বৃষ্টির ফোঁটার নিচে দাঁড়িয়ে রইলো। আকাশের কাঁন্না যেন তার নিজের কাঁন্নার প্রতিফলন। তক্ষুনি তার ফোনে একটা ম্যাসেজ এলো। ফোনটা হাতে নিয়ে ম্যাসেজ টা দেখতেই তার অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়া চকচক করে উঠলো। সুক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠলো ঠোঁট কোলে। এটাই তার শেষ দুর্বলতা,তার জীবনের শেষ কান্না। সে আর কখনোই কাঁদবে না। ভীষণ দামী তার অশ্রু, ভীষণ দামী। আজকের পর থেকে আর কখনো কোনো সম্পর্ক তাকে দুর্বল করবে না। আজ থেকে শুধুই নিজের জন্য বাঁচবে।

ভার্সিটির ক্যান্টিনে রীতিমতো হইচই চলছে। ক্যান্টিনে অল্প কিছু ছাত্রছাত্রী, শোরগোল ছিল খুব একটা। ইচ্ছে ক্যান্টিনের টেবিলের পাশে মেঝেতে বসে কি যেনো করছে। তার হাতে একটি দামি খাবারের প্লেট, যা সাধারণত ক্যান্টিনের মেন্যুতে কমই দেখা যায়। মেয়েটি আজ ক্যান্টিনের সবচেয়ে দামী খাবার কিনেছে।

তিনজন মেয়ে, তুলি, জাকিয়া, আর শারমিন, যারা প্রায়ই গরীব ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে, তাদের আজ ইচ্ছে নামের নাজুক মেয়েটার উপর নজর পড়েছে। তুলি অট্টহাসি দিয়ে বলল, “দেখ, দেখ, এই ইচ্ছে আজ কেমন দামি খাবার খাচ্ছে! এ এতো টাকা পেলো কোথায়? নিশ্চয়ই কোথাও হাত সাফাই করেছে!”

জাকিয়া চিৎকার করে বলল, “তুই কি মনে করছিস আমাদের থেকে টাকা চুরি করে খাবার কিনবি আমরা টের পাবো না। যার বিশ টাকার সিঙারা খাওয়ার মুরোদ হয় না সে কি না খাচ্ছে চারশো টাকার ফুল একটা প্ল্যাটার? এই তুলি, শারমিন দেখ তো তোদের টাকা পয়সা সব ঠিক আছে কি না।”

শারমিন, তুলি ব্যাগ চেক করে দেখলো কিছু চু’রি যাইনি৷ কিন্তু তাঁরা মিথ্যা বললো, “আরে আমার ব্যাগ থেকে দুশো টাকা গায়েব। এখন বুঝলাম কে করেছে কাজটা।”

“আমার ব্যাগেও তো নেই টাকা। মিসিং লাগছে!”

এই কথাগুলো শুনে ইচ্ছের চোখে জল চলে আসে। তার মুখ বয়ে যায় কষ্টের রেখা। সে নিজেকে অস্বস্তিতে এবং লজ্জায় অনুভব করছে। খাবার হাতে ধরে চুপচাপ কাঁদতে থাকে, তার কষ্টের ভার অনুভব করা যায়।

ক্যান্টিনে প্রচুর ভিড় জমে গেছে। ইচ্ছের ফিঁচফিঁচানি কাঁন্নার আওয়াজ ছড়িয়ে পড়েছে। জুহাইর ক্যান্টিনে আসছিল। তার পোশাক দেখেই সবাই বলেই দেয় যে, সেও গরীব। তবে সে চুপচাপ, সাধারণ, মনে তার রয়েছে গভীর দয়া। ভিড় ঠেলে প্রবেশ করলো ক্যান্টিনে। মেয়েলি কাঁন্না শুনে তার চোখ ক্যান্টিনের একদিকে ঘুরে। দেখলো তিন চারটে মেয়েতে একটা মেয়েকে কেমন হেনস্তা করছে। হঠাৎই কেমন সুক্ষ্ম রাগ ধরা দেয় শরীর জুড়ে। লম্বা কদম ফেলে এগোই সে। গমগমে আওয়াজে প্রশ্ন ছুড়ে,“কি হচ্ছে এখানে?”

জুহাইর হালকা অগ্রসর হয় ইচ্ছের দিকে। মেয়েটি পর্দা করা। দেখা যাচ্ছে শুধু অশ্রু ভেজা ধূসর দুটো চোখ৷ তার চোখে কষ্টের ছাপ দেখে তার হৃদয় ব্যথিত হয়ে উঠল। সে ধীরপায়ে ইচ্ছের পাশে গিয়ে দাঁড়াল, তারপর বলল, “তোমার কি কোনো সাহায্য লাগবে?”

ইচ্ছে গম্ভীর কন্ঠে শুনে মাথা নিচু করে বলল, “না, ধন্যবাদ। আমি নিজেই সামলাবো।”

জুহাইর তার দুঃখের চিহ্ন লক্ষ্য করে,“আপনি বলুন প্লিজ? যদি আমি আপনার কোনো সাহায্য করতে পারি।”

ইচ্ছে কালো হাত মুজা পড়া হাতে চোখ মুছে বলল, “আমি শুধু ভালো খাবার কিনেছি আজকে কিন্তু আমাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করছে, বলছে চুরি করা টাকায় খাবার কিনেছি। আর নোংরা আর সুঁচালো অপমানজনক কথা বলছে ওরা। আমি গরীব বলে কি ভালো খাবার খাওয়ার অধিকার নেই আমার?”

জুহাইরের চোখে গভীর মায়া এবং দুঃখের আভা দেখা গেল।

“এই ছোটো বিষয় নিয়ে এতো লজ্জার কিছু নেই। কিছু কিছু মানুষের কাজ ই এটা, অন্যের বিষয়ে নাক গলানো৷ এদের নাকটা একটু বেশিই লম্বা কিনা।”

জুহাইরের কথা শুনে তুলি, জাকিয়া, আর শারমিন সহ সবার চোখ ছানাবড়া। কারণ সাধারণত জুহাইর এসবে জড়ায় না বা কারোর কথার প্রতুত্তর করে না। কিন্তু জুহাইরের হাবভাব অন্য রকম আজ। দেখেই ভয় লাগছে বলে তিনজনেই সটকে পড়ে। চোখের ইশারায় বোঝায় তোকে দেখে নেবো।

ইচ্ছে খাবারের থালা নিয়ে চলে আসে ভার্সিটির পেছনের পুকুরের দিকে। ও নিজেই নিজের মতো করে একটা জায়গা নিজের জন্য বানিয়েছে। মন খারাপে সে ইচ্ছে হলেই চলে আসে। জুহাইরের একটা কৌতুহল হয়। ইচ্ছের পিছু নেয়।

#চলবে