#তৃষ্ণা_তব_নাহি_মেটে
#পর্ব৫
#রাউফুন
জুহাইর দৌড়ে তৃতীয় তলার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। হলের সামনে দায়িত্বরত গার্ড দাঁড়িয়ে আছে। সে এখন যাবে কিভাবে? ও ভেতর থেকে ছটফট করছে। ওর কেন যেনো মনে ইচ্ছে ঠিক নেই। হঠাৎই ওমন স্বপ্ন কেন দেখলো সে? তারপর সেদিন যখন শুনেছিলো যে হলের মেয়েগুলো খুব একটা সুবিধার না। জুহাইর নিজেও জানে মেয়েগুলো উত্ত্যক্ত করতে উস্তাদ। সব নরম আর গরীব মেয়েদের সঙ্গেই ওরা এরূপ আচরণ করে। রীতিমতো মতো অতিষ্ঠ করে তুলে সবার জীবন। গার্ড কি তার উপস্থিতি টের পায়নি? কখন থেকে ও পায়চারি করছে। একটু পর ও খেয়াল করলো নাক ডাকার শব্দ আসছে। কিন্তু শব্দের উৎস খুঁজে পেতে একটু বেগ হলো। দেখলো গার্ড বসে বসে চোখ খোলা রেখেই ঘুমাচ্ছে। এমন ভাবে ঘুমাচ্ছে বোঝার উপর নেই লোকটা জেগে আছে না ঘুমিয়ে। জুহাইর নিশ্চিত করতে হাত নাড়লো লোকটার সামনে। নিশ্চিত হতেই ও এক ফাঁকে ঢুকে পড়লো লেডিস হলে৷ ধরা পড়লেই সর্বনাশ। জুহাইর পা টিপে টিপে দোতালায় উঠে এলো। একশো বারো নম্বর রুমে থাকে ইচ্ছে। রুমের সামনে এসে বুঝলো ও কত বড়ো বোকামো করেছে তারাহুরো করতে গিয়ে। ও এখন কিভাবে ডাকবে ইচ্ছেকে? যদি পুরুষ কন্ঠ শুনে সবাই জেগে যায়। গণধোলাই তো খাবেই সাথে ইচ্ছেরও বদনাম হবে। মেয়েটার তো একটা সেল ফোন ও নেই যে কল করে বলবে সে যেনো বের হয়।
মুখ আমসির মতো করে সে নিচে নেমে এলো। হেলেদুলে নামতে নামতে ওর মাথায় একটা কথা খেলে গেলো। ছুটে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে এলো। ভার্সিটির বিল্ডিংয়ের পেছনের দিকে এলো ফোনের টর্চ ফেলে ফেলে। বড়ো বড়ো গাছ বিল্ডিংয়ের গা বেয়ে উঠে গেছে উপরে। হিসেব করে বের করলো কোনটা তে ইচ্ছে থাকতে পারে। সে অনুযায়ী একটা বড়ো গাছ বেয়ে উঠে গেলো। মনে মনে দোয়া করতে লাগলো যেন ঠিক ঠাক রুমে পৌঁছে যায় ও। বউয়ের চিন্তায় বেচারা এমনই মরিয়া যে রাত তিনটাই সে এমন পাগলামো করছে। ভাবা যায়? অথচ দুদিন আগেও অন্য একটা মেয়ের জন্য সে কতটা পাগলামো করেছে, কষ্ট পেয়েছে তার দেওয়া ধোকায়। এখন সেসবই কেমন যেনো ছাগলামী লাগে ওর কাছে। মনে হয় কত বড়ো পাপ করছিলো ও। মরীচিকার পেছনে ছুটে গেছে। অধিক সময় ব্যয় করেছে হারামে। দ্বিতীয় তলার বারান্দায় নেমে জুহাইর হাপাতে লাগলো। গাছে উঠা এতো কষ্টের কেন? ছোটো বেলায় কত গাছে উঠেছে, কই এতো কষ্ট হয়নি তো। অনেক দিন পর গাছ বেয়ে উঠায় হইতো এমন হচ্ছে। বারান্দায় উঠেও হতাশ হলো বেচারা। বারান্দার দরজা আঁটকে রাখা। থাই গ্লাস লাগানো বারান্দা পর্দা টেনে দেওয়া ভেতর থেকে৷ আরও অস্থির হলো জুহাইর। কতই না কসরত করতে হলো ওকে৷ একবার ভাবলো দরজায় টোকা দেবে। বারান্দায় পায়চারি করতে করতে একটা সরু কন্ঠঃস্বর ভেসে এলো।
“ক-কে?”
জুহাইরের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। স্বরটা ওর চেনা। রাত তিনটার বেশি বাজে এখন। ইচ্ছে কি ওর পায়চারির শব্দে ঘুম থেকে উঠে গেলো? কিয়ৎক্ষন পরেই ওর মনে হলো দরজা খোলা হচ্ছে। ও একটু আড়াল হলো। হুট করেই দেখে ইচ্ছে চেচাতে পারে। তখন হিতে বিপরীত হবে। ইচ্ছে দরজা খুলে এদিক সেদিক দেখলো। তাহাজ্জুদের দু রাকাত নামাজ আদায় করতেই ওর অনুভব হয় বারান্দায় কারোর পায়ের আওয়াজ হচ্ছে। ইচ্ছে ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে ডান দিকে তাকাতেই একটা অবয়ব দেখলো। চিৎকার করতে যাবে তক্ষুনি কেউ ওর মুখ চেপে ধরলো। জুহাইর সেভাবেই ওর মুখ চেপে ধরে ফিসফিস করে বললো,“আমি, ইচ্ছে আমি।”
উম উম শব্দ করছে ইচ্ছে। জুহাইর বললো,“চেচাবে না। আমি তোমার বর।”
চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেলো ইচ্ছের। জুহাইর এখানে কেন? সর্বনাশ হয়ে যাবে কেউ দেখে ফেললে। ইচ্ছেও একদম ফিসফিস করে বললো,“আপনি এখানে কেন?”
জুহাইর কি বলবে ভেবে পেলো না। মাথা চুলকে অপ্রস্তুত হয়ে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। কথা ঘুরিয়ে বললো,”আমার জন্য তোমার ঘুমের ব্যাঘাত হলো৷ এতো অল্প শব্দে তোমার ঘুম ভাঙবে জানলে আসতাম না।”
“আমি রোজ ই তিনটাই উঠি। ঘুম আগেই ভেঙেছে। আপনি এখানে কেন এটা বলুন।”
জুহাইর এবারে অকপটে স্বীকার করে বললো,“বউ দেখতে এসেছি। নিজের বউ দেখতেও যে এতো কসরত করতে হবে ভাবিনি। উফফ!”
ইচ্ছের মনে হলো মাটি ফাঁক হয়ে যাক আর ও সেখানে ঢুকে পড়ুক। কান দিয়ে ধোয়া বের হচ্ছে যেনো লজ্জায়। শুষ্ক ওষ্ঠ ভিজিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো সে। নিমজ্জিত গলায় বললো,“এখন যান আপনি। কেউ দেখলে কেলাংকারি হয়ে যাবে। সকালে পুকুর ঘাটে দেখা হবে।”
“এতো কষ্ট করে বউ দেখতে এলাম। না দেখেই চলে যাবো?”
অন্ধকারের দরুণ ইচ্ছের অবয়ব ই কেবল বোঝা যাচ্ছে। মুখ স্পষ্ট নয়। ইচ্ছে বললো,“মূল্যবান কিছু দেখতে হলে তো ধৈর্য্য ধরতেই হবে? কষ্ট যা করেছেন তা স্বার্থক হয়েছে আপাতত। এই যে আমি স্বয়ং আপনার সঙ্গে কথা বলছি এটাই কি যথেষ্ট নয়?”
হঠাৎই ইচ্ছের গলায় এমন দুষ্টুমি শুনে জুহাইরের অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করলো। হুট করেই সে ইচ্ছের একদম সন্নিকটে চলে এলো। ইচ্ছে পিছিয়ে যাওয়ার ফুরসত টুকুও পেলো না। রেলিঙের সঙ্গে চিপকে দাঁড়িয়ে রইলো। ওর দুই পাশে জুহাইর দিয়ে বন্দি করে রেখেছে ওকে। জুহাইর ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কেবল দুটো শব্দ বললো,“যথেষ্ট বউ!”
ইচ্ছেকে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় রেখে জুহাইর যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই নেমে এলো। ইচ্ছে তখনও খেই হারিয়ে রেলিঙের সঙ্গে ঘেঁষে আছে। জুহাইর যখন নামলো তখন মৃদু আওয়াজ হলো। তাতেই সম্বিত ফিরলো ইচ্ছের। ওর মনে হচ্ছিলো এতক্ষণ ও একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো না হলে এটা স্বপ্ন ছিলো। এখুনি বুঝি ঘুম ভেঙে যাবে ওর। নিচে তাকাতেই অন্ধকারে সেই অবয়ব টি ওকে হাত নাড়লো। সেও হাত নেড়ে চলে যেতো বললো। তখনই ভেতর থেকে জাকিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে এগিয়ে এলো। চোখ কচলে ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো,“এই ইচ্ছে, তুই এতো রাতে বারান্দায় কেন? মনে হলো কি একটা শব্দ হলো।”
চমকে উঠে ইচ্ছে। ভয়ে সিটিয়ে যায় আবারও। এই রে শুনে ফেললো নাকি? কোনো রকমে বললো,“আমি তো রোজই বারান্দায় আসি আপু!”
“তোর জন্য আমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলো। রাত জাগলে যদি আমার চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ে তোকে দেখে নেবো।”
বলেই আবার যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই চলে গেলো জাকিয়া। ইচ্ছে স্বস্তির শ্বাস ফেললো। যাক বুঝতে পারেনি তাহলে। ইচ্ছে একবার নিচে উঁকিঝুকি দিয়ে দেখলো। নাহ কোনো অবয়ব দেখা যাচ্ছে না। যাক চলে গেছে তাহলে। ও ফোঁস করে দম ছাড়লো। মনে হচ্ছিলো এখনি দমটা বন্ধ হয়ে যাবে। হৃদ যন্ত্র টা কেমন তড়পাচ্ছে অজানা অনূভুতিতে। এ কেমন অসহনীয় অনূভুতি?
ভেতরে এসে আবারও তাহাজ্জুদ নামাজে দাঁড়ালো। নামাজ শুরু করেই কোর-আন নিয়ে বসলো। হালকা আলোর একটা মোমবাতি জ্বলছে। সেই আলোয় অল্পই আলোকিত হয়েছে। তবুও সে পড়লো। লাইট জ্বালালে ওঁদের ঘুমের অসুবিধা হবে। আর ঘুম ভাঙলেই আরেকদফা ঝগড়া হবে। ইচ্ছের আর ভালো লাগে না সেসব। টেবিল ল্যাম্প জ্বালালেও এদের নাকি সমস্যা। তাই ইচ্ছে বিকল্প হিসেবে মোমবাতি জ্বালিয়ে পড়ে। ফজরের নামাজ পড়ে হাশরের তিন আয়াত পড়লো সে। এরপর জিকির করলো ইচ্ছে। জিকির শেষে পাঠ্যবই খুলে বসলো। এটা ওর রোজকার রুটিন।এখনো কেমন ঢিপঢিপ করছে বুকের ভেতরটা। মানুষ টা এমন পাগলামী করছিলো? একটা সুক্ষ্ম টান অনুভব করে ইচ্ছে। হুট করেই দমকা হাওয়ার ন্যায় লোকটার আগমন তার জীবনে। সেদিনের একটা ভুল তার জীবনে ফুল হয়ে এসে ধরা দিলো। এখনো সেই ভুলটার জন্য অনুতাপে দগ্ধ হয়। এমন ভুল আর সে ইহ জীবনে করবে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা তাকে ক্ষমা করুন। আল্লাহ তো ক্ষমাশীল।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
“আল্লাহ তাআলা বলেছেন, হে আদম সন্তান! তুমি যদি আমাকে ডাকা ও আমার কাছে ক্ষমা চাওয়া অব্যাহত রাখো, তবে আমি তোমার পাপ ক্ষমা করব, যত বড়ই তা হোক। হে আদম সন্তান! যদি তোমার পাপ আকাশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়, আর তুমি আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো, তবে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব। হে আদম সন্তান! যদি তুমি পৃথিবী ভরতি পাপ নিয়ে আমার কাছে আসো, তবে যদি আমার সাথে কাউকে অংশীদার না করো, তাহলে আমি পৃথিবী ভরতি ক্ষমা নিয়ে তোমার কাছে আসব।”
(তিরমিজি, হাদিস: ৩৫৪০, মুসনাদে আহমদ)
এই বিশ্বাস নিয়েই ইচ্ছে প্রতি নিয়ত আল্লাহর দরবারে কেঁদে কেঁদে ক্ষমা প্রার্থণা করে। ওর বিশ্বাস আল্লাহ ওকে ক্ষমা করবেন। বান্দা আল্লাহকে যেমন ভাবে ভাববে আল্লাহও তার বান্দার নিকট সেভাবেই ধরা দেবেন।
যথারীতি ইচ্ছে সকাল নয়টাই গিয়ে পুকুর পাড়ে চলে গেলো। গিয়ে দেখলো আগে থেকেই জুহাইর ওখানে উপস্থিত আছে। ইচ্ছে চমকালো। লোকটা এখানে কখন এসেছে?
মৃদু গলা খাকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতির জানান দিলো ইচ্ছে। জুহাইর তড়াক করে উঠে একদম সামনে এলো ওর। সরাসরি বললো,“আমি আর পারছি না বউ৷ প্লিজ তোমার মুখ খানা দেখিয়ে আমাকে ধন্য করো।”
ইচ্ছে অদ্ভুত ভাবে হাসলো। বললো,“কখন এসেছেন আপনি?”
“ফজরের নামাজ পড়েই।”
“এতোক্ষণ থেকে বসে আছেন? কত মশা এখানে দেখেছেন? ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া হলে কি হবে?”
“আমার অসুখের কাছে ওসব ম্যালেরিয়া ফ্যালেরিয়া তুচ্ছ।”
“আপনার কি খুব বড়ো অসুখ? কই বলেন নি তো!”
“অসুখের উৎপত্তি হয়েছে সবে তিন দিন আগে। জানাবো কখন?”
“সেকি? ডক্টর এর কাছে গেছিলেন?”
“গেছিলাম, কিন্তু ডক্টর বড়ো নিষ্ঠুর। ওষুধ না দিয়েই বিদেয় করেছে!”
ইচ্ছে চোখ সরু করে তাকালো। জুহাইরের কথা বোধগম্য হতেই হিচকি উঠে গেলো ওর। জুহাইর পানির বোতল বের করে এগিয়ে দিলো ওর দিকে। ইচ্ছে এক মূহুর্তে সবকিছু ভুলে, কোনো কিছু না ভেবে মুখ থেকে হিজাবের পাট্টা সরিয়ে পানি পান করলো। আর জুহাইর তখনই থমকে গেলো। বিড়বিড় করে বললো,“কিছু কিছু অপেক্ষারা সত্যিই সুন্দর, হৃদয় থমকে যায় কেবল।”
#চলবে