তৃষ্ণা তব নাহি মেটে পর্ব-০৬

0
20

#তৃষ্ণা_তব_নাহি_মেটে
#পর্ব৬
#রাউফুন
রান্নাঘরে গ্লাস ভাঙার আওয়াজ শুনে শিশির দ্রুত সেখানে ঢুকলো। শিপা কপালে ভাঁজ ফেলে দাঁড়িয়ে, হাতের চুড়িদারের দোপাট্টা দিয়ে গ্লাসের ভাঙা টুকরো পরিষ্কার করছে।

“তুমি কি একটু সাবধানে কাজ করতে পারো না? রান্নাঘরে আসলেই একটা না একটা জিনিস ভেঙে ফেলছো। এসব যে ভেঙে ফেলছো এগুলো আবার কিনতে টাকা লাগবে না? মাস শেষ হওয়ার আগে আমি আমার বাবার কাছে একটা টাকাও চাইতে পারবো না বুঝেছো? একটা কাজ যদি ঠিক করে করতে পারো। গড, কি অবস্থা রান্না ঘরের।” শিশির বিরক্ত হয়ে বললো।

“তুমি কিনবে আবার কোনো সমস্যা? রান্নাঘরে একটা কাজে আসো না, আমার কি এতোই আজাইরা সময় আছে যে তোমার জন্য দিনভর পরিশ্রম করব?” শিপা কটাক্ষ করলো।

“বিয়ের পর থেকে তো এই নিয়ে কতবার বললাম, রান্না শিখে নাও। এভাবে না পারলে ইউটিউব দেখে শিখো। তুমি তো একেবারে লবডঙ্কা, রান্নার র ও জানো না৷ । একটা কাজও ঠিকঠাক করেছো এই পর্যন্ত? পারো তো শুধু গিলতে।” শিশির রাগে ফেটে পড়লো।

“রান্না করে তোমার জন্য আমার সৌন্দর্য নষ্ট করতে যাবো? লাগলে একটা চাকরিতে ঢুকে পড়ো।,নিজে উপার্জন করে সংসার চালাও। ওসব তো আমি দেখতে যাবো না। না হলে নিজের ফ্যামিলিকে আমাদের বিয়ের কথা বলে দাও! দুদিন সময় দিলাম, হই তুমি ফ্যামিলিকে জানাবে বিয়ের ব্যাপার না হলে আমি সরাসরি তবে মার বাড়িতে গিয়ে উঠবো।” শিপা গর্জে উঠলো।

শিশির ঘাবড়ে গেলো। বাড়িতে জানাজানি হলে ওর বাবা ওকে এক কানা কড়িও দেবে না। বাড়িতে উঠানো তো পরের ব্যাপার। ও চুপ হয়ে গেলো। তবে চুপ থাকা মানেই অপরাধ স্বীকার করা নয়। সে ধীর স্বরে বললো, “শিপা, পরিস্থিতি বোঝো। এই মূহুর্তে তাদের জানালে তারা কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবে, সেটা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। আমি সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করছি, সময় হোক জানিয়ে দেবো। আগ বাড়িয়ে কিছু করার চেষ্টাও করবে না।”

“সঠিক সময়? কতদিন? সপ্তাহ পেরিয়ে গেলো আমাদের লুকিয়ে থাকতে। এভাবে কতদিন লুকাবে? নাকি সত্যি বলার মতো সৎ সাহস নেই? তা-ই যদি হয়, তাহলে আমাকে বিয়ে করতে গিয়েছিলে কেন?” শিপার কণ্ঠে হতাশার ছাপ স্পষ্ট।

শিশির মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ নিজের রাগকে কন্ট্রোল করলো। তারপর বললো, “তুমি বুঝবে না। আমি এমন একটা অবস্থায় আছি, যেখানে আমাকে দু’দিক সামলাতে হচ্ছে।”

“দু’দিক? মানে?” শিপার চোখে সন্দেহের ঝিলিক।

শিশির কোনো উত্তর দিলো না। তার চুপ থাকাটাই যেনো শিপার সন্দেহ বাড়িয়ে দিলো।

“তোমার এই চুপ থাকাটা কী বোঝাচ্ছে, শিশির? তুমি কি সত্যিই আমাকে নিয়ে সিরিয়াস? নাকি তুমি এখনো অন্য কারও সঙ্গে কিছু চালিয়ে যাচ্ছ?” শিপার গলা কাঁপলো।

“এভাবে কথা বলো না, শিপা। আমি যা করছি, সব তোমার ভালোর জন্য,” শিশির সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলো।

“তাহলে সত্যি বলো। তুমি কি অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছ? এটা আমার জানার অধিকার আছে।” শিপা দৃঢ় কণ্ঠে বললো।

শিশির এবার রেগে গিয়ে বললো, “তোমার এসব পাগলামো আমি আর সহ্য করতে পারছি না। যদি এত সন্দেহ করো, তাহলে এই সম্পর্ক রাখার কোনো মানে নেই।”

“ওহ! সত্যি কথা বললে সম্পর্ক রাখার মানে নেই, তাই না? তুমি কী ভেবেছো, আমি কিছু বুঝি না? তোমার দ্বিচারিতার মানে বুঝতে আমার সময় লাগবে না, শিশির। আমি তোমাকে ছাড়বো না, এটা মনে রেখো।” শিপা কঠিন স্বরে বললো।

ঘরজুড়ে নীরবতা। দু’জনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। সম্পর্কের এই চাপা উত্তেজনা যেনো তাদের ফাটলটাকে আরও বড় করে তুললো। শিপা আফসোস করতে লাগলো মনে মনে। ভেবেছিলো বড়লোক বাপের ছেলেকে নিজের রূপের জ্বালে ফুসলিয়ে বিয়ে করে বড়ো বাড়িতে গিয়ে উঠবে। তারপর শিশির একা, ওর আর কোনো ভাই বোন নেই। শিশিরই এক মাত্র সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে। কিন্তু শিশির ওর কোনো কথায় শুনছে না। উলটো টাকা পয়সা দেওয়ার সময় কৃপণতা করে। অথচ জুহাইর অল্প আয় করলেও সব সময় ওর সব আবদার পূরণ করতো। জুহাইরের কথা মনে পড়তেই আড়ালে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। শিশিরকে বিয়ে করা কি তবে তার ভুল হলো?

জুহাইর আর ইচ্ছে সকাল থেকেই উচ্ছ্বসিত। কদিন টানা বাসা খুঁজেও কোনো ভালো বাসা পায়নি তারা। বাসা পছন্দ হলেও ভাড়া অনেক বেশি হয়ে যায়, আবার ভাড়া ঠিক থাকলেও সেই বাড়ি পছন্দ করতে পারে না৷ অবশেষে আজ তাদের নতুন বাসা দেখতে যাওয়ার দিন। ইচ্ছে পুকুর পাড়ে অস্থিরভাবে জুহাইরের জন্য অপেক্ষা করছিল। জুহাইর এসে ইচ্ছের কাছে এসে বললো, “ স্যরি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করালাম বউ। সব ঠিকঠাক আছে তো? চল, দেরি করব না।”

ইচ্ছে মুখ ফুলিয়ে বললো,“পা ব্যাথা হয়ে গেছে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে।”

“স্যরি বউ! এই যে কান ধরছি!”

ইচ্ছে হাসলো। তাকালো জুহাইরের দিকে। এই মানুষ টা তার জন্য হালাল। নিঃসংকোচে তাকাতে পারবে ও। কিন্তু ও লজ্জায় ভালো ভাবে স্বামীর দিকে এখনো তাকাতে পারে না৷ জুহাইর লক্ষ্য করলো ইচ্ছের চাহনী। ওর চোখে চোখ রাখতেই ইচ্ছে চোখ নামিয়ে নিলো। হেসে উঠলো জুহাইর। বললো,“তোমারই তো বর। অনেক দেখতে পারবে। এখন চলো।”

লজ্জায় আড়ষ্ট হলো নাজুক মেয়েটা। ইশ, লোকটা এমন সুন্দর কেন? রিকশায় চেপে দুজন রওনা হলো। ইচ্ছে নিকাবের আড়াল থেকে জুহাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার চোখে ভালোবাসার উজ্জ্বল আলো। জুহাইরও সুযোগ পেলেই ইচ্ছের দিকে চুপি চুপি তাকাচ্ছে। ইচ্ছে বেশ লজ্জা পাচ্ছে, তবু তার মুখে একচিলতে হাসি।

ওরা যে বাসাটা দেখতে এল, সেটি শহরের প্রাণকেন্দ্রে নয়, একটু ভেতরের দিকে। ছোট্ট সুন্দর একতলা বাড়ি। চারপাশে ফুলের গাছ, উঠানে একটি বড় মেহগনি গাছ। বাড়ির রঙ হালকা ধূসর, বারান্দায় সাদা রঙের গ্রিল। তিনটি ঘর, একটি রান্নাঘর এবং একটি সুন্দর বারান্দা। ইচ্ছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলল, “শুনুন, এখান থেকে সন্ধ্যেবেলা চা খাওয়ার সময় কী সুন্দর লাগবে, না?”

জুহাইর হেসে বলল, “তুমি পছন্দ করলেই আমি বাসা ভাড়া নিয়ে নেব। এই বাসাটা বাকি গুলোর থেকে কিন্তু বেশ ভালো। নিয়ে নিচ্ছি, সে যাই হোক না কেন ভাড়া।”

“বাজেটের বাইরে ভাড়া হলে নেবো না।”

“ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না তোমাকে। বাসা এটাই নিচ্ছি।”

“কিন্তু!…”

”কোনো কিন্তু না। এই বাসা আমারও পছন্দ হয়েছে, ব্যস।”

ইচ্ছে বাড়ি দেখে খুশি। ওদের ছোট সংসারের জন্য বাসাটা একদম উপযুক্ত। ওরা মালিকের সঙ্গে কথাবার্তা সেরে বেরিয়ে এল।

ইচ্ছে আর জুহাইর সংসারের বেসিক জিনিসপত্র কিনতে গেল। কয়েকটা নতুন থালা-বাসন, গ্যাসের স্টোভ, কিচেন সেট, আর ইচ্ছের পছন্দমতো সাদা পর্দা কিনল। জুহাইর বেশ খুশি মনে ইচ্ছের পছন্দ অনুযায়ী সব কিনে দিল।

এরপর জুহাইর ইচ্ছেকে নিয়ে গেল বোরখা কেনার দোকানে। দুটি বোরখা কিনল – একটি কালো আরেকটি হালকা নীল। এরপর সালোয়ার কামিজও কেনা হলো। হঠাৎই বেরিয়ে আসার সময় খেয়াল করলো শিপা শিশির একে অপরের সঙ্গে তর্ক করছে। জুহাইর বেরিয়েই আসতে নিচ্ছিলো, কিন্তু ওদের নজরে পড়ে গেলো।

জুহাইর আর ইচ্ছে মার্কেট থেকে বের হওয়ার সময় পেলো না। এগিয়ে এলো শিপা আর শিশির। শিশির অবাক হয়ে জুহাইরকে বলল, “তুই এখানে কী করছিস?”

জুহাইর শান্তভাবে বলল,“আমার বউয়ের জন্য জিনিসপত্র কিনতে এসেছি।”

শিপা অবাক হয়ে বলল, “বউ? তোমার বউ আবার কে?”

জুহাইর যেনো শিপাকে দেখেও দেখলো না৷ একবার ফিরেও তাকালো না সে শিপার দিকে। বিন্দুমাত্র সংকোচ না করে ইচ্ছের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, “ইনি আমার স্ত্রী।”

“বাপরে, তোর মতো ভিখিরিকে কে বিয়ে করলো? নির্ঘাত কোনো রাস্তার মেয়েকেই বিয়ে করেছিস?”

“মুখ সামলে কথা বল, শিশির। আমার বউকে নিয়ে কোনো অপমানসূচক বাক্য প্রয়োগ করিস না৷ ফল ভালো হবে না। এখন যেমন শান্তশিষ্ট জুহাইরকে দেখছিস, তার থেকেও ভয়া’নক হয়ে উঠতে পারি আমি। সাবধান।”

“আরেএএ রাখ তোর ফাঁকা বুলি। তা, এখানে ভুল করে এসে পড়ে বিপদে পড়েছিস নাকি? টাকা পয়সা আছে নাকি লাগবে? এতো বড়ো শপিংমল দেখেছিস কখনো? দাম জানিস এখানকার জিনিসের?”

শিপা হতভম্ব হয়ে ইচ্ছে আর জুহাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। ইচ্ছের চোখ দুটোই কেবল দেখা যাচ্ছে। হতচকিত শিপার মুখ থেকে কোনো কথা বের হলো না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শিপা বলল, “তো বিয়ে কবে হলো তোমাদের? আমাদের কাউকে জানালে তো?”

জুহাইর মৃদু হেসে বলল, “এগুলো ব্যক্তিগত বিষয়, শিশির। তোর বউকে বল, আমি ওর জন্য পরপুরুষ ওভাবে গায়ে পড়ে যেনো কথা বলতে না আসে। আমি আমার বউ ব্যতীত কারোর কথা শুনতে বা বলতে ইন্ট্রেস্টেড না। আমাদের বিয়েতে মানুষের নজর লাগতে পারে তাই কাউকে জানানো জরুরি মনে করিনি, আর কোনো প্রশ্ন?”

শিপা ও শিশিরের মুখ রাগে লাল হয়ে গেলো। ইচ্ছে পুরো টা সময় চুপ ছিলো কারণ সামনে পরপুরুষ। পরপুরুষের সঙ্গে কথা তো দূরে থাক ছায়াও মা’রানো নিষেধ। ইচ্ছে জুহাইরের পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে। জুহাইর ইচ্ছেকে নিয়ে মার্কেট থেকে বেরিয়ে এল, আর শিপা আর শিশির পেছনে দাঁড়িয়ে রইল হতবাক হয়ে।

“আমি কখনোই তোমাকে সুখী হতে দেবো না জুহাইর।”

“কি করবে তুমি? ভুলে যেও না তুমি এখন আমার বউ। তাই অন্য পুরুষের দিকে নির্লজ্জের মতো ঝুঁকে যেও না৷ নাকি জুহাইর বিয়ে করেছে দেখে এখন তোমার জ্বালা ধরেছে? এইজন্য মেয়ে মানুষকে আমার পছন্দ না, যত্তসব।”

#চলবে