তৃষ্ণা তব নাহি মেটে পর্ব-০৯

0
22

#তৃষ্ণা_তব_নাহি_মেটে
#পর্ব৯
#রাউফুন
জুহাইর যখন দোতালা থেকে নামছিলো তখন খেয়াল করলো ইচ্ছেকে। সে ছুটে এলো ওর কাছে। শ্বাস ফেলে শুধালো,“কোথায় ছিলে?”

ইচ্ছে চুপ করে অস্থির মানুষটার দিকে তাকায়। জুহাইরের দিকে এখনো ভালো ভাবে তাকাতে পারে না মেয়েটা। এক পল তাকিয়ে চোখ নামিয়ে বললো,“লাইব্রেরিতে গেছিলাম!”

“কখন?”

“আপনি ছিলেন সেখানে।”

“তোমাকে দেখিনি আমি।“

“আমি আপনাকে দেখেছি!”

“ডাকবে তো!”

“সুযোগ পাইনি, তার আগেই আপনি বেরিয়ে এলেন রেগে।”

জুহাইর একদম স্বাভাবিক। লুকোছাপার ব্যাপার তার মধ্যে নেই। এমনিতেও আজকের ব্যাপারে সে ইচ্ছেকে বলতো। ইচ্ছের কথায় যতটা বুঝলো সে শুনেছে সব কথায়। সে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না ইচ্ছে কিছু শুনেছে কি না তা নিয়ে৷ বরং যে প্রসঙ্গে কথা বললে ওঁদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হতে পারে বা ইচ্ছে কষ্ট পেতে পারে সেই বিষয় টা উঠালোই না৷ সাথে থাকা প্রান্তর দিকে তাকালো জুহাইর। বললো,“তুই মাহিনের কাছে যা, আমি তোর ভাবিকে বাসায় রেখেই যাচ্ছি। বেশি না আধ ঘন্টার মধ্যে চলে যাবো।”

প্রান্ত মাথা নাড়লো। ইচ্ছে অন্য কোনো পুরুষ মানুষের সঙ্গে কথা বলে না৷ তা প্রান্ত জানে, তাই সেও কিছু জিজ্ঞেস করে না। এতে ইচ্ছেও স্বস্তি বোধ করে। সৌজন্য মূলক কথাও বলে না ওরা। পরপুরুষ এর সঙ্গে খুব প্রয়োজন না হলে কথা বলাও নিষেধ৷ যদিও বলতে হবে তবে তা যেনো কর্কশ কন্ঠের জবাব হয়। ইচ্ছে সলজ্জ পায়ে হেঁটে সামনে এগোলো, জুহাইরও বিদায় নিলো প্রান্তর থেকে। প্রান্ত নিজের গন্তব্যে রওনা হলো৷

ইচ্ছেকে নিয়ে বাসায় পৌঁছে বললো,“সন্ধ্যার আগে বাসায় আসবো। তুমি খেয়ে নিও।”

ইচ্ছে মাথা নাড়লো। ইচ্ছে করছিলো জিজ্ঞেস করতে এতো দেরি কেন হবে। কিন্তু করলো না৷ জুহাইর নিজে তার মনোভাব ধরতে পেরে থেকেই বললো,

”আসলে মাহিন আমার বন্ধু, ওর একটা মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আছে৷ স্বামী স্ত্রীর মতো সম্পর্ক না হলেও বলতে পারো সেটা খুব ঘনিষ্ঠই। ওরা না বুঝেই সেসময় এগিয়েছিলো৷ এখন মাহিন নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। মেয়েটাও বুঝেছে তবে সেটা জিনা করার পর। এখন মেয়েটার বাবা মা মেয়েটাকে অন্যত্র বিয়ে দিতে চাইছে। যদি মেয়েটার অন্য কারোর সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় তবে, তিনটা জীবন নষ্ট হবে। প্রথমত সেই ছেলেটাকে ঠকানো হবে, আর মেয়েটাও মন থেকে সংসার করতে পারবে না। মাহিনও বাঁচতে পারবে না৷ তাই আমরা চাইছি মাহিনের দুজনের পরিবারকে রাজি করিয়ে ওঁদের বিয়ে দিতে। বিয়ে ঠিক হওয়াই মেয়েটা মাহিনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। কিন্তু আমরা চাচ্ছি মেয়েটার সঙ্গে আজই বিয়ে দিতে মাহিনের। দুজনের পরিবারকে সেজন্য রাজি করানোটা জরুরি।”

ইচ্ছে কিছু বললো না৷ পরিবার রাজি না থাকলে বিয়ে হবে না। কিন্তু হারাম সম্পর্ক হালাল রূপ দিতে, দু পরিবারকেই রাজি থাকতে হয় বিয়েতে। নিঃসন্দেহে জুহাইর একটা প্রশংসনীয় কাজ করতে যাচ্ছে। জুহাইর চাইলেই মেয়েটার সঙ্গে প্রথমেই মাহিনের বিয়ে করিয়ে দিতে পারতো কারণ মেয়েটা এখন জুহাইরের বন্ধুর কাছেই। কিন্তু না সে সরাসরি দু পরিবারকে রাজি করানোর উদ্যোগ নিয়েছে। জুহাইর নিজের ব্যাগটা ইচ্ছের দিকে এগিয়ে দিলো। ইচ্ছে তাকিয়ে আছে জুহাইরের পানে। জুহাইর ও তাকালো। শুধালো,

“একা থাকতে পারবে?”

“আপনি যান। আমি একা থাকতে পারবো!” ইচ্ছে মুচকি হাসলো। জুহাইর দরজা থেকেই বিদায় নিলো। ইচ্ছে বোরখা ছাড়লো। রেস্ট নেওয়ার সময় নেই, তাই সরাসরি গোসলে চলে গেলো। এরপর জোহরের সালাত আদায় করলো। নামাজ শেষে রান্না বসালো। আপাতত ভাত রেধে সঙ্গে একটা ডিম ভেজে নিজে খেলো। জুহাইরকে রেখে ওর খেতে খারাপ লাগছিলো। কিন্তু কিছু করার নেই। এরপর রাতের জন্য রান্না চাপালো। রান্নার হাত টা ওর দাদির থেকে পাওয়া। ওর মা তো ওকে রান্না শেখানোর পূর্বেই আল্লাহর কাছে চলে গেছে। ইচ্ছের মায়ের মৃ’ত্যুর কথাটা স্মরণ করতে চায় না৷ মাথা যন্ত্রণা করে কেবল।

জুহাইর গিয়েই দেখলো মাহিনের গার্লফ্রেন্ড পৃথা কাঁদছে। মাহিন ওকে মানানোর চেষ্টা করছে। মাহিনের গার্লফ্রেন্ডও পর্দাশীল। মেয়েটা হাফেজা হয়েও এমন ভুল পথে পা বাড়ালো কিভাবে সেটাই বুঝতে পারছে না জুহাইর৷ শয়তানের ধোকায় পড়ে কত কত ভালো মানুষ ভূল পথে আগায় তার বাস্তব উদাহরণ এই হাফেজা মেয়েটা। মেয়েটার সঙ্গে মাহিনের রং নাম্বার থেকে পরিচয়। একবার মাহিনের বাবা মাহিনের নাম্বারে টাকা পাঠাতে গিয়ে পৃথার নাম্বার পাঠিয়ে দেয়। পরবর্তীতে মাহিন নাম্বার টা দেখে কল দিয়ে বলে তার বিকাশে ভুল করে টাকা চলে গেছে। মেয়েটাও বলে হ্যাঁ তার কাছে টাকা গেছে। পরবর্তীতে টাকাটা ফেরত ও দেয়। টাকার এমাউন্ট দশ হাজার ছিলো। এতো গুলো টাকা চাইলেই সে অস্বীকার করতে পারতো যে তার কাছে কোনো টাকা যায়নি। মাহিন মেয়েটার সততায় মুগ্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে সেই মেয়েটার সঙ্গে ককথা-বার্তা চালিয়ে যেতে থেকে, সেই থেকেই ভালো লাগা বাড়তে থাকে। পৃথা মেয়েটা মাঝে মধ্যেই মাহিনকে কোর-আন তেলাওয়াত করিয়ে শোনাতো। তেলাওয়াত শুনে মাহিন আরও বেশি মুগ্ধ হয়। জড়িয়ে যায় দুজন হারাম সম্পর্কে।

জুহাইর মাথা চুলকে বললো,“চল আমার সঙ্গে!”

“কোথায়?”

প্রশ্ন করে মাহিন। পৃথা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রান্ত জবাব দেয়,“তোর বাবা মাকে আমরা রাজি করাতে যাবো। একটা বিয়ের জন্য অবশ্যই পরিবারকে রাজি করানো আবশ্যক। প্রথমে তোর তারপর মেয়েটার!”

পৃথা কাঁচুমাচু করে বলে,“ না ভাইয়া, আমার আব্বু আম্মু জানলে আমাকে মে’রে ফেলবে। উনাদের জানাবেন না। আমাকে তারা অনেক বিশ্বাস করে, এসব জানলে উনারা অনেক কষ্ট পাবেন।”

জুহাইর শান্ত কন্ঠে বললো,“এসব কথা আগে ভাবা উচিত ছিলো আপনার। এখন এসব ভেবে কোনো ফায়দা হবে না। তার চাইতে ভালো হবে উনাদের রাজি করানো। রাজি করানোর দায়িত্ব আমাদের। আপনি এসব নিয়ে চিন্তা করবেন না।”

কেউ-ই কথা কোনো কথা বলল না৷ মাহিনের ফ্যামিলিতে জুহাইর নিজেই সবটা জানালো। জুহাইরের বাবা প্রথমে রাজি না হলেও জুহাইর কিভাবে যেনো রাজি করিয়ে ফেললো। মাহিনকেই এখনো তার বাবাকে চালাতে হয় সেখানে অন্য আর একটা পেট চালানো কষ্টকর হবে। জুহাইর বুঝালো ‘রিজিকের মালিক আল্লাহ, তাই কারোর রিজিক নিয়ে কোনো চিন্তা করার প্রয়োজন নেই, যে আসবে সে রিজিক নিয়েই আসবে। যদি কেউ মনে করে রিজিক টা তার আয় না হলে আসবে না তবে সেটাও এক প্রকার শিরকের অন্তর্ভুক্ত হবে। কারণ মানুষের আয়ের উৎস আল্লাহই করে দেন, বে-হিসাব রিজিকও আল্লাহই দেন। সেক্ষেত্রে কেউ যদি ভাবে সে কাউকে চালাচ্ছে তবে সেটা শিরকের অন্তর্ভুক্ত হবে৷’

বেশি কসরত করতে হয়নি মাহিনের বাবা মাকে মানাতে কিন্তু পৃথার বাবা মা কিছুতেই মানবেন না বলে দিলেন৷ ওদের সামনেই পৃথার গায়ে হাত তুললেন পৃথার মা। মাহিনের মনে হচ্ছিলো আঘাতটা পৃথাকে নয় তাকে করছে৷ মাহিনের বাবা মা ও সঙ্গে এসেছিলেন৷ উনারা থামালেন এসব৷ দু পরিবার মিলে অনেকক্ষণ শলা পরামর্শ করলেন৷ পৃথার বাবা এক কথার মানুষ। একেবারে বেকে বসেছে। কারণ তিনি অন্যত্র কথা দিয়ে ফেলেছেন, তাই কথার বরখেলাপ করতে পারবেন না। সবাই মিলে বুঝিয়েও কাজ হচ্ছে না। জুহাইরও আটঘাট বেধেই নেমেছে৷ সেও রাজি না করিয়ে নড়বে না এখান থেকে।

জুহাইর পৃথার বাবার সামনে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তার চোখে ছিলো একধরনের দৃঢ়তা এবং শব্দগুলো ছিলো ভারি অথচ হৃদয়গ্রাহী। তিনি গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,

“চাচা, আমি জানি আপনি খুবই বিরক্ত এবং অপমানিত বোধ করছেন। আপনার মেয়ে পৃথা এবং আমার বন্ধু মাহিনের এই সম্পর্কের কথা জেনে আপনার হৃদয় ভেঙে গেছে। আমি এটি অস্বীকার করি না যে তাদের এই কাজ আমাদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ ভুল এবং হারাম। কিন্তু চাচা, আমি এখানে এসেছি আপনাকে বোঝানোর জন্য, তাদের এই পাপের বোঝা কমানোর একটি পথ আছে এবং সেটি হলো তাদের সম্পর্ককে হালাল করা।

ইসলামে হারাম সম্পর্কের বিষয়ে আল্লাহর বিধান অত্যন্ত কঠিন। এটি একটি গুরুতর পাপ। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘জিনা-ব্যভিচারের নিকটেও যেও না। নিশ্চয়ই এটি অশ্লীল কাজ এবং খুবই নিকৃষ্ট পথ।’ (সূরা ইসরা, আয়াত ৩২)। কিন্তু আল্লাহ একই সঙ্গে আমাদের জন্য তওবা এবং সংশোধনের পথও খুলে রেখেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ‘আর যারা তওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে, তাদের পাপ আল্লাহ ভালো কাজ দিয়ে প্রতিস্থাপন করেন। আল্লাহ তো অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা ফুরকান, আয়াত ৭০)।

চাচা, আমরা মানুষ, ভুল করব। কিন্তু আল্লাহ আমাদের সেই ভুল সংশোধনের সুযোগ দিয়েছেন। পৃথা এবং মাহিন যদি এই মুহূর্তে তাদের সম্পর্ককে হালাল করার জন্য বিয়ে করে, তাহলে তারা তাদের পাপ থেকে মুক্তি পেতে পারে এবং তাদের জীবনকে সঠিক পথে নিয়ে যেতে পারে। এতে শুধু তাদেরই নয়, আমাদের সমাজের জন্যও একটি উদাহরণ স্থাপন হবে—যে ভুল করা স্বাভাবিক, কিন্তু ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সঠিক পথে ফিরে আসাই প্রকৃত বুদ্ধিমানের কাজ।

আপনি যদি তাদের এই বিয়ে মেনে না নেন, তাহলে হয়তো তারা আরও গভীর অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। কিন্তু আপনি যদি তাদের বিয়ে করার অনুমতি দেন, তবে তারা একটি নতুন জীবনের সূচনা করতে পারবে। মাহিন এবং পৃথা উভয়েই এখনও তরুণ। তাদের জীবনে আরও অনেক কিছু করার সুযোগ আছে। তাদের যদি ইসলামের আলোয় ফিরে আসতে সাহায্য করি, তাহলে তারা ভবিষ্যতে আরও ভালো মুসলিম হতে পারবে।

চাচা, আপনি জানেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই উত্তম যে তার পরিবারের প্রতি সদয়।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৩২৬৭)। আপনি যদি এই মুহূর্তে তাদের পাশে দাঁড়ান, তবে আপনার বড় হৃদয়ের পরিচয় পাব আমরা এবং আল্লাহও আপনার এই উদারতাকে পছন্দ করবেন।

চাচা, তাদের সম্পর্ক হালাল করে আপনি শুধু তাদের জীবনই বাঁচাবেন না, তাদের পাপকে সঠিক পথে নিয়ে যাওয়ার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ স্থাপন করবেন। আমি আপনার প্রতি বিনীত অনুরোধ করছি, এই সিদ্ধান্তটি বিবেচনা করুন। আল্লাহ আপনাকে এর উত্তম প্রতিদান দেবেন।”

জুহাইরের কথা শুনে পৃথার বাবা গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আর জুহাইরের ইসলামের দৃষ্টিতে কঠিন বিষয়টি নিয়ে ভেবে রাজি হলেন৷ বললেন এক সপ্তাহের মধ্যে অনুষ্ঠান করে বিয়ে দেবেন। এর মধ্যে তিনি যেখানে মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছিলেন সেখানে কথা ব্যাপারটা সর্টআউট করবেন। সবাই মেনে নিলো তার সিদ্ধান্তকে। কিন্তু মাহিনের ভেতরে কেমন যেনো খচখচ করছে, কেন জানেনা।

#চলবে