#তৃষ্ণা_তব_নাহি_মেটে
#পর্ব১৪
#রাউফুন
রাত তখন দশটা। জুহাইর আর ইচ্ছের বাড়ি ফেরার পথ নিঃশব্দে কাটলো। কেউ কিছু বলার প্রয়োজন মনে করলো না। তবু দুজনের ভেতরেই একটা চাপা কষ্ট, অপমান আর হতাশার ছায়া।
জুহাইর সাদা পাঞ্জাবি আর সুতির পায়জামা পরেছিল। দিনের ধকল তার পোশাকে ফুটে উঠেছে, পাঞ্জাবির হাতা ভাঁজ করা, পায়জামায় মাটির ধুলোর দাগ। বোরখা খুললো ইচ্ছে। ইচ্ছের পরনে ছিল হালকা গোলাপি রঙের সালোয়ার-কামিজ। ওড়নাটা কাঁধে ঝুলিয়ে মাথায় কাপড় দিলো। দুজনের মুখই ম্লান হয়ে আছে।
এরপর তারা হাত-মুখ ধুয়ে একসঙ্গে ডাইনিং টেবিলে বসল। কেউই খেতে চাইছিল না। খাবারের থালা সামনে থাকলেও দুজনেই চুপচাপ বসে রইলো। খাবার খাওয়ার রুচি একদমই নেই, অর্থহীন লাগছে সবকিছু। কিন্তু ইচ্ছের মনে হলো, জুহাইর না খেলে সে খাবে না, আর জুহাইর ভাবলো, ইচ্ছে যদি না খায়, তাহলে তার খাওয়া অর্থহীন। দুজনের এই বোঝাপড়ায়, কেউ কিছু না বলেও একসঙ্গে খাওয়া শুরু করলো। নিঃশব্দে খাবার খেয়ে তারা উঠে পড়লো।
এশার নামাজ আদায়ের জন্য দুজনে অজু করলো। ইচ্ছের গাল তখনও ভেজা, মনে হয় কষ্ট থেকে চোখে জল এসে পড়েছিল। দুজনেই একসঙ্গে নামাজ পড়লো। নামাজ শেষে জায়নামাজে বসে, হাত তুলে দোয়া করলো। জুহাইরের মুখে তখনও বিষণ্ণতার ছাপ, আর ইচ্ছের চোখে অশ্রুর ছায়া।
দোয়া শেষে জুহাইর গভীর একটা শ্বাস নিয়ে ইচ্ছের দিকে তাকালো। তার কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছে,, তবু সে নিজের ভেতরের সন্দেহটা ইচ্ছের সামনে তুলে ধরতে দ্বিধা করলো না। ধরা গলায় সন্তর্পণে শুধালো,
“তুমিও কি বিশ্বাস করো, টাকাটা আমি নিয়েছি?”
জুহাইরের শান্ত কিন্তু ব্যথিত কণ্ঠে প্রশ্ন শুনে, ইচ্ছে এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। তারপর ধীরে ধীরে তার চোখে জল জমলো। সে জুহাইরের কাছে এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। তার কণ্ঠ কাঁপছিল, তার প্রতিটি পদক্ষেপ, গতিবিধি এক অটুট বিশ্বাসের দৃঢ় প্রকাশ।
“আপনার তাই মনে হয়? এমন একটা অভিযোগ আমি বিশ্বাস করবো? তাছাড়া ফোনটা তো আমরা এক সঙ্গে পেয়েছিলাম। এর চাইতে বড়ো প্রমাণ কি আর আছে যে আপনি টাকা নেন নি? কিন্তু আপনি এমন বোকার মতো কাজ করলেন কেন বলুন তো? চিঠি লিখেছেন বলেই ওঁরা প্রমাণ করতে পেরেছে না হলে কখনোই এমন অপদস্ত হতেন না।
আপনি জানেন, আজ ওরা যখন আপনাকে সবার সামনে অপমান করছিল, আমার কলিজা ছিড়ে যাচ্ছিল। আমার ভেতরে যেন আগুন জ্বলছিল, কিন্তু কিছুই করতে পারছিলাম না। আমি জানি, আপনি সৎ, আপনি কখনো অন্যায় করতে পারেন না। কিন্তু ওরা আপনাকে কীভাবে এমনভাবে হেনস্তা করলো! আমি মানতে পারছি না, ওদের এই আচরণ।
আপনি যে এমনটা কেন করেছেন, তা আমি জানি, বাকিরা তো জানেনা তাইনা? আপনি যা করেছেন, তা স্যারের প্রতি আপনার ভালোবাসা থেকে করেছেন। কিন্তু এর পরিণতি এভাবে হবে, তা কি আপনি কল্পনাও করতে পেরেছিলেন?”
ইচ্ছের কণ্ঠ ভেঙে এলো। সে জুহাইরের বুকে মুখ গুঁজে রাখলো। তার চোখের জল জুহাইরের পাঞ্জাবিতে ভিজে যাচ্ছে।
জুহাইর নিশ্চুপ, ইচ্ছের কথাগুলো যেন তার হৃদয়ের গভীরে গিয়ে আঘাত করছে। ইচ্ছের বিশ্বাস, তার প্রতি ভালোবাসা, আর এই অপমানজনক ঘটনার বিরুদ্ধে তার সঙ্গ দেওয়া, সবকিছুই কেমন অদ্ভুত ভাবে জুহাইরের মনে নতুন প্রতিজ্ঞার জন্ম দিল। সে দৃঢ়তার সঙ্গে ইচ্ছের পিঠে হাত রাখলো।
“আমি সবার ভুল প্রমাণ করবো, ইচ্ছে। একদিন সবাই জানবে, আমি চোর নই। আমি সৎ ছিলাম, সৎ থাকবো আজীবনই। আর তুমি সবসময় আমার পাশে আছো, ভবিষ্যতেও যে থাকবে, এই বিশ্বাসটাই আমার সবচেয়ে বড়ো শক্তি।”
ইচ্ছে তার হাত চেপে ধরলো। তাদের চোখে তখনও জল, কিন্তু সেই জলে ছিল নতুন করে শুরু করার অঙ্গীকার। ইচ্ছেকে ওভাবেই কোলে তুলে নিলো জুহাইর। ইচ্ছে নিশ্চুপ! ওকে বুকে নিয়েই একদম বিড়াল ছানার মতো আগলে নিলো সে। জুহাইর কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বললো,“তোমার আমার কাছে কোনো দাবী, বা আবদার আছে?”
“কোনো দাবী বা আবদার নেই আমার। হঠাৎই এমন কথা কেন?”
“কিজানি মনে হলো!”
“সবকিছুই অদ্ভুত লাগছে খুব। হইতো এই সবকিছুই আল্লাহর আমাদের প্রতি করা একটা পরীক্ষা। আল্লাহর উপর সব সময় ভরসা রাখবো, যদি কোনো বিপদ মৃত্যুর দাড়গোড় অব্দি থামিয়ে দেয় আমাদের, তবুও, কেবলই আল্লাহর উপর ভরসা রাখবো।”
মৃত্যুর কথা স্মরণ হতেই একদম হুট করেই, হুট করেই একটা কথা মাথায় চলে এলো। ইচ্ছে গভীর মমতায় জুহাইরের বুকের সাথে মিশে বললো,
“জানেন, আমি সবসময় আল্লাহর কাছে দু’আ করতাম, এখন করি। আমার মৃত্যু যেনো ইমানের সঙ্গে হয়। আর আমি চাই আমার জানাযা, দাফন, সবকিছুই ইসলামী শরীয়তের নির্দেশনা অনুযায়ী হোক। আপনার কাছে একটা অনুরোধ থাকবে, যদি আমার মৃত্যুর সময় আসে, তাহলে আপনি নিজ হাতে আমাকে শেষ গোসল করাবেন। ঠিক নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্ত্রীদের ক্ষেত্রে যেভাবে করা হয়েছিল। কোনো নারীকেও যেনো আমার শরীর স্পর্শ করতে না হয়। আপনি আমার শরীরের ওপর সাদা কাফনের কাপড় এমনভাবে পরাবেন, যেনো আমার শরীরের কোনো অংশ কারো দৃষ্টিগোচর না হয়।
আরেকটা অনুরোধ, আমার লম্বা চুলগুলো দিয়ে আমার শরীর ঢেকে দেবেন। যেনো নারী হিসেবে আমার সৌন্দর্য কারো সামনে প্রকাশিত না হয়। দাফনের সময়ও এমনটি করুন। আমার কবর যেন রাতের আঁধারে খনন করা হয় এবং দাফন সম্পন্ন হয়। কেউ যেনো না জানে, কোনটা আমার কবর। আমার দাফনের পর আল্লাহর কাছে দু’আ করবেন যেনো তিনি আমাকে কবরের আযাব থেকে রক্ষা করেন এবং জান্নাতুল ফিরদাউসে একটি স্থান দান করেন।”
ইচ্ছে থামলো না, তার কণ্ঠ আরও মৃদু, আরও নরম হয়ে এলো। তার চোখের কোণায় অশ্রু ঝিলমিল করছে। সে আবার বললো,
“আপনার কাছে আরেকটা অনুরোধ, জুহাইর। আপনি আমার জানাযার ইমামতি করবেন। আমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবেন। আপনার মতো একজন নেককার স্বামী পেয়ে আমি ধন্য। আমি চাই, মৃত্যুর পরেও আমাদের সম্পর্ক এমনই দৃঢ় থাকুক।”
জুহাইর স্তব্ধ হয়ে তার কথাগুলো শুনছিল। তার হৃদয়ের গভীরে প্রতিটি শব্দ যেনো বিদ্ধ হচ্ছে। বুকের ভেতর এক অজানা শূন্যতা ছড়িয়ে পড়ছে। সে একবার তার স্ত্রীকে ভালোবাসায় আগলে ধরলো। শক্ত করে বুকের সঙ্গে চেপে ধরলো মেয়েটিকে। বিরস গলায় বললো,
“ইচ্ছে, এসব কথা আমাকে বলো না। তুমি জানো না, তুমি কি বলছো। তোমার প্রতিটি শব্দ আমার কলিজায় ছুরি মারছে। এসব ভেবেও আমি অস্থির হয়ে পড়ি। আমাকে আর এসব বলো না, প্লিজ। আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর রহমতে কাটুক। আমরা যেনো একসাথে দ্বীনের পথে চলি, একসাথে জান্নাতে প্রবেশ করি।”
ইচ্ছে নীরব হয়ে গেলো। কিন্তু তার কথাগুলো যেনো জুহাইরের হৃদয়ের গভীরে চিরস্থায়ী হয়ে রইলো, এক অমূল্য স্মৃতির মতো।
”আমি মা’রা গেলে আপনার একটা সাদা পাঞ্জাবী আমার গায়ে জড়িয়ে দেবেন, ঠিক যেমনটা নবীজির প্রাণের স্ত্রী খাদিজা( রাঃ) নবী করিম (সাঃ) বলেছিলেন তাঁর পাঞ্জাবী পড়ানোর জন্য, ঠিক সেরকম ভাবে৷ আমাকে শেষ গোসলটা কিন্তু অবশ্যই অবশ্যই আপনি করাবেন, জুহাইর। আমি কখনোই চাইবনা মৃত্যুর পরেও আমার শরীর অন্য কোনো চোখ দেখুক, সে নারী হলেও না। আমার লম্বা চুল গুলো দিয়ে আমার নারী দেহটা পেচিয়ে দেবেন কেমন? আমার কবর যেনো কেউ না দেখে, রাতের আঁধারে আমাকে দাফন করবেন৷ কেউ যেনো না জানে কোনটা আমার কবর, আপনি ব্যতীত।”
“আবার, আবার, এসব কথা বউ? পাগল হয়ে গেছো? বার বার কেউ এসব বলে? প্রথমবার বলেছো রাগ করিনি, কিন্তু দ্বিতীয়বার আবার এসব কথা সহ্য হয়? স্বামীর কাছে কখনো, মৃ’ত্যুর কথা এভাবে বলতে আছে? সেটাও যে তোমাকে ভালোবাসে তার কাছে? কেমন নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিচ্ছো বউ? কলিজাটা যে এঁফোড়
ওঁফোড় করে দিচ্ছো প্রতিটি কথায়! তোমাকে যদি আমার মৃত্যুর কথা এভাবে বলতাম, তোমার কেমন লাগতো?”
“ আমার ইচ্ছা, আমি যেন আপনার আগে মৃত্যুবরণ করি।
আমি, এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে প্রিয় মানুষদের হারানোর ব্যথা সহ্য করেছি। আরও কোনো প্রিয়জনকে হারানোর শক্তি আমার নেই। খোদার কাছে আমার একমাত্র প্রার্থনা হলো, তিনি যেন আমাকে আপনার আগে নিয়ে নেন। আমি চাই না, আমি বেঁচে থেকে আপনাকে হারানোর কষ্টে ভুগি। আমার আগে যেনো আপনার কখনোই মৃত্যু না হয়, আমার প্রানপ্রিয় স্বামী! আমি এইটুকু জীবনে আমার আপন সব মানুষদের মৃত্যু দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে উঠেছি, এরপর আর পারবো না। খোদার কাছে এ আমার আর্জি, আমাকে যেনো আপনার আগে নেন তিঁনি!”
জুহাইরের মনে হচ্ছে হৃদপিণ্ড বরাবর কেউ ছু’ড়ি বসিয়ে দিয়েছে। বুকটা কেমন ঝা ঝা করছে ব্যথায়৷ অথচ নিষ্ঠুর রমনীর থামার নাম নেই। জুহাইর হাত জোর করে বললো,“প্লিজ বউ, থামো। আমি আর এসব কথা বরদাস্ত করবো না৷”
ইচ্ছে হাসলো। জুহাইরের সঙ্গে একদম মিশে রইলো। মানুষ টার মনের উপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে আজকে। তারপর তার এসব কথা সত্যিই মানুষ টাকে ব্যথিত করছে। ইচ্ছে থামলো। বললো,“আজ অনেকটা আদর করবেন জুহাইর?”
জুহাইরের চোখ ভিজে উঠে। এতোদিন যখন ইচ্ছের সম্মতি পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছিলো আজ তা হাতের কাছে পেয়েও সে পারছে না৷ ওর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে, ইচ্ছের একটু আগে করা এসব পাগলামীর কারণে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। ইচ্ছের আকুল গলায় স্বর আবারও,“আদর করবেন না জুহাইর?”
জুহাইর ভাঙা, রোধ হয়ে আসা গলায় বললো,“করবো বউ! অনেক, অনেক, অনেকটা আদর করবো!”
আবেগে ইচ্ছে আবৃত্তির মতো করে বলতে লাগলো,
“আমাকে এমনভাবে আগলে রেখো, যেন পৃথিবীর কোনো ঝড় এসে ছিনিয়ে নিতে না পারে।
আমার অস্তিত্ব তোমার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনে মিলিয়ে দিও,
যেন আমার অনুপস্থিতি কখনো অনুভব না করতে হয় তোমাকে।
বিশ্বাস করো, আমার ভালোবাসা এতটাই গভীর,
যে আমার ছায়াও তোমার পাশে রয়ে যাবে, চিরকাল।
যদি কখনো বিদায় নিতে হয়,
আমার নামটি ধরে কেঁদো না,
আমি তোমার চোখের প্রতিটি অশ্রুবিন্দুতে বেঁচে থাকব।
তোমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে আমার ভালোবাসা থাকবে মিশে,
যেখানে সময়ও আমাদের আলাদা করতে পারবে না।
আমাকে রেখে দিও সেই গভীরতর অনুভূতিতে,
যেখানে আমার প্রতিটি হাসি আর কান্না তোমার হয়ে বেঁচে থাকবে।
তোমার হৃদয়ের সেই কক্ষপথে আমায় বাঁধা দিও,
যেখানে তুমি ছাড়া আমার জন্য কিছুই নেই।
আমার মৃত্যুর দিনেও তুমি খুঁজে পাবে আমাকে,
তোমার হৃদয়ের প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে থাকা আমার ভালোবাসায়।”
জুহাইর ইচ্ছের ভেজা চোখে চুমু খেলো। ইচ্ছে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। জুহাইর সমস্ত হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসায় মোড়ানো গাঢ় চুম্বন করলো ইচ্ছের ভেজা ওষ্ঠে! ইচ্ছে ভয়ে সিটিয়ে গলা জড়িয়ে ধরলো জুহাইরের৷ আবেশে দু চোখ মুদে রইলো কেবল।
#চলবে
#তৃষ্ণা_তব_নাহি_মেটে
#পর্ব১৫
#রাউফুন
জুহাইর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, যে কোনো মূল্যে তাকে তার সুনাম ফেরাতে হবে। সত্য প্রকাশের জন্য সে এবার আর পিছিয়ে থাকবে না। অপমান আর সন্দেহের ভার তাকে গ্রাস করে ফেলছে, কিন্তু ইচ্ছে তাকে যেভাবে সমর্থন দিয়েছে, তাতে তার মনে নতুন উদ্যম জন্ম নিয়েছে।
সকাল সকাল ব্যাংক থেকে চেক বানিয়ে নিয়ে সরাসরি রওনা হলো মফিজুর রহমান স্যারের বাড়ির দিকে। সারা রাত সে ভাবছিল, কীভাবে এই সত্যের অন্ধকার ঘাটিতে আলো আনবে। জুহাইর মফিজুর রহমান স্যারের বাড়ি গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লো।
মফিজুর রহমান দরজা খুললেন। তাকে দেখে খানিকটা বিস্মিত হলেও মৃদু হাসলেন। “জুহাইর, তুমি এসময়—কি মনে করে এসেছো? ভেতরে আসো।”
জুহাইর মাথা নিচু করে বললো, “স্যার, আপনার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে। সব খুলে বলতে চাই। আর কিছু প্রমাণ দিতে চাই যে, আমি কোনো অন্যায় করিনি।”
মফিজুর রহমান তাকে বসতে বললেন। জুহাইর চ্যাক বইটা টেবিলের ওপর রাখলো। স্যার চেকটির দিকে তাকিয়ে বললেন, “এটা কী?”
জুহাইর গভীর শ্বাস নিয়ে শুরু করলো,
“স্যার, এই চেকটি দশ লক্ষ টাকার। তবে এটি কোনো অপরাধের অর্থ নয়। এটি আমার বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির একটি অংশ। আমি জন্মসূত্রে বিত্তশালী একটি পরিবার থেকে আসা একজন সাধারণ মানুষ। আমার বাবার আদর্শ ধারণ করেই আমি সবসময় সাধারণত্বের লেবাস ধারণ করে চলেছি, ভবিষ্যতেও চলবো। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, বিলাসিতা এবং অহংকার আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার কাছে অপছন্দনীয়। অহংকার হলো আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার চাঁদর, এটা নিয়ে টানা হেচড়া করাও আল্লাহর অপছন্দের কাজ, যদি পৃথিবীর বুকে কেউ অহংকার করতে পারতেন, তিঁনি আল্লাহর হাবিব আমাদের নবী করিম (সাঃ)।
আমাদের নবী করিম (সাঃ) ছিলেন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং শ্রেষ্ঠ মানুষ। তবে তাঁর জীবন ছিল বিনয়, সরলতা, এবং দানের এক মহান উদাহরণ। তিনি নিজে ধনী হওয়া সত্ত্বেও সবসময় নিজের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি দান করে দিতেন। এমনকি, বহুদিন তাঁর ঘরে রান্না হতো না। ক্ষুধার্ত থাকার পরেও তিনি নিজের খাবার অন্যদের দান করতেন। এই মহান আদর্শের ভিত্তিতেই আমার পরিবার আমাকে বড় করেছে। তারা চেয়েছে, আমি যেন দুনিয়াবি সম্পদের প্রাচুর্যে না ভেসে যাই এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যে অটল থাকতে পারি।
আমি কখনো দুনিয়ার ভোগ-বিলাসের দিকে ঝুঁকিনি, আর কখনোই শো-অফ করিনি আমার অর্থ বা সম্পদ নিয়ে। কারণ, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা পছন্দ করেন তাদের, যারা বিনয়ী এবং সাধারণভাবে জীবন যাপন করে।
তাই সেদিন যখন আপনি বললেন, আপনার জীবনের সমস্ত সঞ্চয় চুরি হয়ে গেছে, আমি ভীষণ অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা থেকেই আমি আপনাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। প্রথমত আমাকে সবাই গরীব বলেই জানে, সেখানে হুট করেই যদি আপনাকে দশ লক্ষ টাকা আপনাকে দিতাম তবে সবাই আমাকে সন্দেহ করতো আরও বেশি, তাই অন্য পন্থা অবলম্বন করতেই চিঠি দেওয়ার মতো বোকামো টা করেছিলাম। আর দ্বিতীয়ত আমি এটাও জানতাম, সরাসরি আপনাকে এই অর্থ দিতে চাইলে আপনি কখনোই গ্রহণ করতেন না।
আপনি শুধু আমাদের শিক্ষক নন, স্যার, আপনি আমাদের পিতৃতুল্য। আপনার সম্মান রক্ষার জন্য এবং আপনাকে এই দুঃসময়ে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে আমি একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমার উদ্দেশ্য কখনোই মন্দ ছিল না, বরং তা ছিল আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা ও সম্মানের প্রকাশ। আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী, স্যার, যদি এই ঘটনায় আপনার মনে কষ্ট দিয়ে থাকি।”
জুহাইর মাথা নিচু করে দাঁড়ালো,তার কণ্ঠে ছিল সত্যতা এবং অনুতাপের গভীর ছাপ। মফিজুর রহমান মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনলেন। জুহাইর এক নিশ্বাসে বলে চললো,“আর আমি ভেবেছিলাম, যদি বলি টাকা আমি নিয়েছি, তবে আপনি সহজেই তা গ্রহণ করবেন। কারণ আপনি জানেন, আমি কোনোদিন অসৎ পথে চলি না। আমি ভুল করেছি, স্যার। আমার উদ্দেশ্য ভালো ছিল, কিন্তু পদ্ধতিটা ভুল ছিল। আমি জানতাম না যে এই ঘটনা এত বড় আকার ধারণ করবে।”
স্যার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “তাহলে ফোনটা? সেটাও কি তোমারই কাজ? ওটা তোমার স্ত্রীর কাছে কিভাবে গেল?”
জুহাইর মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “না স্যার। ইচ্ছে আর আমি পুকুর পাড়ে আসার পথে ফোনটা কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম, সেটা কারও হারানো জিনিস। আমি আর ইচ্ছে দুজনেই পরেরদিন জমা করে দিতাম ডিপার্টমেন্টের হেড এর কাছে।কিন্তু জানতাম না এটা এমন বিতর্কে জড়াবে। স্যার, আমি চাই এই ফোনে যার হাতের ছাপ আছে, সেটা পরীক্ষা করা হোক। আমি নিশ্চিত, এতে আমার এবং ইচ্ছের ছাপ থাকবে, কারণ আমরা সেটা কুড়িয়ে পেয়েছি। কিন্তু তৃতীয় কোনো ব্যক্তির ছাপ থাকলে প্রমাণ হবে, ওই ব্যক্তিই মূল অপরাধী।”
মফিজুর রহমান গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি বললেন, “তোমার কথাগুলো যুক্তিসঙ্গত মনে হচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি তুমি সত্য বলছো। কিন্তু বিষয়টা তদন্ত করতে হলে ফোরেনসিক পরীক্ষা দরকার। আর সেটাই করতে হবে।”
জুহাইর দৃঢ় কণ্ঠে বললো, “স্যার, আমি এটাই চাই। সত্যের জয় হোক। আমি আমার সম্মান ফেরাতে চাই। আমি জানি, আপনি আমাকে ভালোবাসেন, কিন্তু আমার ভুল সিদ্ধান্তে আপনাকে যে অসম্মানিত হতে হলো, তার জন্য আমি অনুতপ্ত। স্যার, এই ফোনের সত্য বের হলে, সবাই বুঝবে যে আমি দোষী নই।”
মফিজুর রহমান মাথা নেড়ে বললেন, “ঠিক আছে, জুহাইর। আমি এই বিষয়টি পুলিশকে জানাবো এবং তদন্তের জন্য বলবো। সত্য প্রকাশ হলে তুমিই সম্মান ফিরে পাবে।”
জুহাইর মাথা নিচু করে বললো, “ধন্যবাদ স্যার। আপনি আমাকে বিশ্বাস করেছেন, এটাই আমার জন্য বড়ো প্রাপ্তি। আমি অপেক্ষা করবো সত্য উদঘাটনের।”
পরের কয়েক দিন মফিজুর রহমান বিষয়টি তদন্তের জন্য পুলিশে জানালেন। ফোনের ফোরেনসিক পরীক্ষা হলো। তদন্তে দেখা গেল, ফোনে জুহাইর ও ইচ্ছের ছাপ ছাড়াও একজন অপরিচিত ব্যক্তির ছাপ পাওয়া গেছে। তাছাড়া মফিজুর রহমানের ছিনতাই হওয়া সময়ের বর্ণনার সঙ্গে সেই অপরিচিত ছাপের মালিকের তথ্য মিলে যায়। যখন ছিনতাই হয়েছে তিনি তখন ভার্সিটি থেকে বের হচ্ছিলেন, রাস্তায় ছিলেন তিনি, আর সেসময় জুহাইর ছিলো ভার্সিটিতে পুকুর ঘাটে।
সবাইকে বিষয়টি জানানোর জন্য মফিজুর রহমান একটি সভা ডাকলেন। সেখানে তিনি জুহাইরকে সামনে ডেকে বললেন, “আজ প্রমাণ হলো, তুমি নির্দোষ। আমি তোমার ওপর যেভাবে সন্দেহ করেছি, সেজন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাই।”
শিপা ও শিশির তখন রাগান্বিত হয়ে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। জুহাইরের সৎ চরিত্র ও ইচ্ছের বিশ্বাস তাদের অপমানের আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিল। জুহাইর মাথা উঁচু করে বললো, “স্যার, সত্য প্রকাশ পেয়েছে। এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় জয়। অন্তত আমি যেটুকু প্রমাণ দিয়েছি এতে করে আমার উপর আসা বদনামের ঝড় ঝুড়ো বালির মতোই ঝড়ে পড়বে। কেউ অন্তত বলতে পারবে না, জুহাইর সিকান্দার চোর!”
জুহাইর যখন মফিজুর রহমান স্যারের সামনে তার বক্তব্য শেষ করলো, তখন স্যার গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। কিন্তু তার মুখে সন্তুষ্টির আভাস ফুটে উঠলো, কারণ জুহাইরের কথা ও প্রমাণগুলো একের পর এক তার নির্দোষিতা প্রমাণ করছে। জুহাইর বুঝতে পারলো, এতো সহজে এই ঘটনা শেষ হবে না।
জুহাইর দৃঢ় কণ্ঠে বললো, “স্যার, আমি এই তদন্তে আপনাদের সাহায্য করতে চাই। আমি নিশ্চিত, আমরা যদি ঠিকমতো বিশ্লেষণ করি, তাহলে প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে বের করা সম্ভব। আমার মনে হয়, শহরের সব পরিচিত ছিনতাইকারী ও তাদের কর্মকাণ্ডের একটি তালিকা তৈরি করা উচিত। তাদের লেনদেন বা ব্যাংক একাউন্ট চেক করা হলে বোঝা যাবে, সাম্প্রতিক সময়ে কারো একাউন্টে কোনো বড় অংকের লেনদেন হয়েছে কি না। আর স্যার, আপনার ছিনতাইয়ের তারিখ ও সময়ের সঙ্গেও এই তথ্য মেলাতে হবে।”
মফিজুর রহমান মাথা নেড়ে বললেন, “তুমি একদম ঠিক বলেছো, জুহাইর। আমি পুলিশকে এসব বলবো। কিন্তু তুমি নিজেও কি কিছু খুঁজে পেয়েছো, যা আমাদের কাজে লাগতে পারে?”
জুহাইর সামান্য দ্বিধা নিয়ে বললো, “স্যার, আমি কিছুটা সন্দেহ করছি। তবে এটা সরাসরি বলার চেয়ে, প্রমাণসহ কথা বলা ভালো। আপনার অনুমতি পেলে আমি সেই সন্দেহের ভিত্তিতে কাজ করতে চাই। আমি চাই, পুলিশের কাছে আপনার অনুমতি নিয়ে আমি একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির ব্যাংক ডিটেলস ও লেনদেন সমূহ চেক করাই। আমি মনে করি, এতে সত্য উন্মোচনে সময় লাগবে না।”
স্যার কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কার ব্যাপারে সন্দেহ তোমার?”
জুহাইর কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললো, “স্যার, আমি আমাদের ভার্সিটির একজনকে সন্দেহ করছি, তার সাম্প্রতিক আচরণ খুবই অস্বাভাবিক। আপনার সাথে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটার সময় তার লোকেশন আশেপাশে ছিলো, কিন্তু তার বিবৃতি আর কার্যকলাপে মিল খুঁজে পাচ্ছি না। তাছাড়া, সেদিন ফোন কুড়িয়ে পাওয়ার পর থেকে সে যেন কিছুটা আতঙ্কিত। আমি মনে করি, তাকে পর্যবেক্ষণ করা উচিত।”
মফিজুর রহমান কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, “তুমি যা বলছো, সেটার ভিত্তি আছে। আমি এই বিষয়ে পুলিশকে জানাবো। তারা তদন্ত করবে। তবে তুমি সাবধানে থেকো, কারণ এ ধরনের কাজ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।”
জুহাইরের সন্দেহের ভিত্তিতে মফিজুর রহমান পুলিশে রিপোর্ট করলেন। জুহাইর যদি দোষী হতো তবে সে নিশ্চয়ই নিজে থেকে পুলিশে রিপোর্ট করতে বলতো না? আর এতো সহজে এতো বড়ো একটা এমাউন্টও নিশ্চয়ই সে দিয়ে দিতো না।
জুহাইর বাড়ি ফিরলো। কলিংবেল বাজাতে দরজা খুলল ইচ্ছে। তার মলিন মুখটা দেখে জুহাইর দরজার সামনেই মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরলো। ধরে আসা গলায় বললো,“চিন্তা করছিলে?”
ইচ্ছে হ্যাঁ না কিছুই বললো না। জুহাইর বললো,“ভার্সিটির সবার কাছে মোটামুটি এটা প্রমাণিত যে আমি স্যারের টাকাটা নিই নি। শুধু এবারে আসল অপরাধীকে পাকড়াতে পারলেই পুরোপুরি আমার উপর থেকে এই এঞ্জাম মিটে যাবে।”
ইচ্ছে কাঁন্না করছে। জুহাইরের গাত মেয়েটার কোমড় ছঁয়ে রেখে চুমু খেলো তার ওষ্ঠে। এরপর হাত সরিয়ে চোখের পানি মুছে দিলো অতিযত্নে। এরপর আবারও টুপটুপ করে কয়েকবার ঠোঁট ছোঁয়ালে মেয়েটা মুষড়ে গেলো লজ্জায়।
#চলবে…