#প্রিয়_প্রেমানল
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ২
“কান্নার পর গভীর ঘুমে ডুবে গিয়েছিল মেহের। চোখ মেলে দেখে, যোহরের ওয়াক্তের পর, আলো নিস্তব্ধ ঘরজুড়ে ছড়িয়ে আছে। হতবিহ্বলভাবে উঠে পড়ে সে, তাড়াহুড়ো করে ফ্রেশ হয়। অতপর ফোনটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বাবার বাড়ির দিকে। কিন্তু গেইটের কাছেই হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হয় তাকে।একটা কালো, ঝকঝকে দামি গাড়ি। গাড়ির ছাদ খোলা। সামনের সিটে বসে আছে ইলহাম।
সানগ্লাসে মুখ ঢাকা। চিবুকে আত্মবিশ্বাসের রেখা। মেহেরকে ইলহাম একবার দেখে, কিন্তু তার ভাবমূতি স্বাভাবিক। চোখে কোনো প্রশ্ন নেই। না অভিমান, না বিস্ময়।
একটা নিঃশব্দ দেয়াল যেন দাঁড়িয়ে রইল ওদের মাঝখানে।
মেহেরের বুকটা হঠাৎ ভার হয়ে ওঠে। কিছু বলার চেষ্টা করে, কিন্তু গলা শুকিয়ে আসে। ইলহাম ঠোঁটের কোনে এক রকম উপেক্ষা মেখে গাড়ি স্টার্ট দেয়। আর মেহের দাঁড়িয়ে থাকে
ফেলে যাওয়া অনুভূতির ধ্বংসস্তূপে। জীবন এমন হওয়ার কথা ছিল?
.
গেইটের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায় মেহের। গেইট ইতিমধ্যে লাগানো হয়ে গেছে। মেহের ঠকঠক আওয়াজ করে।
অপর প্রান্তে সাড়া দেয় দারোয়ান হারুন চাচা।
গলার স্বরটা আজ অন্যরকম যেন কিছু বলতে ইতস্তত করছেন উনি।
“ চাচা, গেইট খোলেন। বাইরে যাবো।”
একটু থেমে হারুন চাচা জানায়
“ম্যাডাম… আপনি হয়তো জানেন না, স্যারের নির্দেশ আছে আজ আপনি বাইরে যেতে পারবেন না।”
মেহের হতভম্ব হয়ে যায়।
“মানে? কেন? কে বলেছে?”
“স্যার ইলহাম। তিনি এখন যাওয়ার সময় বলে গেছেন ‘ম্যাডাম যেন আজ বাসা থেকে না বের হন। কাল বাড়িতে অনুষ্ঠান আছে। আপনার বাবা আসবেন। আপনি ঘরেই থাকেন।”
মেহেরের বুকের ভেতর কিছু একটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে।
যে মানুষটা চোখে চোখ রেখেও কিছু বলে না! সে আজ বাইরে যাওয়ার স্বাধীনতাও কেড়ে নিল?
তার গলা রুদ্ধ হয়ে আসে।
“ চাচা, দয়া করে গেইট খুলে দেন। আমি বাবার বাসায় যাবো।”
“ম্যাডাম, আমি আপনার কথা বুঝি… কিন্তু কিছু করার নেই। স্যারের আদেশ আমি অমান্য করতে পারি না।”
মেহের অনেক বলেও লাভ হয় না। আচমকা নিজেকে বন্দিনী মনে হয় তার। অভিমান, অপমান, হতাশা সব মিলিয়ে মনে হয়, যেন নিশ্বাস নিতে পারছে না।
ধীর পায়ে ফিরে আসে সে ভিতরে। চারদেয়ালের ভেতরেও যেন শ্বাসরুদ্ধ পরিবেশ। ঘরে ঢুকেও কোথাও স্বস্তি নেই।
অবশেষে সে গিয়ে বসে ছোট দেবর এহানের ঘরে।
ঘরটা এখনো ছেলেমানুষি ছোঁয়ায় সাজানো। বইয়ের গন্ধ, দেয়ালে ক্রিকেটারদের পোস্টার, টেবিলে এলোমেলো খাতাপত্র।
বিছানায় বসে পড়ে মেহের।নিজের ফোনটা হাতে নেয়, স্ক্রল করে, আবার রেখে দেয়। এহান গেমস খেলতে ব্যাস্ত তখন৷
মেহেরের বুকে বিষ জমে থাকে, কিন্তু চোখে জল আসে না আজ।ঘড়ির কাঁটা ঘোরে, কিন্তু সময় কেটে না। বিকেল থেকে সন্ধ্যা। মেহের কেবল বসে থাকে, যেন সময়ের কাছে পরাজিত এক যাত্রী। এমনি করে দুপুরের খাবারের সময় হয়৷ কেউ এসে দুপুর তিনটায় ডেকে যায়। খাবার টেবিলে ছিমছাম পরিবেশ। এহান পাশে বসে, মাঝে মাঝে তাকায়
মেহের কোনো কথা বলে না, চুপচাপ কিছু খেয়ে উঠে পড়ে।
চোখেমুখে ক্লান্তি আর অবসাদের ছাপ। ভাবে সে বসে তাকে জানানো হয়নি অনুষ্ঠানের কথা। বাবা আসবেন, এটাও সে দারোয়ানের মুখে শুনেছে প্রথমবারের মতো।
বিকেলের নরম রোদে ছাদের দোলনায় বসে আছে মেহের।
আকাশটা আজ মেঘলা, রোদের চেয়ে হাওয়া বেশি।
দোলনায় পা ঝুলিয়ে বসে থেকে থেকে দৃষ্টি আকাশের দিকে।
কিন্তু মনটা আকাশে নয়, বরং কোথাও আটকে আছে।
এহান পাশে বসে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলছে, মেহের মাঝে মাঝে মাথা নাড়ায়, কখনো এক-আধটা শব্দ বলে
তবে তা মন থেকে নয়।
“ভাবি জানেন… ভাইয়া ছোটবেলায় একেবারে চুপচাপ ছিল।
অন্য ছেলেরা যখন খেলাধুলায় ব্যস্ত,
তখন ইলহাম ভাই বই আর ব্যবসার হিসাব নিয়ে পড়ে থাকত।”
মেহের চমকে তাকায়।
“ব্যবসার হিসাব? কিন্তু তুমি জানো কিভাবে এসব?”
” দাদির মুখে প্রতিদিন শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে। ”
” তাই?”
“হুম,”
এহান হেসে বলে,
“কোম্পানির দায়িত্ব ছিল দাদার হাতে।
কিন্তু ইলহাম ভাই এতটাই আগ্রহী ছিল যে,
মাত্র সতেরো বছর বয়সে প্রথম মিটিংয়ে গিয়েছিল।ছোট মানুষ, অথচ কী সাহস! সেই থেকে শুরু। আজকের এই ইলহাম ভাইয়াকে আপনি ভাবতেই পারবেন না।সে কীভাবে তৈরি হয়েছে।”
মেহের নিঃশব্দে শোনে। এহানের কণ্ঠে প্রশংসা, মায়া।
“তোমাদের বাবা-মা?”
চুপ করে থাকে এহান।
তারপর হালকা নিঃশ্বাস ফেলে বলে
“কার অ্যাক্সিডেন্টে দুজনেই একসাথে চলে যান।আমি তখন খুব ছোট।ভাইয়া তো আরও ছোট ছিল। দাদা-দাদি মানুষ করেছে আমাদের। তবে ভাইয়ার মনটা কঠিন হয়ে গেছে তখন থেকেই। সে কাঁদে না, হাসেও না। শুধু দায়িত্ব নেয়।”
মেহের কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর বলে,
“তোমার ভাইয়া আসলে একটা রোবট।”
বাতাসে কিছুক্ষণ নীরবতা ভেসে বেড়ায়।
এরপর এহান দোলনা থেকে উঠে ব্যাস্ত হয়ে বলে
“চলেন না, গাছে পানি দিই। আমি ছাদে গাছগুলোতে হালকা পানি দিই প্রতিদিন।”
মেহের হালকা মাথা নাড়ায়। দুজন উঠে ছাদের দিকে যায়।
ছাদে উঠেই দেখে, এক বৃদ্ধা মহিলা পানির কলসি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চুল সাদা, গাল শুকনো, আর পরনে হালকা সাদা শাড়ি। তিনি গাছগুলোতে পানি দিচ্ছেন ধীরে ধীরে, একটু কাঁপা হাতে।
“চাচী! আপনি! আজ কেন পানি দিচ্ছেন?”
এহান তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায়।
বৃদ্ধা হালকা হাসেন,
“তোমার ভাইয়া বলেছে গাছগুলোতে যেন নিয়ম করে পানি দেওয়া হয়। কিন্তু আজকে আমার মনে হলো, আমি নিজেই দিই। কতদিন গাছগুলোকে ছুঁয়ে দেখা হয় না…”
মেহের ও এহান কিছু বলতে যাবে এমন সময়ই বৃদ্ধার মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিতে নিতে বসে পড়েন। মেহের তাড়াতাড়ি তাকে ধরে ফেলে।
“চাচী! আপনি ঠিক আছেন?”
“হ্যাঁ মা, শুধু একটু দুর্বল লাগছে।”
এহান গিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দেয় তাকে। মেহের ততক্ষণে পানির বোতল এনে তার হাতে দেয়। বৃদ্ধা ধীরে ধীরে চুমুক দেন।
তারপর দুজনে মিলে গাছগুলোতে পানি দিতে শুরু করে।
মেহেরের হাতে জলভরা ডালের ঠান্ডা স্পর্শ, পাতায় ছিটিয়ে দিলে সেই স্নিগ্ধতা যেন তার হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
ছোট ছোট টবের মধ্যে ফুটে আছে নানা রঙের ফুল,
সবুজ পাতাগুলো ধুলায় ঢেকে গেছে, মেহের নিজে হাতে তা পরিষ্কার করে। হঠাৎ তার মনে হয়, বহুদিন পর যেন কোথাও কাজে লাগছে সে। ছোট্ট একটি হাসি খেলে যায় ঠোঁটে।
এহানও পাশে দাঁড়িয়ে গাছের পাতায় পানি ছিটায়।
দুজনের মাঝে নীরব বোঝাপড়া।
আকাশ তখন আর মেঘলা নয়। হালকা রোদ গায়ে এসে পড়ে। আর মেহের বুঝতে পারে, জীবনে যত যন্ত্রণাই থাকুক না কেন কখনো কখনো নির্ভরতা আসে ছোট ছোট মুহূর্তে।
যেমন এই ছাদে, গাছের পাতায়, কিংবা একজন ছোট দেবরের অচেনা স্নেহে।
.
পরদিন সকালে বাড়িতে আগমন হলো মেকআপ আর্টিস্ট। তারও আগে ভোরে বিদেশ থেকে ফিরলেন ইলহামের দাদা-দাদি। নাত বউকে দেখে তারা খুবই খুশি। অসুস্থতার জন্য ইলহামের দাদাকে নিয়ে ওনারা ছিলেন সিঙ্গাপুর। আদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন এবার ইলহাম বিয়ে করে যেন খবর দেয় তাদের। বিয়ের পরই দেশে ফিরবেন তারা। নয়তোবা বিদেশে মেয়ের বাড়িতেই একেবারে থেকে যাবেন। এমন সব কথা সজ্জিত নব বঁধু মেহেরকে জানালে মেহের হাসে এক চিলতে। তবে ভেতর ঘর তখন কাঠকাঠ তার। তবে এটাও একটা কারণ ছিল এই বিয়ের। মেহের এরপর চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় থাকে তার বাবার আগমনের। এরই মাঝে দেখামেলে ড্রয়িং রুমে সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত ইলহামের। শ্যামলা রঙের সুদর্শন নাক মুখ চোখের অধিকারী তাকে দেখতে লাগছে অসম্ভব রকমের সুন্দর। শ্যামলা মানুষও সুন্দর হয়? এক লহমায় এ প্রশ্ন মাথায় এলে মেহের দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নেয়।
চলবে….