এমন একদিন সেদিন পর্ব-৪+৫

0
1

#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৪
কথা কাটাকাটি চলতেই থাকলো। একসময় সিড়িন হকের একমাত্র দেবর মারুফ হক ধমকে উঠলেন,

‘কি শুরু করলে সবাই? থামো! আর নীরা, বড় বউ এতোদিন সবদিক সামলেছে এখন তো সে অসুস্থ। বড়বউয়ের পর সংসারের হাল ধরার দায়িত্ব তো তোমার’ই। বিয়ে করলে, বাচ্চা হলো আর বসে বসে খেলে-দেলে, ঘুরলে, ঘুমালে এভাবে তো সংসার হয় না।’

নীরার কপাল হলো উল্টো কপাল। সবার শ্বাশুড়ি যন্ত্রণা করে আর তাকে করে শ্বশুড়। মহিলা মানুষের মতো নীরার প্রতিটা খুঁত বের করে ঠিক সবার সামনে অপদস্থ করবে। নীরা রাগের ঠেলায় কনুই দিয়ে সাজিদকে জোরে গুতা দিলো। সাজিদ বিরক্ত মুখে চেয়ে খাবার শেষ করে মায়ের থেকে ছেলেকে কোলে নিয়ে ঘরে চলে গেলো।

বরের পেছন পেছন গেলো নীরাও। মারুফ হক উঠে চলে যেতেই সবুজা হকও তার স্বামীর পেছন পেছন ছুটলেন। এরই মাঝে সিড়িন হককে বলতে শোনা গেলো,

‘বউমা, আমার কিন্তু নাতনি চাই।’

ইরা নিচু কণ্ঠে জবাব দিলো, ‘সবই তো আল্লাহ’র হাতে মা।’

সিড়িন হকের কোনো মেয়ে না থাকায় তার খুব শখ একটা নাতনির। তিনি জোর গলায় বললেন,

‘দিন-রাত দোয়া করবে আল্লাহ যাতে তোমাকে এবার মা ডাক শোনার তৌফিক দান করেন এবং একটা মেয়ে দেন।’

ইরা কথা বাড়ালো না। মাথা নিচে নামিয়ে খাওয়া শুরু করলো। দুষ্টু ভাঙা গলায় থেমে থেমে বলল,

‘সব দাদা-দাদি ছেলে চায় আর আপনি মেয়ে চাইছেন? আপনি আসলে’ই উল্টো।’

সিড়িন হকের মুখের উপর এভাবে কেউ কখনোই কথা বলেনা। প্রচ্ছদ এমনভাবে তাকালো যেনো তার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। সিড়িন হকের তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। তার সাথে দুষ্টু এভাবে’ই কথা বলে চিরকাল। বস্তুত শুধু তার সাথে নয়, সবার সাথেই। কিন্তু আচম্বিতে তিনি দুষ্টুকে অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে দিয়ে দ্বিগুণ গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,

‘ওতোসব তোমার না ভাবলেও চলবে। আছোই তো মাত্র তিনমাস। এতো মাথা ঘামালে পরে নতুন সংসারে গিয়ে তো মাথার সমস্যা দেখা দিবে। এই সংসারে তোমার এতো মাথা না ঘামালেও চলবে।’

টিয়ার খাওয়া থেমে গেলো। বাকিরা স্বাভাবিক। কিন্তু দুষ্টুর মাথায় যেনো গোটা আকাশ ভেঙে পরলো। পায়ের তলার মাটি সরে গেলো। সমস্ত বস্তু, জীব অপার্থিব ঠেকলো। হতবিহ্বল টলটলে চোখে প্রচ্ছদের দিকে তাকাতেই দেখা গেলো অপ্রস্তুত চোখে সেও তাকিয়েছে দুষ্টুর দিকে।

৭.
কাঠা ফাঁটা রোদ্দুরে দূরের আকাশ নীল রঙে ডুবেছে। নরম তুলোর মেঘ সূর্যকে মুক্ত করেছে শ্রান্ত বদনে। তখন প্রকৃতির শুভ্র সফেদ পবনের এক ফালি স্ফটিক রোদ্দুরে দুষ্টুর চোখ ভরে উঠেছে। সজোরে নাক টানতেই একটা হাত বাড়িয়ে দিলো সাদা রুমাল। করুণ চোখ মেলে তাকাতেই প্রচ্ছদ রুমালটা তার হাতে ধরিয়ে দিলো। দুষ্টু নাক মুছে প্রচ্ছদের দিকে আবার রুমাল এগিয়ে দিতেই নাক মুখ কুচকে তাকালো প্রচ্ছদ। দুষ্টু রুমাল নিজের কাছে ফিরিয়ে নিলো। দুষ্টুর পাশে বসে জুতা পরতে পরতে প্রচ্ছদ শাসন ভরা স্নেহের গলায় বলল,

‘এমনিতেই তো গলা বসিয়ে ফেলেছেন তারউপর আবার কান্নাকাটি করছেন কেনো?’

দুষ্টু তেজের চোটে বলল, ‘সাট আপ।’

প্রচ্ছদ অবাক চোখে চাইলো, ‘সাট আপ? আশ্চর্য! এখানে সাট আপ বলার কি হলো?’

‘অনেক কিছু হয়েছে। আপনি তুমি বারবার গুলিয়ে ফেলেন কেনো? আমার বিরক্ত লাগে।’

প্রচ্ছদ ঠোঁট বিকৃত করে চাইলো। দুষ্টু চোখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ নিভৃতে বসে রইলো। এরপর ঠান্ডা গলায় শুধালো,

‘বিয়ের একদিন যেতে না যেতেই সবাইকে ডিভোর্সের কথা বলা’টা কি ঠিক হয়েছে?’

মাথা নিচু করে জুতার ফিতা বাঁধতে বাঁধতে প্রচ্ছদের উত্তর এলো,

‘বাসর রাতে সদ্য বিবাহিত স্বামীর কাছে ডিভোর্স চাওয়া’টাও কি ঠিক হয়েছিলো?’

‘তো ডিভোর্স চাইবো না? আমি অন্যকাউকে ভালোবাসি। আপনি বুঝতে পারছেন না?’

প্রচ্ছদ উঠে দাঁড়িয়ে ধীর গলায় বলল,

‘নিশ্চয়ই পারছি। আর পারছি বলেই আপনি এখনো আমার সামনে দাঁড়িয়ে এভাবে কথাগুলো বলতে পারছেন।’

দুষ্টু অভিমানে টলমলে হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘সবার সামনে এভাবে আমাকে ছোট করতে পারলেন আপনি?’

দুষ্টুর অভিমানী চোখের দিকে তাকানো মাত্র ফিচেল হাসলো প্রচ্ছদ। বললো,

‘বিয়ের রাতে ডিভোর্স চাইতে পারলে, আমি কেনো আমার পরিবার’কে জানাতে পারবো না? একসময় না একসময় তো তারা সব জানবেই। আর আমি আপনাকে ছোট করেছি? তবে আপনি তো আমাকে নিকৃষ্ট বানিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের রাতেই ডিভোর্স চেয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন আমি পুরুষ কতটা অক্ষম, কতটা নিষ্প্রয়োজন, কতটা অপদার্থ!’

দুষ্টু ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। এরপর অনেকক্ষণ পর ঠোঁট আলগা করে বললো,

‘আপনার মা কিচ্ছু বললো না? সবাই এতো স্বাভাবিক? কীভাবে সম্ভব? আচ্ছা? আমি পালালাম। আপনার মা আমাকে ধরে নিয়ে এলো। তা সত্ত্বেও আপনার মা কীভাবে আমার সাথে আপনার বিয়ে দিতে পারে?’

দুষ্টুর কৌতুহল ভরা চোখের দিকে এক পলক তাকিয়ে প্রচ্ছদ হালকা গলায় উত্তর দিলো,

‘আমার ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে আমি আসছি। সাবধানে থেকো। কারোর সাথে তর্ক করো না। নতুন বউদের এতো উড়নচণ্ডী মানায় না। একটু লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে চলতে ফিরতে হয়।’

দুষ্টুকে কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে প্রচ্ছদ পা বাড়ালো। দুষ্টু হাতে রাখা রুমাল মুঠোয় মুচড়ে ফেলল। বাইরে রোদের ঝিলিক বাড়লো। সাথে বাড়লো দুষ্টু নামক যুবতীর বুকের ভেতর তেজের ঝিলিক। রাগ হওয়ার নতুন আরেকটি মাত্রা যোগ হলো তখন, যখন খেয়াল হলো প্রচ্ছদ আবার আপনি তুমি গুলিয়ে ফেলেছে। রাগে দুঃখে রৌদ্রস্নাত মাখামাখি বিছানাটায় ধপ করে বসে পরলো সে। এরপর ক্রোধে… না অভিমানে… না দমবন্ধে.. নাকি প্রিয় মানুষটির অভাবে… ঠিক বুঝতে পারা গেলো না তবে দুষ্টুর ওই গভীর সুন্দর চোখজোড়া কানায় কানায় পূর্ণ ঠিক দীঘির জলের মতোই ভাস্যমান হলো। রোদ্দুরে চিকচিক মুক্তোর মতো জানান দিলো নীরের সৈন্যদল। হাতের সেই অপরিষ্কার রুমাল’টার দিকে তাকিয়ে থাকলো বহুক্ষণ।

৮.

তখন ভরদুপুর। ঘরের মাঝে বসে থেকেও ঘেমে জুবুথুবু হয়ে উঠেছিলো দুষ্টু। গোসল করে এসে বন্ধ মুঠোফোন টাকে সজাগ করার কিছুক্ষণ পরেই পাওয়া গেলো শ্রেয়সীর ফোন। ফোন রিসিভ করে কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। এরপর খুব ধীরে বলে উঠলো,

‘বল।’

নিশ্চুপ শ্রেয়সী ভ্রু কুচকে নিজ বাচ্যের ধারায় প্রথমেই যে প্রশ্ন করলো তা ছিলো এরকম, ‘কি হয়েছে রে?’

দুষ্টু জোরপূর্বক হাসলো। বলল, ‘কি আর হবে? কিচ্ছু না।এভরিথিং ইজ টোটালি ফাইন।’
‘গলার স্বর ভাঙা। ঠান্ডা লেগেছে?’
‘হুম একটু।’
‘কীভাবে লাগলো?’
‘এমনি লেগে গেছে। সিজন চেঞ্জ না?’
‘নীড় শুনলে তো হার্ট অ্যাটাক করবে।’

দুষ্টু নিঃশব্দে হাসলো। নীড়ের কথা উঠতেই বুকের মাঝে বিশাল কান্নার একটা দল গড়াগড়ি খেলো সাথে গলায় আটকে স্বরবটাকে আরো খানিকটা ভেঙে দিলো। শ্রেয়সী বলল,
‘দুই দিন থেকে ফোন বন্ধ কেনো?’
‘ফোন নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।’
‘ওহ। নীড়ের সাথে কথা হয়েছে?’
‘নাহ।’
শ্রেয়সী ভ্রু কুচকে সন্দেহ গলায় শুধায়, ‘ঝগড়া হয়েছে?’
‘আমাদের কখনো ঝগড়া লাগে না, তুই জানিস না? আচ্ছা, ও কি ঢাকায় ফিরেছে?’
‘হ্যাঁ, ফিরেছে তো।’
‘কবে?’
‘পরশুদিন।’
দুষ্টু বিস্ময়ে উচ্চস্বরে প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠলো, ‘কিহ?’

শ্রেয়সী আকস্মিক চিৎকারে থতমত খেয়ে গেলো,

‘হ্যাঁ, ও তো পরশু দিনই এসে পরেছে। আর পরশুদিন থেকে তোকে ফোনে না পেয়ে নীড় তো চিন্তায় অস্থির।’

দুষ্টু মুখে হাত দিলো। অবাকতার চরম শিখরে পৌছুলো। খেয়াল করলো এমন অপ্রস্তুত কথায় সে ঘেমে নেয়ে আবারো অস্থির হয়ে উঠেছে। গলার স্বর বন্ধ হয়ে গিয়েছে। হাজারো চেষ্টা করেও কথা বলা যাচ্ছে না। শ্রেয়সী বলে গেলো তারস্বরে,

‘শোন শালী, কাল দেখা করবি বুঝছিস? আমার অনেক গল্প আছে। নীড়ও থাকবে। ওর সাথে যোগাযোগ করিস। আল্লাহ হাফেজ, দোস্ত।’

ফোন কেটে দিয়েই দুষ্টু অস্থিরচিত্তে সারাঘর ময় পায়চারি করলো। কিছুক্ষণ পর কাঁপা হাতে একটা নাম্বারে ডায়াল করে আর্তনাদ স্বরে বলে উঠলো,

‘আপু..।’

দৃষ্টি ঘুম থেকে ধরফরিয়ে উঠলো। ভীত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

‘কি হয়েছে? কাদছিস কেনো? গলা ভেঙেছে কীভাবে?’

‘আপু… ‘

দৃষ্টির আদর মাখা ডাক, ‘কি হইছে আপু? বল।’

‘আপু নীড় পরশুদিন’ই চট্রগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে পরেছে।’

দৃষ্টি হতবিহ্বল কন্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ? কি বলছিস?’

দুষ্টু নাক টেনে কন্ঠ যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা করে বললো,

‘পরশুদিন আমার গায়ে হলুদ ছিলো আর ওইদিন’ই নীড় ঢাকায় এসে পরেছে। আমি তো ভেবেছিলাম ও চট্টগ্রামেই আছে। একবার যদি জানতে পারতাম ও ঢাকায় তাহলে এই বিয়ে টিয়ে এতো কান্ড ঘটতো না। ওকে সব খুলে বললেই ও ম্যানেজ করে নিতো। এটলিস্ট আমি ওর সাথে পালিয়ে যেতে পারতাম। আমি কত্ত বড় ভুল করে ফেললাম! আমার শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, আপু।’

‘শিট! তুই ফোন করে যোগাযোগ রাখিসনি কেনো নীড়ের সাথে?’

দৃষ্টির কন্ঠে রাজ্যের বিরক্তি। দুষ্টু রেগে বলল,

‘তুমি জানো না মা আমার ফোন গায়ে হলুদের দিন থেকেই নিজের কব্জায় রেখেছিলো? কাল বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর ফোন আমার হাতে দিয়েছে। মাকে নীড়ের ব্যাপারে সব বলে দেওয়াই ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।’

‘তুই অন্যকোনো নাম্বার দিয়ে নীড়ের সাথে যোগাযোগ করবি না, গবেট?’

‘আমি তো আর জানতাম না, নীড় ওইদিন’ই ঢাকায় আসবে। ভেবেছিলাম অন্য কারো নাম্বার দিয়ে যোগাযোগ করলে ও সন্দেহ করবে। হেনতেন নানান প্রশ্ন করবে। আমি এসব কি করে বসলাম? আগেই ওকে সব কেনো খুলে বললাম না? আমার নিজের উপর ভীষণ রাগ লাগছে।’

দুষ্টু কান্নায় ভেঙে পরতেই দৃষ্টি আশ্বাস দিয়ে বললো,

‘আচ্ছা থাক, কাঁদিস না। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। যা হবার হয়ে গেছে। নিজে নিজে পন্ডিতি করেছিস। আমি বারন করেছিলাম। বলেছিলাম নীড় কে সব বলে দিতে। তুই বললি একাই সব ম্যানেজ করবি। এবার হলো তো! যাই হোক, এখন আপসোস করলে তো আর দিন ঘুরে ফিরে আসবে না। সামনের দিনগুলো দেখ কি হয়!’

চলবে❤️

#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৫

৯.
চারিদিকে শুনশান নীরবতা। নিরবিচ্ছিন্ন শব্দহীন পরিবেশে ঠান্ডা হাওয়ার শা শা শব্দ, পাতার মড়মড় ধ্বনি, আধাঁরে সবুজ জোনাকি। প্রচ্ছদ ঘরে প্রবেশ করতেই দেখলো, দুষ্টু কপালে এক হাত রেখে শুয়ে আছে। ঘরে ঢুকে শার্ট খুলে প্রচ্ছদ তড়িৎ বেগে বাসার টি-শার্ট পরলো। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বললো,

‘আজ কি খাটে একসাথে থাকার প্ল্যান?’

দুষ্টু কপাল থেকে হাত সরিয়ে নিষ্প্রভ গলায় জবাব দেয়,

‘কালকে মেঝেতে থেকে আমার গলা ভেঙেছে। সো, আজকে আপনি মেঝেতে শুবেন।’

প্রচ্ছদ ত্যাড়া গলায় বলে, ‘আমি আমার বিছানায় থাকবো। তোমার সমস্যা হয় তুমি অন্যকোথাও যাও।’

দুষ্টু উঠে বসে আগ্নেয়গিরির ন্যায় তাকিয়ে থাকলো। যেনো ভস্ম করে দিবে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অবাধ্য এই যুবককে কিংবা অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারলে বেশি ভালো হতো। তেজের ঝাঁঝে দুষ্টু বলল,

‘ঘরে ডিভান কিংবা সোফা রাখতে পারেন না?’

‘না পারি না। আমি তো আর এতো বড়লোক নই যে ঘরের মাঝেই ড্রইংরুম গড়বো। এক রুমে দুটো এসি লাগাবো।’

‘একদম খোঁচা দিয়ে কথা বলবেন না। ঠোঁট কেটে রেখে দিবো।’
‘এতো সাহস?’
‘অবশ্যই। থাকতে হয়। এখন বিয়ে করেছেন না? ঘরে একটা সোফা রাখবেন।’
‘বিয়ে করলে মানুষ ঘরে সোফা রাখে?’
‘হ্যাঁ রাখে তো, যাতে বর বউয়ের ঝগড়া হলে আলাদা থাকতে পারে।’
প্রচ্ছদ বিরক্তির স্বরে বলল, ‘তিনমাসের জন্য এসব কেনার কোনো মানেই হয় না।’

দুষ্টু চুপসে গেলো। গাল ফুলিয়ে তাকালো প্রচ্ছদের দিকে। প্রচ্ছদ নিঃশব্দে নিচে বিছানা পেতে শুয়ে প্রশ্ন করলো,

‘তোমার বয়ফ্রেন্ড জানে না বিয়ের কথা?’

কপালে আবারো হাত রেখে বন্ধ চোখে নিমিত্তে দুষ্টু উত্তর দিলো,

‘নাহ। জানানোর প্রয়োজনও নেই। ডিভোর্সই তো দিবো। পরে সব জানালেই চলবে। এখন জানালে বিষয়টা অন্যরকম পর্যায়ে চলে যাবে।’

‘কেনো?’

‘কারণ আমি ওকে জানিয়ে বিয়ে করিনি। ও বলতে পারে, আমি ওকে ঠকিয়েছি।’

‘ডিভোর্স নিয়ে যাওয়ার পর বলবে না, আপনি ওকে ঠকিয়েছেন?’

‘জানি না। সবভাবেই ঠকানো হচ্ছে। এই পথ’টা বেছে নিয়েছি কারণ সবদিক সামলে উঠে আমি ওকে বোঝানোর একটা রাস্তা পাবো। আপনার সাথে বিনা সম্পর্কে আমার ডিভোর্স হবে। পরিবারের চাপে পরে বিয়ে করেছিলাম। ওকেও বলার মতো স্কোপ পাইনি। আই হোপ, হি কেন আন্ডারস্ট্যান্ড।’

প্রচ্ছদ বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথার নিচে দু’হাত রেখে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে শুলো। কিছুক্ষণ পর দুষ্টুর ডাক শোনা গেলো,

‘শুনুন।’

প্রচ্ছদ টান টান হয়ে শুয়ে পরেছিলো। দুষ্টুর নরম মিষ্টি গলার ডাক শুনে সে স্তম্ভিত। ধরফর করে উঠে বললো, ‘বলো।’

‘তুমি কিংবা আপনি যেকোনো একটা ডাকবেন। দয়া করে দু’টো ডেকে কনফিউজড করবেন না। ‘

১০.
স্নিগ্ধ প্রভাতের প্রথম প্রহরে এক ফালি পেলব রোদ্দুর যখন হক বাড়ির দু’তলার ডান পাশের ঘরটার কালো বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে দুষ্টু তখন এক মগ ঠান্ডা পানি এনে প্রচ্ছদের গায়ে আস্তে করে ঢেলে দিলো। গরম গায়ে ঠান্ডা সুরসুরি পেয়ে প্রচ্ছদ আরামে ঘুম দিলো। একটু পর যখন ভেজা খিদখিদে লাগতে শুরু করলো তখন হুড়মুড় করে জেগে বসলো। বিছানা, বালিশের দিকে তাকিয়ে নাক ছিটকে বললো,

‘ইয়াক! কি করলে এটা?’

দুষ্টু বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হেসে বলে,

‘আপনার জন্য আমার গলা ভেঙেছে এখন গলা ব্যথাও করছে। তো শোধ নিতে হবে না? এবার লাগুক ঠান্ডা!’

দুষ্টু বিদ্রুপ করে চলে যেতে নিলেই প্রচ্ছদ ওর চুল টেনে ধরলো। কোমর ছাড়ানো দু’ হাত লম্বা চুলে ব্যাপক টান পরতেই দুষ্টু ব্যথায় চোখ মুখ খিচে তাকালো। প্রচ্ছদ বলল,

‘কাল নিচে শুয়িয়েও শান্তি হইনি তোমার, বেয়াদব মেয়ে। আমি এসব নোংরামি একদম পছন্দ করি না। এক মগ পানি দিয়ে প্রচ্ছদের ঠান্ডা লাগে না। আমি তোমার মতো ননীর পুতুল না।’

‘উফফ লাগছে! চুল ছাড়ুন।’

প্রচ্ছদ চুল ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘যাও, চাদর আর বালিশের কভার সুন্দর করে ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে বারান্দায় নেড়ে দাও।’

দুষ্টু চোখ বাঁকিয়ে বলল, ‘আর যদি না করি?’

বাকা হেসে প্রচ্ছদ সাথে সাথে উত্তর দিলো, ‘তবে ডিভোর্স ক্যান্সেল।’

‘ব্ল্যাকমেইল?’

‘যা মনে করো। নাম দুষ্টু বলে ক্যারেক্টরও কি সেই লাইনে নিয়ে যেতে হবে?’

দুষ্টু নাক ফুলিয়ে তাকালো। এরপর ভীষণ আক্রোশে জড়োপল্টো করে চাদর, বালিশের কভার নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।

১১.
বারান্দায় জায়গা কম বিধায় দুষ্টু ছাদে কাপড় নাড়তে এলো। তখন সকাল সাতটা বাজে। রোদের উত্তাপে তপ্ত ছাদের পাটাতন। ছাদঘরের টিনের চালে রোদের ঝিলিকে ক্রমশ আলো চোখে লাগছে। তাকিয়ে থাকা দায়। চোখ কুচকে রাজ্যের আক্রোশ নিয়ে দুষ্টু বিরবির করতে করতে কাপড় নাড়লো। প্রচ্ছদ তার আগের দিনে পরা প্যান্ট আর টি-শার্টও ধুতে দিয়েছে। দুষ্টুর মাথা রাগে ফেটে যাচ্ছে।

‘কি করছো?’

দুষ্টু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। ছাদে আগমন ঘটেছে নীরার। দুষ্টু এক মুহুর্তের জন্য ভ্রু কুচকে তাকিয়ে মিষ্টি গলায় হেসে বলল,

‘কাপড় নাড়ছি।’

নীরা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলে,

‘ওমা! অর্ধেক ভিজে গেছো দেখছি। আবার তো পরে ঠান্ডা লাগলে আমাদের বাড়ির দোষ দিবে। তা এই সাত সকালে বিছানার চাদর, বালিশের কভার, প্রচ্ছদের প্যান্ট, শার্ট ধুয়ে দিয়েছো কেনো?’

দুষ্টু চোখ ঘুরিয়ে নীরার হাতে ধরে থাকা ছোট বালতি টার দিকে তাকালো। নীরার মতো ভাবভঙ্গি নিয়েই বলল,

‘ওমা! সাত সকালে এতো কাপড় ধুয়েছো কেনো?’

নীরা একবার বালতির দিকে তাকিয়ে আবারো দুষ্টুর দিকে তাকালো। বলল,

‘এসব বাবুর কাপড়। রাতে প্রস্রাব, হাগু দিয়ে শেষ করে ফেলে।’

‘বাব্বাহ!’

‘তুমি এতো সকালে বিছানার চাদর, প্রচ্ছদের প্যান্ট, শার্ট ধুয়েছো কেনো?’

নীরার অতি আগ্রহ দেখে মনে হচ্ছে বিছানার চাদরে, প্রচ্ছদের টি-শার্ট, প্যান্টে স্বর্ণের দলা ছিলো। কাপড় গুলো ধোয়াতে সেই স্বর্ণের দলা পানির সাথে মিশে হারিয়ে গেলো। দুষ্টু বিরবির করলো, ‘কারণ তোমার প্রচ্ছদ বিছানায় হাগু দিয়েছে।’

‘কিছু বললে?’

দাঁত কিড়িমিড়ি করে দুষ্টু আবারো নীরার হাতের বালতি ইশারা করে বলল,

‘শুধু বাবুর কাপড় কোথায়? তোমার আর ভাইয়ার কাপড়ও তো দেখা যাচ্ছে। তোমার চুলও ভেজা। আল্লাহ! এত্তো সকালে গোসল করেছো?’

দুষ্টুর চোখে অবাকতা ঝরে ঝরে পরলো। নীরা একটু অপ্রস্তুত হলো। বলল,

‘আমি সকালেই গোসল করি।’

দুষ্টু ঠোঁট দুটো গোল করে বলল, ‘ওও.. ভাইয়াও ভোরে গোসল করে?’

নীরা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে শুধায়, ‘বিবাহিত স্বামী স্ত্রীরা সকালে কেনো গোসল করে তুমি জানো না? আশ্চর্য মেয়েমানুষ!’

দুষ্টুও ঠোঁট বাকিয়ে বলে,

‘বিবাহিত স্ত্রী চাদর, বালিশের কভার আর তার স্বামীর গেঞ্জি প্যান্ট কেনো ধুয়ে দেয় সেটা তুমি জানো না? অবুঝের মতো বারবার একই প্রশ্ন করে খোঁচাচ্ছো।’

নীরা আহাম্মক এর মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। এই মেয়ে এতো ঠোঁটকাটা? নীরার মনে আছে, ও যখন প্রথম এ বাড়ির বউ হয়ে এলো তখন এক মাস লজ্জায় তেমন কারোর সাথে কথাই বলেনি। আর এই মেয়ে তো….ওর তিন ডিগ্রি উপরে!

বার বার এই মেয়ের কাছে তর্কে, খোঁচায়, কথার জ্বালে হেরে নীরার মন’টা অপমানের বিষে ভরে উঠছে। ক্রোধান্বিত হয়ে বলে,

‘ভারি নির্লজ্জ তো তুমি, মেয়ে?’

দুষ্টু বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো। মিটমিটে হেসে অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল,

‘ওমা! তুমি আমার জা হও তোমার সাথে এসব কথা বলবো না তো আর কাকে বলবো? এসো আমাদের বাসর রাতের গল্প শোনাই তোমাকে। এরপর তুমি তোমার’টা শোনাবে।’

নীরার কান দিয়ে ধোঁয়া উঠলো। চোখ পাকিয়ে ফুসতে ফুসতে দুষ্টুর দিকে তাকালো। সেই মুহুর্তে তাকে দেখা গেলো একদম সাপিনীর ন্যায় আবার কিছুটা রাক্ষসীর ন্যায়। দুষ্টুর হাসি পেলো। নীরা তেজের চোটে উল্টোপাল্টা পা ফেলে চলে গেলো।

চলবে❤️