#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৮
১৭.
আসমানের রং গাঢ় হলো। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়েই নীড় বলল, ‘চলো তোমাকে পৌঁছে দেই।’
দুষ্টু আমতা আমতা করে বলল, ‘কি দরকার? এমনিতেই তুমি অসুস্থ।’
‘নাহ চলো। অনেকদিন হলো তোমার সাথে রিক্সায় চড়ি না। তোমার বাসার সামনের জামরুল গাছটার নিচে দাঁড়িয়েও থাকি না অনেকদিন হলো।’
দুষ্টু কেমন করে যেনো চাইলো। নিজেকে বলহীন, দুর্বল, অসহায় লাগলো। নীড়ের ঠোঁট থেকে হাসি সরছে না। প্রেয়সীকে দেখে এতোদিনের খরার বুকে বৃষ্টি হয়েছে। রোদের ঝিলিকে দুষ্টু কপালে হাত রেখে চোখ ঢেকে বলল,
‘আমি তো বাসায় যাবো না।’
নীড় অবাক হলো, ‘বাসায় যাবে না?’
‘না।’
‘কোথায় যাবে তাহলে?’
‘ওই তো… ওই একটু শপিং এ যাবো।’
দুষ্টুর তোতলানো স্বর। শ্রেয়সী ফোন থেকে চোখ তুলে চোখ রাঙিয়ে কিছুটা আশ্চর্যবোধ থেকে বলল,
‘তুই আমাকে ছাড়া শপিং এ যাবি? কখনো তো যাস না।’
দুষ্টু নিচুস্বরে দুরুদুরু বুকে বলে, ‘কাজিনের সাথে যাবো। আমার কাজিন মিতার সাথে। আম্মুও যাবে নাকি!’
কথাগুলো বলেই চোরাচোখে দুষ্টু শ্রেয়সীর দিকে তাকালো। শ্রেয়সী কোনো উত্তর করলো না। দুষ্টু আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
‘তোর যদি কিছু কেনার থাকে তবে চল, যাই।’
‘লাগবে না। আমার কিছু কেনাকাটার নেই। তুই যা।’
১৮.
ভারী পবনের ধুলোমাখা বাতাসের বিপক্ষে হেটে আসা দায়। শ্রেয়সীর গলায় ফেলে রাখা স্কাপটা বারবার পরে যাচ্ছে। বাতাসে উড়ে চলে যেতে চাইছে। চোখে নাকে বালি ঢুকছে। তাকানো কঠিন। কয়েকবার হাচ্চি উঠেছে। সে বিরক্ত চোখে তাকালো আশেপাশে। ঝড়ো বাতাস দেখে মনে হচ্ছে খানিক বাদেই ভয়ংকর বৃষ্টি নামবে। চটজলদি পা চালিয়ে কনফেকশনারি দোকানের দিকে গেলো। মা আসার সময় কানের কাছে পইপই করে বলে দিয়েছে, আসার সময় চার হালি ডিম কিনে আনতে আর একটাও যদি ভেঙে যায় তবে ওর খবর আজ টিভির হেডলাইনে উঠবে। ডিম সবগুলো ওর মাথায় ভাঙা হবে!
খানিক বাদে দোকানে গিয়ে দাঁড়াতেই শ্রেয়সী চকলেট কিনলো। বোনের জন্য একটা নিলো। এরপর দুটো চিপস, কয়েকটা বিস্কুটের প্যাকেট আর কিছু ক্যান্ডি কিনে ব্যাগে ভরলো। পাশেই চায়ের দোকান। পাক্কা ছয় মিনিট পর তার চা এলো ! চা’য়ে চুমুক দিতে দিতে প্রায় ভুলতে বসলো দোকানে আসার মূল কারণ। চায়ের কাপ’টা মুখের সামনে ধরে কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে ভাবলো। মাথায় হাত দিয়ে বিরবির করলো,
‘কেনো জানি এসেছিলাম দোকানে? কেনো? কেনো..? ধুর, মনে পরছে না কেনো?’
তখনি ঝুম বৃষ্টি তেড়ে এলো। ঝমঝমঝম! তুখোড় ধ্বনি তুলে মিশে গেলো দূরের বড় পুকুরের সাথে। নর্দমার পঁচা পানির সাথে। মাটি ভেজালো। ধুলোময় বাতাস ভিজে শান্ত হলো। ভিজলো শ্রেয়সীর জামার একাংশ। সে সরে দোকানের ছাউনির আরেকটু ভেতরে দাঁড়ালো। বিরক্তিকর চোখে আপসোস করে বলল,
‘এখনি বৃষ্টি আসতে হলো? আমি কি নিতে এসেছিলাম তাই তো ভুল গেলাম?’
পাশ থেকে তখন কোনো এক পুরুষ হন্তদন্ত হয়ে এসে ব্যস্ত স্বরে দোকানদারকে বলল, ‘মামা তাড়াতাড়ি দুই হালি ডিম দেন। বৃষ্টির জোর বাড়ছে।’
শ্রেয়সীর চা শেষ। সে এখন চকলেট ধরেছিলো। আগুন্তকের কথায় তার ঠোঁট প্রস্ফুটিত হলো। এই তো! ডিম! ঠোঁট আলগা করে হাসি দিয়ে যখন সে পাশে তাকালো সেকেন্ড কয়েকের জন্য তার চোখ থমকালো। ঠোঁট ভিজলো আচমকা বৃষ্টির ছিটায়। সে দেখলো, এক বৃষ্টি ভেজা পুরুষ মাথা কাৎ করে তার আধ ভেজা চুল ঝাড়তে ঝাড়তে করুণ দৃষ্টিতে বৃষ্টির দিকে মনোনিবেশ করেছে। মোটা লালচে ঠোঁটে একটু পরপর বিরবির করছে। জীবনে এই প্রথমবার বুঝি শ্রেয়সী কোনো ছেলের দিকে অপলক চেয়ে রইল। এই প্রথমবারের মতোন তার মনে হলো,
‘বৃষ্টি ভেজা পুরুষও বুঝি হয়?’ ভেবেই সে নিঃশব্দে হাসলো। অজানা পুরুষ’টির দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
‘থ্যাংকস আ লট!’
প্রযুক্ত বিব্রত চোখে ঘুরে তাকালো। সামনের কোনো এক অল্প-বিস্তর সুন্দরী রমণীর মুখে হঠাৎ ধন্যবাদ শুনে রীতিমতো চমকে উঠলো। জোরপূর্বক হেসে বলল,
‘থ্যাংকস ফর হুয়াট?’
শ্রেয়সী বলতে গিয়ে হেসে ফেলল। প্রযুক্ত তখনও অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলো। মেয়েটা হাসলে নাক কুচকে যায়। চোখ প্রসারিত হয়। সুন্দর লাগে! সে মেয়েটাকে হাত বাড়িয়ে বলতে শুনলো,
‘হাই, আই এম শ্রেয়সী।’
প্রযুক্ত একবার হাতের দিকে তাকিয়ে আবারো মেয়েটার মুখের দিকে তাকালো। এরপর ফর্সা, আদুরে চেহারার মেয়ে’টির হাত অনায়াসে ধরে বলল,
‘প্রযুক্ত।’
শ্রেয়সী ঠিকমতো শুনলো না। জিজ্ঞেস করলো আবার, ‘সরি?’
প্রযুক্ত মাথা চুলকে হেসে বলে, ‘একচুয়েলি মাই নেম প্রযুক্ত।’
শ্রেয়সী একটু অবাকতায় হেসে বলল, ‘ইউনিক নেইম।’
‘থ্যাংকস। বাট তখন ধন্যবাদ জানালেন কেনো বললেন না তো?’
‘আসলে আম্মু আমাকে ডিম আনতে বলেছিলো। রাস্তা দিয়ে মনে করতে করতে দোকানে এসে হাবিজাবি কিনতে কিনতে ভুলে গিয়েছি। আপনি এসে দোকানদারের কাছে ডিম চাইতেই মনে পরলো।’
প্রযুক্ত ঠোঁট গোল করে ‘ও’ বলল। খেয়াল করলো মেয়েটার হাতে চকলেট। ঠোঁটের বাম পাশে চকলেট লেগে ছড়িয়ে গিয়েছে। প্রযুক্ত ভ্রু উচিঁয়ে বলল,
‘আপনার মুখে চকলেট।’
শ্রেয়সী ব্যাগ থেকে ছোট আয়না বের করলো। টিস্যু দিয়ে ঠোঁট মুছে আয়না আবার ব্যাগে রাখলো। প্রযুক্ত বাকাঁ হেসে বলল,
‘মেয়েদের ব্যাগে অলওয়েজ সাজগোছের আইটেম থাকবেই। এটা যেনো নিয়ম!’
‘থাকতে হয়। ইট’স ইম্পোর্টেন্ড ফর গার্লস। যদি ছেলেরা সাজগোজের অধিকার পেতো তবে তাদেরও একটা করে সাইড ব্যাগ থাকতো এবং সাজগোজ করার জিনিস থাকতো।’
প্রযুক্ত ঘাড়ে হাত দিয়ে অনিচ্ছাবশত ঠোঁট টানলো, ‘ভেরি স্মার্ট।’
দোকানদার প্রযুক্তর হাতে ডিম এনে দিলো। দোকানদারকে টাকা দিয়ে শ্রেয়সীর উদ্দেশ্যে সে বলল,
‘আই হেভ টু গো নাও। নাইছ টু মিট ইউ।’
শ্রেয়সী জোর করে হাসলো। হালকা গলায় বলে, ‘বায়।’
বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দোকানের ছাউনি থেকে বের হতেই পেছন থেকে আকস্মিক চিৎকার ভেসে এলো। প্রযুক্ত ভীত দৃষ্টিতে ঘাড় ফেরালো। দেখলো, শ্রেয়সী ব্যাগ হাতড়াচ্ছে আর চিল্লিয়ে বলছে,
‘ওহ মাই গড, মাই ফোন! আমার ফোন কোথায়?’
প্রযুক্ত আবার এগিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে?’
শ্রেয়সী মুখে যতটা সম্ভব দুঃখ ফুটিয়ে বলল, ‘আমার ফোন’টা পাচ্ছি না।’
প্রযুক্ত বলল, ‘ওহ। ব্যাগেই আছে হয়তো খুঁজে দেখুন।’
শ্রেয়সী খুঁজতে খুঁজতে ব্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘পাচ্ছি না তো।’
মিনিট দুয়েক পর প্রযুক্তের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আপনার ফোন’টা কি একবার দেওয়া যাবে?’
‘হ্যাঁ?’
শ্রেয়সী প্রযুক্তর হাতের ফোন’টার দিকে ইশারা করে ভ্রু নাচিয়ে বলল, ‘আপনার ফোন’টা? দেওয়া যাবে?’
প্রযুক্ত নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে যেনো ঘোর থেকে ফিরে বলল, ‘ওহ! অফকোর্স। নিন।’
সে ফোন এগিয়ে দিলো। শ্রেয়সী নিজের নাম্বারে ডায়াল করতেই ফোন’টা তার ব্যাগেই বেজে উঠলো। চোরাচোখে তাকিয়ে জোরপূর্বক স্মিত হাসলো। দোকানদার’কে বলল,
‘মামা পাঁচ হালি ডিম দেন। তাড়াতাড়ি।’
ফোন’টা ব্যাগ থেকে বের করে ফোনের দিকে তাকিয়েই শ্রেয়সী ক্যাবলা কান্তের মতো হাসলো। এরপর ছন্নছাড়া গলায় বলল,
‘ফোন। আমার ফোন।’
প্রযুক্ত গোপনে হাসে। ভ্রু বাকিয়ে তাকিয়ে বলে, ‘জি। এটা তো আপনারই ফোন। হারায়নি তো।’
‘হ্যাঁ। আমার’ই তো। ব্যাগেই ছিলো। আসলে অনেক চিপস চকলেট কিনেছি তো ওগুলার নিচে পরেছিলো। তাই খুঁজে পাইনি।’
প্রযুক্ত মিটিমিটি হাসলো। শ্রেয়সী অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। যাওয়ার আগে বৃষ্টি ভেজা পুরুষটি ধীরস্বরে বলে গেলো,
‘কমন টেকনিক। ডোন্ট ট্রাই টু বি আ ওভার স্মার্ট।’
তার যাওয়ার পানে শ্রেয়সী তাকিয়ে থাকলো কতক মিনিট। এরপর হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হেসে দিলো। কী নির্লজ্জের মতো একটা কাজ করে বসলো! যদিও তার লজ্জা সরম একটু কম। দোকানদারকে টাকা দিয়ে শ্রেয়সী আবার হাসলো। নাক কুচকালো। চোখ প্রসারিত হলো। অতঃপর ডিমের দিকে তাকিয়ে গুনতেই চোখ বড় বড় করে ধমকে দোকানদারকে বলল,
‘এই মামা, চার হালি চেয়েছি।’
দোকানদার রেগে গেলো,
‘ফাপরবাজি করেন? পাঁচ হালি ডিম চায়ে চার হালি কন?’
‘আমি চার হালি চেয়েছি। আপনি আমার এক হালির টাকা ফেরত দেন। আর এক হালি ডিম কমান।’
‘কিয়ের কমানি? আমার দোকান থেকে কেউ একবার কিছু নিয়ে গেলে পরে আর ফেরত নেওয়া হয় না টাকাও ফেরত দেওয়া হয় না। দোকানের দেওয়ালে লেইখে রাখছি। দেহেন। তয় আপনি যদি এক হালি ডিম রাইখা যাইতে চান তাইলে রাইখা যান। কিন্তু টাকা পাইবেন না।’
‘আপনি তো দেখি বহুত ছ্যাচড়া।’
‘হ, আমি ছ্যাচড়া আর আপনি জাত ছ্যাচড়া।’
শ্রেয়সী বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। এরপর এক দু’ ঘন্টা চলবে তাদের মাঝে বিশাল ঝগড়া কিংবা বাকবিতণ্ডতা কিংবা যুদ্ধ। যে যেটা বলতে ইচ্ছুক!
চলবে❤️
#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৯
১৯.
মল থেকে বের হয়ে দুষ্টু টেনেটুনে হিজাব ঠিক করলো। উত্তাপ রোদে চোখ কুচকে এদিক ওদিক চাইলো। প্রচ্ছদ বিল পে করে ওর পাশে এসে দাঁড়াতেই সে তেজ নিয়ে বলল,
‘আমি আপনাকে শাড়ি কিনতে বলেছিলাম? আমি কি শাড়ি পড়ি? বিয়েতে কত শাড়ি কেনা হয়েছে আর কত শাড়ি উপহার পেয়েছি জানেন? আবার আপনি শাড়ি কিনেছেন কেনো?’
প্রচ্ছদ পাত্তা না দেওয়ার ভঙ্গিতে গাড়ির লক খুলতে খুলতে বললো, ‘আমার পছন্দ হয়েছে আমি কিনেছি।’
দুষ্টু সাদা চকচকে গাড়ি’টায় উঠে বসে বলে,
‘পছন্দ হলেই কিনতে হবে? টাকাগুলো নষ্ট হলো না? এতো শাড়ি দিয়ে আমি কি করবো?’
প্রচ্ছদ বিরক্তে কপাল কুচকে তিক্ততার সহিত ঝাঁঝালো স্বরে বলল,
‘শুনুন, ইচ্ছে হলে পরবেন তা নাহলে পরবেন না। রেখে যাবেন। তিনমাস পর যখন আপনি চলে যাবেন তখন আমার নতুন বউ এসে পরবে। এক্সট্রা আর কেনাকাটা করতে হবে না।’
গাড়ি হক বাড়ির উদ্দেশ্যে পথ ধরছে। প্রচ্ছদ তুমি থেকে আপনিতে নেমেছে। দুষ্টু চোখ তুলে তাকালো। প্রচ্ছদের বিরক্ত মুখ’টার দিকে তাকিয়ে থাকলো ক্ষণকাল। এই ধারালো, গম্ভীরমুখো মানুষ’টাকে ছেড়ে যাওয়ার পর হয়তো দুষ্টুর কষ্ট হবে না তবে সারাজীবনের জন্য মনের মাঝে একটা দাগ কেটে যাবে। দাগটা কালো হবে না, হবে সাদা। কোনো একদিন নিজের অমতের এমন প্রহরে বিয়ে করা হয়েছিলো যে… সেদিন থেকেই আজীবন লোকটার রেশ দুষ্টুর মনের কোথাও একটা থেকে যাবে। ভালোবাসা নয়… ভালোলাগা নয়.. প্রেম নয়.. মায়া নয়.. কেমন যেনো এক অনুভূতি… বিয়ে বিয়ে সম্পর্ক! যে সম্পর্কের কথা আজীবন দুষ্টুর মনে থাকবে। থাকতে হবে!
গরমের উত্তাপে তখন প্রচ্ছদের গৌরবর্ণ মুখ’খানায় রক্তিম রেখা প্রদর্শন করেছে। প্রশস্ত বুক, চওড়া কাধ, পেটানো শরীরে আষ্টেপৃষ্টে জড়ানো মেরুন রঙের শার্ট। কপালে দু’তিনটে কুঞ্চন। রাগের না বিরক্তের বোঝা দায়! দুষ্টু অন্যদিকে ফিরলো। নিচু স্বরে বলল,
‘উকিলের সাথে দেখা করেছিলেন?’
প্রচ্ছদের ছোট উত্তর, ‘হু।’
‘কি বলল?’
‘দুই তিনদিনের মধ্যে কোর্টে আবেদন করা হবে।’
দুষ্টুর মুখ উজ্জ্বল হলো। উৎফুল্লতার গলায় চিৎকার ভেসে এলো, ‘সত্যি?’
গাড়ির গতি ধীর হলো। প্রচ্ছদ এক ঝলক দুষ্টুর দিকে তাকালো। একটু কি অবাকতা ছিল তার চোখে? বুকের মাঝে কেমন ধরনের এক শূন্যতা নাকি বিস্ময়তা! এতো খুশি মেয়েটা? প্রেমিক’কে এতোটা ভালোবাসে?
২০.
শুভ্র রোশনাই কালোতে রূপান্তরিত হলো। কৃষ্ণবর্ণ আকাশ চাঁদের জেল্লায় আমোদিত হলো। রূপোর কিরণ মেঘকে করে তুললো রৌপ্য ধরণের। কালো অন্তরীক্ষে শুভ্রতার পথ চলন। হক বাড়িতে সেসময় প্রযুক্তর খাতিরযত্ন চলছিলো। প্রযুক্তর পাশে বসা প্রচ্ছদ। তাদের সামনাসামনি বসে আছে সিড়িন হক। বাম পাশে হাস্যোজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে টিয়া। সন্ধ্যার নাস্তায় ছিলো অনেক কিছু। প্রযুক্তের হাতে ধরা এখন এক কাপ কফি এবং হোয়াইট সস পাস্তার বাটি। ডান পাশের সোফায় বসা ছিলো সবুজা হক এবং নীরা। নীরা সচেতন দৃষ্টিতে ভ্রু কুটি করে একবার টিয়া আরেকবার প্রযুক্তর পানে তাকাচ্ছিলো। টিয়ার এতো ঔজ্জ্বল্যতা একমাত্র প্রযুক্ত বাড়িতে এলেই প্রকাশ পায় সাথে সাথে বৃদ্ধি পায়। এদিক সেদিক তাকাতেই টিয়া আর নীরার চোখাচোখি হলো। টিয়ার মনটা আতংকের সুর তুলল সাথে ভীষণ বিরক্তিকরতায় বিষিয়ে উঠলো। এই পুরো দৃশ্যপটে খুঁজে পাওয়া গেলো না দুষ্টুকে।
টিয়া আড়চোখে আরেকবার নীরার দিকে তাকাতেই আবারো চোখাচোখি হলো। এবার রাগ হলো। নাক ফুলিয়ে বলল,
‘ভাবী যান না! দেখেন আকাশ’কে বোধ হয় মশা ধরছে। সন্ধ্যা বেলা! ঘরের জানালা, বারান্দার দরজা বন্ধ করেছিলেন?’
সবুজা হক চোখ পাকিয়ে পুত্রবধূর দিকে তাকালেন। তিনি সাদাসিধা, সোজাসাপ্টা মানুষ কিন্তু তার নাতির সাথে নো কম্প্রোমাইজ। নীরা তাড়াতাড়ি আসন ছেড়ে উঠলো। ঘরের দিকে একপ্রকার দৌড়ে চলে গেলো। টিয়া গিয়ে নীরার জায়গা’টায় বসতেই সবুজা হক জিজ্ঞেস করলেন,
‘তোর পড়া নেই?’
টিয়ার বিরক্তি এবার আকাশ ছুলো। মায়ের দিকে কপাল কুচকে তাকালো। একটু শান্তি মতো বসে সামনে থেকে পুলকিত নয়নে দীর্ঘ সময় মানুষটাকে দেখবে তার জো নেই। একটার পর একটা ঝামেলা। টিয়ার কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে হলো এবং সাথে সাথে মনস্থির করলো, দুনিয়া উল্টে গেলেও এ স্থান থেকে নড়বে না সে আর পড়তেও বসবে না। কিন্তু পরক্ষণেই যখন প্রযুক্ত বলল,
‘টিয়া সকালে যেই চ্যাপ্টার’টা বুঝিয়ে ম্যাথ দিলাম। সেই ম্যাথ গুলো সলভ করেছো? এখন গিয়ে তাড়াতাড়ি করো। আমি কিছুক্ষণ আছি। যেগুলো পারবে না। রেখে দিবে। যাওয়ার আগে বুঝিয়ে দিয়ে যাবো।’
টিয়ার তখন ঠোঁটে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটলো। মেঘ না চাইতেই জল। টিয়া মূহুর্তে গলে গলে পড়লো। এক দৌড়ে ঘরে গিয়ে পড়তে বসলো। ভেঙে গেলো আজকের শপথ, সংকল্প, জেদ। মানুষ’টার কাছে যেনো সবকিছুই তুচ্ছ!
প্রচ্ছদ প্রযুক্তকে ঠেস দিয়ে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
‘বিয়েশাদি কিছু করবি না নাকি?’
প্রযুক্ত হালকা হেসে খোঁচা দিয়ে বলল,
‘করে কি হবে? বন্ধু বিয়ে করেই পর হয়ে গেলো। আমার আর পর হওয়ার ইচ্ছে টিচ্ছে নেই।’
প্রযুক্তর কণ্ঠে হতাশা ঝরে ঝরে পরে। প্রচ্ছদ উঠে চলে আসতেই দেখা গেলো, সিড়ি দিয়ে অর্জন ইরাকে ধরে ধরে নামাচ্ছে আর ইরা বারংবার বলছে,
‘আরে, আমি একাই চলতে ফিরতে পারি। এখনি ধরে ধরে নামাতে হবে না।’
প্রযুক্ত এগিয়ে গেলো। অর্জন থেকে ইরার এক হাত নিয়ে নিজে ধরে চোখ টিপে বলল, ‘মাত্র তো দু’ মাস। এখনি এ অবস্থা? বউকে এতো চোখে হারাও?’
অর্জন হাত উঠিয়ে বলে, ‘যাহ ভাগ।’
ইরাকে ধরে সোফায় বসালো। সিড়িন হক উঠে নিজের ঘরের দিকে গেলেন। অর্জন এসে তার জায়গায় স্থান নিলো। প্রযুক্ত ইরার কোলে মাথা রেখে টান টান হয়ে সোফায় শুয়ে পরলো। তৎক্ষণাৎ অর্জন চোখ পাকিয়ে বলে,
‘ওই উঠ, আমার বউয়ের কোল। শুধু আমার অধিকার।’
প্রযুক্ত ত্যাড়া গলায় বলে, ‘আমার ডাবল অধিকার।’
‘ভাই, উঠ! ব্যথা পাবে তো।’
অর্জনের অসহায় কণ্ঠ। ইরা শব্দ করে হেসে প্রযুক্তের কপালে চুমু দিলো। তার শরীরে দুষ্টুর কিনে আনা সুতি শাড়ি। প্রযুক্ত ইরার হাত ধরে মুচকি হেসে বলল,
‘কেমন আছো আপু?’
ইরা নিরব গলায় বলল, ‘ভালো। অনেক ভালো। বাবা-মা কেমন আছে?’
‘ভালো আছে।’
অর্জন ইরার দিকে তাকিয়ে ভঙ্গি করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
‘তুমি ওর কপালে চুমু দিলা কেন? কই আমি চাইতেও তো দেও না। এই শালা, তুই আমার বউয়ের কোল থেকে উঠবি নাকি?’
‘না দুলাভাই।’
ইরা আবারো শব্দ করে হাসলো। জিজ্ঞেস করলো, ‘খেয়েছিস কিছু?’
‘হুম, অনেক কিছু।’
২১.
বারান্দার পাল্লা খোলা। দুপুরে বৃষ্টি হওয়ার পর বিকেল থেকে ঠান্ডা হাওয়া। হিম ধরে যাচ্ছে শরীরে। আজ শরতের শেষ দিন। কাল থেকে পরবে নতুন মাস কার্তিক। নরম সূর্যরশ্মি হেমন্তকালের শুরু। শীতের আগমন বার্তা। প্রচ্ছদ সারা ঘরে চোখ বুলিয়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ালো। বারান্দার পাশেই বেড়ে উঠা কাঠগোলাপ গাছ থেকে ভেসে আসছিলো মিষ্টি সুগন্ধ। গাছের নিচে সাদা হলুদ মিশেলে ফুলের হাট। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মুঠো ভরতি করে কাঠগোলাপ ছিড়তে ছিড়তেই কথোপকথন সারছিলো দুষ্টু। প্রচ্ছদ আস্তে করে ওর কাঁধে হাত রাখলো। দুষ্টু চমকে উঠে প্রায় সাথে সাথেই কল কেটে পেছন দিকে ঘুরে তাকালো। প্রচ্ছদকে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলো,
‘মুখে কথা বলতে পারেন না? গায়ে টাচ করেন কেনো?’
প্রচ্ছদ অবাক হয়ে পরলো, ‘কারোর উপকার করতে নেই। ভাবলাম তোমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছো এর জন্য আমি এসে কথা না বলে টাচ করেছি।’
দুষ্টু আমতা আমতা করে বলল, ‘সরি। কিন্তু বয়ফ্রেন্ড আবার কি? বাজে লাগে কানে।’
প্রচ্ছদ চোখ উল্টিয়ে বলল, ‘তুমি তো আর নাম বলোনি।’
‘এতো নাম শুনতে হবে না। ডাকছিলেন কেনো?’
‘ নিচে চলো। আমার বন্ধু এসেছে। দেখা করবে।’
‘পারবো না।’
প্রচ্ছদ বিস্ময় নিয়ে তাকালো। দুষ্টুর সাইলেন্ট ফোনে আলো দেখা গেলো। ফোন রিসিভ করে বলল,
‘একটু পরে ফোন দিচ্ছি। বাবা ডাকছে।’
ফোন কেটে দিতেই প্রচ্ছদ বলল, ‘এতো মিথ্যে কথা কেনো বলো? এই মিথ্যে কথার জন্য একদিন খুব পস্তাবে।’
দুষ্টু তেড়ে গিয়ে বলল, ‘আপনার জন্যই তো এসব হয়েছে। আপনি আমাকে বিয়ে না করলে এসব হতো নাকি?’
দীর্ঘশ্বাস বাতাসে ছেড়ে আবারো নিজের মাঝে টেনে নিলো প্রচ্ছদ। বলল, ‘হুম, সব দোষ আমার। নিচে চলো। প্রযুক্ত অপেক্ষা করছে।’
‘বলছি না পারবো না! আমার এখন অপরিচিত কারোর সাথে দেখা করার মুড নেই।’
প্রচ্ছদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘বাড়াবাড়ি করছো কিন্তু। ফল খুব খারাপ হবে। ও আমার বেস্টফ্রেন্ড তার চেয়েও বড় কথা বড় ভাবীর ভাই।’
দুষ্টু চোখ বড় বড় করে তাকালো। ঠোঁট উল্টে বলল,
‘তাই নাকি? তবে তো দেখতে হয়। চলুন। চলুন।’
চলবে❤️