এমন একদিন সেদিন পর্ব-১০+১১

0
3

#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১০
২২.
প্রচ্ছদ ওর বউকে ডাকতে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই প্রযুক্তর ডাক পরলো। ইরার কোল থেকে মাথা উঠিয়ে সে সোজা হয়ে বসলো। কাজের মেয়েটা এসে বলে গেলো,

‘টিয়া আফামনি আফনেরে ডাহে।’

ইরা ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

‘টিয়া তোকে ডাকছে? পড়ার বিষয়ে নাকি? আসার সময় তো ওকে পড়তে বসতে দেখলাম।’

প্রযুক্ত মাথা ঝাঁকালো। অর্জনের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত মুখে বলল,

‘এখনি ডাকাডাকি কেনো করছে? আমি বলেছি যাওয়ার আগে প্রবলেম সলভ করে দিয়ে যাবো। শুনো, আমি আমার বোনের দেখভাল করি আর তুমি তোমার বোনের সমস্যার সমাধান করো গিয়ে, যাও।’

অর্জন ত্যাড়া গলায় বলে, ‘আমার বউয়ের দেখভাল তোর করার লাগবে না, শালা। তুই যা।’

প্রযুক্ত বিরক্ত মুখেই উঠে দাড়ালো। যেতে যেতে বলল,

‘তোমার বোন একটা মাথামোটা। ভার্সিটিতে গেলেও ডাকাডাকি। এই চ্যাপ্টারে সমস্যা, ওই চ্যাপ্টারে সমস্যা। বেড়াতে এসেছি, সেখানেও ডাকাডাকি। বিয়ে দিয়ে বিদায় করো তো তোমার বোনকে।’

টিয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে পাউডার লাগালো। ঠোঁট হালকা গোলাপি করে গায়ে সুগন্ধি মাখালো। এরপর চুল ঠিক করে এসে পড়ার টেবিলে বসলো। প্রযুক্ত এসে গম্ভীর মুখে বলল,

‘আমি বলেছিলাম যাওয়ার আগে প্রবলেম সলভ করে দিবো।’

টিয়া মাথা দুলিয়ে বলল, ‘আমার এখন পড়ার মুড হয়েছে। তখন পড়ার মুড নাও থাকতে পারে।’

প্রযুক্ত ভ্রু কুচকে ভরাট স্বরে বলল, ‘ছাত্রজীবনে পড়ার মুড থাকবে না তো আর কীসের মুড থাকবে?’

টিয়া মন’কে বলল ‘আপনার প্রেমে পড়ার মুড।’ সে আড়চোখে তাকালো,

‘আপনি কি শুধু আমার সাথেই এমন গম্ভীর সুরে কথা বলেন?’

‘কেনো তুমি কি স্পেশাল কেউ?’

প্রযুক্তের গলা শক্ত। টিয়ার কষ্ট হলো। ম্যাথ বোঝানো শুরু হলো। খানিক বাদেই প্রযুক্তর ফোন এলো। পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে দরাজ গলায় বলল,

‘এই ম্যাথ টা কর।’

টিয়া অংক কষতে কষতেই আড়চোখে প্রযুক্তের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

‘হ্যালো, হ্যালো। কে বলছেন?’

ফোন কানে ধরে বারংবার হ্যালো হ্যালো করা হলো। মিনিট দুয়েক পরেই দুজন রমণী হেসে উঠে ফোন কেটে দিলো। প্রযুক্ত চিন্তিত ভঙ্গিতে ফোন রাখতেই টিয়া সতর্কিত কণ্ঠে শুধালো,

‘কে ফোন দিয়েছিলো?’

‘অপরিচিত নাম্বার। মেয়েদের হাসির শব্দ শোনা গেলো শুধু।’

টিয়ার হাত থেকে কলম পরে যায়। মুখটা কিঞ্চিৎ হা হয়ে গেলে সে উচ্চস্বরে তেজের ছাটে বলল,

‘নিশ্চয়ই আমাদের ক্লাসের ফাজিল কিছু মেয়ে এসব করছে। আপনি নাম্বার’টা আমাকে দিন। আমি দেখছি।’

‘দরকার নেই। অংক করো।’

‘আরে দিন। আপনি জানেন না আমাদের ক্লাসের কিছু বেয়াদব মেয়ে আপনার আর ভাইয়ার প্রতি ক্রাশড। আপনাদের সাথে একটা সুযোগ করিয়ে দেওয়ার জন্য সর্বদা আমাকে খোঁচায়।’

প্রযুক্ত অপ্রস্তুত হলো। যতই হোক টিয়া তার ছাত্রী। ছাত্রীর বাইরে পারিবারিক সম্পর্ক থাকলেও এহেন কথা বলার মতো সখ্যতা তাদের ভেতর কোনোকালেই ছিলো না। অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে টিয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই প্রচ্ছদের ডাক এলো। প্রযুক্ত হাফ ছেড়ে বেঁচে তাড়াতাড়ি উঠে চলে গেলো।

২৩.
তমসার ধূম্রজালে চারিদিক গভীর শর্বর। ঝিঁঝি পোকার হালকা আওয়াজ ভেসে যাচ্ছে দূর দূর… দূরান্তে। পাশের বিল্ডিং থেকে গানের আওয়াজ ভেঙে ভেঙে অল্প-বিস্তর ভেসে আসছে। তিন-চারটে গলা একত্রে রেওয়াজে সুর তুলেছে। বারান্দার নীল বাতির রওশনে পাশ ঘেঁষে বেড়ে উঠা কাঠগোলাপ গাছ’টার রঙেও নীলচে বর্ণ ঝিলিক দিয়ে চোখে লাগছে। লোরের স্রোতে চোখ ভেসে গেছে আরো বহুক্ষণ আগে৷ হঠাৎ নিস্তব্ধ সেই নীলচে তিমির ভেদ করে প্রচ্ছদের কণ্ঠ শুনতেই দুষ্টু তড়িঘড়ি করে চোখ মুছলো। প্রচ্ছদের দিকে ঘুরে বলল,

‘বলুন।’

তার ফোলা চোখ, অসম্ভব লাল। টসটসে চোখ দুটো দিয়ে গড়িয়ে পরবে আবারো নোনতা নীর। প্রচ্ছদ তাকিয়ে থাকলো মিনিট কতক। ওই বড় বড় পল্লব বিশিষ্ট সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত প্রগাঢ় সুকান্ত টইটম্বুর চোখ জোড়া যেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরতম নয়ন। এর থেকে সুন্দর চোখ হতেই পারে না… এর থেকে সুন্দর আনন এই মহাবিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। প্রচ্ছদ হাত বাড়ালো না। অপ্রিয় নীর মুছে দিলো না। পলকবিহীন নেত্রে শুধু চেয়ে রইল। দুষ্টুর সিক্ত কোমল নরম হয়ে আসা চোখের চাহনি বুঝলো না প্রচ্ছদের থমকে যাওয়ার কারণ। খানিক বাদে প্রচ্ছদ খুব সতর্কে চক্ষুদ্বয় সরালো। কি আশ্চর্য! কাঁদতে তো দুষ্টুকে এর আগেও দেখেছে। কখনো তো এমন’টা হয়নি নাকি মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করা হয়ে উঠেনি? প্রচ্ছদ আবারো তাকালো অতঃপর চোখ সরালো। এরপর আবার যখন তাকালো তখন তাকিয়েই থাকলো। তার অবাধ্য মন আকস্মিক দুষ্টুকে হতচকিত করে বলে উঠলো,

‘আপনি সবসময় কাদঁবেন, দুষ্টু। কাঁদলে আপনাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুরূপা, রূপিণী, বরাঙ্গনা বলে বোধ হয়। এতোটা সুন্দর দেখায় যে বোধ হয়…. রূপকথার দেশের হাজারো লাল-নীল পরি মিলে আপনি একজন।’

দুষ্টু বড় করে চোখের পলক ফেলল। কেমন ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে! হাত নাড়লো প্রচ্ছদের চোখের সামনে।

‘কি বলছেন এসব?’

প্রচ্ছদ নিচুস্বরে বলে, ‘এভাবে কাদঁবেন না। আপনার ওই নিষ্ঠুর নীরের অতলস্পর্শী চোখ আমার অন্তরিন্দ্রিয় ছিন্নভিন্ন করে দেয়!’

দুষ্টু শুনলো না সে প্রচ্ছদের বাহুতে থাপ্পড় দিলো। ঝাঁঝ নিয়ে বলল,

‘হা করে কি বিরবির করছেন?’

প্রচ্ছদ সেসব অসংজ্ঞায়িত চিন্তা ভাবনা থেকে চমকে বেরিয়ে ছন্নছাড়া গলায় বলল,

‘হুম? কই? কিছু না তো।’

দুষ্টু উল্টোদিকে ঘুরলো। নিরবিচ্ছিন্ন কণ্ঠে বলল,

‘তাহলে চলে যান।’

প্রচ্ছদ এদিক ওদিক তাকিয়ে দুষ্টুর উদ্দেশ্যে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো, ‘কি হয়েছে?’

দুষ্টু নাক টেনে বলল, ‘আপনি জেনে কি করবেন? চলে যান।’
‘কিছু করতে না পারি, শুনতে তো পারবো।’
‘দরকার নেই।’
‘বলো, দেখি শুনি।’

দুষ্টু পেছন ঘুরে প্রচ্ছদের দিকে তাকালো। বলতে গিয়ে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠলো। এবার ভালো দেখালো না। সুন্দর লাগলো না। ভীষণ কষ্টের কান্নায় প্রচ্ছদেরও কষ্ট হলো। প্রচ্ছদ দুষ্টুর চোখ মুছে দিতে গিয়েও পিছিয়ে এলো। অধৈর্য্য কণ্ঠে বলল,

‘দুষ্টু, চোখ মুছো। কাদঁছো কেনো? এভাবে কেউ কাঁদে নাকি, বোকা?’

দুষ্টু হেচকি তুলে বলল, ‘আমি বাসায় যাবো।’

প্রচ্ছদের ভ্রু’জোড়া বেঁকে গেলো। দুষ্টুকে এক লহমায় দেখেই প্রযুক্ত যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলো, জান কয়লা হয়ে যাবে এই মেয়েকে সামলাতে সামলাতে। ধুরন্ধর মেয়েমানুষ! বিনিময়ে প্রচ্ছদ তাচ্ছিল্য হাসি দিয়েছিলো। সেই হাসি এই অর্থ বহন করে যে, ‘তিন মাসে আর কি জান কয়লা হবে?’

কিন্তু এই নিরব নিস্তব্ধ গভীর সময়টাতে দুষ্টুর এতো কষ্টের বহরের ন্যায় কান্নার কারণ যে ছোটো মানুষের মতো এই..ই তা শুনেই প্রচ্ছদ চোখ কুচকে ফেললো। বিরবির করে বলল, ‘আমি আরো ভাবলার ওর বয়ফ্রেন্ড’টা মরে টরে গেলো কিনা। কপাল!’ এরপর নিজেকে ধাতস্থ করে বিরক্তির সুরে বলল,

‘যাবে। তিনমাস পর একবারে রেখে দিয়ে আসবো। এতে এতো কান্নাকাটির কি আছে?’

দুষ্টু ক্রন্দনরত অবস্থাতেই চোখ পাকিয়ে তাকালো,

‘এরজন্যই আপনাকে বলতে চাইনি। মহা ফাজিল লোক আপনি!’

প্রচ্ছদ হালকা হেসে বলে, ‘আচ্ছা বলো।’

দুষ্টুর দৃষ্টি অসহায় হয়ে এলো। নরম গলায় বলল,

‘বাবা অসুস্থ হয়ে পরেছে। আমি আন্টির কাছে গিয়ে বললাম। আন্টি সরাসরি বলল, সাতদিনের আগে বাপের বাড়ি যাওয়া যাবে না। ‘

‘তুমি বলেছিলে, তোমার বাবা অসুস্থ?’

দুষ্টু মাথা নিচু করে ডানে বামে নাড়ালো। প্রচ্ছদ বলল,

‘এর জন্যই যেতে দেয়নি। কাল আমি বলবো’নি।’

প্রচ্ছদ চলে যেতে নিলেই দুষ্টু ডাকলো, ‘শুনুন।’

প্রচ্ছদ থেমে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকায়। দুষ্টু বলে,

‘আপনিও যাবেন। আমি একা একা যাবো না। দু’দিন থেকেই এসে পরবো।’
প্রচ্ছদ বাঁকা হেসে বলে, ‘তিনমাস পর একা কীভাবে যাবে?’

ঠেস দিয়ে কথা বলার ধরণে দুষ্টুর গা জ্বলে উঠলো। চোখ মুছে বলল,

‘সমস্যা কি বলুন তো? তিনমাস তিনমাস জপ করে কান’টা আমার জ্বালাপালা করে দিচ্ছেন। বিয়ে করতে বলেছিলো কে আপনাকে?’

‘আশ্চর্য! তিন মাসের কথা তো তুমি তুলেছিলে। বাসর রাতে ডিভোর্সও তুমি চেয়েছো।’

‘হ্যাঁ চেয়েছি, আমি কোনোদিন আপনাকে ভালোবাসতে পারবো না তাই চেয়েছি। আপনার সাথে থাকতে হলে সারাজীবন জড় বস্তুর মতো কাটাতে হবে।’

প্রচ্ছদের চোখ গরম হলো। আগুন লাল চোখে তাকিয়ে বলল,

‘কে বলেছে সারাজীবন থাকতে? তোমাকে কে ধরে বেঁধে রেখেছে? পারলে এই মুহুর্তে চলে যাও।’

দুষ্টু উচ্চস্বরে বলল,

‘বিয়েই তো করতে চাইনি, আপনার মা-ই তো ধরে বেধে স্টেশন থেকে নিয়ে এসে আপনার সাথে আমার বিয়ে দিলো। ভুলে গিয়েছেন সব?’

‘নাহ, ভুলবো কেনো? কিচ্ছু ভুলিনি। সব মনে আছে। তোমার মতো মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসাই সবচেয়ে বড় ভুল। আগেই ভাবা উচিত ছিলো, গোড়া যেমন হবে গাছও তেমনি হবে।’

‘একদম আমার বোনকে টানবেন না এসবের মধ্যে। আমরা নাহয় খুব খারাপ আর আপনারা খুব ভালো?’

‘কি খারাপি করেছি তোমার সাথে?’

‘অনেক কিছু করেছেন, বিয়ের পর প্রথম সকালেই সবাইকে ডিভোর্সের ব্যপারটা জানিয়ে আমাকে মহা খারাপ বানিয়ে দিয়েছেন।’

দুষ্টুর গলা ধরে এলো। প্রচ্ছদ বিরক্তিকর চোখে তাকালো। পরক্ষণেই নিজেকে শান্ত করে ধীরেসুস্থে জবাব দিলো,,

‘দেখো দুষ্টু, ব্যপার’টা তুমি ভুল বুঝছো। আজ বাদে কাল তুমি এ বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছোই। এই তিনমাস বউ-শ্বশুড়বাড়ি মিথ্যে খেলা খেলতে খেলতে আমার পরিবার তোমার প্রতি খুব বেশি উইক হয়ে পরবে। সেক্ষেত্রে তুমি চলে গেলে তাদের সামলানোটা আমার পক্ষে কঠিন হয়ে দাড়াঁবে। তোমার দেওয়া হঠাৎ এতো বড় ধোকাটা তারা সামলিয়ে উঠতে পারবে না। আই থিংক, ইউ ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড।’

দুষ্টু কেমন বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে তাকালো। নিষ্প্রাণ অভিলাষী চোখদুটোতে প্রশ্নের বহর। একটা শব্দ-ই মাথায় গেঁথে গেলো তখনি ভয়ানক ব্যথা হলো। মাথার ভেতর শুয়ো পোকার মতো কামড়াতে লাগলো, ‘ধোকা’ শব্দটা। প্রচ্ছদ আবার বলল,

‘ডিভোর্সের ব্যপারটা নিয়ে আমাদের বাড়িতে কেউ সমস্যা করলে সেটা মা করতো। কিন্তু মা জানে বিয়ের রাতে তুমি পালাতে গিয়েছিলে। বিয়ে করবে না বলেই নিশ্চয়ই! সেক্ষেত্রে ডিভোর্সের কথা বলে তেমন প্রশ্নের ঝামেলা পোহাতে হয়নি। সবাই আগেভাগেই জানুক না তুমি যে তিনমাসের অতিথি পাখি।’

শেষের কথা শুনে দুষ্টু চমকিত দৃষ্টিতে তাকালো। এরপর কেমন আচ্ছন্ন ভরপুর কণ্ঠে শুধালো,

‘তবে বিয়ে কেনো করেছিলেন?’

প্রচ্ছদ বুঝতে পারলো না এমন দৃষ্টি নিয়ে চাইলো। কিছুক্ষণ মৌন থেকে দুষ্টু অধৈর্য্য গলায় বলে চলল,

‘আচ্ছা, আমি যে পালিয়েছিলাম এটা আপনি কখন জেনেছেন?’

প্রচ্ছদ কিছু না বুঝেই উত্তর দিলো, ‘বিয়ের আগমুহূর্তে।’
‘কীভাবে?’
‘মা স্টেশন থেকে যখন তোমাকে ধরে নিয়ে আসছে তখন আমাকে ফোন করেছিলো।’

দুষ্টুকে এবার মাত্রাতিরিক্ত উত্তেজিত দেখালো। খুব ব্যস্ততার সাথেই কণ্ঠে অবাকতা ঢেলে প্রশ্ন ছুড়লো,

‘তবে… তবে আমাকে বিয়ে করলেন কীভাবে আপনি? একটা মেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো বিয়ের আসর ছেড়ে, এটা জানা মাত্রই তো বিয়ে ভেঙে চলে যাওয়া উচিত ছিলো আপনাদের। আপনার মা কীভাবে এমন একটা মেয়েকে বাড়ির বউ করে আনলো? ডিভোর্সের ব্যাপারটাই বা কীভাবে সবাই এতো সহজ করে নিচ্ছে? কারোর কোনো ভাবান্তর নেই কেনো?’

দুষ্টুর আচমকা আক্রমনে প্রচ্ছদ থমকে গেলো, চমকে গেলো, অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। দিশেহারা চঞ্চল নয়নে এদিক ওদিক তাকিয়ে সময় নিয়ে উত্তর দিলো,

‘বিয়ের আগে তুমি পালালে কিংবা বিয়ে ভেঙে আমরা চলে গেলে সবার রেপুটেশন নষ্ট হতো। আমার মা চায়নি তোমার মা দ্বিতীয় বার এমন আঘাত পাক।’

‘এখন নষ্ট হবে না? তিনমাস পর যখন সোসাইটির সবাই জানবে আমরা তিনমাসের বর-বউ পুতুল খেলা খেলেছি তখন এই রেপুটেশন কোথায় যাবে?’

প্রচ্ছদ বারান্দা থেকে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে কদম বাড়ালো। বলল, ‘আমার কাজ আছে। বাইরে যেতে হবে আমার।’

দুষ্টু দৌড়ে গিয়ে খপ করে প্রচ্ছদের হাত টেনে ধরলো। প্রচ্ছদ একবার হাতের বাধঁনের দিকে তাকিয়ে আবার দুষ্টুর মুখের দিকে তাকালো। দুষ্টুর গলা করুণ শোনা গেলো,

‘বলুন না কেনো বিয়ে করেছেন আমাকে? প্রতিশোধ নিতে? ইজ দিজ আ রিভেঞ্জ গেইম?’

প্রচ্ছদ অবজ্ঞায় হাসলো। ঘাড় ঘুরিয়ে, ভ্রু উপরে তুলে নরম কন্ঠে বলল,

‘আমি বা আমার পরিবার কেউ’ই তো জানতাম না যে আপনি বিয়ের রাতে ডিভোর্স চাইবেন। জানলে কক্ষনো বিয়ে করতাম না।’

হাতের বাধঁন আলগা হলো। চোখে চোখ চেয়ে রইল অনেকক্ষণ। দুষ্টুর চোখ প্রশ্ন-উত্তরের বিস্ময়ে ভরপুর। হঠাৎ মাথায় চারা দিয়ে উঠা উত্তর না মেলা প্রশ্নের ভিড়। এলো গলায় বলল,

‘এটা ঠিক না। আপনি বিয়ের রাতে আমাকে বলেছিলেন, আপনি বিয়ে করতে চাননি। নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করেননি। তবে যখন শুনেছেন আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম তখন তো মোক্ষম সুযোগ ছিলো। কেনো বিয়ে ভেঙে দেননি?’

দুষ্টুর কণ্ঠে কান্না আটকে আসছে। প্রচ্ছদ তাকিয়েই ছিলো একচিত্তে, নিভৃতে। দুষ্টু ধরা গলায় আবার বলল,

‘তিনমাস পর আমি চলে গেলে সবাই পারবে আমার জায়গাটা অন্যকাউকে দিয়ে দিতে?’

প্রচ্ছদ সপ্রতিভ চোখে তাকালো। তার দৃষ্টি তখন প্রণয় বেড়ায় থমকানো। দুষ্টুর ওই কথা বলার মুহুর্তটাতে, ঠিক ওই মুহুর্তটাতে মনের স্ফটিক রৌদ্র উজাড় করে শীতল কণ্ঠে তাকে বলতে শোনা গেলো আকস্মিক,

‘আপনি থেকে যান না! তিনমাস কেনো তিন হাজার লক্ষ কোটি বছর থেকে যান। এই পবিত্র গৃহবনে, আমার অন্তরিন্দ্রিয় চিত্তের স্থান শুধু আপনার সম্পদ হবে। আপনি হবেন সেই চিত্তের অভিনিবেশ অন্তর্বত্নী সন্ধানী। থেকে যান!’

দুষ্টু চমক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কিছুমুহূর্ত। তার মনে হলো, পৃথিবীতে এতো সুন্দর বর্ণের, শব্দের, বাক্যের কথা হতে পারে না। এই এতো সুন্দর বাণীতে আপনি শব্দটাও খুব সুন্দর করে মিশে গেছে। মিলে গেছে। কথার যথাযথ মনোরঞ্জন অর্থ বহন করছে। দুষ্টুর তাকিয়ে থাকার কালেই প্রচ্ছদ ঠোঁটের কোলে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে বলল,

‘কিন্তু আপসোস, আপনি থাকবেন না। আপনার স্থান সেই চিত্তের যোগ্য নয়।’

কথাটা বলে প্রচ্ছদ চোখের পলকে শব্দ তুলে হেটে চলে গেলো। মনের গোপনী সিন্দুকের কথা বলতে গিয়েও বলা হলো না। বলা হলো না, গোপনী কোনো এক রানীর কথা। ওই পেলব রঙের নীল আলো আর চাঁদের আলোয় মাখামাখি বারান্দা’টাতে রেলিং ধরে ধপ করে বসে পরলো দুষ্টু। ওর প্রশ্নের একটা জবাবও দিয়ে গেলো না প্রচ্ছদ! উল্টো ওকে দোষী সাব্যস্ত করে গেলো।

চলবে❤️

#এমন_একদিন_সেদিন
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১১
২৪.
তখন প্রায় মধ্যরাত। কার্তিক মাসের দুই তারিখ। অন্ধকার কুয়াশার নিবিড় জাল। গাছেরা দোদুল্যমান। বাদুড় পাখা ঝাপটাচ্ছে। ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হচ্ছে। পিচ ঢালা রাস্তায় হালকা হলুদ ফ্লুরোসেন্টের আলোয় পাতারা নকশা আকঁছে। প্রযুক্ত জেগেছিলো। পরীক্ষার খাতা দেখছিলো। বেসুরা গলায় ফোন’টা তখনি বেজে উঠলো। নাম্বার’টা দেখেই ব্যস্ততার সহিত বিরক্তে কপাল কুচকে এলো। সন্ধ্যা থেকে এ পর্যন্ত তিনবার কল রিসিভ করা হয়েছে। রিসিভ করার পর হ্যালো হ্যালো বলে মুখের ফেনা তোলা হলেও ওপাশ থেকে নো রেসপন্স। অবশেষে হ্যালো-নিশ্চুপ খেলা শেষে তুমুল হাসির ঝংকার তুলে ফোন কাটা হচ্ছে। বারংবার এভাবেই চলছে। যেন এটাই নিয়ম! ইচ্ছাকৃত ভাবেই যে এই হাস্যরসাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে তা বুঝতে প্রযুক্তর বাকি নেই। চশমাটা খুলে হাতে নিয়ে এবার ফোন ধরেই তার নিত্যতার ককর্শ গলায় বলে উঠলো,

‘আমি কিন্তু আপনাকে চিনে ফেলেছি। অযথা বিরক্ত না করে আসল নাম্বার থেকে ফোন দিন তা নাহলে কথা বলুন। ভূতের মতো প্রথমে চুপ থেকে তারপর রাক্ষসীর মতো খেক খেক করে হেসে উঠবেন না। এতে আমি ভয় পাই না।’

ওপাশ থেকে প্রায় সাথে সাথেই ফোন কাটা হলো। ভয়ে তটস্থ হয়ে বুকের মাঝে ফোন আড়াল করে দাঁড়িয়ে রইল। কানে লাগলো হৃদপিণ্ড থেকে ভেসে আসা জোরছে ধুকপুক… ধুকপুক শব্দ। এরপর দুজন দুজনার দিকে কিছুক্ষণ স্থিত চোখে তাকিয়ে আবারো ঘর কাপিঁয়ে হেসে দিলো।

প্রযুক্ত অনেকক্ষণ বাদে সেলফোনটা হাতে নিয়ে কল লিস্টে ডুকলো। এরপর খানিকটা সংকিত মনেই ফোন লাগালো অপর নাম্বার’টিতে। ত্রস্ত হাতে ফোন দিয়ে কানে ধরলো। অপরপাশ থেকে প্রথম বারেই ধরা হলো না। প্রযুক্ত স্মিত হাসলো। মিনিট কতক পর ভদ্রতার খাতিরে আর খানিকটা উশখুশ মনকে শান্ত করতে আরেকবার ফোন লাগালো। এবার রিং হওয়ার সাথে সাথেই ধরে ফেলল। ঘুম জড়ানো কণ্ঠ নিয়ে কেউ বলল,

‘হ্যালো। স্মালাইকুম।’

প্রযুক্ত দীর্ঘ এক শ্বাস ছাড়ে, ‘আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে বলছেন?’
‘এতোক্ষণ যাকে আপনি ডিস্টার্ব করছিলেন।’
‘সরি?’
প্রযুক্ত খাটের হেড বোর্ডে বালিশ ঠেস দিয়ে হেলান দিয়ে বসলো। ঈষৎ হেসে বলল,

‘আমি জানি, আপনি অভিনয় খুব ভালো জানেন। বলুন, কী সমস্যা? এবার কি সিম হারিয়ে গিয়েছে, যার কারণে অন্য নাম্বার থেকে ফোন? ‘

শ্রেয়সী যেনো শোয়া থেকে উঠে বসে হাই তুললো দু একবার। ঘুম জড়ানো ভাব কাটাতে কাটাতে ফোন নাম্বার চেক করলো। অতঃপর মনে পরে গিয়েছে এই অভিমতের ন্যায় বলল,

‘ওহ আপনি? ডিম কিনতে গিয়ে যার সাথে অপ্রত্যাশিত দেখা?’

প্রযুক্ত হাসলো। আশ্চর্যান্বিত হওয়ার ভান ধরে বলল,

‘Oh my god, Recognized? however?’

শ্রেয়সী এক হাত দিয়ে চুল পেছনে ঠেলে দিলো,

‘কিছু পুরুষকে অনিচ্ছায় মনে রাখতে হয়। এবার বলুন, হাউ কেন আই হেল্প ইউ?’

শ্রেয়সীর এই কথা শুনে প্রযুক্ত জোরে জোরে হাসলো। শ্রেয়সী ভ্রু বাঁকালো। প্রযুক্ত বলল,

‘আপাতত বারবার ফোন দিয়ে কিছু না বলে কেটে দিয়ে, বিরক্ত করা বন্ধ করুন প্লিজ। আমি কাজ করছি। বেশি না দুইদিন পর আবার এই নিয়ম স্টার্ট করতে পারেন।’

শ্রেয়সীর তীক্ষ্ণ নাসিকা ফুলে উঠলো। চিকন ঠোঁট জোড়া বেঁকে গেলো ভেঙ্গানো তে। প্রযুক্ত মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো,

‘আপনারা কয় ভাই-বোন?’

আমতা আমতা করে শ্রেয়সী উত্তর দিলো, ‘দুই বোন।’

‘ওহ, এর জন্যই ফোন কাটার আগ-মুহুর্তে দুই রাক্ষসীর হাসির সুর শোনা যাচ্ছে?’

শ্রেয়সী মুখ ফুলিয়ে চোখ জোড়া ছোট ছোট করে ফেলল। প্রযুক্ত জিজ্ঞেস করলো,
‘আপনার বোন কি এখনো আপনার সাথে?’
‘জি।’
‘কি নাম তার?’
‘শ্রেয়া।’
‘ছোটো বোন?’
‘জি।’
‘বিচ্ছু! একটু দেওয়া যাবে?’

শ্রেয়সী শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে ফোন এগিয়ে দিলো গাল ফুলিয়ে। শ্রেয়া ফোনে কান লাগিয়ে এতোক্ষণ সব-ই শুনেছে। ইতস্তত করে ফোন হাতে নিয়ে আমতা আমতা করে চোখ মুখ খিচে বলল, ‘হ্যালো।’

‘হ্যাঁ, শ্রেয়া। কেমন আছো? শুনো, এরপর যখনি ফোন দিবে অন্তত দুলাভাই হলেও একটা ডাক ডেকে দিবে। বারবার ফোন দিয়ে কথা না বলে কেটে দিচ্ছো, খামোখা তোমার বোনের ফোনের টাকা নষ্ট হচ্ছে। ‘দুলা….ভাই’ এই একটা ওয়ার্ড টান দিয়ে লম্বা করে তিন মিনিট লাগিয়ে বলবে। এটলিস্ট ফোনের টাকাটা উশুল হবে আর আমারও আত্মা শান্তি পাবে। বিয়ের আগে শালি পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার। ক’জনের হয় এমন ভাগ্য?’

শ্রেয়া শ্রেয়সীর সাথে হিসহিস করে হাসলো। এরপর গলা পরিষ্কার করে বলল,

‘আপনি তো দেখি এক ধাপ এগিয়ে। আমার বোনকে বউ বানিয়েও ফেলেছেন?’

প্রযুক্ত হেসে মাথা দুলিয়ে বলল,

‘তা তো বলিনি একবারো। তোমার বোনের সাথে পরিচয় হয়েছে দু’দিন কেবল। এতো তাড়াতাড়ি বউয়ের আসনে বসাবো? মাস্টার মশাইরা সদা-সর্বদা পরীক্ষা নিতে ভালোবাসে। তারা খাতায় ছাত্রীর মার্কস দেখে কোয়ালিটি নির্বাচন করে। বুঝলে? বাই দ্যা ওয়ে, কিসে পড়ো তুমি?’

‘ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার।’

‘এসব বাদ দিয়ে ভালো করে পড়ো, বুঝলে, শালী?’

‘দিলেন তবে গালি?’

প্রযুক্ত সজোরে হেসে উঠলো, ‘তোমার বোনকে দাও।’

শ্রেয়সী কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন’টা নিয়েই একদমে বলে ফেলল,

‘দেখুন মিস্টার, আমি আপনাকে ফোন দেইনি। আর আমার বোনকে শালী বলে ডাকবেন না। ওর দ্বিতীয় কোনো বোন নেই।’

শেষের কথাটা মুখ টানা মেরে বলল শ্রেয়সী। প্রযুক্ত মাথা ঝাঁকিয়ে হাসলো। বলল,

‘আচ্ছা ফোন দেননি। কিন্তু যদি দেন, তবে প্লিজ পরিচয়’টা দিবেন। অপরিচিত নাম্বার চিনতে কষ্ট হয়, ভূতের মতো চুপ করে থাকলে তো আরো!’
‘আবার?’
‘ওকে, ফাইন। গুড নাইট।’
‘ব্যাড নাইট।’

ফোন রাখতে নিয়েও প্রযুক্ত রাখলো না। শরীর শিরশির করা কণ্ঠে ঠান্ডা আমেজে শুধালো,

‘আপনি কি আমায় কিছু বলতে চান?’

দুরুদুরু বুক… ধুমধাম শব্দ… সমুদ্রের ঢেউয়ের ন্যায় প্রবল গর্জনে আছড়ে পরছে হৃদয় মাঝারে। সেই ঢেউয়ে ভাসছে সব। ভাসছে এই প্রথমবার শ্রেয়সী। শ্রেয়ার কাঁচা মাথা থেকে ভেসে আসা সস্তা মজা করার বুদ্ধিটা শ্রেয়সীকে পীড়া দিচ্ছে এই মূহুর্তে ব্যাপক পরিসরে। যন্ত্রণা, লজ্জা, ভয়-ভীতি, সংশয় সকল অনুভূতি একত্রে আঁকড়ে ধরতেই সে মূর্ছা গেলো। উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে কিছু বলতে ধরেও থেমে গিয়ে এলোমেলো নিবৃত্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,

‘নাহ, কিছু না। কিছু বলার নেই। ভালো থাকবেন।’

২৫.
রং চটা দু’তলা বাড়িটার আশেপাশে আগাছা ভরপুর। বাড়ির দেয়ালে সবুজ-কালো শ্যাওলা। ছাদঘরের টিনের চাল বেয়ে টিপটপ করে পরা ট্যাংকির পানি। বারান্দা বেয়ে অনুমতিবিহীন ঘরে ঢুকছে বেলীর সুঘ্রাণ। এ বাড়ির চারিপাশে অপ্রয়োজনীয় গাছ-গাছালির মধ্যে শিউলি ফুলের লম্বাটে দেহ’টা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মধ্যমনি বেশে। ছড়াচ্ছে সুগন্ধ! চাঁদের নরম আলোয় দৃশ্যমান তার সাদা গা। এমতাবস্থায়, হাতের মুঠো ভর্তি করে শিউলি ফুল নিয়ে নুসরাত ছুটলো নিচ’তলায়।

রাত বাড়ছে। বেলীফুলের ঘ্রাণ কড়া হচ্ছে। বারান্দার দুয়ারে পা ভাঁজ করে বসে ফোনের স্ক্রিনে স্লাইডশো চলছে প্রেয়সীর ছবি। বদ্ধ ঠোঁটে সামান্য প্রকাশিত প্রশান্তির হাসি। চোখের তাঁরায় সন্তুষ্টি। এর মাঝেই আচম্বিতে নুসরাতের ডাক পরলো। নীড় বুকের মাঝে ফোন চেপে ধরলো। দুষ্টুর ছবির দিকে একবার তাকিয়ে বিরক্ত মুখে চাইলো ভেসে আসা ডাকের দিকে। কপাল কুচকে গেল তৎক্ষণাৎ।
দু’তলা বাড়িটা নীড়ের। বাবা-মা মারা যাওয়ার আগে অন্তত তার এই একটা গতি করে রেখে গেছে ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে আল্লাহর কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া আদায় করে রাত-দিন। মাঝে মাঝে চরম অভাবেও দিন চলে তার। মাসে পাঁচ হাজার টাকা বাসা ভাড়া তুলে আর কি হয়? সে টিউশনি করায় না। অন্যের বাসার কলিংবেল চাপতে তার ভালো লাগে না। কিন্তু রোজ উপর তলার ভাড়াটিয়ার ক্লাস টেনে পড়া ছেলেটা তার কাছে পড়তে আসে। মাস গেলে টাকাও নেয় না। ভাই পড়তে আসার অছিলায় মাঝে মাঝেই সাক্ষাৎ দিয়ে যায় ছাত্রের বড় বোন। কিন্তু আজ তো শুক্রবার। আজ কেনো এসেছে?

নুসরাত এসে দেখলো রাস্তা থেকে আসা ঠিকানা-পরিচয়’হীন ঘরে মৃদু আলো। বারান্দা অন্ধকার।অন্ধকারে আবছা বোঝা যাচ্ছে মানুষের চিহ্ন। সে ব্যস্ত উৎফুল্লতার হাতে ঘরের বাতি জ্বালালো। হাত পা মৃদু কাপঁছে। নুসরাত দৌড়ে নীড়ের কাছে দাঁড়িয়ে বলল,

‘আমি ঢাবিতে চান্স পেয়ে গেছি।’

তার আমোদিত কণ্ঠস্বর। খুশিতে ঝুমুরঝুমুর। ছোট্ট মেয়েটার উল্লাসে উল্লসিত হলো নীড়ও। ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

‘কংগ্রাচুলেশন।’

নুসরাতের হাসি মিলিয়ে গেলো। ঠোঁট কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে ফুটলো বিস্ময়তা। বাড়িয়ে দেওয়া হাত’টার দিকে তাকালো অর্ধনিমীলিত নয়নে। পরমুহূর্তে নীড়ের দিকে তাকালো। তখন পর্যন্ত নীড়ের ঠোঁটে বহমান হাসির ঝিলিক। নুসরাত তাকিয়েই থাকলো একনিষ্ঠ নেত্রে। লোকটা… লোকটা কখনো তাকে পাত্তা দিতো না। খানিকটা অবহেলায়, অপমানের পরেও বারবার ফিরে আসতে হয় তার। এই সুঠাম দেহের.. সুন্দর মনের.. সুন্দর যুবক টিকে একপলক দেখার জন্য মন’টা আঁকুপাঁকু করে সারাক্ষণ। একদণ্ড দেখার জন্য প্রতিদিন ছুটে ছুটে চলে আসতে চায়। থাকা দায়। লোকটা কি বুঝে, তাকে এক ঝলক দেখার জন্যই ছোট ভাইটাকে তার কাছে পড়তে দেওয়া? পাত্তা না পাওয়া সত্ত্বেও প্রতিটি দিন তার কাছে এসে কিছুটা সময় অযথা বকবক করে মনপ্রাণ ভরে তাকে দেখে চলে যাওয়া? বুঝে না সে? অবুঝ যুবক বুঝি?

নুসরাত খপ করে হাত’টা ধরলো। তৎক্ষণাৎ যেন তার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। শক লাগলো। অসীম খুশি বয়ে গেলো চিত্ত তরে। এতোটা খুশি.. এতোটা খুশি যে বাইরে প্রকাশ হচ্ছে না। নুসরাত পারছে না বুঝাতে।

‘আপনিও তো ঢাবিতে পড়েছেন?’

নীড় মাথা নাড়ালো। তার মন’টা ভালো আজ। পুচকি মেয়েটার খুশির খবরে আরো খানিকটা ভালো হয়ে গেল। বলল, ‘হ্যাঁ।’

নীড় হাত নরম করলো। বাধন আলগা হতেই নুসরাত হাত ছেড়ে দিলো। বলল, ‘এখন কি করছেন আপনি?’
‘চাকরি খুঁজি।’
‘ওহ।’
এরপর নিশ্চুপতার ধূম্রজাল। তার কিছুক্ষণ পর নিবিড় নিরবতার জাল ছিড়ে ভেসে এলো একটি শব্দ, ‘ধরুন।’

নীড় তাকালো। পুচকে হাতের মুঠো ভরতি শিউলি ফুল বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তার পানে। পুচকে মেয়েটার ঠোঁটে রমরমা হাসি। ঠোঁটের মাঝে দু’ইঞ্চি ফাঁক। খুব করে হাসছে সে আজ। কিন্তু নীড়ের হাসি কোথায় একটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো, কর্পূরের ন্যায় উবে গেলো যখন এই তাজা শিউলি ফুল’গুলো অতিযত্নে বাড়িয়ে দেওয়া হলো তার দিকে। এই বয়সী মেয়েদের সময়’টা খারাপ! অজ্ঞাত আশা দিয়ে খুশি নিরাশা করতে পারবে না। নীড় ফুলগুলো নিলো না। ঈষৎ হেসে মুহুর্তটাকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো। সে বুঝলো না, এই বয়সের… ঠিক এই খারাপ সময়’টাতেই ফুলগুলো গ্রহণ না করায় মেয়েটার ঠোঁটের এতোক্ষণের হাসির বদলে ফুটলো লজ্জা, চোখের চিকচিক কোণা, বুকের মাঝে বেদনার ঝড়!

একটু কি নেওয়া যেতো না ফুলগুলো? নাই-বা নিলো, ছুয়ে দেখতো একটু!

চলবে❤️